ভুল বানানের ব্যবহার বাড়ছে যে-কারণে
বুধবার, ২৬ জুন, ২০১৯
Comment
মূলত কয়েকটি কারণে বাংলা বানানে ভুলের ব্যবহার বাড়ছে। এর মধ্যে বাংলা ভাষা ও বানানের প্রতি অবজ্ঞা; ভাষা-জ্ঞানহীন কিছু লেখকের ভুলে ভরা লেখা; ভুলে ভরা চাকরির বিজ্ঞপ্তি প্রভৃতি অন্যতম।
এগুলি ছাড়াও বিভিন্নভাবে ভুল বানান ব্যবহারের প্রবণতা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এখন অনেকেই ভাবতে শুরু করেছে—— ঈ-কারের পরিবর্তে ই-কার ব্যবহার বা, ই-কারের পরিবর্তে ঈ-কার ব্যবহার তেমন কোনো ভুল নয়। রাজীবকে লিখছে রাজিব, সজীবকে লিখছে সজিব। আবার বলে নাম হিসেবে ই-কার বা, ঈ-কার ভুল নয়! আমাদের অবশ্যই জানা উচিত এ ধারণাটি সবক্ষেত্রেই গ্রহণযোগ্য নয়।
অর্থবহ কিছু শব্দ আছে যা নাম হিসেবেও ব্যাকরণবিধি মেনে চলতে হবে। যেমন : রাজীব, সজীব, নীল, রবীন্দ্র, রবি ইত্যাদি। অর্থাৎ অর্থবহ বাংলা শব্দ দ্বারা গঠিত নাম। যাদের এ সম্পর্কে ধারণা আছে তারা নাম হিসেবেও অর্থবহ শব্দের শুদ্ধ ব্যবহার করতে জানে।
বাংলা বিভাগের কিছু শিক্ষক ছাড়া অন্যান্য বিভাগের শিক্ষকদের বাংলা ভাষা ও বানান সম্পর্কে ধারণা নেই বললেই চলে। এমন কিছু লোক আছে যারা মনে করে আমার ব্যবহার করা বানানটি শুদ্ধ! অন্যরা ভুলটি ধরিয়ে দিতে গেলে তাদের শুনতে হয় নানা কথা! কেউবা আবার শুদ্ধটাকে ভুল ভেবে ভুলই ব্যবহার করছে।
যে যেভাবে পারছে ভুলে-ভরা লেখা দিয়ে সাইনবোর্ড, ব্যানার, পোস্টার টাঙিয়ে দিচ্ছে। আর এর প্রভাব পড়ছে অগণিত মানুষের মাঝে। দেখা যাচ্ছে প্রতিটি ব্যক্তির, প্রতিটি পত্রিকার, প্রতিটি সংস্থার, প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব বানান রীতি আছে! কেউ দাবি করছে এটা ঠিক; কেউ বলছে ওটা ঠিক!
আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ বানানের বেলায় ঈ-কার ব্যবহার করা হচ্ছে। এটি তাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ চাইলে শুদ্ধরূপে লিখতেও পারে, না-ও লিখতে পারে। কিন্তু আপনি যখন ফুটবল লিগ, ক্রিকেট লিগ, এই লিগ, সেই লিগ লিখবেন তখন অবশ্যই ই-কার ব্যবহার করতে হবে।
বাংলা বর্ণমালা ও সংশ্লিষ্ট তথ্যাদি
1. বিসর্গ বাংলা ভাষার ১১টি স্বরবর্ণ..................হচ্ছে: অ আ ই ঈ উ ঊ ঋ এ ঐ ও ঔ।
2. বাংলা ভাষার ৭টি মৌলিক স্বরধ্বনি..................হচ্ছে: অ আ ই উ এ ও অ্যা।
3. বাংলা ভাষার ৩৯টি ব্যঞ্জনবর্ণ.................. হচ্ছে: ক খ গ ঘ ঙ চ ছ জ ঝ ঞ ট ঠ ড ঢ ণ ত থ দ ধ ন প ফ ব ভ ম য র ল শ ষ স হ ড় ঢ় য় ৎ ং ঃ ঁ ।
4. পূর্ণ মাত্রার ৩২টি বর্ণ ..................হচ্ছে: অ আ ই ঈ উ ঊ ক ঘ চ ছ জ ট ঠ ড ঢ ত দ ন ফ ব ভ ম য র ল ষ স হ ড় ঢ় য়।
5. অর্ধ মাত্রার ৮টি বর্ণ ..................হচ্ছে:ঝ খ গ শ ণ থ ধ প।
6. মাত্রাহীন১০টিবর্ণ .................. হচ্ছে: এ ঐ ও ঔ ঙ ঞ ৎ ং ঃ ঁ।
কোথায় হ্রস্ব ই-কার কোথায় দীর্ঘ ঈ-কার হবে?
1. অ-তৎসম অর্থাৎ তদ্ভব, দেশি, বিদেশি, মিশ্র শব্দে ই-কার ব্যবহার হবে।
যেমন : সরকারি, তরকারি, গাড়ি, বাড়ি, দাড়ি, শাড়ি, চুরি, চাকরি, মাস্টারি, মালি, পাগলামি, পাগলি, বোমাবাজি, দাবি, হাতি, বেশি, খুশি, হিজরি, আরবি, ফারসি, ফরাসি, ইংরেজি, জাপানি, জার্মানি, ইরানি, হিন্দি, সিন্ধি, ফিরিঙ্গি, সিঙ্গি, ছুরি, টুপি, দিঘি, কেরামতি, রেশমি, পশমি, পাখি, ফরিয়াদি, আসামি, বেআইনি, কুমির, নানি, দাদি, বিবি, চাচি, মাসি, পিসি, দিদি, বুড়ি, নিচু।
2. ত্ব, তা, নী, ণী, সভা, পরিষদ, জগৎ, বিদ্যা, তত্ত্ব শব্দের শেষে যোগ হলে ই-কার হবে।
যেমন : দায়িত্ব (দায়ী), প্রতিদ্বন্দ্বিতা (প্রতিদ্বন্দ্বী), প্রার্থিতা (প্রার্থী), দুঃখিনী (দুঃখী), অধিকারিণী (অধিকারী), সহযোগিতা (সহযোগী), মন্ত্রিত্ব, মন্ত্রিসভা, মন্ত্রিপরিষদ (মন্ত্রী), প্রাণিবিদ্যা, প্রাণিতত্ত্ব, প্রাণিজগৎ, প্রাণিসম্পদ (প্রাণী) ইত্যাদি।
3. ঈ, ঈয়, অনীয় প্রত্যয় যোগ ঈ-কার হবে।
যেমন : জাতীয় (জাতি), দেশীয় (দেশি), পানীয় (পানি), জলীয়, স্থানীয়, স্মরণীয়, বরণীয়, গোপনীয়, ভারতীয়, মাননীয়, বায়বীয়, প্রয়োজনীয়, পালনীয়, তুলনীয়, শোচনীয়, রাজকীয়, লক্ষণীয়, করণীয়।
4. ভাষা ও জাতিতে ই-কার হবে।
যেমন : বাঙালি/বাঙ্গালি, জাপানি, ইংরেজি, জার্মানি, ইরানি, হিন্দি, আরবি, ফারসি ইত্যাদি।
5. ব্যক্তির '-কারী'-তে (আরী) ঈ-কার হবে।
যেমন : সহকারী, আবেদনকারী, ছিনতাইকারী, পথচারী, কর্মচারী ইত্যাদি।
6. ব্যক্তির '-কারী' নয়, এমন শব্দে ই-কার হবে।
যেমন : সরকারি, দরকারি ইত্যাদি।
7. প্রমিত বানানে শব্দের শেষে ঈ-কার থাকলে –গণ যোগে ই-কার হয়।
যেমন : সহকারী > সহকারিগণ, কর্মচারী > কর্মচারিগণ, কর্মী > কর্মিগণ, আবেদনকারী > আবেদনকারিগণ ইত্যাদি।
8. 'বেশি' এবং '-বেশী' ব্যবহার : 'বহু', 'অনেক' অর্থে ব্যবহার হবে 'বেশি'। শব্দের শেষে যেমন : ছদ্মবেশী, প্রতিবেশী অর্থে '-বেশী' ব্যবহার হবে।
এ ব্যবহার
1. চিহ্নিত শব্দ/বাক্য বা উক্তির সাথে সমাসবদ্ধ রূপ।
যেমন: গুলিস্তান ‘ভাসানী হকি ষ্টেডিয়াম’-এর সাইনবোর্ডে স্টেডিয়াম বানানটি ভুল।
2. শব্দের পরে যেকোনো প্রতীকের সাথে সমাসবদ্ধ রূপ।
যেমন : হাদিস রাসুল (সা.)-এর বাণী।
3. বিদেশি শব্দ অর্থাৎ বাংলায় প্রতিবর্ণীকরণ নয় এমন শব্দের সাথে সমাসবদ্ধ রূপ।
যেমন : sms-এর মাধ্যমে টাকা পাঠাতে হবে।
4. গাণিতিক শব্দের সাথে সমাসবদ্ধ রূপ।
যেমন : ৫-এর চেয়ে ২ কম।
5. সংক্ষিপ্ত শব্দের সাথে সমাসবদ্ধ রূপ।
যেমন : অ্যাগ্রো কোম্পানি লি.-এর সাথে চুক্তি।
এ ছাড়া পৃথক রূপে ব্যবহার করা যাবে না।যেমন : বাংলাদেশ-এর না লিখে বাংলাদেশের, কোম্পানি-এর না লিখে কোম্পানির, শিক্ষক-এর না লিখে শিক্ষকের, স্টেডিয়াম-এ না লিখে স্টেডিয়ামে, অফিস-এ না লিখে অফিসে লিখতে হবে।
উ-কার, না ঊ-কার?
1. দূরত্ব বোঝায় না এরূপ শব্দে উ-কার যোগে ‘দুর’ (‘দুর’ উপসর্গ) বা ‘দু+রেফ’ হবে।
যেমন : দুরবস্থা, দুরন্ত, দুরাকাঙ্ক্ষা, দুরারোগ্য, দুরূহ, দুর্গা, দুর্গতি, দুর্গ, দুর্দান্ত, দুর্নীতি, দুর্যোগ, দুর্ঘটনা, দুর্নাম, দুর্ভোগ, দুর্দিন, দুর্বল, দুর্জয় ইত্যাদি।
2. দূরত্ব বোঝায় এমন শব্দে ঊ-কার যোগে ‘দূর’ হবে।
যেমন : দূর, দূরবর্তী, দূর-দূরান্ত, দূরীকরণ, অদূর, দূরত্ব, দূরবীক্ষণ ইত্যাদি।
চন্দ্রবিন্দু’র ব্যবহার
1. বাংলা ভাষায় চন্দ্রবিন্দু একটি গুরুত্বপূর্ণ বর্ণ। চন্দ্রবিন্দু যোগে শব্দগুলোতে চন্দ্রবিন্দু ব্যবহার করতে হবে; না করলে ভুল হবে।
যেমন : চাঁদ।
2. অনেক ক্ষেত্রে চন্দ্রবিন্দু ব্যবহার না করলে শব্দে অর্থের পরিবর্তন ঘটে। এ ছাড়া চন্দ্রবিন্দু সম্মানসূচক বর্ণ হিসেবেও ব্যবহার করা হয়।
যেমন : তাহাকে>তাঁহাকে, তাকে>তাঁকে ইত্যাদি।
‘ঙ’ নাকি অনুস্বার ‘ং’?
1. উঁঅ (ঙ) ব্যবহার যোগে কিছু শব্দ। এক্ষেত্রে অনুস্বার (ং) ব্যবহার করা যাবে না।
যেমন : অঙ্ক, অঙ্কিত, অঙ্কন, অঙ্কুর, অঙ্গ, অঙ্গন, আকাঙ্ক্ষা, আঙিনা, আঙুর (ঙ্গ বর্জন), আতঙ্ক, আশঙ্কা, ইঙ্গিত, উচ্ছৃঙ্খল, উলঙ্গ, কঙ্কাল, কঙ্কর, কামরাঙা (ঙ্গ বর্জন), গঙ্গা, গাঙ (ঙ্গ নয়), গাঙচিল (ঙ্গ নয়), চাঙ্গা, চোঙা, টাঙা, ঠুঙি (ঙ্গ নয়), ঠোঙা (ঙ্গ নয়), ঠোঙা, ডিঙা (ঙ্গ নয়), ডিঙি (ঙ্গ নয়), ডিঙানো (ঙ্গ নয়), ডিঙোনো (ঙ্গ নয়), দাঙ্গা, নোঙর (ঙ্গ নয়), প্রাঙ্গণ, প্রসঙ্গ, পঙ্ক্তি, পঙ্কজ, পতঙ্গ, ফিঙে (ঙ্গ বর্জন), বঙ্গ, বাঙালি, ভঙ্গ, ভঙ্গুর, ভাঙা, মঙ্গল, রঙিন (ঙ্গ নয়), রাঙা (ঙ্গ নয়), লঙ্কা, লঙ্গরখানা, লঙ্ঘন, লিঙ্গ, শঙ্কা, শঙ্খ, শৃঙ্খল, শৃঙ্গ, শশাঙ্ক, সঙ্গ, সঙ্গী, সঙ্গে, সঙ্ঘাত, হুঙ্কার, হাঙ্গামা, হাঙর (ঙ্গ নয়)।
[দ্রষ্টব্য: অলংকার/অলঙ্কার, অহংকার/অহঙ্কার, কিংকর/কিঙ্কর, ভয়ংকর/ভয়ঙ্কর, শংকর/শঙ্কর, শুভংকর/শুভঙ্কর, সংকুচিত/সঙ্কুচিত, সংকীর্ণ/সঙ্কীর্ণ, সংকীর্তন/সঙ্কীর্তন, সংকেত/সঙ্কেত, সংকট/সঙ্কট, সংকর/সঙ্কর, সংকল্প/সঙ্কল্প, সংকুল/সঙ্কুল, সংকলক/সঙ্কলক, সংকলন/সঙ্কলন, সংগীত/সঙ্গীত, সংগম/সঙ্গম, সংঘ/সঙ্ঘ, সংঘাত/সঙ্ঘাত, সংঘর্ষ/সঙ্ঘর্ষ শব্দে ঙ এবং ং উভয়ই ব্যবহার করা হলেও প্রমিত বানানে এসব শব্দে ং (অনুস্বার) ব্যবহার করতে হবে।]
2. অনুস্বার (ং) ব্যবহার যোগে কিছু শব্দ। এক্ষেত্রে উঁঅ (ঙ) ব্যবহার করা যাবে না।
যেমন : কিংকর্তব্য, কিংকর্তব্যবিমূঢ়, কিংবদন্তি, সংজ্ঞা, সংক্রামণ, সংক্রান্ত, সংক্ষিপ্ত, সংখ্যা, সংগঠন, সংগ্রাম, সংগ্রহ, সংগৃহীত।
[দ্রষ্টব্য : বাংলা ও বাংলাদেশ শব্দ দুটি অনুস্বার (ং) দিয়ে লিখতে হবে। বাংলাদেশের সংবিধানে তাই করা হয়েছে।]
শব্দে ‘স্ট’ এবং ‘ষ্ট-এর ব্যবহার
1. বিদেশি শব্দে 'স্ট' ব্যবহার হবে। বিশেষ করে ইংরেজি ‘st’-যোগে শব্দগুলোতে 'স্ট' ব্যবহার হবে।
যেমন : পোস্ট, স্টার, স্টাফ, স্টেশন, বাসস্ট্যান্ড, মাস্টার, ডাস্টার, পোস্টার, স্টুডিও, ফাস্ট, লাস্ট, বেস্ট ইত্যাদি।
2. ষত্ব-বিধান অনুযায়ী বাংলা বানানে ট-বর্গীয় বর্ণে 'ষ্ট' ব্যবহার হবে।
যেমন : বৃষ্টি, কৃষ্টি, সৃষ্টি, দৃষ্টি, মিষ্টি, নষ্ট, কষ্ট, তুষ্ট, সন্তুষ্ট ইত্যাদি।
3. এসব ক্ষেত্রে 'স্ট'-এর উচ্চারণ হবে ‘স্ট্-এর মতো এবং 'ষ্ট'-এর উচ্চারণ হবে ‘শ্টো-এর মতো।
যেমন : পোস্ট (পোস্ট্), লাস্ট (লাস্ট্), কষ্ট (কশ্টো), তুষ্ট (তুশ্টো) ইত্যাদি।
4. ‘স’ এবং ‘ষ’-এর সাথে ‘ক, প, ফ, ম’-এর ব্যবহার : বাংলা বানানে স্ট/স্ঠ এবং ষ্ত/ষ্থ হবে না। তাই নিম্নের নিয়মগুলোতে ‘ষ্ট/ষ্ঠ দ্বারা গঠিত বানান প্রযোজ্য নয়।
5. অ-কার এবং আ-কারের পর স্ক, স্প, স্ফ, স্ম হবে।
যেমন : তিরস্কার, তেজস্ক্রিয়, নমস্কার, পুরস্কার, পুরস্কৃত, বয়স্ক, ভস্ম, ভাস্কর, ভাস্কর্য, মনস্ক, সংস্কার, পরস্পর, বৃহস্পতি ইত্যাদি।
তবে এর ব্যতিক্রম হচ্ছে বানানবাষ্প/বাষ্প দ্বারা গঠিত শব্দসমূহ। এ ছাড়া স্পৃশ্য, স্পর্ধা, স্পষ্ট, স্পন্দ, স্পন্দন, স্পর্শ, স্পৃষ্ট, স্পর্শী দ্বারা গঠিত শব্দে ‘স’ হবে। নিষ্ফল বাদে ‘ফ’-এ ‘স্+ফ (স্ফ)’ হবে। স্মর, স্মরণ, বিস্ময় দ্বারা গঠিত শব্দে স্+ম (স্ম) হবে।
6. ই/ঈ-কার, উ/ঊ-কার, এ/ঐ-কার এবং ও/ঔ-কারের পর ‘ষ্ক, ষ্প, ষ্ফ, ষ্ম’ হবে।
যেমন : আবিষ্কর, আয়ুষ্কাল, আয়ুষ্কর, আয়ুষ্মান, আয়ুষ্মতী, উষ্ম, কুষ্মাণ্ড, গ্রীষ্ম, গীষ্পতি, গোষ্পদ, চতুষ্কোণ, চতুষ্পার্শ্ব, চতুষ্পদ, জ্যোতিষ্ক, দুষ্কর্ম, দুষ্কর, দুষ্ট, দুষ্প্রাপ্য, নিষ্কাশন, নিষ্কণ্টক, নিষ্পাপ, নিষ্পত্তি, নৈষ্কর্ম্য, পরিষ্কার, পুষ্করিণী, পুষ্টি, পুষ্প, মস্তিষ্ক, শ্লেষ্মা, শুষ্ক ইত্যাদি। এর ব্যতিক্রম একটি বানানহচ্ছে বিস্ময়/বিস্ময় দ্বারা গঠিত শব্দসমূহ।
ণ-ত্ব বিধান বা বানানে মূর্ধন্য ণ ব্যবহারের নিয়ম
তৎসম শব্দের বানানে মূর্ধন্য ‘ণ’ ব্যবহারের সঠিক নিয়মকেই ণ-ত্ব বিধান বলা হয়। বানানে ‘ণ’ ব্যবহারের মৌলিক নিয়মগুলি নিচে দেওয়া হলো।
1. ট-বর্গীয় ধ্বনির আগে ন যুক্ত হয়ে যুক্তব্যঞ্জন গঠিত হলে তা ‘ণ’ হয়। অর্থাৎ, ট, ঠ, ড, ঢ, ণ-- বর্ণগুলির আগে দন্ত্য ‘ন’ যুক্ত হয়ে যুক্তব্যঞ্জন গঠিত হলে সেই ‘ন’, ‘ণ’ হয়।
যেমন : কণ্ঠ, ঘণ্টা, লণ্ঠন, কাণ্ড ইত্যাদি।
2. ঋ, র, ষ-- এই বর্ণগুলির পরে ‘ণ’ হয়।
যেমন : ঋণ, তৃণ (ত+ঋ+ণ+অ), বর্ণ (ব+অ+র+ণ+অ), বর্ণনা, কারণ, মরণ, ব্যকরণ, ভীষণ, ভাষণ, উষ্ণ (উ+ষ+ণ) ইত্যাদি।
3. ঋ, র, ষ-- এর পরে ‘স্বরকপযবহং’ থাকলে এবং তারপর ‘ন’ আসলে তা ‘ণ’ হয়।
এখানে স্বরকপযবহং মানে হলো :
স্বর = স্বরধ্বনি
কপ = ক ও প বর্গীয় ধ্বনি (ক-বর্গীয় ধ্বনি = ক, খ, গ, ঘ, ঙ; প-বর্গীয় ধ্বনি = প, ফ, ব, ভ, ম)
যব = ষ, য়, য, ব
হং = হ, ং
যেমন : কৃপণ (ক+ঋ+প(প-বর্গীয় ধ্বনি)+অ(স্বরধ্বনি)+ণ)
হরিণ (হ+অ+র+ ই(স্বরধ্বনি)+ণ)
অর্পণ (অ+র+প(প-বর্গীয় ধ্বনি)+অ(স্বরধ্বনি)+ ণ)
লক্ষণ (ল+অ+ক্+ষ+অ (স্বরধ্বনি)+ণ)
রামায়ণ (র+আ(স্বরধ্বনি+ম(প-বর্গীয় ধ্বনি)+আ(স্বরধ্বনি)+য়(যব)+ণ)
রুক্মিণী (র+উ(স্বরধ্বনি)+ক(ক-বর্গীয়ধ্বনি)+ম(প-বর্গীয়ধ্বনি)+ই(স্বরধ্বনি)+ ণ +ই)
ব্রাহ্মণ(ব+র+আ(স্বরধ্বনি)+হ(হং)+ম(প-বর্গীয় ধ্বনি)+অ(স্বরধ্বনি)+ ণ)
4. কতোগুলো শব্দে স্বভাবতই মূর্ধন্য ‘ণ’ হয়।যেমন :
চাণক্য মাণিক্য গণ বাণিজ্য লবণ মণ
বেণু বীণা কঙ্কণ কণিকা
কল্যাণ শোণিত মণি স্থাণু গুণ পূণ্য বেণী
ফণী অণু বিপণি গণিকা
আপণ লাবণ্য বাণী নিপুণ ভণিতা পাণি
গৌণ কোণ ভাণ পণ শাণ
চিক্কণ নিক্কণ তূণ কফোণি বণিক গুণ
গণনা পিণাক পণ্য বাণ
5. সমাসবদ্ধ শব্দে ণ-ত্ব বিধান খাটে না।অর্থাৎ, সমাসের মাধ্যমে গঠিত শব্দে ‘ণ’ হয় না, ‘ন’ হয়। (এটি ণ-ত্ব বিধানের সংজ্ঞানুযায়ী ণ-ত্ব বিধানের নিয়ম নয়)
যেমন : ত্রিনয়ন (২ নম্বর নিয়ম অনুযায়ী ত্রিণয়ন), সর্বনাম (৩ নম্বর নিয়ম অনুযায়ী সর্বণাম), দুর্নীতি (২ নম্বর নিয়ম অনুযায়ী দুর্ণীতি), দুর্নাম (২ নম্বর নিয়ম অনুযায়ী দুর্ণাম), দুর্নিবার (২ নম্বর নিয়ম অনুযায়ী দুর্ণিবার), পরনিন্দা (২ নম্বর নিয়ম অনুযায়ী পরণিন্দা), অগ্রনায়ক (২ নম্বর নিয়ম অনুযায়ী অগ্রণায়ক)
6. (এটিও ণ-ত্ব বিধানের সংজ্ঞানুযায়ী ণ-ত্ব বিধানের নিয়ম নয়) ত-বর্গীয় ধ্বনির সঙ্গে যুক্ত হলে কখনওই ‘ন’, ‘ণ’ হয় না। অর্থাৎ, ত, থ, দ, ধ, ন-- এসব বর্ণের সঙ্গে যুক্ত হলে সেটা ‘ন’ হবে।
যেমন : অন্ত, গ্রন্থ, ক্রন্দন, চন্দন ইত্যাদি।
ষ-ত্ব বিধান বা বানানে মূর্ধন্য ষ ব্যবহারের নিয়ম
তৎসম শব্দের বানানে মূর্ধন্য ‘ষ’ ব্যবহারের সঠিক নিয়মকেই ষ-ত্ব বিধান বলা হয়। বাংলা ভাষায় শ, স, ষ থাকার কারণে বানানের ক্ষেত্রে অনেকসময় দ্বিধায় পড়তে হয়। তাই ‘ষ’ ব্যবহারের নিয়মগুলি জানা থাকলে এমন সমস্যা থেকে সহজেই রক্ষা পাওয়া যায়। ‘ষ’ ব্যবহারের সঠিক নিয়মগুলি নিচে দেওয়া হলো।
1. অ/আ ছাড়া অন্য স্বরধ্বনি এবং ক, র-এর পরের ‘স’, ‘ষ’ হয়। অর্থাৎ, ই, ঈ, উ, ঊ, ঋ, এ, ঐ, ও, ঔ, ক, র-- বর্ণগুলির পরে ‘স’ থাকলে তা ‘ষ’ হয়।
যেমন : ভবিষ্যৎ (ভ+অ+ব+ই+ষ+য+ত্)
মুমূর্ষু (ম+উ+ম+ঊ+র+ষ+উ)
চক্ষুষ্মান (চ+অ+ক+ষ+উ+ষ+ম+আ+ন)
চিকীর্ষা (চ+ই+ক+ঈ+র+ষ+আ)
2. ই-কারান্ত ও উ-কারান্ত উপসর্গের পরে প্রায়ই ‘ষ’ হয়।
অর্থাৎ, যে সব সংস্কৃত উপসর্গের শেষে ই-কার বা উ-কার আছে, সেসব উপসর্গযোগে গঠিত শব্দে প্রায়ই ‘ষ’ হয়।
যেমন : অভিসেক > অভিষেক (এখানে উপসর্গ অভি, অ+ভ+ই- ই-কারান্ত উপসর্গ)। এরকম : সুসুপ্ত > সুষুপ্ত, অনুসঙ্গ > অনুষঙ্গ, প্রতিসেধক > প্রতিষেধক, প্রতিস্থান > প্রতিষ্ঠান (দন্ত্য স-র সঙ্গে দন্ত্য ধ্বনি থ যুক্ত হয়। আর মূর্ধণ্য ষ-এর সঙ্গে মূর্ধণ্য ধ্বনি ঠ যুক্ত হয়েছে।), অনুস্থান > অনুষ্ঠান, বিসম > বিষম, সুসমা > সুষমা ইত্যাদি
3. ঋ ও র-এর পরে ‘ষ’ হয়।
যেমন : ঋষি, কৃষক (ক+ঋ+ষ+অ+ক)
তৃষ্ণা (ত+ঋ+ষ+ণ+আ)
উৎকৃষ্ট, বৃষ্টি (ব+ঋ+ষ+ট+ই)
দৃষ্টি (দ+ঋ+ষ+ট+ই)
কৃষ্টি, সৃষ্টি, বর্ষা (ব+অ+র+ষ+আ), বর্ষণ ইত্যাদি।
4. ট ও ঠ-র সঙ্গে যুক্ত হলে ‘ষ’ হয়।
যেমন : কষ্ট, স্পষ্ট, নষ্ট, কাষ্ঠ, ওষ্ঠ ইত্যাদি।
5. কতোগুলো শব্দে স্বভাবতই ‘ষ’ হয়।
যেমন :
অ = অভিলাষ আ = আষাঢ়, আভাষ
ঈ = ঈষৎ ঊ = ঊষা, ঊষর
ঔ = ঔষধ, ঔষধি ক = কলুষ, কোষ
ত = তোষণ দ = দ্বেষ
প = পাষণ্ড, পাষাণ, পোষণ ভ = ভাষা, ভাষণ, ভূষণ
ম = মানুষ র = রোষ
শ = শোষণ স = সরিষা
ষ = ষণ্ডা, ষোড়শ, ষড়যন্ত্র, ষটচক্র
7. বিদেশি শব্দে কখনওই ‘ষ’ হয় না।
যেমন : জিনিস, পোশাক, মাস্টার, পোস্ট ইত্যাদি। এই বানানগুলোর ব্যাপারে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করা জরুরি।(এটি ষ-ত্ব বিধানের সংজ্ঞানুযায়ী ষ-ত্ব বিধানের নিয়ম নয়)
8. (এটিও ষ-ত্ব বিধানের সংজ্ঞানুযায়ী ষ-ত্ব বিধানের নিয়ম নয়) সংস্কৃত ‘সাৎ’ প্রত্যয় যুক্ত হয়ে গঠিত শব্দেও ‘ষ’ হয় না। অর্থাৎ, যেসব শব্দের শেষে ‘সাৎ’ শব্দাংশটি আছে, সেখানে সাৎ বানানে ‘ষ’ হয় না।
যেমন : অগ্নিসাৎ, ধূলিসাৎ, ভূমিসাৎ ইত্যাদি।
ম-ফলা, ব-ফলা ও য-ফলা...
ম-ফলার উচ্চারণ
1. পদের প্রথমে ম-ফলা থাকলে সে বর্ণের উচ্চারণে কিছুটা ঝোঁক পড়ে এবং সামান্য নাসিক্যস্বর হয়। যেমন:
শ্মশান (শঁশান্), স্মরণ (শঁরোন্)। কখনো কখনো ‘ম’ অনুচ্চারিত থাকতেও পারে। বিশেষ করে যেমন: স্মৃতি (সৃতি বা সৃঁতি)।
2. পদের মধ্যে বা শেষে ম-ফলা যুক্ত হলে উচ্চারণে সে বর্ণের দ্বিত্ব হয় এবং সামান্য নাসিক্যস্বর হয়। যেমন:
আত্মীয় (আত্তিঁয়), পদ্ম (পদ্দোঁ), বিস্ময় (বিশ্শঁয়), ভস্মস্তূপ (ভশ্শোঁস্তুপ্), ভস্ম (ভশ্শোঁ), রশ্মি (রোশ্শিঁ)।
3. গ, ঙ, ট, ণ, ন, বা ল বর্ণের সঙ্গে ম-ফলা যুক্ত হলে, ম-এর উচ্চারণ বজায় থাকে। যুক্ত ব্যঞ্জনের প্রথম বর্ণের স্বর লুপ্ত হয়। যেমন:
বাগ্মী (বাগ্মি), যুগ্ম (যুগ্মো), মৃন্ময় (মৃন্ময়), জন্ম (জন্মো), গুল্ম (গুল্মো)।
ব-ফলার উচ্চারণ
1. শব্দের প্রথমে ব-ফলা যুক্ত হলে উচ্চারণে শুধু সে বর্ণের উপর অতিরিক্ত ঝোঁক পড়ে।যেমন:
ক্বচিৎ (কোচিৎ), দ্বিত্ব (দিত্তো), শ্বাস (শাশ্), স্বজন (শজোন), দ্বন্দ্ব (দন্দো)।
2. শব্দের মধ্যে বা শেষে ব-ফলা যুক্ত হলে যুক্ত ব্যঞ্জনটির দ্বিত্ব উচ্চারণ হয়। যেমন:
বিশ্বাস (বিশ্শাশ্), পক্ব (পক্কো), অশ্ব (অশ্শো)।
3. সন্ধিজাত শব্দে যুক্ত ব-ফলায় ব-এর উচ্চারণ বজায় থাকে। যেমন:
দিগ্বিজয় (দিগ্বিজয়), দিগ্বলয় (দিগ্বলয়)।
4. শব্দের মধ্যে বা শেষে ‘ব’ বা ‘ম’-এর সঙ্গে ব-ফলা যুক্ত হলে ব-এর উচ্চারণ বজায় থাকে। যেমন:
তিব্বত (তিব্বত), লম্ব (লম্বো)।
5. উৎ উপসর্গের সঙ্গে ব-ফলা যুক্ত হলে ব-এর উচ্চারণ বহাল থাকে। যেমন: উদ্বাস্তু (উদ্বাস্তু), উদ্বেল (উদ্বেল্)।
6. ‘হ’-এর পর ব-ফলা থাকলে হ+ব-ফলা ‘ওভ’ উচ্চারিত হয়।যেমন: জিহ্বা (জিওভা), গহ্বর (গওভর), আহ্বান (আওভান) ইত্যাদি।
য-ফলার উচ্চারণ
1. য-ফলার পর ব্যঞ্জনধ্বনি বা অ, আ, ও ধ্বনি থাকলে য-ফলা ‘অ্যা’ উচ্চারিত হয়।যেমন:ব্যবহার (ব্যাবোহার্), ব্যস্ত (ব্যাস্তো) ইত্যাদি।
2. য-ফলার পরে ‘ই’ ধ্বনি থাকলে য-ফলা ‘এ’ উচ্চারিত হয়। যেমন: ব্যক্তি (বেক্তি), ব্যতীত (বেতিতো) ইত্যাদি।
3. য-ফলা শব্দের মাঝে বা শেষে থাকলে ‘দ্বিত্ব’ উচ্চারিত হয়। যেমন: বিদ্যুৎ (বিদ্দুত্), বিদ্যা (বিদ্দা) ইত্যাদি।
4. শব্দের প্রথমে য-ফলার সাথে উ-কার, ঊ-কার, ও-কার থাকলে য-ফলার উচ্চারণ হয় না। যেমন: দ্যুতি (দুতি), জ্যোতি (জোতি) ইত্যাদি।
5. ‘হ’-এর পর য-ফলা থাকলে হ+য-ফলা ‘জ্ঝ’ উচ্চারিত হয়।যেমন:সহ্য (শোজ্ঝো), গ্রাহ্য (গ্রাজ্ঝো) ইত্যাদি।
6. উদ্যোগ শব্দটির উচ্চারণ বাংলায় দুটি পাওয়া যায়। যেমন: উদ্দোগ ও উদ্জোগ। তবে জনমনে বেশি প্রচলিত উদ্দোগ। অনেকের মতে উদ্যোগকে যদি সংস্কৃত ভেঙে উদ্যোগ রূপে লেখা হয়—তবে এর উচ্চারণ উদ্জোগ হবে।
7. য বা য-ফলার আদি বা সংস্কৃত উচ্চারণ ‘ইঅ (ইয়)’। যেমন: যামিনী (ইয়ামিনি), শ্যাম (শিয়াম) ইত্যাদি।
[দ্রষ্টব্য : আমাদের অবশ্যই বাংলা বানান ও বাংলা বানানের উচ্চারণ সম্পর্কে ধারণা থাকতে হবে। কারণ বাংলা বানান ও উচ্চারণের পার্থক্য রয়েছে। যেমন:
আছ (আছো), দেখা (দ্যাখা), একা (অ্যাকা) ইত্যাদি।]
☞ এই পোষ্ট সম্পর্কে যদি আপনার কোন প্রশ্ন☞জিজ্ঞাসা☞সমস্যা☞তথ্য জানার থাকে তাহলে আপনি☞কমেন্ট করলে আপনাকে আমরা প্রয়োজনীয় তথ্য দিয়ে সাহায্য করার চেষ্টা করব☞☞☞ "ভুল বানানের ব্যবহার বাড়ছে যে-কারণে"
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন