আজকে প্রকাশিত চাকরির পরীক্ষার নোটিশ গুলো পাবেন

কাঁকড়া চাষ ও রপ্তানী

কাঁকড়া চাষ ও রপ্তানী



এ দেশে খাবার হিসেবে কাঁকড়ার ব্যাপক চাহিদা না থাকলেও বিশ্বের অনেক দেশে এটি সুস্বাদু খাবার হিসেবে সমাদৃত। কাঁকড়া রপ্তানি করে আসছে মোটা অঙ্কের বৈদেশিক মুদ্রা। কাঁকড়া চাষের সুবিধা হচ্ছে, এতে পরিশ্রম তেমন নেই, উত্পাদনব্যয়ও তুলনামূলক কম। আর কাঁকড়ার বংশবৃদ্ধিও ঘটে দ্রুত। উপকূলীয় এলাকায় কাঁকড়া চাষ করে অনেকেই এর সুফল পাচ্ছেন। বতর্মানে কেবল দক্ষিণাঞ্চল থেকেই কাঁকড়া রপ্তানির মাধ্যমে বছরে ৫০ থেকে ৭০ কোটি টাকা বৈদেশিক মুদ্রা আসছে। সারা দেশ থেকে এ রপ্তানি-আয়ের পরিমাণ বছরে প্রায় ১৫০ কোটি টাকা। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে উপকূলীয় অঞ্চলে লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ায় সেখানকার কৃষি উত্পাদন এখন ঝুঁকির মধ্যে। এতে স্থানীয় লোকজনের অনেকে আরও গরিব হচ্ছে। কাঁকড়ার চাষ এসব গরিব মানুষের বিকল্প আয়ের উত্স হতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।



কাঁকড়ার উৎস

দেশে দুই ধরনের কাঁকড়া পাওয়া যায়। একটি লোনাপানির, অন্যটি মিঠাপানির। মিঠাপানির কাঁকড়া তুলনামূলক কম। লোনাপানিতে লবণাক্ততার পরিমাণ যত বেশি থাকবে, কাঁকড়ার উত্পাদনও তত বেশি হবে। দক্ষিণাঞ্চলের নদী-নালা, খাল-বিল, বিস্তৃত চিংড়িঘের ও সুন্দরবনের গোটা বনাঞ্চলে লোনাপানির কাঁকড়া মেলে। এদের গড় আয়ু এক থেকে দেড় বছর। চিংড়িঘেরে বড় হওয়া কাঁকড়ার ৯০ শতাংশই ধরা পড়ে। প্রাকৃতিকভাবে বড় হওয়া কাঁকড়ার ২০ থেকে ২৫ শতাংশ আহরণ করা সম্ভব হয়।



আহরণ ও প্রজনন

কাঁকড়া ব্যবসায়ীরা জানান, দক্ষিণাঞ্চলে প্রায় দেড় লাখ জেলে প্রাকৃতিক উত্সগুলো থেকে কাঁকড়া ধরে জীবন যাপন করছেন। বেসরকারি সংস্থা কেয়ারের তথ্য অনুযায়ী, কেবল সুন্দরবন এলাকায় ৫০ থেকে ৬০ হাজার জেলে কাঁকড়া ধরে জীবিকা নির্বাহ করছেন।

সুন্দরবন অঞ্চলে জেলেরা স্থানীয় ভাষায় দোন দিয়ে পানি থেকে কাঁকড়া ধরেন। সারা দিন খেটে একজন জেলে দোন দিয়ে ২০ থেকে ৩০ কেজি কাঁকড়া ধরে থাকেন। চিংড়িঘেরের গই (পানি বের হওয়ার পথ) মুখে জাল পেতে চিংড়ি ধরার সময় ঘেরে থাকা কাঁকড়াও ধরা পড়ে।

খুলনার পাইকগাছা উপজেলার চিংড়িঘের ব্যবসায়ী মিজানুর রহমান বলেন, প্রতিবছর এ অঞ্চলে প্রাকৃতিকভাবে যে পরিমাণ কাঁকড়ার পোনা জন্মে, এর ১০ শতাংশও যদি চিংড়িঘেরে ছাড়া যেত, তাহলে কাঁকড়ায় ভরে উঠত ঘের। চিংড়ি বাঁচাতেই ঘেরে পর্যাপ্ত কাঁকড়ার পোনা ছাড়া হয় না।

চাষিরা জানান, প্রতিবছরের ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি এবং জুন থেকে জুলাই হচ্ছে কাঁকড়ার প্রজননকাল। এ সময় গভীর সমুদ্রে ও সুন্দরবনের মধ্যে ডিম থেকে কাঁকড়া জন্ম নেয়। এসব পোনা পানিতে ভেসে এসে নদ-নদী, খাল ও মাছের ঘেরে আশ্রয় নিয়ে বড় হয়। প্রজননের সময় উপকূলীয় অঞ্চল ও সুন্দরবনের বিস্তৃত এলাকার জলাশয় ও তীরে প্রচুর কাঁকড়ার পোনা দেখা যায়।



খামারে চাষ

খুলনার পাইকগাছা, সাতক্ষীরার শ্যামনগর, বাগেরহাটের রামপাল ও মংলা এলাকা ঘুরে দেখা যায়, খামারে তিন পদ্ধতিতে কাঁকড়ার চাষ হচ্ছে। একটি পদ্ধতিতে ছোট ছোট পুকুরে রেখে মোটাতাজা করা হচ্ছে কাঁকড়া, আরেক পদ্ধতিতে বড় বড় ঘেরে চিংড়ির সঙ্গে কাঁকড়ার পোনা ছেড়ে বড় করা হচ্ছে, আবার উন্মুক্ত জলাশয়ে খাঁচায় আটকে রেখেও চাষ করা হচ্ছে কাঁকড়া।

কাঁকড়ার খামার বিভিন্ন মাপের হতে পারে। পাঁচ কাঠা থেকে এক বিঘা পর্যন্ত জমিতে কাঁকড়ার পুকুর করা যায়। এসব পুকুর মাছের পুকুরের মতো হলেও নিরাপত্তাবেষ্টনী রাখতে হবে। অন্যথায় কাঁকড়া হেঁটে অন্যত্র চলে যেতে পারে।

মোটাতাজাকরণ পদ্ধতিতে পুকুরে প্রতি বিঘায় ৯০০ কেজি থেকে এক হাজার কেজি (৫০ হাজার থেকে ৫৫ হাজার) কাঁকড়া চাষ করা যায়। নদীতে বা মুক্ত জলাশয়ে ৬০ খোপবিশিষ্ট ২১ ঘনফুট আয়তনের বাঁশের খাঁচায় কাঁকড়া চাষ বেশি লাভজনক। পাইকগাছা উপজেলার মত্স্য চাষ গবেষণা কেন্দ্রে পরীক্ষামূলকভাবে এভাবে কাঁকড়া চাষ করে ভালো ফল পাওয়া গেছে। চিংড়ি চাষের মতো ঘেরে এক থেকে ১০ গ্রাম ওজনের কাঁকড়ার পোনা ছেড়ে চাষ করলেও ভালো উত্পাদন হয়।

খামারে খাবার হিসেবে কাঁকড়াকে ছোট মাছ, কুঁচে, শামুকের মাংস দেওয়া হয়। এসব খাবার চাষিরা ১৫ থেকে ২০ টাকা কেজি দরে কেনেন।

মংলার দিগরাজ এলাকার কাঁকড়া চাষি মধুসূদন হালদার জানান, প্রায় সারা বছরই কাঁকড়া চাষ হয়। রপ্তানি-উপযোগী প্রতিটি কাঁকড়ার গড় ওজন হয় ২০০ থেকে ২৫০ গ্রাম। এসব কাঁকড়া ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করা হয়। মাঝেমধ্যে এমন সময়ও আসে, যখন প্রতি কেজি কাঁকড়ার দাম ৮০০ থেকে ৯০০ টাকায় দিয়ে দাঁড়ায়।



মোটাতাজাকরণ

দক্ষিণাঞ্চলে এখন কেবল ব্যক্তিগত উদ্যোগে কয়েক হাজার কাঁকড়া মোটাতাজাকরণ খামার গড়ে উঠেছে। সাতক্ষীরার শ্যামনগর, কালীগঞ্জ, আশাশুনি, দেবহাটা; খুলনার পাইকগাছা, বটিয়াঘাটা, দাকোপ, ডুমুরিয়া এবং বাগেরহাটের রামপাল ও মংলা উপজেলায় নয় শতাধিক কাঁকড়া মোটাতাজাকরণ খামার গড়ে উঠেছে। শুধু পাইকগাছাতেই রয়েছে ৩০০ খামার।

পাইকগাছার কাঁকড়া খামারের মালিক প্রশান্ত কুমার মণ্ডল জানান, মাত্র এক বিঘার কাঁকড়ার ঘেরে বছরে দেড় থেকে দুই লাখ টাকা লাভ করা যায়। দুই থেকে আড়াই মাস বয়সের কাঁকড়া ঘেরে ছাড়ার পর ২০ থেকে ২৫ দিনেই তা বিক্রির উপযোগী হয়।

দক্ষিণাঞ্চলে কাঁকড়া চাষ ও মোটাতাজাকরণ সম্প্রসারণ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করেন বাগেরহাটের জেলা মত্স্য কর্মকর্তা মো. আবদুর রাশেদ। তাঁর মতে, কাঁকড়া চাষ দক্ষিণাঞ্চলের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর বিকল্প আয়ের উত্স হতে পারে। মাত্র এক শতাংশ জমিতে পাঁচ থেকে ছয় হাজার টাকা খাটিয়ে বছরে গড়ে ৩০০ কেজি কাঁকড়া উত্পাদন করা সম্ভব। এর মূল্য প্রায় এক থেকে দেড় লাখ টাকা। বিদেশে বাংলাদেশের কাঁকড়ার খুব চাহিদা রয়েছে; বিশেষ করে চীন, তাইওয়ান, হংকং, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর ও থাইল্যান্ডে।

সাতক্ষীরা জেলা কাঁকড়া সমিতির সভাপতি পরিতোষ চন্দ্র দাশ বলেন, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে বিস্তীর্ণ অঞ্চলের ফসলি জমিতে লবণাক্ততা বাড়ছে। এতে দিন দিন আয়ের পথ রুদ্ধ হচ্ছে কৃষকদের। লবণাক্ত পানিতে কাঁকড়া চাষ করে এ সংকট অনেকাংশে কাটিয়ে ওঠা সম্ভব।



বাড়ছে রপ্তানি-আয়

পাইকগাছা কাঁকড়া ব্যবসায়ী সমবায় সমিতি লিমিটেডের সভাপতি আধিবাস সানা প্রথম আলোকে বলেন, ২০০৪-০৫ অর্থবছরে কেবল পাইকগাছা উপজেলা মোকাম (বাজার) থেকে এক হাজার ৫০০ মেট্রিক টন কাঁকড়া বিদেশে রপ্তানি করা হয়। এর মূল্য প্রায় ২৫ কোটি টাকা। ২০০৮-০৯ অর্থবছরে এই রপ্তানি বেড়ে এক হাজার ৭০০ মেট্রিক টনে দাঁড়িয়েছে। গত অর্থবছরে সারা দক্ষিণাঞ্চল থেকে প্রায় ৭০ কোটি টাকা মূল্যের কাঁকড়া রপ্তানি হয়েছে।

বাংলাদেশ কাঁকড়া রপ্তানিকারক সমিতি সূত্রে জানা যায়, ১৯৭৭-৭৮ অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে অপ্রচলিত পণ্য হিসেবে মাত্র ২৩ হাজার টাকা মূল্যের কাঁকড়া বিদেশে প্রথম রপ্তানি করা হয়। গত অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে প্রায় ১৫০ কোটি টাকার কাঁকড়া রপ্তানি করা হয়েছে।

সহযোগিতা চান ব্যবসায়ীরা: কাঁকড়া ব্যবসায়ীরা জানান, কাঁকড়া আহরণ পরিবেশের ক্ষতি করে—এ যুক্তিতে সরকার ১৯৯৭ সালের নভেম্বরে দেশজুড়ে কাঁকড়া আহরণ ও রপ্তানি নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। এতে বিদেশে বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের কাঁকড়ার বাজার দখল করে নেয় ভারত, মিয়ানমারসহ কয়েকটি দেশের ব্যবসায়ীরা। পরে কাঁকড়া ব্যবসায়ীদের চাপের মুখে সরকার রপ্তানি করার অনুমতি দিলেও আহরণের ক্ষেত্রে সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয়। ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি—এই তিন মাস বিদেশে কাঁকড়ার চাহিদা বেশি থাকে বলে এ সময়কে আহরণের জন্য নির্ধারণ করা হয়েছে। এ বিধিনিষেধ বিলোপ করা হলে কাঁকড়ার ব্যবসায় আরও বৈদেশিক মুদ্রা আসবে বলে তাঁরা দাবি করছেন।

কাঁকড়া রপ্তানিকারক সমিতির সাবেক আহ্বায়ক গাজী আবুল হাসেম বলেন, ‘২০ বছর ধরে কাঁকড়া রপ্তানি করে আসছি। এখনো এটি দেশের অপ্রচলিত পণ্যের মধ্যে রয়েছে। অথচ এটি বেশ অর্থকরী সম্পদ।’ এটিকে প্রচলিত পণ্যের মর্যাদা দেওয়ার দাবি জানান তিনি।

☞ এই পোষ্ট সম্পর্কে যদি আপনার কোন প্রশ্ন☞জিজ্ঞাসা☞সমস্যা☞তথ্য জানার থাকে তাহলে আপনি☞কমেন্ট করলে আপনাকে আমরা প্রয়োজনীয় তথ্য দিয়ে সাহায্য করার চেষ্টা করব☞☞☞ "কাঁকড়া চাষ ও রপ্তানী"

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Iklan Atas Artikel

Iklan Tengah Artikel 1

Iklan Tengah Artikel 2

Iklan Bawah Artikel