শিক্ষার মান উন্নয়ন/শিক্ষার মানোন্নয়ন
সোমবার, ১৫ জুলাই, ২০১৯
Comment
ভূমিকা: শিক্ষাই জাতির মেরুদন্ড। শিক্ষা ছাড়া কোনো জাতি উন্নতি লাভ করতে পারে না। শিক্ষার আলোয় আলোকিত ব্যক্তি এবং জাতি সবসময় উন্নতি ও অগ্রগতির শীর্ষে অবস্থান করে। এরূপ শিক্ষিত শ্রেণিই সবসময় নেতৃত্বের আসনে থাকে। কিন্তু শিক্ষা তখনই এরূপ যোগ্যতাসম্পন্ন নাগরিক তৈরি করতে সমর্থ হবে যখন তা হবে উপযুক্ত মানসম্পন্ন। কেবল মানসম্পন্ন আধুনিক যুগোপযোগী শিক্ষাই পারে যোগ্য ও দক্ষতা সম্পন্ন জনবল তৈরি করতে। আর এজন্যই শিক্ষার মানোন্নয়ন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
শিক্ষার মানোন্নয়ন: মান বা গুণ বলতে সাধারণভাবে কোনো ব্যক্তি, বস্তু, পণ্য, ঘটনা, ফলাফল ইত্যাদির কাঙ্ক্ষিত অবস্থাকে বুঝানো হয়। গুণগত বা মানসম্পন্ন শিক্ষা বলতে শিক্ষার আদর্শ মানকে বোঝানো হয়, যা সেই শিক্ষা থেকে প্রত্যাশা করা হয়। শিক্ষার এই মানকে দুটি দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা করা হয় (ক) শিক্ষার পরিমাণগত মান এবং (খ) শিক্ষার গুণগত মান।
(ক) শিক্ষার পরিমাণগত মান: শিক্ষা সবার মৌলিক চাহিদা। আন্তর্জাতিক চুক্তি, সম্মেলন এবং বাংলাদেশের সংবিধান অনুসারে সবাই শিক্ষা লাভের অধিকারী। প্রতিটি নাগরিকের নিকট শিক্ষা পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব সরকারের। এভাবে শিক্ষা কতগুলো মানুষের নিকট পৌঁছানো হলো, কতসংখ্যক শিক্ষার্থী বিদ্যালয়ে ভর্তি হলো, তাদের পাশের হার কত, ছেলে মেয়ে শিক্ষার্থীদের অনুপাত কত, শিক্ষকের সংখ্যা কত, বিদ্যালয়ের সংখ্যা, বিদ্যালয় প্রতি শিক্ষার্থীর সংখ্যা ইত্যাদি হলো শিক্ষার পরিমাণগত দিক। শিক্ষার পরিমাণগত দিকে কেবল সংখ্যাকেই দেখা হয় এর মান বা গুণাবলীর দিকে লক্ষ্য রাখা হয় না। যেমন- প্রতি বছর বাংলাদেশের পাবলিক পরীক্ষাগুলোতে A+ এবং পাশের হার বৃদ্ধি পাচ্ছে। এটি শিক্ষার পরিমাণগত দিকের উন্নতি নির্দেশ করে।
(খ) শিক্ষার গুণগত মান: শিক্ষার গুণগত মানের ক্ষেত্রে দেখা হয় শিক্ষা গ্রহণ করে শিক্ষার্থীরা কতটুকু উপকৃত হচ্ছে। A+ এবং পাশের হার বৃদ্ধি পেলেও তারা কতটুকু মান সম্পন্ন শিক্ষা অর্জন করতে পারল, তাই এখানে মূখ্য। শিক্ষার্থীদের যে স্তর শেষে যে যোগ্যতা অর্জন করার কথা, তা কতটুকু অর্জন করতে সমর্থ হয়েছে, এখানে তা দেখা হয়। এরূপ মান উন্নয়নে উপযুক্ত শিক্ষক, যথাযথ ব্যস্থাপনা, শিক্ষক প্রশিক্ষণ, সঠিকভাবে শিক্ষার্থীদেরকে মূল্যায়ন ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ।
শিক্ষার মানোন্নয়নের গুরুত্ব: আধুনিককালে শিক্ষা বলতে মানসম্পন্ন শিক্ষাকেই বোঝানো হয়। কেননা, যে শিক্ষায় যথাযথ মান বজায় রাখা হয় না, চূড়ান্ত বিচারে সে শিক্ষা দেশের বা ব্যক্তির কল্যাণ বয়ে আনতে পারে না। শিক্ষার পরিমাণগত এবং গুণগত মানোন্নয়ন উভয়ই গুরুত্বপূর্ণ নিন্মোক্ত কারণে-
নিরক্ষরতা দূরীকরণ: বিপুল সংখ্যক মানুষকে নিরক্ষর রেখে দেশের উন্নতি করা যায় না। নিরক্ষরতা দূরীকরণে শিক্ষার পরিমাণগত মান উন্নত করতে হবে। কেননা নিরক্ষরতা সকল অজ্ঞতা, কুসংস্কার ও অনুন্নয়নের মূল কারণ।
সবার জন্য শিক্ষা নিশ্চিতকরণ: সর্বজনীন বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করা সরকারের দায়িত্ব। আবার নাগরিকদের কর্তব্য হলো নিজের এই শিক্ষা গ্রহণ করা। এজন্য শিক্ষার পরিমাণগত বিকাশ ঘটানো প্রয়োজন।
দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি: বাংলাদেশের বিপুল পরিমাণ জনসংখ্যাকে জনসম্পদে পরিণত করতে উপযুক্ত শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। এজন্য প্রয়োজন যথাযথ গুণগত মানসম্পন্ন শিক্ষা। শিক্ষার পরিমাণগত এবং গুণগত উভয় প্রকার মান উন্নয়ন এক্ষেত্রে অপরিহার্য।
যুগের চাহিদা পূরণ: তথ্য প্রযুক্তির উন্নতির চরম পর্যায়ের এই যুগে বৈশ্বিক প্রতিযোগিতা মোকাবিলা করতে হয়। এরূপ প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে দক্ষতা অর্জন অপরিহার্য। আর এই দক্ষতা-যোগ্যতা নিশ্চিত করতে পারে মানসম্পন্ন শিক্ষা। তাই এর গুরুত্বও কম নয়।
বাংলাদেশের শিক্ষার বর্তমান অবস্থা: বাংলাদেশ পৃথিবীর অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ একটি উন্নয়নশীল দেশ। আয়তনে পৃথিবীর দেশসমূহের মধ্যে বাংলাদেশ ৯১তম বৃহত্তম দেশ হলেও এর জনসংখ্যা বিশ্বের ৮ম বৃহত্তম। সীমিত সম্পদ, অনুন্নত অবকাঠামো এবং দারিদ্র্যের জন্য বাংলাদেশের জনসংখ্যার বিরাট অংশ এখনও নিরক্ষর। সরকারি হিসাবে এদেশে সাক্ষরতার হার ৬০% এর মতো দেখানো হচ্ছে এবং ৭-৮টি জেলাকে নিরক্ষর মুক্ত বলে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এটি প্রকৃত চিত্র নয়। বর্তমানে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষার পরিমাণগত মানোন্নয়নের প্রতি যতটা গুরুত্ব দেওয়া হয়, গুণগত মানোন্নয়নের প্রতি ততটা গুরুত্ব দেওয়া হয় না। বাংলাদেশের শিক্ষার বর্তমান অবস্থা নিন্মোক্ত উপায়ে বর্ণনা করা যায়-
-প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তির হার ১০০% বা তার কাছাকাছি।
-এদের প্রাথমিক শিক্ষাচক্র সমাপনের হার ৪৮% ভাগ।
-ছেলে-মেয়ে অনুপাত সন্তোষজনক।
-মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষার সুযোগ পর্যাপ্ত নয়।
-শিক্ষা ব্যবস্থা যুগোপযোগী নয়।
-প্রতিবছর প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী, জুনিয়র সমাপনী, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় পাশ এবং A+ প্রাপ্তদের সংখ্যা বাড়লেও মান বাড়ছে না।
-সার্বিক বিচারে শিক্ষা সময়ের চাহিদা পূরণ করতে পারছে না।
-নারী শিক্ষার উন্নয়নে বাংলাদেশের অর্জন প্রশংসাযোগ্য।
-শিক্ষার্থীর সংখ্যা বৃদ্ধি এবং ধরে রাখতে বিনামূল্যে বই বিতরণ এবং ছাত্রী উপবৃত্তির ব্যবস্থা করা হয়েছে।
শিক্ষার মানোন্নয়নের প্রতিবন্ধকতা: শিক্ষার মানোন্নয়ন একটি জটিল ও সময় সাপেক্ষ কাজ। এটি নিশ্চিত করতে পরিকল্পিত উপায়ে দীর্ঘ সময় ধরে কাজ করতে হয়। নানাবিধ প্রতিবন্ধকতা এর গতিকে মন্থর করে দিতে পারে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো-
সম্পদের সীমাবদ্ধতা: শিক্ষার মানোন্নয়নের জন্য প্রয়োজন প্রচুর অর্থ। সীমাবদ্ধ সম্পদ এক্ষেত্রে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
অনুন্নত অবকাঠামো: অবকাঠামোগত সমস্যা শিক্ষার পরিমাণগত এবং গুণগত উভয় প্রকার উন্নয়নকে ব্যহত করে।
সুষ্ঠু পরিকল্পনার অভাব: শিক্ষার উন্নয়নে দরকার সুষ্ঠু ও নিরবচ্ছিন্ন পরিকল্পনা। বাংলাদেশে এর যথেষ্ট অভাব লক্ষণীয়।
উপযুক্ত শিক্ষকের অভাব: উপযুক্ত দক্ষতাসম্পন্ন শিক্ষক ছাড়া শিক্ষার মান উন্নয়ন সম্ভব নয়। কিন্তু আমাদের দেশে দক্ষ শিক্ষকের অভাব প্রকট।
রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা: অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশ শিক্ষার মান উন্নয়নকে চরমভাবে ব্যহত করে। হরতাল, অবরোধ, ভাংচুর বিদ্যালয় এবং শিক্ষার্থীদেরকে অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দেয়।
দুর্নীতি: শিক্ষা খাত অন্যতম দুর্নীতিগ্রস্ত একটি খাত। দুর্নীতি এই খাতের উন্নতির বড় অন্তরায়।
শিক্ষার মানোন্নয়নে করণীয়: দেশ ও জাতির উন্নতির লক্ষ্যে শিক্ষার মানোন্নয়ন অতীব জরুরি। শিক্ষার মান উন্নত করতে হলে যা করা প্রয়োজন তার মধ্যে প্রধান কয়েকটি হলো-
-শিক্ষা খাতে বরাদ্দ বাড়াতে হবে।
-উপযুক্ত শিক্ষকের ব্যবস্থা করতে হবে। এজন্য শিক্ষকদের পর্যাপ্ত বেতন ভাতার ব্যবস্থা করতে হবে।
-শিক্ষকদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।
-পর্যাপ্ত অবকাঠামোগত উন্নয়ন সাধন করতে হবে।
-বৃত্তির পর্যাপ্ত ব্যবস্থা রাখতে হবে। গরীব শিক্ষার্থীদের দুপুরের খাবারের ব্যবস্থা করতে হবে। অন্যান্য বৃত্তির সুবিধা মেধার ভিত্তিতে দিতে হবে।
-শিক্ষার উন্নয়নে বাস্তবসম্মত পরিকল্পনা নিতে হবে।
-শিক্ষাখাতের দুর্নীতি বন্ধে কার্যকর পদপেক্ষ নিতে হবে।
-রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা যাতে শিক্ষার পরিবেশকে নষ্ট না করে সে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। ছাত্র রাজনীতির নামে সন্ত্রাস ও দলীয় লেজুরবৃত্তি বন্ধ করতে হবে।
-নারী শিক্ষার উন্নয়নে আরও কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে হবে।
-বিদ্যালয়কে শিক্ষার্থীদের জন্য আনন্দদায়ক করে গড়ে তুলতে হবে।
উপসংহার: আয়তনে পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশ কানাডার মোট জনসংখ্যা ৩ কোটি। অন্যদিকে বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষায় গ্রহণ উপযোগী শিক্ষার্থীর সংখ্যাও ২.৫ কোটির বেশি। অর্থাৎ কানাডার মোট জনসংখ্যার প্রায় সমান সংখ্যক শিক্ষার্থী বাংলাদেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ে। বিপুল সংখ্যক এই শিক্ষার্থীদের মানসম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিত করা সাধারণ কাজ নয়। বাংলাদেশ এক্ষেত্রে সীমিত সম্পদ ও সামর্থ্য নিয়ে যে সাফল্য অর্জন করেছে, তা কোনো অংশেই কম নয়। শিক্ষার উন্নয়নে বাংলাদেশের সাফল্য যথেষ্ট না হলেও আশাব্যঞ্জক। সামগ্রিক উন্নয়ন ও কল্যাণের জন্য শিক্ষার মান আরও উন্নত করা প্রয়োজন।
☞ এই পোষ্ট সম্পর্কে যদি আপনার কোন প্রশ্ন☞জিজ্ঞাসা☞সমস্যা☞তথ্য জানার থাকে তাহলে আপনি☞কমেন্ট করলে আপনাকে আমরা প্রয়োজনীয় তথ্য দিয়ে সাহায্য করার চেষ্টা করব☞☞☞ "শিক্ষার মান উন্নয়ন/শিক্ষার মানোন্নয়ন"
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন