সংস্কার-কুসংস্কার ও বিজ্ঞান-দৃষ্টি
শনিবার, ১৩ জুলাই, ২০১৯
Comment
ভূমিকা: সামাজিক জীব হিসেবে একজন মানুষ জন্মের পর থেকে সমাজে বসবাস করে। সে একই সাথে একটি পরিবারের সদস্য, সমাজের একটি অংশ এবং একটি রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে গড়ে ওঠে। প্রত্যেক পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের কিছু নিজস্ব নিয়মনীতি, আচরণ বিধি থাকে। থাকে কিছু সংস্কার ও কুসংস্কার। সমাজের সদস্য হিসেবেই মানুষ সেসব সংস্কার -কুসংস্কারকে মেনে চলে, বিশ্বাস করে। নিজেদের সংস্কৃতি ও আচার-আচরণে সেই সংস্কার-কুসংস্কারগুলোকে ধারণ করে। এই সংস্কার-কুসংস্কারগুলো স্থান ভেদে ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে। এক সমাজের কাছে যে বিষয়গুলো কুসংস্কার মনে হয় অন্য সমাজের লোকের কাছে তা হয়তো অবশ্য পালনীয়। তাই এখন সংস্কার-কুসংস্কার না বলে এগুলোকে ‘লোকাচার’ বলা হয়। যাতে করে কারো বিশ্বাসে আঘাত না লাগে বা কারো বিশ্বাসকে যেন ছোট করা না হয়।
সংস্কার ও কুসংস্কার: মানুষ নিজেকে শুদ্ধ রাখতে, ভালো রাখতে, পবিত্র রাখতে, দোষ-ত্রুটি মুক্ত রাখতে, সৎ মানুষ হিসেবে গড়ে উঠতে পরিবার বা সমাজ দ্বারা আরোপিত যে সকল আচার-ব্যবহার মেনে চলে সেগুলোই হলো সংস্কার। অন্যদিকে কুসংস্কার হলো যুক্তিহীন অবৈজ্ঞানিক কিছু সংস্কার। আমরা জানি না সেগুলো কোথা থেকে এসেছে, কিভাবে এসেছে, কে সৃষ্টি করেছে। বছরের পর বছর ধরে সেগুলো লোক মুখে প্রচলিত হয়ে এসেছে। কিন্তু মানুষ সেগুলো বিশ্বাস করে পালন করে। অর্থাৎ সংস্কার কিংবা কুসংস্কার মানুষের মানসিক চেতনা ও বিশ্বাসের ফল।
সংস্কার ও কু-সংস্কারের উদ্ভব: সঠিক কোথা থেকে সংস্কার কিংবা কুসংস্কারের জন্ম হয়েছে তা আমরা কেউই নিশ্চিত করে বলতে পারি না। তবে লোক মুখে প্রচলিত হওয়া বিভিন্ন কাহিনী, গীতি-কাব্য, পৌরাণিক কাহিনী, প্রাচীন পন্থী গোঁড়া চিন্তা ও ভাবাদর্শ থেকে সংস্কার-কুসংস্কারের উদ্ভব ও বিকাশ হয়েছে বলে মনে করা হয়। ‘মহাভারত’ ও ‘রামায়ণ’ এর মতো পৌরাণিক কাহিনীগুলো থেকে সনাতন ধর্মের মানুষের মধ্যে অনেক সংস্কার ও কুসংস্কার জন্ম নিয়েছে। যেমন- নারীদের সতীত্বের ধারণা কিংবা সতীদাহ প্রথা। ধর্মভেদে মানুষের সংস্কার-কুসংস্কারগুলো আলাদা হয়ে থাকে। যেমন- মুসলমানরা মনে করে চন্দ্রগ্রহণ ও সূর্যগ্রহণের সময় কিছু খেতে হয় না। প্রাচীনকাল থেকে লোক মুখে চলে এসেছে এমন বিষয়কেও মানুষ সংস্কার হিসেবে মেনে নেয়। যেমন- অনেক মানুষ বিশ্বাস করে কলেরা রোগ নিয়ে আসে ওলা বিবি, যার এক পা খোড়া ও এক চোখ অন্ধ। তাই এক পা খোড়া কোনো কাক দেখলে মানুষ ভয় পায়।
সংস্কার ও ধর্মীয় গোঁড়ামী: বিভিন্ন ধর্মের ধর্মীয় গোঁড়ামীগুলো এক সময় সংস্কার ও কুসংস্কারে পরিণত হয়ে যায়। যেমন হিন্দু ধর্মের অস্পৃশ্যতা; ছোট জাতের কেউ অপেক্ষাকৃত বড় জাতের কাউকে ছুলে তাকে গঙ্গা জল কিংবা গোবর মিশ্রিত পানি ছিটিয়ে শুদ্ধ হতে হয়, পবিত্র হতে হয় কিংবা বিধবা নারীদের বিভিন্ন ব্রত পালন করতে হয়। সারাজীবন নিরামিষ ভোজী হিসেবে কাটিয়ে দিতে হয়। মুসলমানদের ক্ষেত্রে মেয়েকে ১২ বছর বয়সের মধ্যেই বিয়ে দেয়া কিংবা হিন্দুদের ‘গৌরীদান’ সবই ধর্মীয় গোড়ামী থেকে সৃষ্ট সংস্কার-কুসংস্কার। খ্রিস্টানরা ১৩ সংখ্যাকে অশুভ মনে করে। কারণ তাদের বিশ্বাস যিশু খ্রিস্টের ১৩ তম শিষ্যই তার মৃত্যুর জন্য দায়ী। এই সকল সংস্কার-কুসংস্কার হলো ধর্মীয় গোঁড়ামীর ফল।
কুসংস্কার ও অন্ধবিশ্বাস: কুসংস্কার টিকে থাকে শুধুমাত্র মানুষের বিশ্বাসের কারণে। কেননা, যুক্তি দিয়ে বিচার করলে কিংবা বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে দেখা যায়, কুসংস্কারের আসলে কোনো ভিত্তি নেই। মানুষ তার অমঙ্গলের ভয়ে ভীত হয়ে বিভিন্ন হাস্যকর বিষয়কেও বিশ্বাস করে মেনে চলে। তাদের অন্ধ বিশ্বাসই কুসংস্কারকে অন্য সবার মধ্যে ছড়িয়ে দেয় এবং বছরের পর বছর, যুগের পর যুগ সেগুলোকে প্রচলিত রাখে। কুসংস্কারে বিশ্বাসী মানুষের কুসংস্কারের প্রতি বিশ্বাস এত দৃঢ় হয় যে তারা কুসংস্কারগুলোকে অবশ্য পালনীয় কর্তব্য বলে মনে করে। কোনো রকম চিন্তা বা বুদ্ধি-বিবেচনা দিয়ে বিচার করা ছাড়াই তারা কুসংস্কারের প্রতি অন্ধ বিশ্বাস স্থাপন করে। আর তাই কেউ কেউ মঙ্গল কিংবা শনিবার অমঙ্গল ও অশুভ কিছু ঘটার আশংকায় অনেক প্রয়োজন থাকলেও কোথাও যাত্রা করে না। কালো বিড়াল কিংবা এক শালিক দেখলে যাত্রা অশুভ ভেবে যাত্রাবিরতি দেয়। কোনো কথা বলার সময় টিকটিকি যদি টিক টিক করে শব্দ করে তাহলে সেই শব্দকে ঐ কথার সত্যতা নিশ্চিত করার মাধ্যম হিসেবে ধরে নেয়। জোড়া শালিক দেখলে ভাগ্য সু-প্রসন্ন হবে বলে কেউ কেউ বিশ্বাস করে। এর সবই হলো কুসংস্কারের প্রতি অন্ধবিশ্বাসের ফল।
কুসংস্কারের কুফল: ‘কু’ এই উপসর্গটি দিয়ে আমরা যেকোনো অশুভ বা খারাপ বিষয়কে নির্দেশ করি। ‘কুসংস্কার’ শব্দটি দিয়ে তাই বোঝায় কু যে সংস্কার। অর্থাৎ যে সংস্কার মানুষের জন্য ভালো নয় সেটাই কুসংস্কার। এই সংস্কার না মানলে কোনো ক্ষতির সম্ভাবনা নেই। এটা অবশ্য পালনীয় কোনো কর্তব্য বা দায়িত্ব নয়। বরং এই কুসংস্কার মেনে চললেই আমাদের ক্ষতির সম্ভাবনা থাকে। কুসংস্কারে বিশ্বাস করি বলেই আমরা এখনো সব দিক থেকেই অনেক পিছিয়ে আছি। কুসংস্কার গ্রামীণ এলাকাতেই সবচেয়ে বেশি মানতে দেখা যায়। এ কারণেই গ্রামীন জীবন এখনো অনেক অনগ্রসর। কুসংস্কারে বিশ্বাসের কারণে মানুষ কোনো সত্যের অনুসন্ধান করে না। ফলে তাদেরকে বারবার একই সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। কুসংস্কার ব্যক্তি জীবনকে নানা সাফল্য থেকে দমিয়ে রাখে। মানুষকে সামনে অগ্রসর হতে না দিয়ে পেছনে টানতে থাকে। ফলে কুসংস্কারে বিশ্বাসী মানুষ বর্তমান সময়ের সাথে, যুগের সাথে তারা তাল মেলাতে পারে না। তাদের অন্ধবিশ্বাস তাদেরকে কুয়োর ব্যাঙ করে রাখে।
সংস্কার-কুসংস্কার ও বিজ্ঞান: সংস্কার, কুসংস্কার ও বিজ্ঞান তিনটি বিষয়ই একটি অন্যের বিরোধী। সংস্কার সৃষ্টি হয় মানুষের ভালোর জন্য, নিয়মের মধ্যে থেকে সুশৃঙ্খল জীবনযাপনের জন্য। মানুষের বিশ্বাসেই সংস্কার বিকাশ লাভ করে। আর কুসংস্কার হলো সংস্কারেরই একটা বিকৃত রূপ। অন্যদিকে বিজ্ঞান সব সময়ই যুক্তির উপর, প্রমাণের উপর প্রতিষ্ঠিত। তাই বিজ্ঞান সব সময়ই কুসংস্কারকে চ্যালেঞ্জ করে, এর বিরোধীতা করে। বিজ্ঞান কোনো ঘটনার পেছনের যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যাকে প্রতিষ্ঠিত করে। কিন্তু কুসংস্কার পুরোটাই যুক্তিহীন বলে বিজ্ঞান ও কুসংস্কারের মধ্যে বিরোধ প্রকাশ্য ও চিরন্তন।
বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে কুসংস্কার: বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে কুসংস্কার হলো শুধুই মানুষের ভ্রান্ত ধারণা ও বিশ্বাস। যারা কুসংস্কারকে বিশ্বাস করে এবং মেনে চলে তারা সব সময়ই এই বিষয়টিকে অতিপ্রাকৃত বিষয়ের সাথে সম্পৃক্ত করে। তারা বিশ্বাস করে যে একটি প্রাকৃতিক ঘটনা ঘটে যাওয়ার প্রেক্ষিতেই অন্য একটি ঘটনা ঘটে। যেমন কাক এসে মাথার ওপরে কা কা করে ডাকলে আপনজনের মৃত্যুর সংবাদ আসে। এখানে কাকের কা কা ডাক একটি প্রাকৃতিক ঘটনা। এর প্রেক্ষিতে মৃত্যুকে সম্পৃক্ত করা হয়েছে। কিন্তু বিজ্ঞান দেখায় যে কাকের ডাক এবং মৃত্যু দুটোই খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। এ দুটির কোনটিই অতিপ্রাকৃত কোনো কিছু নয়। এদের মধ্যে কোনো সম্পর্কও নেই। এটা পুরোপুরি মানুষের ভ্রান্ত ধারণা ও অন্ধবিশ্বাস। প্রতিদিন হাজারো কাক ডেকে ওঠে। তাই বলে প্রতিদিন আমাদের আপনজনের মৃত্যু হয় না। তেমনি ঘরের মধ্যে লক্ষ্মী পেঁচা থাকলেই কেউ ধনী হয় না। বরং বিজ্ঞান দেখায় লক্ষ্মী পেঁচা ঘরকুনো স্বভাবের বলেই মানুষের ঘরে বাসা বাঁধে। আবার কেউ কেউ বিশ্বাস করে ঢেঁকির ফুল পেলে মানুষ বিত্তশালী হয়। কিন্তু বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে ঢেঁকি একটি ফার্ন জাতীয় অপুষ্পক উদ্ভিদ। যা থেকে কখনোই কোনো ফুল হয় না। এভাবেই বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে এক একটি কুসংস্কার ভ্রান্ত ধারণা বলে প্রতীয়মান হয়।
কুসংস্কার বিরোধী বিজ্ঞান চর্চা: মানুষের মধ্যে বিজ্ঞানের চর্চা থাকলে তার পক্ষে কুসংস্কারে বিশ্বাসী হওয়া সম্ভব নয়। কুসংস্কার তারাই বিশ্বাস করে যাদের মধ্যে বিজ্ঞানের কোনো চর্চা নেই। যে ব্যক্তি বিজ্ঞানের চর্চা করে, বিজ্ঞানে বিশ্বাস করে সে সর্বদাই সত্যের সন্ধান করে। যে ব্যক্তি বিজ্ঞানকে বোঝে সে জানে চন্দ্র ও সূর্য গ্রহণ কেনো হয়। সে বোঝে চাঁদ বা সূর্য কেউ কাউকে ‘খেয়ে’ ফেলে না বরং একটির ছায়া অন্যটিকে ঢেকে দেয়। তাই এ সময়ে খাবার খেলে কোনো সমস্যা হয় না। বিজ্ঞানের চর্চার ফলে মানুষের জানার ক্ষেত্র অনেক বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে মানুষ কুসংস্কারের মতো সংকীর্ণ বিষয়গুলোকে কাটিয়ে উঠতে পারে এবং কুসংস্কারের বিরোধীতা করে। বিজ্ঞান চর্চা মানুষকে সত্যের সন্ধান করতে শেখায় এবং ভ্রান্ত ধারণাগুলোকে দূরে সরিয়ে রাখে। ফলে বিজ্ঞানের চর্চা সব সময়ই কুসংস্কার বিরোধী হয়।
কু-সংস্কার দূরীকরণে বিজ্ঞান শিক্ষা: মানুষের মনে অজ্ঞতার অন্ধকারকে দূর করে সেখানে সত্যকে প্রতিষ্ঠা করতে পারে বিজ্ঞান শিক্ষা। তাই কুসংস্কার দূর করতে বিজ্ঞান শিক্ষার প্রয়োজন। সঠিকভাবে বিজ্ঞান শিক্ষা পরিবার সমাজ ও রাষ্ট্রের সর্বস্তর থেকে কুসংস্কারকে দূর করতে পারে। বিজ্ঞান শিক্ষা মানুষের জ্ঞানের দরজা খুলে দেয়। ফলে এই শিক্ষার মাধ্যমে মানুষ সত্য আর ভ্রান্ত বিশ্বাসের মধ্যে যে পার্থক্য রয়েছে তা বুঝতে পারে। বিজ্ঞান শিক্ষা মানুষকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে কুসংস্কার ও ভ্রান্ত ধারণাগুলোকে চিহ্নিত ও পরিহার করতে শেখায়। বিজ্ঞান শিক্ষা মানুষের মন থেকে তার অলীক ভয় দূর করে। এর ফলে মানুষ যেকোনো ঘটনার বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যা দাঁড় করাতে পারে এবং কুসংস্কারকে অবিশ্বাস করতে শেখে। বিজ্ঞান শিক্ষা মানুষকে জানায় কুসংস্কার না মানলে কখনোই কোনো অমঙ্গল মানুষকে আক্রমন করে না। কুসংস্কারের তথাকথিত অতিপ্রাকৃতিক ঘটনা যে ভিত্তিহীন, মানুষের কল্পিত তাও বিজ্ঞান শিক্ষার মাধ্যমেই মানুষ জানতে পারে। তাই জীবন থেকে কুসংস্কারকে সমূলে উৎপাটন করার জন্য বিজ্ঞান শিক্ষা খুবই জরুরী। কুসংস্কার দূরীকরণে এর বিকল্প নেই।
উপসংহার: সমাজের প্রচলিত সংস্কার-কুসংস্কার মানুষকে অলীক আতঙ্কে আটকে রাখে। কুসংস্কার বিশ্বাস করে কিছু ভ্রান্ত ধারণা নিয়ে মানুষ বেঁচে থাকে যেগুলো আসলে একেবারেই ভিত্তিহীন। যুক্তিহীন এসব কুসংস্কারকে বিশ্বাস করেই মানুষ পড়ে থাকে আদিম যুগে। কিন্তু বর্তমানে এই বিজ্ঞানের যুগে, তথ্য-প্রযুক্তির যুগে তা একেবারেই বেমানান। আজ যেখানে সর্বত্রই বিজ্ঞানের জয়জয়কার, সেখানে কুসংস্কারে বিশ্বাসী হয়ে আমরা কুয়োর ব্যাঙ হয়ে থাকতে পারি না। বিজ্ঞান চর্চার অভ্যাস করে আমাদেরকে সব কুসংস্কার থেকে মুক্ত হতে হবে। সব কিছুকে বিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে চিন্তা করলেই তা সম্ভব। পুরো পৃথিবী এগিয়ে গিয়েছে। এখন সময় এসেছে আমাদেরও সামনে এগিয়ে যাবার।
☞ এই পোষ্ট সম্পর্কে যদি আপনার কোন প্রশ্ন☞জিজ্ঞাসা☞সমস্যা☞তথ্য জানার থাকে তাহলে আপনি☞কমেন্ট করলে আপনাকে আমরা প্রয়োজনীয় তথ্য দিয়ে সাহায্য করার চেষ্টা করব☞☞☞ "সংস্কার-কুসংস্কার ও বিজ্ঞান-দৃষ্টি"
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন