প্রাত্যহিক জীবনে বিজ্ঞান
মঙ্গলবার, ১৬ জুলাই, ২০১৯
1 Comment
ভূমিকা: মানব সভ্যতার ক্রমবিকাশমান ইতিহাসে বিজ্ঞানের সীমাহীন ও রহস্যময় বিভিন্ন উদ্ভাবন ও আবিষ্কারের উদাহরণ অনস্বীকার্য। বিজ্ঞানের আবিষ্কার ক্রমাগত দৈনন্দিন জীবনে মানুষকে সেবা দিয়ে যাচ্ছে। বিজ্ঞান মানুষের জীবনে এনেছে গতিময়তা, সমস্ত পৃথিবীকে এনেছে মানুষের হাতের মুঠোয়, মানুষের জীবন যাত্রাকে করেছে সহজ। বিজ্ঞান সভ্যতার অগ্রযাত্রাকে তরান্বিত করেছে। আধুনিক বিজ্ঞান শুধু শিল্প ও বাণিজ্য ক্ষেত্রেই নয়, মানুষের দৈনন্দিন জীবন যাত্রায় এনেছে অভাবনীয় পরিবর্তন। দৈনন্দিন জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আমরা প্রতিনিয়তই বিজ্ঞানের ব্যবহার করে চলেছি।
বিজ্ঞানের অবদানসমূহ: বিজ্ঞান মানুষের সনাতন ধ্যান-ধারণা ও চিন্তা-চেতনার পরিবর্তন ঘটিয়ে মানুষের জীবনকে উন্নীত করেছে এক নতুন উচ্চতায়। সভ্যতার উষা-লগ্নের সেই নিরীহ মানুষ আজ বিশেষ জ্ঞান ও অদ্যম শক্তির অধিকারী। বিজ্ঞান চর্চার মাধ্যমে জেম্স ওয়াট স্টিম ইঞ্জিন ও জর্জ স্টিভেনস্ন রেলগাড়ি আবিষ্কার করেছেন। টমাস আলভা এডিসন টেলিভিশন আবিষ্কার করেছেন। বিজ্ঞানের অভাবনীয় কৌশল আবিষ্কার মানুষের দৈনন্দিন জীবনকে দিয়েছে অনাবিল সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য। বিদ্যুৎ, আনবিক শক্তি, মহাকাশ গবেষণা, বিভিন্ন ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি প্রভৃতি বিজ্ঞানের বিষ্ময়কর আবিষ্কার। বিজ্ঞান মানুষকে জল, স্থল, নভোম-ল জয় করার সুযোগ করে দিয়েছে। আর্কিমিডিস, কোপর্নিকাস, গ্যালিলিও, নিউটন, আইনস্টাইন প্রমুখ মহান বিজ্ঞানীদের অক্লান্ত শ্রমে মানুষ আধুনিক যুগে উন্নীত হওয়ার সুযোগ পেয়েছে।
দৈনন্দিন জীবনে বিজ্ঞান: আমাদের দৈনন্দিন জীবন যাত্রাকে জালের মতো আবৃত করে আছে বিজ্ঞান। বিজ্ঞানের দান ছাড়া আমরা এক মুর্হূতেও চলতে পারি না। প্রতিদিন সকালে ধোঁয়া ওঠা চায়ের সাথে হাতে সংবাদপত্র না পেলে পুরো পৃথিবী থেকে আমরা নিজেদেরকে বিছিন্ন মনে করি। টেলিভিশনের পর্দায় আমরা পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ঘটে যাওয়া অসংখ্য ঘটনার জীবন্ত ভিডিও চিত্র দেখতে পারি। টেলিফোনের মাধ্যমে পৃথিবীর এক প্রান্তে বসে মুহূর্তের মধ্যেই অন্য প্রান্তে যোগাযোগ করতে পারি। শিল্প বিপ্লবের পিছনে বিজ্ঞানের অশেষ অবদান রয়েছে। কৃষি কাজ, বাড়িঘর নির্মাণ, পরিধেয় বস্ত্র ও ঔষধপত্র তৈরি, খনিজ পর্দাথ উত্তোলন ও ব্যবহার উপযোগী করে তোলা প্রভৃতি ক্ষেত্রে বিজ্ঞানের প্রয়োজনীয়তা অনিবার্য। মোট কথা আমরা প্রতিনিয়ত বিজ্ঞান নিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন করে চলেছি।
গৃহস্থলি কাজে বিজ্ঞান: বিজ্ঞানের সংস্পর্শে গৃহস্থলির কাজ সর্বদা সচল থাকে। দৈনন্দিন বিভিন্ন প্রয়োজনে ও সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যময় জীবনযাপনে বাড়ি-ঘরে মানুষ বিজ্ঞানের অবদানকে ব্যবহার করে চলেছে। রান্নার কাজে প্রাকৃতিক গ্যাস, বৈদ্যুতিক হিটার প্রভৃতি ব্যবহার করা হয়। এছাড়া গবাদি পশুর বর্জ্য থেকে রান্নার কাজে ব্যবহার উপযোগী বায়োগ্যাস তৈরির প্রযুক্তি জনপ্রিয়তা পেয়েছে। বিদ্যুৎ ছাড়া দৈনন্দিন জীবন প্রায় অচল। বৈদ্যুতিক পাখা, বিজলিবাতি চালানো; মোবাইল ফোন ও চার্জার লাইট চার্জ দেওয়া; টেলিভিশন, ওয়াটার হিটার, প্রেসার কুকার, রাইস কুকার, এয়ার কুলার প্রভৃতি ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করতে বিদ্যুৎ প্রয়োজন। মোট কথা বিজ্ঞান মানব জীবনে আর্শীবাদ রূপে তাদের গৃহস্থলি কর্মকা-কে স্বাচ্ছন্দ্যময় করেছে।
শিক্ষা ব্যবস্থায় বিজ্ঞানের ভূমিকা: শিক্ষা ক্ষেত্রেও বিজ্ঞানের রয়েছে বিস্তর অবদান। বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুমে প্রজেক্টরের সাহায্যে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। ইন্টারনেটের আবিষ্কার শিক্ষা ক্ষেত্রে এনেছে সূদূর প্রসারী বিপ্লব। যেকোনো তথ্য বর্তমানে গুগল অনুসন্ধানের মাধ্যমে অতি সহজেই শিক্ষার্থীর হাতের নাগালে পৌছে যাচ্ছে। বর্তমানে উচ্চ শিক্ষার বিভিন্ন শাখায় ও গবেষণামূলক কাজে কম্পিউটার, ল্যাপটপ, নোটবুক, আইপ্যাড, ইন্টারনেট ব্রাউজিং প্রভৃতি অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়েছে। এসব কিছুই মূলত বিজ্ঞানের অবদান।
চিকিৎসাক্ষেত্রে বিজ্ঞান: মানুষকে সুস্থ করা ও জটিলরোগ উপশমে বিজ্ঞান চিকিৎসা বিজ্ঞান নিত্য নতুন আবিষ্কারের মাধ্যমে মানুষকে সেবা দিয়ে যাচ্ছে। দুরারোগ্য ব্যাধি এখন আর মানুষের জন্য ভয়ের কারণ নয়। আধুনিক প্রযুক্তির আবিষ্কারের ফলে চশমা ব্যবহার ছাড়াই মানুষ আজ স্বাভাবিক দৃষ্টিশক্তি ফিরে পাচ্ছে। স্ট্রেপটোমাইসিন, পেনিসিলিন, এক্সরে প্রভৃতি আজ মৃত্যু পথযাত্রীকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে ব্যাপক ভূমিকা পালন করছে। কর্নিয়া (অক্ষি গোলকের স্বচ্ছ আবরণ), বৃক্ক, অস্থিমজ্জা, হৃৎপি-, ফুসফুস এবং যকৃতের মতো অঙ্গ-প্রতঙ্গ প্রতিস্থাপনে চিকিৎসা বিজ্ঞান আজ সফল।
কর্মস্থল ও পরিবহন ক্ষেত্রে বিজ্ঞান: অফিস, আদালত-প্রাঙ্গণ, কল-কারখানা, শপিংমল, দোকান-পাট প্রভৃতি ক্ষেত্রে প্রতিদিন প্রতিনিয়ত বিজ্ঞান সৃষ্ট প্রযুক্তি ব্যবহার হচ্ছে। প্রিন্টার ও ফটোস্ট্যাট মেশিন এসব প্রতিষ্ঠান সমূহের অবিচ্ছেদ্য অংশ। তৈরি পোশাক শিল্প ও বিভিন্ন কল-কারখানায় শ্রমিকরা বৈদুত্যিক যন্ত্রের সাহায্যে তাদের দৈনন্দিন নির্ধারিত কাজগুলো সম্পন্ন করছে। বড় বড় শপিংমলগুলোতে গ্রাহকদের নিরাপত্তা রক্ষা ও সুবিধার্থে সি.সি. ক্যামেরা, লিফট, এসকিউলেটার প্রভৃতি ব্যবহৃত হয় যা বিজ্ঞানের আবিষ্কার। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে বিজ্ঞানকর্তৃক আবিষ্কৃত উড়োজাহাজ ও জলযান প্রধান মাধ্যম। এছাড়া স্থানিক দূরত্ব অতিক্রমে ও জনগণের কল্যাণে বাস, ট্রাক, মোটর সাইকেল, প্রাইভেট কার, লঞ্চ, স্টিমার প্রভৃতি আবিষ্কৃত হয়েছে। বেতার যন্ত্র, ভিডি ও চ্যাট, মোবাইল ফোন প্রভৃতির মাধ্যমে যোগাযোগের স্থানিক দূরত্ব হ্রাস পেয়েছে।
কৃষি ও শিল্পের প্রসারে বিজ্ঞান: বিজ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে মানুষ অনুর্বর জমিতেও ফলায় সোনার ফসল; ঊষর মরু-প্রান্তরকে করে খাদ্যভা-ার। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষের দিকে এবং উনবিংশ শতাব্দীর সূচনালগ্নে শিল্পবিপ্লবের মাধ্যমে কৃষির আধুনিকায়নের সূচনা ঘটে। প্রাচীন আমলের কাঠের লাঙলের পরিবর্তন বর্তমানে কৃষকদের হাতে এসেছে কলের লাঙল, ট্রাক্টর, পাওয়ার টিলার ইত্যাদি। সেচ ব্যবস্থায় ব্যবহৃত হচ্ছে বিদ্যুৎ শক্তি চালিত পাম্প। বর্তমানে বিজ্ঞানীরা কৃত্রিম বৃষ্টিপাত ঘটিয়ে কৃষিক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধন করেছে। কৃষিতে পচা আবর্জনা ও গোবরের সাথে ব্যবহার হচ্ছে আধুনিক রাসায়নিক সার। গবেষণার মাধ্যমে কৃষকদের হাতে উচ্চফলনশীল বীজ সরবরাহ করা হচ্ছে। অন্যদিকে মুদ্রণ শিল্পের বিপ্লবের ফলে কম্পিউটার ও সর্বাধুনিক মুদ্রণ যন্ত্রের সাহায্যে মাত্র দুই তিনজন কর্মী দিয়ে অল্প সময়ে লাখ লাখ পৃষ্ঠা ছাপানো সম্ভব হচ্ছে। প্রতিটি শিল্পকারখানা এখন বিজ্ঞানের উদ্ভাবিত বিভিন্ন যন্ত্র দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে। বিজ্ঞান ছাড়া মূলত শিল্প বিপ্লবই সম্ভব ছিল না।
বিজ্ঞানের অকল্যাণকর দিকসমূহ: কল্যাণকর দিকের পাশাপাশি বিজ্ঞানের অকল্যাণকর দিকও কম নয়। বিজ্ঞান কর্তৃক আবিষ্কৃত স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রগুলো যখন কাজ করতে শুরু করেছে তারপর থেকেই অসংখ্য মানুষ বেকার হয়ে পরছে। দ্রুত শিল্পায়ন, যন্ত্রশিল্প কারখানা ইত্যাদি পৃথিবীর বায়ুম-লকে দূষিত করতে ও প্রাকৃতিক পরিবেশকে বিনষ্ট করতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। পরিবেশবিদদের আশঙ্কা এ দূষণ প্রক্রিয়া অব্যহত থাকলে প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হবে যা জীবজগতের উপর বিভিন্ন ধরণের বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করবে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়- রাশিয়ার চেরনোবিলে পারমাণবিক দুর্ঘটনায় যে তেজষ্ক্রিয় পদার্থ নির্গত হয়েছিল তা পবিশেকে মারাত্মকরূপে দূষিত করেছিল এবং এতে অসংখ্য মানুষ পঙ্গু হয় ও মারা যায়। বিজ্ঞানের কোনো কোনো বিষ্ময়কর আবিষ্কার মানুষের জন্য আর্শীবাদ না হয়ে অভিশাপে পরিণত হয়েছে।
উপসংহার: আধুনিক যুগকে বলা হয় বিজ্ঞানের যুগ। বিজ্ঞান মানুষকে করেছে স্বনির্ভরশীল এবং স্বাভাবিকের চেয়ে অধিক ক্ষমতাধর। বিজ্ঞানের আবিষ্কার ও অবদানসমূহকে মানুষ কোনো পথে ব্যয় করবে তা নির্ভর করে মানুষের ইচ্ছার উপর। যদিও বিজ্ঞানের সৃষ্টি হয়েছে মহৎ উদ্দেশ্যে তথা মানব কল্যাণে। মানুষ যদি কেবল মানব কল্যাণে বিজ্ঞানকে ব্যবহার করে তবেই এর সার্থকতা প্রতিপন্ন হবে। শিক্ষা, চিকিৎসা, গৃহস্থলি কাজকর্ম, কৃষি, শিল্প, আণবিক শক্তি প্রভৃতি ক্ষেত্রে বিজ্ঞানের যে অবদান তা কোনোভাবেই অস্বীকার করার উপায় নেই। বিজ্ঞান আমাদের জীবনে প্রতিটি ক্ষেত্রে বর্তমানে এমনভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে যে বিজ্ঞান ছাড়া আমরা এক পা-ও এগুতে পারব না। তাই জয় হোক বিজ্ঞানের।
প্রাপ্তহীক জীবক
উত্তরমুছুন