ভাব সম্প্রসারণ-১
বুধবার, ২৬ জুন, ২০১৯
1 Comment
অর্থ সম্পদের বিনাশ আছে কিন্তু জ্ঞান সম্পদ কখনো বিনষ্ট হয় না।
মানুষ যখন থেকেই সভ্যতা নির্মাণ করার শুরু করেছে তখন থেকে অর্থের গুরুত্ব বাড়তে শুরু করেছে। বর্তমান সভ্যতার মাপকাঠিতে অর্থ একটি বড় ব্যাপার। অর্থ দিয়েই মূলত আমরা সমাজে মানুষের অবস্থান এবং গ্রহণযোগ্যতা পরিমাপ করে থাকি। বিত্তবান হিসেবে সমাজে পরিচিত হওয়াটাও অনেকের কাছে জীবনের একমাত্র লক্ষ্য। কিন্তু এই বিত্ত-বৈভব, ধন-সম্পদ যেকোনো মুহূর্তে হারিয়ে যেতে পারে। আমীর পরিণত হতে পারে ফকিরে। কিন্তু জ্ঞান এমন এক সম্পদ যা কোনদিন বিনষ্ট হয় না। একজন জ্ঞানী চিরদিনের জন্য জ্ঞানী। কিন্তু একজন ধনী চিরদিন ধনী নাও থাকতে পারে। অর্জিত সম্পদ যেকোনো সময় হাত ছাড়া হয়ে যেতে পারে। অর্জিত জ্ঞান কখনোই হারানোর ভয় থাকে না। ধনী ব্যক্তি তার সম্পদ দান করে নিঃশেষ হয়ে যাওয়ার সুযোগ আছে। কিন্তু জ্ঞানীর বিতরণ করা জ্ঞান অন্যদেরকেও জ্ঞানীর কাতারে সামিল করে অনিঃশেষ থেকে যায়। জ্ঞান মানুষকে অমরত্ব দান করে, সম্পদ তা পারে না। সক্রেটিস, প্লেটো, নিউটনরা বহু শতাব্দি আগে পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলেও তাদের জ্ঞান সভ্যতাকে এখনো পথ দেখাচ্ছে। জ্ঞানের শাশ্বত এ সত্য সবারই জানা, সম্পদের বিনাশ আছে কিন্তু জ্ঞান সম্পদের বিনাশ নেই। মানুষের গড়া বহু সভ্যতা বহু ধন সম্পদ সময়ের সাথে সাথে বিলীন হয়ে গেছে। কিন্তু মানুষ যে জ্ঞান পৃথিবীতে রেখে গেছে তা ক্রমশ নানা প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছে। শুধু জ্ঞানের কারণেই মানুষ সকল সৃষ্টির মাঝে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেছে।
শিক্ষা: জ্ঞান আহরণ এবং জ্ঞান বিতরণ সভ্যতাকে গুহার অন্ধকার থেকে আজকের অবস্থানে নিয়ে এসেছে। সুতরাং জ্ঞান কখনোই বিনষ্ট হতে পারে না। অর্থ সম্পদ মানুষকে সাময়িক তৃপ্তি দিলেও জ্ঞানের সমকক্ষ হতে পারে না।
অতিবাড় বেড়ো না, ঝড়ে পড়ে যাবে অতি ছোট থেকো না, ছাগলে মুড়াবে।
অহংকার এবং নম্রতা কোনোটিই অতিমাত্রায় মঙ্গলজনক নয়। এগুলো নিয়ে বাড়াবাড়ি করলে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই সমস্যা দেখা দেয়। মানুষ রক্ত মাংসের প্রাণী। মানুষের সহজ ধর্ম হলো নিজেকে প্রকাশ করা। তবে প্রতিটি কাজেরই কিছু নিয়ম-কানুন থাকে। এগুলো মানুষকে মেনে চলতে হয়। আর এই নিয়ম-কানুনগুলো না মেনে চললেই সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। অহংকারীর পতন হবে এটাই স্বাভাবিক। অহংকারী ব্যক্তি নিজে ধ্বংস হয় এবং সমাজেরও ক্ষতি মাধন করে। মানবজীবন পুষ্পশয্যা নয়। তাকে সংগ্রাম করেই পৃথিবীতে টিকে থাকতে হয়। মানুষ তার শ্রম ও মেধার মাধ্যমে কোনো কাজে বিজয়ী হয়। বিজয়ী মানুষের মধ্যে এক ধরণের অহংবোধ কাজ করে। মানুষের মধ্যে পরিমিত অহংকারবোধ থাকবে। কখনো কখনো এই অহংবোধ এত তীব্র হয়ে ওঠে যে সমাজের মানুষ তার নিকট থেকে দূরে চলে যায়। ফলে অতিমাত্রায় বাড়াবাড়ির জন্য সে তার জনপ্রিয়তা হারিয়ে ফেলে। সমাজে আমরা আর এক শ্রেণির লোক দেখতে পাই যারা খুব বেশি নমনীয়তা বা নম্রতা দেখায়। তারা নিজেদের খুব ছোট বা তুচ্ছ মনে করে। এ ধরণের লোক কোনো কাজে সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। সমাজের নিকট এই শ্রেণির লোকেরাও উপযুক্ত সম্মান পায় না। অতিরিক্ত অহংকারী হওয়ার ফল ধ্বংস। আবার নিজেকে মাত্রাতিরিক্ত নম্র বা তুচ্ছ ভাবাটাও অনুচিত। চার্লস ডারউইন বলেছেন- “জীবন যুদ্ধে যোগ্যরাই টিকে থাকে।” তাই আমাদের পরিবেশের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে হবে। যে জায়গায় যে সব আচার-ব্যবহার প্রয়োজন সে জায়গায় তাই করতে হবে। পৃথিবীর অনেক দেশ তাদের অতিমাত্রায় অহংকার ও ক্ষমতার দাপটের কারণে ধ্বংস হয়েছে। আবার অনেক জাতি তাদের হীন বা তুচ্ছ মনে করার জন্যে তাদের স্বাধীনতা হারিয়েছে। প্রকৃতির দিকে তাকালে আমরা সুন্দর উদাহরণ দেখতে পাই। যে গাছগুলো বেশি বড় হয় সেগুলো অল্প ঝড়েই ভেঙে যায়। আবার সে গাছগুলো খুব ছোট সে গুলো বিভিন্ন তৃণভোজী প্রাণী খেয়ে ফেলে। ফলে গাছগুলোর আর বিকাশ ঘটে না। তাই স্থান-কাল ও পাত্র ভেদে আচার-ব্যবহারের ভিন্নতা থাকা প্রয়োজন।
শিক্ষা: মানুষ হিসেবে আমাদের মধ্যে স্বাভাবিকভাবে অহংবোধ এবং নমনীয়তা থাকবে। তবে সেগুলো যেন সীমা অতিক্রম করে ধ্বংসের কারণ না হয়ে দাঁড়ায় এ বিষয়ে আমাদের সচেতন থাকতে হবে।
অতি দীন ও অশক্ত লোকেরাই দৈবের দোহাই দিয়া থাকে।
প্রত্যেক সমাজেই বিভিন্ন ধরণের লোক বসবাস করে। সমাজের মধ্যে যারা হীন, নীচ, অভাবগ্রস্থ এবং অক্ষম, অপারগ, তারা নিজেদের ওপর আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলে। তাদের মনের মধ্যে সাহসের জায়গাটুকুও থাকে না। নিজের ওপর বিশ্বাস থাকে না বলে এরা কোনো কাজকর্ম সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে সম্পন্ন করতে পারে না। তারা সব সময় হতাশার মধ্যে দিন অতিবাহিত করে। নিজেদের এই অক্ষমতার জন্য অলৌকিক বা স্বর্গীয় শক্তিকে দায়ী করে থাকে। তারা মনে করে ভাগ্য দেব কর্তৃক নির্ধারিত বলে তারা কাক্সিক্ষত লক্ষ্য অর্জন করতে পারছে না। তেমনি যারা দরিদ্র তারাও ভাবে, যে, দারিদ্র্যতা দৈব-কর্তৃক নির্ধারিত বলে তারা চিরকালই অভাবগ্রস্থ থাকবে। কিন্তু এ ধারণা একেবারে ভুল। কারণ দেবতা থেকে আগত দৈবশক্তি সব মানুষের মধ্যেই বিদ্যমান। তারা সমাজের মধ্যে মনের দিক দিয়ে দরিদ্র ও দুর্বল। জীবনকে অর্থহীন ভেবে একরাশ দুঃখ-কষ্টের গ্লানি নিয়ে বয়ে বেড়ায়। উদ্দেশ্যহীনভাবে তাদের জীবন চলতে থাকে। পৃথিবীতে এসব লোকের কোনো মূল্য নেই। জীবনে কাক্সিক্ষত লক্ষ্যের দিকে যেতে হলে অনেক বাধাবিপত্তি অতিক্রম করতে হয়। একেবারে দৈবের ওপর ভরসা করে নিঃচেষ্ট হয়ে বসে থাকলে কখনো কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যের ছোঁয়া পাওয়া যায় না। আত্মবিশ্বাসের মাধ্যমে দীন ও অশক্ত লোকেরাও জীবনকে সাফল্যমন্ডিত করতে পারে।
শিক্ষা: সত্যিকারের পরিশ্রমী আত্মবিশ্বাসী মানুষ কখনোই দৈব বা ভাগ্যকে দিব্যি দেয় না। বরং তারা আত্মপ্রত্যয় ও কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে নিজের জীবনকে সার্থক করে তোলে।
অর্থই অনর্থের মূল।
সুখে স্বাচ্ছন্দ্যে জীবনধারণের জন্য মানুষ অর্থের ওপর নির্ভর করে। অর্থ আমৃত্যু মানুষের প্রয়োজন মেটায় বলে অর্থ ছাড়া জীবনকে অনেকেই অর্থহীন মনে করে। মানুষের প্রতিপত্তি সম্মান বর্তমান সমাজে অর্থ দ্বারা নির্ণয় করা হয়। তাই মানুষের অর্থ অর্জনের চেষ্টার কমতি নেই। অর্থ যেমন মানুষের সকল সুখ-শান্তি, মর্যাদা, প্রতিপত্তি সবকিছুর মূলে কাজ করে তেমনি হানাহানি, প্রতিহিংসা, অশান্তি তথা সমস্ত অপকর্মের মূলেও কাজ করে। অর্থের লোভেই মানুষ নীতিবর্জিত হয়ে খারাপ কাজে লিপ্ত হয়। অর্থের কারণেই আপনজনের ভালোবাসাহীনতা, স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কছেদ, বন্ধুতে বন্ধুতে বিচ্ছেদ, জাতি-জাতিতে হানাহানি ও যুদ্ধ-বিগ্রহের সৃষ্টি হয়। জগতের যাবতীয় অনাসৃষ্টি, অঘটন, বিশৃঙ্খলা সবকিছুর মূলে রয়েছে অর্থ। অর্থ এমন এক উপাদান যার নেশায় মানুষ নিকৃষ্ট থেকে নিকৃষ্টতম কাজ করতে দ্বিধাবোধ করে না। অর্থ নেশায় চিন্তা- চেতনা, আচার-ব্যবহার, কাজকর্ম সবকিছুই অর্থমুখী হয়ে ওঠে। অর্থের জন্য মানুষ মানুষকে হত্যা করতেও কুণ্ঠাবোধ করে না। অর্থ এমন এক জিনিস যার মোহে পড়ে মানুষ নীতি, চরিত্র, বিবেক বিসর্জন দেয়। অর্থের অযাচিত বা অপব্যবহার ধ্বংসই ডেকে আনে, অর্থ হয়ে উঠে সকল অশান্তির উৎস। অর্থের প্রতি মাত্রাতিরিক্ত আসক্তি মানুষকে পশুত্বের মোড়কে আবৃত করে। সে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের সামগ্রিক স্বার্থকে বাদ দিয়ে নিজ উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠে। জগতের সকল অপকর্মের পেছনেই অর্থনৈতিক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয় জড়িত। অর্থই মানুষকে কুপথের দিকে ধাবিত করে।
শিক্ষা: সুষ্ঠু, সুন্দর, সুশৃঙ্খল ও স্বাভাবিক জীবনের জন্য অর্থের প্রয়োজনীয়তা বলে শেষ করা যায় না। আবার অর্থই অনাসৃষ্টি, অশান্তি ও হিংসার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে তব ঘৃণা যেন তারে তৃণসম দহে।
সুন্দর সমাজ গড়ার জন্য এবং সামাজিক শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য মানুষ গড়ে তুলেছে অনুশাসন এবং ন্যায়-নীতির মানদ-। কিন্তু কিছু মানুষ রয়েছে যারা এসব ন্যায়-নীতি অমান্য করে অন্যায় ও অবৈধ কর্মতৎপরতায় লিপ্ত হয়। এরা সমাজের চোখে অন্যায়কারী এবং আইনের চোখে অপরাধী হিসাবে বিবেচিত। আবার যারা অন্যায়ের প্রতিবিধান বা বিরুদ্ধাচরণ করে না বরং শৈথিল্যের সাথে তা মেনে নেয়, সূক্ষ্ম বিচারে তারাও অপরাধী। কারণ অন্যায়ের বিচার না করলে তা প্রতিনিয়ত বাড়তে থাকে। আমরা জানি ক্ষমা একটি মহৎ গুণ। এ হিসাবে অপরাধীকে ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখা যেতে পারে। আপাতদৃষ্টিতে এমনটি মনে হলেও মনে রাখা দরকার যে, ক্ষমারও নির্দিষ্ট সীমা থাকতে হবে। তা না হলে অন্যায় বেড়ে গিয়ে সমাজ বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়বে। বিবেকবান মানুষ হিসাবে অন্যায়ের প্রতিবাদ করার চেতনার অধিকারী হলেও অনেক সময় মানুষ নানা কারণে দিনের পর দিন অন্যায়কে সহ্য করে। সরাসরি অন্যায় না হলেও এটি অন্যায়কে সহযোগিতা করার নামান্তর। অনেকে বিপদের ঝুঁকি থাকায় নীরবে অন্যায়কে সহ্য করে চলে। এসব প্রবণতার কারণে আজ আমাদের সমাজে অপরাধীদের দৌরাত্ম্য বাড়ছে। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে অন্যায়কারী এবং অন্যায় সহ্যকারী উভয়ই সম অপরাধে অপরাধী।
শিক্ষা: শুধুমাত্র নিজে অপরাধ না করলে সব দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। অন্যায়কারীকে এবং অন্যায় সহ্যকারীকে ঘৃণা করতে হবে। সমাজের বিবেকবান ও সচেতন মানুষ হিসাবে আমাদেরকে সম্মিলিতভাবে অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। তাহলে আমরা দুর্নীতিমুক্ত সুন্দর সোনার বাংলা গড়ে তুলতে সক্ষম হবো।
অপরের দুঃখ কথা করিলে চিন্তন আপনার মনে দুঃখ থাকে কতক্ষণ।
পৃথিবীতে অসংখ্য মানুষ বাস করে আর তাদের প্রত্যেকেরই আলাদা আলাদা দুঃখ-কষ্ট, অভাববোধ আছে। তবে সে দুঃখ-কষ্টগুলো একান্তই ব্যক্তিগত। আর কেবলমাত্র ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখের চিন্তা করা কোনো মানুষের জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য হতে পারে না। কেননা শুধুমাত্র নিজের ভোগ-বিলাস আর স্বার্থরক্ষার জন্য মানবজীবন নয়। মানুষ পরস্পরের উপর নির্ভরশীল হয়ে সমাজবদ্ধভাবে বাস করে। এই সমাজবদ্ধ জীবনে স্বার্থপরের মতো শুধুমাত্র নিজেকে নিয়ে ভাবা উচিত নয়। বরং চারপাশের সমস্ত দুঃখী, অভাবী মানুষের দুঃখকে উপলব্ধি করতে হবে। অন্যের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা ভাগ করে নেওয়ার মধ্যেই প্রকৃত সুখ নিহিত। অন্যের দুঃখ-কষ্টকে নিজের মধ্য দিয়ে উপলব্ধি করতে পারলে নিজের দুঃখগুলো ভুলে থাকা যায়। যে ব্যক্তির পা নেই তার কথা চিন্তা করলে নিজের জুতা না থাকার অভাব বা কষ্ট নিতান্তই নগন্য মনে হয়। মহৎপ্রাণ ব্যক্তিগণ নিজেদের দুঃখ, বেদনা, হতাশা, ব্যর্থতাকে ভুলে অপরের কল্যাণে নিজেদের জীবন উৎসর্গ করে গেছেন। অপরের কল্যাণে নিজেদের স্বার্থ চিন্তা পরিহার করেছেন বলেই তাদের জীবন হয়েছে মহান। ইতিহাসের পাতায় লেখা হয়েছে তাদের মহৎ ত্যাগের কথা। মানুষ কেবল নিজের জন্য জন্মগ্রহণ করেনি। শুধুমাত্র নিজের ভোগবিলাস, পাওয়া না পাওয়ার হিসেবে ব্যস্ত থাকলে সেই মানুষ কোনোদিনও জীবনের প্রকৃত সুখের সন্ধান পায় না। অন্যদিকে, নিজের দুঃখ-কষ্টকে বড় করে না দেখে যে ব্যক্তি অন্যের দুঃখ- বেদনাকে উপলব্ধি করতে পারে এবং সে দুঃখ লাঘবে সহায়তা করে সেই প্রকৃত সুখী। যে সত্যিকারের মানুষ সে অপরের দুঃখে ব্যথিত হয় এবং অন্যের দুঃখ দূর করতে নিজের সুখ বিসর্জন দিতেও দ্বিধা করে না। অপরের দুঃখ-কষ্টকে উপলব্ধি করে সে নিজেদের দুঃখের কথা ভুলে যায়। জীবনের সত্যিকার সুখের দেখা পায় সে, যে অপরের দুঃখ-বেদনার কথা ভেবে ব্যক্তিগত দুঃখকে মনে স্থান দেয় না।
শিক্ষা: স্রষ্টার শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি মানুষ। মানুষ হয়ে জন্ম নিয়ে এই মহৎ জীবনকে সার্থক করতে হলে, কেবল নিজের স্বার্থচিন্তা না করে, অন্যের দুঃখ-বেদনাকে উপলব্ধি করতে হবে। প্রকৃতপক্ষে, অপরের দুঃখ-বেদনা ভাগ করে নেওয়ার মধ্যেই মানব জীবনের সত্যিকারের সুখ নিহিত।
অভাব অল্প হলে দুঃখও অল্প হয়ে থাকে।
মানবজীবন ছোট হলেও মানুষের চাহিদার কোনো শেষ নেই। একটা অভাব পূরণের সাথে সাথে মানুষের জীবনে অন্য একটি অভাব দেখা দেয়। কিন্তু কোনো মানুষের পক্ষেই জীবনের সব অভাব পূরণ করা সম্ভব নয়। ফলে এই অপূরণীয় অভাবের সাথে সাথে তার জীবনে দুঃখবোধ সৃষ্টি হয়। অভাব যত বাড়ে অপূর্ণতা ততই ভিড় করে। সেই অপূর্ণতা দুঃখকে আরও ঘণীভূত করে। সভ্যতার উন্নয়নের সাথে সাথে মানুষের অভাববোধও বাড়ছে। প্রতিদিনই মানুষের জীবনে নতুন নতুন অভাব সৃষ্টি হচ্ছে। এর ফলে তার না পাওয়ার কষ্টও ক্রমশ বেড়েই চলেছে। কারণ এসব অভাব পূরণ করা মানুষের পক্ষে প্রায়ই অসম্ভব হয়ে পড়ে। মানুষের জীবনে এসব অভাব না থাকলে মানুষের মধ্যে অপূর্ণতার কষ্টও জমা হত না। খুব সাধারণ উদাহরণই এই ধারণাকে আরও স্পষ্ট করে দিতে পারে। যেমন একজন গ্রামের সাধারণ কৃষকের অভাববোধ বলতে দু-বেলা দু-মুঠো খেয়ে বেঁচে থাকাকেই বোঝায়। ফলে সে দু-বেলা ভাত পেলেই খুুশি। কিন্তু একজন শহরের মধ্যবিত্ত মানুষের অভাব হলো, একটি টিভি কিংবা ফ্রিজের আরও উচ্চবিত্ত একজন মানুষের অভাব হলো শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত একটি বাড়ির এবং গাড়ীর। এসব ব্যয়বহুল অভাব মেটাতে সে হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে। কখনও বা এসব অভাব অপূর্ণই থেকে যাচ্ছে। ফলে তার দুঃখও অধিক হচ্ছে। অথচ অল্প অভাবের একজন সাধারণ মানুষ তার চেয়ে অল্প পেয়েই সুখে জীবন-যাপন করছে।
শিক্ষা: অভাব বা চাহিদাই মানুষের দুঃখের মূল কারণ। অভাবকে প্রশ্রয় দিলেই তা বাড়তে থাকবে। সুতরাং অভাবকে দমন করে মানব জীবনে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা উচিত। অভাবের স্বল্পতাই দুঃখকে প্রশমিত করতে পারে।
অভাবে স্বভাব নষ্ট।
পৃথিবীতে চাহিদার তুলনায় সম্পদের পরিমাণ কম বলেই অভাবের তীব্রতা এত প্রকট। সীমিত সম্পদের কারণে অসীম অভাবের অপূর্ণতা মানুষের মনুষ্যত্ব ও স্বভাবের উপর প্রভাব বিস্তার করে। অভাব বলতে শুধু অর্থাভাব নয়, বরং জীবনধারণের প্রয়োজনীয় উপকরণ এর অভাবকেও বোঝায়। যার মধ্যে মূলত অর্থাভাবই প্রধান। মানুষ অর্থাভাবে পড়লে স্বাভাবিক বোধশক্তি কমে যায়, তখন তাদের নেওয়া সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রেও এর প্রভাব পড়ে। প্রায় ক্ষেত্রেই অভাবের তাড়নায় খারাপ সিদ্ধান্ত নিতে দেখা যায়। ঋণমুক্তির জন্য অনেক সময় অতিরিক্ত ঋণ করার প্রবণতাও দেখা যায়, যাতে দুর্দশা আরও বাড়ে। দরিদ্র অবস্থায় অর্থ ছাড়াও আরও কিছু বিষয় লক্ষ্য করা যায়। এ সময় বুদ্ধিবৃত্তিও কমে যায়। গরিব বলে কম মেধা রয়েছে, বিষয়টি এমন নয়। বরং আর্থিক দুশ্চিন্তার সঙ্গে বিষয়টি সম্পর্কিত। পরিমিত অভাব মানুষকে সুখের স্বাদ পেতে সাহায্য করে। অভাব মিটানোর প্রয়োজনে মানুষ অনেক কিছু আবিষ্কার করতেও সক্ষম হয়েছে। অভাবের সুযোগ নিয়ে প্রতারকেরা প্রতারণার ফাঁদ পেতে রাখে সর্বত্র। মানুষ যেমনি অভাবের তাড়নায় ঘৃণিত পথে পা বাড়ায়। তেমনি সমাজে প্রতিযোগিতামূলক অবস্থার কারণে কিছু বিলাসী মানুষের অপ্রয়োজনীয় বিত্তপ্রদর্শন অভাবী মানুষের মাঝে লোভ-লালসা ও হতাশার সৃষ্টি করে। যা থেকে সমাজে চুরি-ডাকাতি, রাহাজানি, মারামারি এমনকি খুন-খারাবি পর্যন্ত হয়ে থাকে। অভাবের সময় ধৈর্যধারণ করে ক্রমাগত চেষ্টা করার মধ্যেই সফলতা রয়েছে। এ থেকে পরিত্রাণের অন্য কোনো পথ নেই। তাইতো মহান আল্লাহ পবিত্র কোরআনে ঘোষণা করেছেন- ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সাথে রয়েছেন।’
শিক্ষা: যখন মনুষ্যত্ব জেগে ওঠে তখন অভাব আর স্বভাবের সম্পর্ক একরৈখিক থাকে না। অভাবের সময় ধৈর্যধারণ করার চেয়ে মহৎ কাজ আর কিছু নেই, ধৈর্যচ্যুতি ঘটলে ধ্বংস অনিবার্য।
অভিজ্ঞতা হল দুঃখ কষ্টের নির্যাস।
সুখ-শান্তির পাশাপাশি দুঃখ-কষ্ট মানুষের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। দুঃসময়ে পতিত হলে মানুষ এই পার্থিব জীবনের জটিলতা ও নিষ্ঠুরতা সম্পর্কে অবহিত হতে পারে। দুঃখের স্পর্শেই মানুষ তার চারপাশে অবস্থিত প্রতিকূল পরিবেশ সম্পর্কে ধারণা লাভ করে। বিপদের সময়ই ব্যক্তি তার প্রকৃত বন্ধুর সন্ধান পায়। সুতরাং এই কথা অকপটে বলা যায় যে, দুঃখ-কষ্ট ও বিপদ আপদ মানুষকে অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ করে। এই সময়ই মানুষ জীবনের যথার্থতা উপলব্ধি করার সুযোগ পায়। দুঃখ-কষ্ট মানুষের বিবেককে মহান আদর্শে উজ্জীবিত করে। দুঃখের আগুনে পুড়ে পুড়ে একজন মানুষ খাঁটি বিবেকবান মানুষে পরিণত হয়। দুঃখ-কষ্টের করুণ দহন শেষে যে সোনালি দিনের সন্ধান মিলে তার স্বাদ অনাবিল ও অতুলনীয়। দুঃখ-কষ্টের অভিজ্ঞতা ছাড়া এই পৃথিবীতে কেউ বড় মাপের মানুষ হতে পারে না। এই জগতে যত সাফল্যের ঘটনা রয়েছে তার সঙ্গে জড়িয়ে আছে সীমাহীন দুঃখের মর্মান্তিক ইতিহাস। ধৈর্য, দুঃখ-কষ্টের দুঃসহ স্মৃতি, ত্যাগ-তিতিক্ষা এসব ছাড়া কেউ জীবনে সফল হতে পারে না। দুঃখ মানুষকে তার জীবনযাপনে দক্ষ ও অভিজ্ঞ করে তোলে। দুঃখ-কষ্ট জীবনের বাস্তবমুখী দিকগুলো মানুষের সামনে তুলে ধরে। দুঃখ-কষ্টের সাথে সংগ্রাম করে নিজের অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখার মধ্যে জীবনের প্রকৃত অর্থ নিহিত। দুঃসময়ে জীবনকে থামিয়ে রাখলে চলবে না। জীবনে দুঃখ-কষ্টকে স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করতে হবে। দুঃখ বেদনা মানুষকে বাস্তববাদী করে। কষ্টবোধে মানুষ আত্মশক্তিতে বলীয়ান হয়, যা মানুষের জীবনে পূর্ণতা নিয়ে আসে। আর এই আত্মশক্তিই মানুষকে ক্রমান্বয়ে উন্নতি ও সমৃদ্ধির পথে পরিচালিত করে। দুঃখবোধ একদিকে যেমন কষ্টের অভিজ্ঞতার জন্ম দেয় অন্যদিকে মানুষকে সংগ্রামী মনোভাবে অনুপ্রাণিত করে।
শিক্ষা: দুঃখ কষ্ট থেকে লব্ধ অভিজ্ঞতা মানুষকে সহনশীল, ধৈর্যশীল, মহান ও সর্বংসহা করে। দুঃখবোধ মানুষকে সত্যাশ্রয়ী ও আত্মসচেতন হতে সহায়তা করে। এর থেকে প্রাপ্ত অভিজ্ঞতা মানুষের অনাগত জীবনের সকল পরিস্থিতি এবং সমস্যা নিয়ন্ত্রণ ও দমনে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
অসির চেয়ে মসি বড়।
‘অসি’ অর্থাৎ তরবারি ক্ষমতার প্রতীক। আর ‘মসি’ অর্থাৎ লেখার জন্য ব্যবহৃত কালি জ্ঞানের প্রতীক। ক্ষমতালিপ্সু মানুষরা অসির বলে অনেক প্রাণ বিনষ্ট করে নিজের আধিপত্য বিস্তার করে। কিন্তু অল্পদিনই তারা নিজেদের প্রাধান্য বজায় রাখতে পারে। কিছুদিনের মধ্যেই আবার সেই স্থান দখল করে নেয় অন্য কোনো ক্ষমতাপিপাসু মানুষ। এমন অনেক দৃষ্টান্ত আমরা ইতিহাসে দেখতে পাই। পক্ষান্তরে মনীষীগণ মসির সাহায্যে মানবজাতির কল্যাণে অনেক সৃষ্টিশীল কর্ম লিপিবদ্ধ করে যান। যা যুগে যুগে মানুষকে শান্তি ও সমৃদ্ধির পথ দেখায়। তাঁদের লিপিবদ্ধ চিন্তাধারা সভ্যতাকে নিয়ে যায় উৎকর্ষের পথে। আর এই উৎকর্ষের পথ ধরেই মনীষীগণ সম্মান পান মানুষের অন্তরে। অন্য কেউ তাঁদের সম্মানটি দখল করতে পারে না। এমনকি মৃত্যুর পরও তাঁরা অমলিন হয়ে থাকেন মানব সভ্যতার ইতিহাসে। কিন্তু যারা অসির বলে বলীয়ান মৃত্যুর সাথে সাথে তাদের অস্তিত্ব হারিয়ে যায় মহাকালের স্রোতে। অসি আর মসির মধ্যে যুদ্ধে মসি হেরে যাবে। কিন্তু অসির এ জয় ক্ষণিকের। শাশ্বত ন্যায় যুদ্ধে মসিই বিজয়ী। অসির ক্ষমতা ধূমকেতুর ন্যায়। এর স্থায়িত্ব খুবই কম সময়ের জন্য। কিন্তু মসির ক্ষমতা সূর্যের ন্যায়। সূর্য যেমন সৃষ্টির আদি থেকে প্রতিদিন তার নিয়মেই আলো ছড়াচ্ছে, মসিও তেমনি অনন্তকাল ধরে নীরবে মানুষকে সত্য, সুন্দর ও শান্তির পথ দেখাচ্ছে।
শিক্ষা: অসি তার ধ্বংসলীলার মধ্য দিয়ে মানবজাতিকে দুঃখের সাগরে ভাসায়। আর মসি তার ফোঁটায় ফোঁটায় গড়ে তোলে স্বপ্ন, সভ্যতাকে নিয়ে যায় সমৃদ্ধির পথে। তাই মসিই হওয়া উচিত আমাদের জীবনে চলার পথের
আত্মশক্তি অর্জনই শিক্ষার উদ্দেশ্য।
শিক্ষা মানুষকে আলোকিত করে। আত্মশক্তি অর্থাৎ মানুষের নিজের যোগ্যতা ও সামর্থ্যকে বাড়ানোই শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য। আত্মশক্তি মানুষের মাঝে সুপ্ত অবস্থায় থাকে বলে অনেক ক্ষেত্রেই মানুষ নিজের শক্তিকে বুঝতে পারে না। শিক্ষা সেই সুপ্ত শক্তিকে জাগিয়ে তুলতে সাহায্য করে। জগতে নিজের অবস্থানকে মজবুত করে ধরে রাখতে শিক্ষার প্রয়োজন। তাই শিক্ষাকে সারা বিশ্বে একটা নির্দিষ্ট ধাপ পর্যন্ত বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। শিক্ষা মানুষের মৌলিক অধিকার। কারণ জ্ঞানীগুণীরা জানেন শিক্ষা গ্রহণ না করে কেউ সফল হতে পারে না। আর যারা অশিক্ষিত, শিক্ষা গ্রহণ করে না তারা নিজেদের শক্তিকে বিকশিত করতে পারে না। তবে শুধুমাত্র পুঁথিগত শিক্ষা মানুষকে সফল করতে পারে না। এমন শিক্ষা অর্জন করতে হবে যা মানুষের যোগ্যতা ও সামর্থ্যকে বাড়িয়ে তোলে এবং প্রতিকূল পরিবেশের সাথে খাপ খাওয়াতে সাহায্য করে। আত্মশক্তি মানুষকে স্বনির্ভর হতে শেখায়, মানুষকে যোগ্য করে গড়ে তোলে এবং দৃঢ় মনোবলের অধিকারী করে। আত্মশক্তি আত্মবিশ্বাসেরই প্রতিরূপ। তাই প্রথাগত শিক্ষায় শিক্ষিত না হয়ে সুপ্ত প্রতিভাকে জাগিয়ে তুলতে পারে এমন শিক্ষা অর্জন করতে হবে। জীবনে সফল হতে হলে অনেক দুঃখ-কষ্ট সহ্য করতে হয়, অনেক বাধা অতিক্রম করতে হয়। নিজের যোগ্যতা না থাকলে কেউ এতসব প্রতিকূলতা মোকাবেলা করতে পারে না। আর এই যোগ্যতা অর্জিত হয় শিক্ষা গ্রহণের মাধ্যমে। এছাড়া মানুষের ভুল-ত্রুটি সংশোধনের পথ দেখায় শিক্ষা। তবে যে শিক্ষা আত্মবিশ্বাসকে বাড়াতে পারে না সে শিক্ষা প্রকৃত শিক্ষা নয়। কারণ শিক্ষার মূল উদ্দেশ্যই হচ্ছে মানুষের সামর্থ্য ও যোগ্যতাকে বাড়ানো। আত্মশক্তি না থাকলে মানুষ পরনির্ভরশীল, পরমুখাপেক্ষী হয়ে যায়। যা কারো কাছেই পছন্দনীয় নয়। তাই শিক্ষা গ্রহণ করে আত্মনির্ভর হয়ে নিজেকে দেশ ও সমাজের যোগ্য হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব।
শিক্ষা: জীবনকে সুন্দর ও সুশৃঙ্খলভাবে পরিচালনা করতে চাইলে শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। শিক্ষা অর্জনের মাধ্যমে আত্মশক্তি অর্থাৎ নিজের যোগ্যতা বা সামর্থ্য বৃদ্ধি করে শুধু নিজের জন্য নয় সমাজের জন্যও অনুকূল পরিবেশ তৈরি করতে হবে।
অহংকার এমন এক আবরণ, যা মানুষের সকল মহত্ত্ব আবৃত করে ফেলে।
মানুষের সকল মানবীয় গুণের সমনি¦ত বহিঃপ্রকাশই হলো মহত্ত্ব। এসব মানবীয় গুণাবলি দিয়েই মানুষ অন্যান্য প্রাণী থেকে নিজেকে আলাদা করেছে, হয়েছে সৃষ্টির সেরা জীব। মহৎ মানুষরা আত্মকেন্দ্রিক না হয়ে, দেশ ও দশের কল্যাণে আত্মোৎসর্গ করেন। তাঁরা সকল প্রকার হীনতা, দীনতা, সংকীর্ণতা, স্বার্থপরতা ও অহংকার থেকে মুক্ত থাকে। তাঁরা সব সময় দেশ, জাতি ও সমাজকে নিয়ে চিন্তা করেন, নিঃস্বার্থভাবে কাজ করে যান। তাঁরা আলোকিত হৃদয়ের অধিকারী, যে আলোয় জাতি পথ খুঁজে পায়। হাজী মুহাম্মদ মহসীন, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ, বেগম রোকেয়া প্রমুখ মনীষীগণ মহত্ত্বের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন। মহৎ মানুষরা সব সময় চিন্তা করেন কিভাবে মানুষকে প্রকৃত মানুষ করা যায়। তাঁরা বিনয়ের ধারক ও বাহক। কখনোই তারা নিজের ধন দৌলত, বিদ্যা-বুদ্ধি নিয়ে অহংকার করেন না। এটি মানুষকে সদুপদেশ গ্রহণ করা থেকে বিরত রাখে। অহংকারী ব্যক্তি নিজের টাকা, যশ, খ্যাতি, জ্ঞান নিয়ে এতটাই গর্বিত হোন যে মানুষ হয়েও তার মাটিতে আর পা পড়ে না। সে যত বড় পন্ডিত, জ্ঞানী-গুণী, ধনী-দাতা, বীর হোক না কেন, তাকে সমাজের কেউ ভালোবাসে না। বরং মানুষ একজন অহংকারীকে অনেক বেশি ঘৃণা করে। অহংকার মানুষকে ধ্বংসাত্মক কাজেও লিপ্ত হতে প্ররোচিত করে। সেই সাথে কালের পরিক্রমায় অহংকার দরিদ্রতাও ডেকে আনে। ফলে অহংকারের আবরণে ব্যক্তির সব মহত্ত্ব ঢাকা পড়ে যায়। কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত বলেন- ‘তুমি পর্বততুল্য উচ্চ হইলে গর্ব দোষে খর্ব হইবে, ইহা বিচিত্র নহে।’
শিক্ষা: অহংকার পরিত্যাগের মাধ্যমেই মানুষের মহত্ত্ব বিকশিত হয়। অহংকার ও দাম্ভিকতা জগতশ্রেষ্ঠ হওয়ার ক্ষেত্রে প্রধান বাঁধা। মানব চরিত্রের এই নেতিবাচক গুণটি সর্বদাই পরিত্যাজ্য।
অশান্তি যুদ্ধ থেকেও গুরুতর।
যুদ্ধ এবং অশান্তি একে অপরের সাথে সম্পর্কযুক্ত। সামাজিক বন্ধনের মাধ্যমে যুগ যুগ ধরে মানুষ পৃথিবীতে বসবাস করছে। মানুষের শান্তি প্রতিষ্ঠার অন্তরায় হলো যুদ্ধ। পৃথিবীর প্রত্যেকটি মানুষ শান্তিকামী। কেউ যুদ্ধ, রক্তপাত, সংঘর্ষ চায় না। এগুলো মানুষের সুন্দর মানসিকতাকে বিনষ্ট করে দেয়। ক্ষুদ্র স্বার্থকে কেন্দ্র করে শক্তিশালী দেশগুলো তাদের শত্রুদেশগুলোকে যুদ্ধের দিকে ঠেলে দেয়। যার ফলে দেশটিতে অনেকদিন যাবৎ অশান্তি বিরাজ করে। এই অশান্তি সামাজিক অগ্রগতির অন্তরায়। সমাজের শিক্ষা ব্যবস্থা, অর্থনৈতিক ভিত্তি, কাঠামোগত উন্নয়ন, সবকিছুতেই বাধার সৃষ্টি হয়। যার ফলে অপরাধপ্রবণতা, মাদকাসক্তি, হানাহানি, সংঘর্ষ, ভূমি দখল প্রভৃতি নেতিবাচক দিকগুলো মাথাচাড়া দিয়ে উঠে। যা যুদ্ধের চেয়েও ভয়াবহ রূপ ধারণ করে। যুদ্ধের মাধ্যমে জয়-পরাজয় নির্ধারিত হয়। কিন্তু সামাজিক অশান্তি দূর করা সম্ভব হয় না। অশান্তির বহুবিধ কারণ থাকতে পারে। ভয়-আতঙ্ক, দুঃখ-দুর্দশা, অভাব-অনটন, রোগ-শোক প্রভৃতি কারণে অশান্তি সৃষ্টি হয়। এই দীর্ঘস্থায়ী অশান্তি সামাজের অগ্রগতি নষ্ট করে দেয়। উদাহরণ হিসাবে আমরা বলতে পারি, জাপানের হিরোশিমা, নাগাসাকিতে পারমাণবিক বোমার আঘাতে বহু মানুষের প্রাণহানি ঘটেছিল। কিন্তু সেখানে এখনও পর্যন্ত মানুষের আর্তনাদ শোনা যায়। সুতরাং অশান্তি যুদ্ধের ভয়াবহতাকেও ছাড়িয়ে যায়।
শিক্ষা: যুদ্ধ বা অশান্তি উভয়ই মানুষের সুখ, আনন্দ, জীবন, সম্পদ প্রভৃতি বিনষ্ট করে। তাই সামাজের শৃঙ্খলার কথা চিন্তা করে আধুনিক বিশ্বে যুদ্ধ বা অশান্তি কোনোটাই কাম্য নয়।
আগে চল, আগে চল ভাই পড়ে থাকা পিছে, মরে থাকা মিছে, বেঁচে মরে কিবা ফল, ভাই।
মানুষ মরণশীল। জন্ম-মৃত্যুর কথা ভেবে সময় নষ্ট করা উচিত নয়। প্রতিটি মানুষকে তার লক্ষ্য স্থির করতে হয়। আর লক্ষ্যকে সামনে রেখেই মানুষকে এগিয়ে যেতে হয়। সমাজে কিছু লোক আছে যারা কাজ পছন্দ করে না। তারা অলসভাবে সময় নষ্ট করে। এতে তাদের মন-মানসিকতা সংকীর্ণ হয়ে পড়ে। তাদের মনে নানা কুসংস্কার এসে ভর করে। অলসতার কারণে তাদের জীবন স্থবির হয়ে পড়ে। তাদের মেধার বিকাশ ঘটে না। উদ্দেশ্যহীনভাবে লক্ষ্য ছাড়া বেঁচে থাকা মানে মৃত্যুর সমতুল্য। এতে মানুষ তার কর্মশক্তি হারিয়ে ফেলে। তারা মরার আগে বার বার মরে। এ প্রসঙ্গে উহলিয়াম শেকস্পিয়র বলেছেন- “প্রকৃত বীর একবারই মরে, আর কাপুরুষেরা মরে বারবার।” নদীতে যখন স্রোত থাকে না তখন তাতে শৈবাল এসে জন্ম নেয়। এতে করে নদীর গতিপথ থেমে যায়। এমনিভাবে যারা সমাজের পিছনে পড়ে থাকে তাদের জীবনের গতিও থেমে যায়। বেঁচে থাকার মধ্যে কোনো সার্থকতা নেই। পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে হলে সাহস নিয়ে বাঁচতে হবে। নানা বাঁধা বিপত্তিকে তুচ্ছ মনে করে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। গতিতেই জীবন-স্থিতিতেই মৃত্যু। মানুষ যদি তার কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে চায় তবে পরিশ্রমের মাধ্যমে তা সম্ভব। পৃথিবী হলো প্রতিযোগিতার স্থান। সংগ্রাম করেই এখানে টিকে থাকতে হয়। পৃথিবীর যে জাতি যত বেশি উন্নত সে জাতি তত বেশি পরিশ্রমী ও গতিশীল। তারা কখনও থেমে থাকে না। চীন, জাপান, রাশিয়া, সিঙ্গাপুর প্রভৃতি দেশ শ্রমের সঠিক ব্যবহার ও ক্রিয়াশীলতার জন্য বিশ্বের উন্নত দেশ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। বাংলাদেশ একটি ছোট দেশ। কিন্তু এর জনসংখ্যা বিশাল। আমরা যদি এই বিশাল জনসংখ্যাকে কর্মমুখী করতে পারি তাহলেই আমাদের দেশের উন্নয়ন সম্ভব। কর্মময় গতিশীল জীবনই প্রগতি, কল্যাণ ও উন্নতির নিশ্চয়তা দেয়। আর এ জন্য আমাদের পেছনে পড়ে থাকলে চলবে না। সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে।
শিক্ষা: বড় হওয়ার ইচ্ছা থাকলে কোনো প্রতিকূল পরিবেশ তাকে থামাতে পারবে না। তাই আমাদের সমাজের পেছনে পড়ে থেকে কোনো লাভ নেই। বুকে সাহস নিয়ে জীবন পরিচালনা করতে হবে এবং সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে।
আগে চুরি করে জেল খাটে পরে, নির্বোধ চোর তারা আগে জেল খাটে পরে চুরি করে, সেয়ানা স্বদেশী তারা।
জ্ঞান-বুদ্ধির সদ্ব্যবহার করলে হয় জনকল্যাণ আর এর অপব্যবহার করলে হয় সমাজের ভয়ংকর ক্ষতি। আর এই অপব্যবহারকারীরা হচ্ছে সমাজ ও রাষ্ট্রের শত্রু। তারা অসৎ ব্যক্তি উদ্দেশ্য হাছিলের জন্য নিজেদেরকে রাজনীতি নামক মোড়কের আড়ালে ঢেকে সাধারণ মানুষের সরলতার সুযোগ নিয়ে থাকে। দেশপ্রেমিক হিসেবে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার জন্য দু’চারটি প্রহসনমূলক ভালো কাজ করে জনমনকে বিভ্রান্ত করার মাধ্যমে শুরু হয় তাদের পথচলা। তাদের স্বাভাবিক চেহারা দেখে মুখোশের আড়ালে লুকায়িত নির্লজ্জ চেহারা চেনা যায় না। কারণ তারা অত্যন্ত ধূর্ত ও কপট। তাদের মুখে সবমসয় লেগে থাকে কৃত্রিম হাসি, যা দিয়ে তারা যেকোনো মানুষকে অতি সহজেই বিভ্রান্ত করতে পারে। জনগণের সহানুভূতিই তাদের একমাত্র লক্ষ্য। আর সে লক্ষ্য হাছিলের জন্য তাদের রয়েছে অভিনব সব পদ্ধতি। সেই পদ্ধতিসমূহের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় পদ্ধতি হলো জেলে যাওয়া। তাদের আচরণ দেখে মনে হবে তারা যেন ওখানে যেতেই সবচেয়ে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। এলোমেলো রাজনৈতিক চিন্তাধারা, দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনীতি, মূল্যবোধের চরম ধ্বংস, তাবেদারি সংস্কৃতির কারণে বিভিন্ন যুগে বিভিন্ন দেশে কখনো কখনো এ রকম অনেক কপট নেতা জনতার উৎকর্ষের রথচক্রকে খানাখন্দেও ফেলে দিয়েছে। যুগে যুগে অনেক ধূর্ত নেতৃত্বাভিলাষী কপটতার জাল বিস্তার করে জনতাকে বিভ্রান্তির পথে নিয়ে গেছে। তাদের খপ্পর থেকে দেশকে বাঁচাতে হলে সর্বদা সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। জাতীয়তাবাবোধ এবং সুনাগরিকের গুণাবলী যেমন, ন্যায়বোধ, অসাম্প্রদায়িক-চেতনাবোধ, কর্তব্যবোধ, মানবাধিকার সচেতনতা, মুক্তবুদ্ধির চর্চা, শৃঙ্খলা, সৎ জীবন-যাপনের মানসিকতা, সৌহার্দ্যতা, অধ্যবসায়ে বিকশিত সৎ ও যোগ্য ব্যক্তিকে সততার সাথে জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত করতে হবে।
শিক্ষা: ধূর্ত ব্যক্তিরা ছলে-বলে-কৌশলে প্রতিনিয়তই আমাদের ক্ষতি করার চেষ্টায় লিপ্ত থাকে। তাদের সংস্পর্শ থেকে আমাদের নিরাপদে অবস্থান করতে হবে।
আছে যাহা আপন হাতে, নিত্য খুশি থাকো তাতে পরদ্রব্যে করলে আশা, দুঃখ পাবে সর্বনাশা।
মানুষ বাঁচার প্রয়োজনে প্রতিনিয়ত অসংখ্য মৌলিক চাহিদার সম্মুখীন হয়। অর্থনীতির ভাষায়- ‘মানুষের অভাব অসীম কিন্তু সম্পদ সীমিত’। সুতরাং, মানুষকে নিজের যা কিছু আছে তা দিয়েই অসীম অভাব পূরণের চেষ্টা করতে হবে। অভাববোধ থেকেই মানুষের মধ্যে চাওয়ার প্রবণতা জন্ম নেয়। তবে আকাক্সক্ষা ও প্রাপ্তির একটা সীমা থাকা দরকার। চাওয়ার প্রবণতা নির্দিষ্ট সীমা অতিক্রম করলেই জীবনে বিপদ নেমে আসে। অল্পতেই মানুষকে তুষ্ট থাকা উচিত। নিজের যা কিছু আছে তাতেই তাকে সন্তুষ্ট থাকতে হবে। অভাববোধকে যদি কেউ নিয়ন্ত্রণ করতে না পারে তখনই সংকটের সৃষ্টি হয়। তখন অতৃপ্ত জীবনকে পরিপূর্ণতা দানের জন্য মানুষ মরিয়া হয়ে ওঠে। ক্রমেই সে অন্যায় পথে পা বাড়ায়, অপরের ক্ষতি করে এবং নিজেকে সমাজের চোখে ছোট করে। লোভে পতিত হলে মানুষ হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়ে। এই প্রেক্ষাপটে লিও টলস্টয়ের গল্পের নায়ককে আদর্শ উদাহরণ বলা যায়। সূর্যাস্ত পর্যন্ত যতটুকু যেতে পারবে ততোটুকু জমির স্বত্ত্বাধিকারী করার কথা তাকে বলা হয়েছিল। পথ চলতে চলতে সে একসময় ক্লান্ত হয়ে যায়। কিন্তু আরও পাওয়ার লোভে আসক্ত হয়ে আবার হাটতে শুরু করে। এক সময় তার জীর্ণশীর্ণ শরীর মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে যায়। এতে বোঝা যায়, লোভে সম্মোহিত হয়ে মানুষ নিজেরই ধ্বংস ডেকে আনে। কথায় আছে ‘লোভে পাপ আর পাপে মৃত্যু’। যারা অল্পে তুষ্ট তারা ন্যায়নিষ্ঠা ও সুন্দর জীবনযাপন করতে পারে। যারা নিজেদেরকে ভোগের তাড়নার ঊর্ধ্বে রাখতে পারে তারা নিজেদের জীবনে এবং অপরের জীবনেও মঙ্গল বয়ে আনতে পারে। আর যারা নিজেদের অল্প সম্পদে তুষ্ট না থেকে লোভে পড়ে অন্যের সম্পদ আশা করে তাদের ধ্বংস অনিবার্য।
শিক্ষা: সন্তুষ্টি এবং তৃপ্তিবোধই আমাদেরকে সুন্দর ও ন্যায়ের পথে পরিচালিত করে। নিজের সম্পদে তুষ্ট থাকাতেই প্রকৃত সুখ নিহিত। অন্যের সম্পদের প্রতি লোভ করলে চরম দুঃখে নিপতিত হতে হয়।
আত্মবিশ্বাসই বীরত্বের মূলমন্ত্র।
আত্মবিশ্বাস সফলতার চাবিকাঠি। আত্মবিশ্বাস ছাড়া সফল হওয়া যায় না, বড় হওয়া যায় না। আত্মবিশ্বাসই মানুষকে পথ দেখিয়ে ভবিষ্যতের কাঙ্খিত সাফল্য এনে দেয়। জীবনে জয় পরাজয়, হাসি-কান্না থাকবে। সবকিছু অতিক্রম করতে হবে আত্মবিশ্বাসের উপর ভর করে। দেখতে কালো, সুন্দর খাটো না লম্বা এ বিষয়গুলো ভেবে সময় নষ্ট করা উচিত নয়। মানুষ নামে বড় হয় না, কাজে বড় হয়। আত্মবিশ্বাস নিয়ে সামনের দিকে এগুতে হবে। তাহলে পথ প্রশস্ত হবে। নিজের মাঝে এই বিশ্বাস সৃষ্টি করতে হবে যে, আমার দ্বারাই সম্ভব। আমিই পারব বিশ্ব জয় করতে, দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে। আজকের পৃথিবী যারা শাসন করছে তাদের সবাই কিন্তু সুন্দর, লম্বা কিংবা সাদা চামড়ার মানুষ নয়। তাদের সবাই সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মগ্রহণ করেনি। অনেকে দরিদ্র ঘরে জন্মগ্রহণ করেও এ পৃথিবী শাসন করেছে, এখনও করছে, ভবিষ্যতেও করবে। জর্জ ওয়াশিংটন একজন সাধারণ ব্যক্তি হয়েও আমেরিকার মতো রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন। তার আত্মবিশ্বাসই তাকে এত বড় পদে আসীন করেছিল। আত্মবিশ্বাস নিয়ে কাজ করলেই কেবল স্বপ্ন পূরণ সম্ভব। তাই স্বপ্ন পূরণের ভিত্তি হলো আত্মবিশ্বাস। এটাই মানুষের চলার পথকে সুগম করে, সহজ করে। এর ওপর ভর করেই মানুষ এভারেস্ট শৃঙ্গ জয় করেছে, উত্তর মেরু ও দক্ষিণ মেরু আবিষ্কার করেছে। মহাকাশ, চাঁদ, মঙ্গল গ্রহ, সমুদ্র ও দুর্গম মরু প্রান্তর জয় করেছে। আত্মবিশ্বাসই আমাদেরকে মাতৃভাষা ও মাতৃভূমি দিয়েছে, স্বাধীনভাবে কথা বলার অধিকার দিয়েছে। আত্মবিশ্বাসে বলিয়ান যারা তারা অবিরাম কাজ করে চলে। স্বপ্নকে সামনে রেখে এগিয়ে চলে।
শিক্ষা: আত্মবিশ্বাস আর কাজের সমন্বয়েই পৃথিবীর সকল অসম্ভবকে সম্ভব করা যায়। তাই আমাদের আত্মবিশ্বাসের বলে বলীয়ান হওয়া প্রয়োজন।
আপনি আচরি ধর্ম শিখাও অপরে।
উপদেশ দেওয়ার মানুষের অভাব হয় না। আমাদের সমাজে এমন অনেক ব্যক্তি আছেন যারা উপদেশ দিতে খুবই পছন্দ করেন। কিন্তু তাদের নিজেদের জীবনে সে কাজের প্রতিফলন খুব একটা দেখা যায় না। এমন ব্যক্তিরা যখন কাউকে কোনো কিছু শিক্ষা দিতে চেষ্টা করেন, তখন সেটা খুব কমই গ্রহণযোগ্য হয়। ভালো কাজ করতে বলা খুবই সহজ, কিন্তু ভালো কাজ করে দেখানোটা খুবই কঠিন। মানবজাতির ধর্মই হলো অন্ধকার ও নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি আকর্ষণ। এইসব খারাপ কাজে মানুষ সহজাত প্রবৃত্তিগত কারণেই আকৃষ্ট হয়। এসব থেকে দূরে থেকে জীবনে সুন্দর ও সত্যের বিকাশ ঘটানোই প্রতিটি মানুষের করণীয়। কিন্তু এসব মিথ্যা ও অন্ধকারের হাতছানিকে উপেক্ষা করে জীবনে সততার পথ অবলম্বন করা ভীষণ কঠিন। আর এই কঠিন কাজটি নিজেরা সম্পাদন করার পরই কেবল অন্যদেরকে শিক্ষা দেওয়া উচিত। তবেই সেই শিক্ষা অর্থবহ হয়ে উঠবে। একজন নীতিবান মানুষ তার সারাজীবনে ন্যায়, নীতি ও অনুশীলন করলেই কেবল অন্যরা তার নিকট থেকে উপদেশ গ্রহন করবে। মহানবী (স.) এর নিকট একদা এক মা এসে তার ছেলেকে মিষ্টি খেতে নিষেধ করার জন্য অনুরোধ করেন। তিনি সেই মাকে এক সপ্তাহ পরে আসতে বলেন। সেই এক সপ্তাহে তিনি আগে মিষ্টি খাওয়া পরিহার করেন, তারপর সেই ছোট ছেলেটিকে মিষ্টি খেতে নিষেধ করেন। এই উদাহরণ আরো স্পষ্ট করে যে, নিজে না করে, অন্যকে কিছু করতে বলাটাই অন্যায়। শুধু ইসলাম ধর্মেই নয়, অন্যান্য সকল ধর্মেই একই কথা বলা হয়েছে। গুণীজনদের ইতিহাস পর্যালোচনা করলেও আমরা তাদের চরিত্রে এই গুণেরই চর্চা দেখতে পাই। সুতরাং উপদেশ দেয়ার আগে আমাদের অবশ্যই চিন্তা করতে হবে আমরা নিজেরা কাজটি করতে কতটুকু সক্ষম।
শিক্ষা: যেকোনো কাজের ক্ষেত্রে উপদেশ প্রদানের পূর্বশর্ত হলো নিজে সেই কাজের যথার্থ অনুশীলন করা। নিজে সে কাজ করে দেখাতে না পারলে উপদেশ অর্থহীন হয়ে পড়ে। নিজে করে অপরকে শিক্ষা দিলেই, কেবলমাত্র সেই শিক্ষা গ্রহণযোগ্য হয়।
আপনা রাখিলে ব্যর্থ জীবন সাধনা জনম বিশ্বের তরে পরার্থে কামনা।
মানুষ সামাজিক জীব। তাকে সমাজে বসবাস করতে হয়। কোনো মানুষই অপরের সাহায্য সহযোগিতা ছাড়া চলতে পারে না। মানুষ সমাজ থেকেই প্রাথমিকভাবে এই সাহায্য সহযোগিতা পেয়ে থাকে। কেউ কেউ পরের কল্যাণে আত্মতৃপ্তি লাভ করে সুখী হয়। কেউবা নিজের স্বার্থলাভে আত্মতৃপ্তি পেয়ে থাকে। এই শ্রেণির লোক সব সময় নিজের সুখের কথা ভাবে। অন্যের সুখ-দুঃখ নিয়ে ভাবার মতো সময় তাদের থাকে না। এভাবে তারা নিজের সুখের কথা ভাবতে ভাবতে আত্মকেন্দ্রিক হয়ে পড়ে। তারা সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। তারা সমাজের কোনো কাজে আসে না। তাদের মনে স্নেহ, মায়া-মমতা ও ভালোবাসা থাকে না বলে তাদের হৃদয় পাথরের মতো। এই ধরণের মানুষেরা মৃত্যুর পর পরই পৃথিবী থেকে বিলীন হয়ে যায়। সমাজে আবার কিছু লোক আছেন, যারা অন্যের উপকারের মাধ্যমে আত্মতৃপ্তি লাভ করে। তারা সমাজের যেকোনো বিপদ-আপদে এগিয়ে আসে। সমাজের মানুষের সাথে তাদের সুন্দর সম্পর্ক গড়ে উঠে। এই শ্রেণির লোকেরা শুধু সমাজের উন্নয়নই নয় জাতীয় উন্নয়নেও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। তারা মৃত্যুর পর যুগ যুগ ধরে অমর হয়ে থাকেন। ফুল প্রকৃতির সৌন্দর্য বাড়ায় এবং মানুষকে আনন্দ দেয়; নিজের জন্য কিছু করে না। তেমনি পৃথিবীতে এমন কিছু মহৎ ব্যক্তি আছেন যারা ফুলের মতোই মানব কল্যাণে কাজ করে অমর হয়ে আছেন। হাজী মুহাম্মদ মুহসীন তার বিশাল সম্পদ মানবকল্যাণে দান করেছিলেন। আবার মাদার তেরেসা সারাজীবন মানব সেবায় নিয়োজিত ছিলেন। যে সমাজে সাহায্য সহযোগিতা থাকে না সে সমাজে নানা ধরণের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়। এতে সমাজের শান্তি-শৃঙ্খলা নষ্ট হয়। পৃথিবীতে যত দিন বাঁচা যায় ততদিন সাহায্য-সহযোগিতার মাধ্যমে বেঁচে থাকা প্রয়োজন। আমরা যদি পরস্পরর সুখ-দুঃখ ভাগ করে চলি, তাহলে পৃথিবীকে অনেক সুন্দর ও মনোরম মনে হবে। তাই প্রত্যেকের অবস্থান থেকে মানব সেবায় আত্মনিয়োগ প্রয়োজন।
শিক্ষা: আত্মসুখের পিছনে ছুটে কোনো লাভ নেই। বরং এতে নিজের দুঃখই আরো বাড়ে। তাই মানব সেবায় আত্মনিয়োগ করা প্রয়োজন।
আপনাকে বড় বলে বড় সেই নয়, লোকে যারে বড় বলে বড় সেই হয়।
পৃথিবীতে বিচিত্র লোকের বসবাস। কেউ কেউ নিজেকে প্রচার করতে উন্মুখ। আর কেউ নিজেকে প্রচার করতে বিমুখ। আত্মপ্রচারে লিপ্ত মানুষ নিজেকে বড় বলে জাহির করে বেড়ায়। সে নিজেকে পরোপকারী, উদার, মহান বলে সবার সামনে তুলে ধরে আত্মতুষ্টি লাভ করে। এতে করে তার হীনমন্যতার প্রকাশ পায়। সে আসলে বড় মনের মানুষ নয়। সে সমাজের জন্য যেসব কাজ করে তা লোক দেখানো। লোকে তাকে মর্যাদা দেয় না। জগতে যারা বড় হয়েছেন তারা কেউ আত্মপ্রচার করে বড় হননি। সাধারণ মানুষই তাদেরকে বড় বলে স্বীকার করেছে। যারা পরোপকার করেন, মানুষের কল্যাণের জন্য কাজ করেন, নিজেদের স্বার্থের চিন্তা না করে অপরের স্বার্থে নিজেদের নিয়োজিত করেন, তারাই সত্যিকারের বড় মানুষ। তারা সমাজের জন্য কাজ করে আনন্দ লাভ করেন। তাদের নিঃস্বার্থ কাজগুলো সমাজে প্রচারিত হোক তারা তা চান না। তারা তাদের কাজ-কর্ম, আচার-ব্যবহার, চাল-চলনে সকলের মনে স্থান লাভ করেন। সবাই তাঁদেরকে সম্মান দেখায় এবং সুনাম করে। তারা আত্মপ্রচার করে এ সম্মান ও সুনাম অর্জন করেন না। আর যারা নিজেদের গুণ প্রকাশ করে বেড়ায়, নিজেদের বড় বলে প্রচার করে, তারা আসলেই গুণী ও বড় মানুষ নয়। আত্মপ্রচার করে কখনও বড় মানুষ হওয়া যায় না। বড় মানুষ হতে হলে অপরের কল্যাণের জন্য কাজ করতে হবে, মানবিক গুণাবলীর বিকাশ ঘটাতে হবে। তাহলেই লোকে বড় মানুষ বলে তার সুনাম করবে। এতেই মানবজীবনের পরম সার্থকতা নিহিত।
শিক্ষা: মানবিক সৎগুণাবলী বিদ্যমান থাকলে লোকেই বড় বলে স্বীকৃতি দেয়। নিজেকে বড় বলে প্রচার করতে হয় না। যারা নিজেকে বড় বলে প্রচার করে, তারা প্রকৃতপক্ষে নিজেদেরকে সমাজে ছোট করে। তাদের জীবনের মাহাত্ম্য বাড়ে না, বরং কমে।
আভিজাত্যের অহংকারের মতো অন্যায়বোধ হয় আর একটিও নাই।
অঢেল সম্পদের অধিকারী হলেই প্রকৃত ধনী হওয়া যায় না। প্রকৃত ধনী হওয়ার জন্য প্রয়োজন একটি উদার মন। আমাদের সমাজে বহু অভিজাত ব্যক্তি আছে যারা সম্পদেও মোহে পড়ে অন্যকে যথাযথ সম্মান দেয় না। এতে তাদের সংকীর্ণ ও অহংকারী মনের পরিচয় পাওয়া যায়। অহংকার সমাজের চোখে সব সময় একটি গর্হিত অন্যায়। আর আভিজাত্যের অহংকার আরো বড় অন্যায়। কারণ আভিজাত্য মানুষে মানুষে বিবাদ সৃষ্টি করে। একই সমাজে মানুষ পরস্পরের শত্রু হয়ে যায়। সম্পদের অহংকার সমাজে নানা ধরণের শ্রেণিভেদ তৈরি করে। আভিজাত্য মানুষকে অনেক সময় পশুর পর্যায়ে নিয়ে যায়। তাদের মধ্যে তখন মানবিক গুণ বলতে কিছুই থাকে না। যেকোনো উপায়ে তারা তখন সমাজের কর্তৃত্ব দখল করার চেষ্টা করে। আভিজাত্যের অহংকার সামাজিক বন্ধন নষ্ট করে দেয়। তাই নিজের ধন-সম্পদ নিয়ে যারা অহংকারে লিপ্ত থাকে তারা সমাজের বিচারে সবচেয়ে বড় অন্যায়কারী। আভিজাত্যের অহংকার মানুষকে এমন এক পর্যায়ে নিয়ে যায় যখন সে অপরের অধিকার সম্পর্কে একটুও চিন্তা করে না। সম্পদের দাম্ভিকতা তাকে সামাজিকভাবে অন্ধ করে দেয়। সে যেন তার চেয়ে কম সম্পদশালীদের দেখতেও পায় না। যারা আভিজাত্যের অহংকার করে তাদের কাছে অন্যের অধিকারের কোনো মূল্য থাকে না। অথচ সমাজ চায় ধনী গরীব সবাই একই কাতারে থাকুক। মানবিক মূল্যবোধের চেয়ে সম্পদের মোহ অনেক বড় হয়ে যায় বলে আভিজাত্যের অহংকারী সমাজের চোখে একজন ঘৃণ্য ব্যক্তি। সাময়িক আভিজাত্য নিয়ে অহংকার করা সমাজের সবচেয়ে গর্হিত অন্যায় বলে বিবেচনা করা হয়।
শিক্ষা: ধনসম্পদের আভিজাত্য একজন মানুষের আসল পরিচয় বহন করে না। আভিজাত্যের অহংকার মানুষকে নিশ্চিত পতনের দিকে ঠেলে দেয়।
আপনারে কভু ভেবোনা ক্ষুদ্র, ভাবিওনা দীন তুমি তুমি নিতে পার জয় করিয়া এ বিপুল বিশ্বভূমি।
পৃথিবীতে সব মানুষেরই মর্যাদা সমান। সামাজিক স্তর বিন্যাসের দিক থেকে ধনী-গরীব, উঁচু-নিচু, ব্রাহ্মণ, শুদ্র ইত্যাদি ভাগ রয়েছে। তবে প্রতটি মানুষের মর্যাদা তার অবস্থানে শ্রেষ্ঠ। আল্লাহর শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি সকল মানুষের মর্যাদা সমান। মানুষকে ক্ষুদ্র ও দীন-ভাবার কোনো সুযোগ নেই। সমাজ পরিচালনায় সকল মানুষের প্রয়োজন পড়ে। আমাদের দৈনন্দিন জীবন পরিচালনার জন্য কামার, কুমার, তাঁতী, জেলে, মেথর, মুচি, দিনমজুর সবারই প্রয়োজন আছে। কাউকে খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। আজ যদি মেথর সম্প্রদায় তাদের কাজ করা বন্ধ করে দেয় তাহলে পরিবেশের বিপর্যয় ঘটবে। সামাজিক স্তর বিন্যাসে যারা নিম্ন, তাদের নিজেদের ছোট ভাবার কোনো কারণ নেই। সবার মাঝেই সুপ্ত প্রতিভা আছে। সে সুপ্ত প্রতিভা জাগ্রত করতে হবে। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জর্জ ওয়াশিংটন অতি সাধারণ লোক ছিলেন। তিনি প্রমাণ করে গেছেন যে, একজন সাধারণ লোক হয়েও এ বিশ্বজগতকে জয় করা যায়। নিজেকে ক্ষুদ্র না ভেবে, সৃষ্টিশীল কাজে মগ্ন থাকতে হবে। নিজ অবস্থান থেকে যতটা সম্ভব আর্ত-মানবতার জন্য কাজ করতে হবে। পৃথিবীতে সবাই সমান মেধা নিয়ে জন্মায় না। মেধাকে কাজে লাগাতে হবে। পৃথিবীকে জয় করতে হলে কাজের বিকল্প নেই। এ পৃথিবীতে অনেক দরিদ্র ঘরেও অনেক শ্রেষ্ঠ মানুষের জন্ম হয়েছে। তাই যেকোনো সমাজেই মানুষ জন্মগ্রহণ করুক না কেন, তার নিজেকে ছোট ভাবা উচিত নয়। বরং আত্মশক্তিতে বলিয়ান হয়ে সৃষ্টিশীল কাজ করতে হবে। যে সৃষ্টিশীল কাজ করতে পারবে, সে তত তাড়াতাড়ি পৃথিবীতে তার একটা অবস্থান তৈরি করতে পারবে। এ পৃথিবী উঁচু-নিচু সমাজের স্তরভেদ চেনে না। চেনে মানুষের কর্মকে। তাই যেকোনো ব্যক্তিরই এ বিপুল বিশ্বভূমি জয় করার অধিকার আছে।
শিক্ষা: শ্রেষ্ঠত্ব ও মহত্ত্ব গুণ দুটি নির্দিষ্ট কোনো সমাজের নয়। কর্মের মাধ্যমে এ গুণ অর্জন করতে হয়। আর তা সবার জন্য উন্মুক্ত।
আপনারে লয়ে বিব্রত রহিতে, আসে নাই কেহ অবনি পরে। সকলের তরে সকলে আমরা, প্রত্যেকে আমরা পরের তরে।
পৃথিবীতে কোনো মানুষই চিরস্থায়ী নয়। মানুষ কেবল চিরস্থায়ী থাকতে পারে তার মহৎ কর্মের মাধ্যমে। কর্মই মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে দীর্ঘ সময়। মানুষের যথার্থ পরিচয় নিহিত কর্মের মধ্য দিয়ে মানুষের মাঝে বেঁচে থাকার মাধ্যমে। যারা শুধু নিজের সুখ নিয়ে ব্যস্ত থাকে তারা প্রকৃত সুখের সন্ধান পায় না। জীবনে কেউ যদি ভালো কাজ না করে তবে সে জীবন অর্থহীন। মানবজীবন শুধু ব্যক্তিকেন্দ্রিক নয়, সবার সুখ তার মধ্যে জড়িয়ে থাকে। কারণ ব্যক্তিস্বার্থের ক্ষুদ্র পরিসরে মানবস্বার্থের চিন্তার অবকাশ থাকে না। অন্যের মঙ্গলের উদ্দেশ্যে কাজ করার মধ্যেই আত্মা প্রকৃত অর্থে সুখী হয়। মানুষ সুখের জন্য দিশেহারা, তারা কাজের মধ্যে সুখ খুঁজে পেতে চায়। তাই মানুষের প্রতি স্নেহ, মমতা, ভালোবাসা, সহানুভূতি, সহমর্মিতা হারিয়ে ফেলে। অপরদিকে পৃথিবীতে কম সংখ্যক মানুষ আছে যারা নিজের কথা চিন্তা না করে, অন্যের সুখ-শান্তি তথা কল্যাণের কথা চিন্তা করে। অপরের সুখ-শান্তির মাঝে নিজের পরম সুখের ঠিকানা খুঁজে পায়। যেমন- মাদার তেরেসা মেসোডেনিয়া ছেড়ে কলকাতায় এসে আর্তমানবতার সেবায় নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছেন। নেলসন ম্যান্ডেলা মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে জেলে কাটিয়েছেন জীবনের ২৭টি বছর, তাছাড়া মার্টিন লুথার কিং, মহাত্মাগান্ধী প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ নিজেদের বিলিয়ে দিয়েছেন মানুষের কল্যাণে। বিশ্বের যা কিছু মহান, মহৎ কর্ম, যা মানব সভ্যতাকে স্বর্ণ শিখরে নিয়ে গেছে তার মূলে রয়েছে মহৎ মানুষের ভূমিকা। অপরের কল্যাণ সাধনের জন্য তারা তাদের নিজেদের সুখ শান্তি, আরাম-আয়েশ, ভোগ-বিলাস সবকিছু বিসর্জন দিতে দ্বিধাবোধ করেননি।
শিক্ষা: সংকীর্ণ স্বার্থপরতায় বিভোর মানুষ কোনো দিন সুখ নামক বস্তুটির দেখা পায় না। তাই মানুষের কল্যাণে নিজেকে বিলিয়ে দেওয়াই প্রকৃত মানুষের কাজ।
আমরা শক্তি আমরা বল, আমরা ছাত্রদল মোদের পায়ের তলায় মূর্ছে তুফান ঊর্ধ্বে বিমান ঝড়-বাদল, আমরা ছাত্রদল।
ছাত্ররাই প্রত্যেক দেশের শক্তি ও ভবিষ্যতের সম্ভাবনা। মানুষের সবচেয়ে সৃজনশীল নির্ভীক সময় হলো ছাত্রজীবন। ছাত্রজীবন তারুণ্যে পরিপূর্ণ থাকে। ফলে তরুণ ছাত্রসমাজ কিছুতেই ভয় পায় না। কোনো অন্যায়, অত্যাচার, শোষণ, পীড়ন, সামাজিক বৈষম্য, ভেদাভেদের প্রতি তারা মাথা নোয়ায় না। সব ভয় ত্যাগ করে অসীম সাহসের সাথে এসবের মোকাবেলা করে। ছাত্র সমাজ অন্যায়ের বিরুদ্ধে, কখনও পরাজিত হয়েছে এমন ইতিহাস নেই। ভবিষ্যতে কখনও পরাজিত হবে না যতক্ষণ ছাত্র সমাজের ভিত্তি হবে সত্য ও ন্যায়। দেশ, জাতির কল্যাণের জন্য যুগে যুগে তরুণ ছাত্র সমাজই সবার আগে এগিয়ে এসেছে। তারা দুর্দিনে ঘুমন্ত জাতিকে জাগিয়ে তোলে। শাসকের রক্ত চক্ষুর ভয়কে উপেক্ষা করে ছাত্র সমাজ। এর উদাহরণ ১৯৫২’র ২১ ফেব্রুয়ারি। মাতৃভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার জন্য রাজপথে বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দেয়। ছাত্ররা জীবন উৎসর্গ করে দিয়েছিল পাক বাহিনীর বন্দুকের গুলিতে। তার পর ১৯৬২-র শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৯’র গণঅভ্যুত্থানে ছাত্র সমাজের সাহসী ভূমিকা অগ্রগণ্য। ১৯৭১ সালের ২রা মার্চ ছাত্ররাই সর্বপ্রথম বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করে। পাক বাহিনীও বুঝতে পেরেছিল যে, ছাত্র সমাজকে দমন করতে পারলেই, পূর্ব পাকিস্তানকে (বর্তমান বাংলাদেশ) দমন করে রাখা যাবে। তাই তো পাক বাহিনী সর্বপ্রথম ছাত্রদের ওপর নির্মমভাবে ঝাপিয়ে পড়েছিল। তারপর ১৯৯০’র স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন ২০১৩’র যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য আন্দোলনে ছাত্র সমাজের ভূমিকা মুখ্য। সব বাধা অতিক্রম করে বীরদর্পে সামনে এগিয়ে চলাই ছাত্র সমাজের বৈশিষ্ট্য।
শিক্ষা: দেশ ও জাতির দুঃসময়ে অন্যায়-অত্যাচার, শোষণ-পীড়নসহ সব বিপদে সবার আগে ছাত্র সমাজ এগিয়ে আসে। কারণ তরুণ ছাত্র সমাজ কখনও অন্যায় সহ্য করতে পারে না। তাদের সাহস ও উদ্ভাবনী শক্তি এবং নিত্য নতুন চিন্তার কাছে সব প্রতিকূল শক্তি হার মানে। জয়ী হয় জাতির শক্তি, জাতির ভবিষ্যৎ, ছাত্র সমাজ।
আমার এ ঘর ভাঙ্গিয়াছে যেবা, আমি বাঁধি তার ঘর আপন করিতে কাঁদিয়া বেড়াই, যে মোরে করেছে পর।
পৃথিবীতে মানুষের আগমন ঘটেছে সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে। মানুষের পরিচায়ক হচ্ছে মনুষ্যত্ব। কারো অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে গিয়ে তার ক্ষতি সাধন করলে এই মনুষ্যত্ব প্রকাশ পায় না। মন্দকর্মের বিপরীতে মন্দকর্ম কখনোই সমর্থণযোগ্য নয়। ক্ষমা মহত্ত্বের লক্ষণ। ক্ষমার দৃষ্টিতে বিচার করে অপকারীর উপকার করলে একদিকে যেমন তার শিক্ষা হয়ে যায় অন্যদিকে আবার পরোপকারের মতো একটি মহৎ কাজও করা হয়ে যায়। শত্রুর অনিষ্টের প্রতিশোধ নেওয়ার মধ্যে কোনো সার্থকতা নেই। আমার ঘর ভেঙ্গেছে বলে শত্রুর ঘরও না ভেঙ্গে যদি উল্টো তার ঘর বেঁধে দেওয়া যায় তাহলে তাতে ক্ষমাশীলতা ও পরোপকারের বিকাশ ঘটে। কোনো অসৎ ব্যক্তি ক্ষতিকর কাজ করলেও তার প্রতিদান ক্ষতিকর কাজ দিয়ে করতে নেই। সুন্দর আচরণ ও ক্ষমার আদর্শ স্থাপনের মাধ্যমে তার বিনিময় দেওয়া উচিত। মনে রাখতে হবে, প্রতিশোধপরায়ণতা কখনো কোনো সমস্যার সমাধান হতে পারে না। এটি বরং নতুন সমস্যা সৃষ্টি করে। অতএব ক্ষতিকর কাজের বিনিময়ে কল্যাণের কাজ করলে তাতে মনুষ্যত্ব ফুটে উঠে। তাই শত্রুকে পর না ভেবে কাছে টেনে নিলে সমাজে ভ্রাতৃত্ব ও সংহতি প্রতিষ্ঠিত হয়। পরোপকারের মধ্যে মানবজীবনের প্রকৃত সার্থকতা নিহিত। একে অপরের মাঝে প্রেম-প্রীতি ও ভালোবাসা আদান-প্রদানের মাধ্যমে একটি সুন্দর ও সুশৃঙ্খল সমাজ গঠন করা সম্ভব। হিংসা-প্রতিহিংসা সমাজে কেবল অশান্তির সৃষ্টি করে। তাই কেউ হিংসা করলে তাকে ভালোবাসা উপহার দেওয়া এবং কেউ ক্ষতি করলে বিনিময়ে তার উপকার করা উচিত। তবেই জীবন হয়ে উঠবে সার্থক ও আনন্দময়।
শিক্ষা: মানব সমাজের প্রত্যেক সদস্যই পৃথিবীতে আগমন করেছে একে অপরের জন্য। প্রতিশোধপরায়ণতা ত্যাগ করে ক্ষমা ও পরোপকারের মাধ্যমেই অক্ষুন্ন রাখা যায় মনুষ্যত্বের মর্যাদা।
আমার একার সুখ, সুখ নহে ভাই সকলের সুখ, সখা, সুখ শুধু তাই।
সমাজের বৃহত্তর কল্যাণে নিজেকে নিয়োজিত করার মাঝেই মানবজীবনের সার্থকতা নিহিত। নিজের সুখ-দুঃখকে বড় মনে না করে অপরের সুখ-দুঃখকে নিজের করে নেওয়ার মাঝেই সুখ। মানুষ জ্ঞান, বুদ্ধি, বিবেক, সুকোমল হৃদয়ের কারণে অন্য প্রাণীর চেয়ে আলাদা। মানুষ পরের উপকারে নিজেকে নিয়োজিত করতে পারে, যা অন্য কোনো প্রাণী পারে না। তাই নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকার জন্য পৃথিবীতে মানুষের জন্ম হয়নি। কিন্তু তা না করে অধিকাংশ মানুষ শুধু স্বীয় স্বার্থ হাসিলের মানসিকতায় ডুবে থাকে। অন্যের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, আপদ-বিপদ প্রভৃতির প্রতি নিয়োজিত থাকা উচিত। অপরের কল্যাণে নিজেকে নিয়োজিত না রাখলে আত্মার বিনাশ ঘটে। মানুষের প্রকৃতি থেকে শিক্ষা নেওয়া উচিত। প্রকৃতি তার সামগ্রিক রূপ, রস, গন্ধ মানুষের মঙ্গলের জন্য বিলিয়ে দেয়। যেমন-ফুলের সৌরভ, সৌন্দর্য তার নিজের হলেও সকলের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করে দিয়ে তার জীবনের সার্থকতা খুঁজে পায়। তেমনিভাবে নদী, তরু, চন্দ্র, সূর্য, সাগর প্রভৃতি নিজেদের বিলিয়ে দেয় অকাতরে। যারা মহৎ লোক তারা অপরের সুখ শান্তির জন্য নিজের সুখ-দুঃখ, আনন্দ- বেদনা ভুলে গিয়ে অপরের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনাকে নিজের মনে করে গ্রহণ করে। সকলের সাথে বন্ধুত্বের বন্ধন সৃষ্টি করে, সবাইকে নিয়ে সমাজের উন্নতির কথা চিন্তা করে। তারা সবার সুখে সুখী এবং সবার দুঃখে দুঃখী। গরীব, অসহায়, দুঃখ দুর্দশাগ্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে তাদের মুখে হাসি ফুটিয়ে তারা সুখী হয়।
শিক্ষা: নিজের সুখ খোঁজার মাঝে প্রকৃত সুখ পাওয়া যায় না। সবার সুখে সুখী এবং সবার দুঃখে দুঃখী হয়ে মানবকল্যাণে নিজেকে বিলিয়ে দেওয়ার মাঝেই প্রকৃত সুখ নিহিত।
আলস্য এক ভয়ানক ব্যাধি।
ব্যাধি মানুষের আয়ু কমিয়ে মানুষকে মৃত্যুর দিকে নিয়ে যায়। অলসতাও ভয়ানক ব্যাধির মতো মানুষের জীবনকে গ্রাস করে। যে ব্যক্তি আলস্যভরে কাজ-কর্ম থেকে নিজেকে দূরে রাখে তার পরিণতি হয় ভয়াবহ। আমাদের সমাজে যে যত বেশি পরিশ্রম করে সে ততবেশি উন্নত জীবনযাপন করে। অলস ব্যক্তিরা পরিশ্রমের ভয়ে নিজেকে ঘরের কোণে আবদ্ধ রাখে যা তার শরীর ও মনকে বিষিয়ে তোলে। অলস ব্যক্তি সুস্থ চিন্তা করতে পারেন না, সে নানা রকম অকল্যাণকর কাজের চিন্তা করে। জ্ঞানীরা বলেন-‘অলস মস্তিষ্ক শয়তানের আড্ডাখানা।’ অন্যদিকে কর্মঠ ব্যক্তিরা তাদের জীবনকে বৈচিত্র্যময় করে উপভোগ করে এবং জীবনে সাফল্য অর্জন করে জগতে অমর হয়। অলস ব্যক্তি সব সময় হতাশা ও হীনমন্যতায় ভোগে। তারা পরিবার, সমাজ-রাষ্ট্রের উন্নতির অন্তরায়। অলস ব্যক্তি সমাজের বোঝা। আর কর্মঠ ব্যক্তিরা তাদের শ্রম দিয়ে দেশ ও জাতির কল্যাণ বয়ে আনে।
শিক্ষা: অলসতা ব্যাধির মতোই ভয়াবহ। অলসতা দূর করে পরিশ্রম করলে শরীর ও মন দুটোই ভালো থাকে। এতে জাতির কল্যাণ ও উন্নতি নিশ্চিত হয়।
আলো ও অন্ধকার পাশাপাশি বাস করে একটিকে বাদ দিলে অন্যটি মূল্যহীন।
আমাদের এই সুন্দর পৃথিবীতে সব কিছুরই একটা বিপরীতধর্মী উপাদান রয়েছে। সুখ, আলো, আনন্দ, হাসি ইত্যাদি মানুষের জীবনকে আলোড়িত করে তোলে। আর অন্ধকার, দুঃখ, বেদনা, কান্না ইত্যাদি মানুষের জীবনকে বিষাদে ভরিয়ে তোলে। কল্যাণকর বস্তুর পাশেই অকল্যাণকর বস্তুর অবস্থান। এদের একটিকে ছাড়া অন্যটি মূল্যহীন। দুঃখ আছে বলেই সুখ এমন মহিমান্বিত। সুখ আছে বলেই মানুষ দুঃখকে মর্মে মর্মে বুঝতে পারে। জন্মের পর মৃত্যু অবধারিত বলেই জীবন এতো মূল্যবান। অন্ধকার আছে বলেই আমরা আলোর গুরুত্ব বুঝতে পারি। কেবল আলোর মধ্যে শুধু বসবাস করলে আমরা আলোর গুরুত্ব উপলব্ধি করতে পারতাম না। অতৃপ্তি না থাকলে মানুষের জ্ঞান বিজ্ঞানের উৎকর্ষ সাধন হতে পারত না। আবার মহৎ বেদনা না থাকলে মহৎ কাব্য কখনো সৃষ্টি হতো না। এটাই সবচেয়ে বড় সত্য। ধ্বংসের ভয় আছে বলেই মানুষ সৃষ্টিকে সংরক্ষিত করে। পৃথিবীতে সুখের পরশ আছে বলেই মানুষ দুঃখকে হাসিমুখে বরণ করে। আর দুঃখের অস্তিত্ব আছে বলেই মানুষ সুখের আশায় আজীবন সংগ্রাম করে যাচ্ছে। বাধা বিপত্তি অতিক্রম করলে জীবন সুখী ও সার্থক হবে। দুঃখ দেখে বিচলিত হলে চলবে না। কারণ সুখ দুঃখ জীবনের সাথে অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত। অন্ধকার শেষে যেমন আলো উদয় হয়; তেমনি দুঃখের শেষে জীবনে এক সময় সুখের সূর্য উদিত হয়। আলো ছাড়া অন্ধকার যেমন মূল্যহীন তেমনি অন্ধকার ছাড়া আলোও মূল্যহীন।
শিক্ষা: সুখ পেতে হলে যেমন দুঃখকে অতিক্রম করতে হয়, তেমিন অন্ধকার অতিক্রম করলেই আলোর পথে আসা যায়। দুঃখ না থাকলে সুখ মধুর হয় না, আবার সুখ আছে বলে আমরা বিষাদের মুহূর্তে দুঃখিত হই।
আলো বলে, অন্ধকার, তুই বড় কালো অন্ধকার বলে, ভাই তাই তুমি আলো।
প্রকৃতির অমোঘ নিয়মেই প্রকৃতিতে আমরা আলো এবং অন্ধকারের উপস্থিতি দেখতে পাই। প্রতিনিয়ত যথা সময়ে দিনের শেষে পৃথিবী অন্ধকারের কালো চাঁদরে ঢেকে যায়। রাতের আঁধার কাটলে সকালে পৃথিবীর পৃষ্ঠদেশ আবার সূর্যের আলোয় আলোকিত হয়। প্রাকৃতিক নিয়মেই এমনটা ঘটে। দিনের স্নিগ্ধতা আর রাতের কোমলতা এসব কিছুকে সৃষ্টিকর্তার অফুরন্ত নিয়ামত হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। সুন্দর এই পৃথিবীতে পরস্পর বিপরীতধর্মী বিষয় ও বস্তুসমূহের মধ্যে তীব্র আকর্ষণ বিরাজ করে। এসব উপাদানের দ্বান্দ্বিক পালা বদল প্রক্রিয়া সর্বদা সচল এবং অস্তিত্বমান। জন্ম-মৃত্যু, সৃষ্টি-ধ্বংস, আলো-আঁধার, আনন্দ-বেদনা, সুখ-দুঃখ এসব কিছুই পরস্পরের সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত, যদিও বৈশিষ্ট্যগতভাবে এরা একে অপরের বিপরীত। সৃষ্টির প্রতিটি জীবের কাছে নিজের জীবন অমূল্য সম্পদ। জন্মের পর মৃত্যু অবধারিত বলেই বেঁচে থাকাটা এত মধুর। পৃথিবীতে মৃত্যুর উপস্থিতি না থাকলে জীবনের কোনো মূল্যই থাকতো না। ধ্বংস সব সময়ই অমঙ্গলজনক এবং এটা কারো কাম্য নয়। ধ্বংস পৃথিবীর বুকে কান্না, হাহাকার, ও আর্তনাদ ডেকে আনে। ধ্বংসের এমন ভয়ানক রূপ আছে বলেই মানুষ সৃষ্টিকে লালন করে। মানুষ যখন অসুস্থ হয়ে পড়ে শুধুমাত্র তখনই সুস্থতার গুরুত্ব বুঝতে পারে। সেজন্যেই মানুষ তার সুস্বাস্থ্য রক্ষা করতে চায়। সুখ-দুঃখও তেমন বিপরীতধর্মী উপাদান বলে একে অপরের পরিপূরক। দুঃখ মানুষের মনকে যদি ব্যথিত করতে না পারতো তাহলে মানুষ সুখ ও আনন্দবোধের মর্ম বুঝতে পারতো না। সুখ লাভের আশায় মানুষ দুঃখ-কষ্টকে হাসিমুখে আলিঙ্গন করতে রাজি হয়। ঠিক একইভাবে প্রকৃতিতে অন্ধকারের উপস্থিতি আছে বলেই আলো এত মহিমাময়। অন্ধকার না থাকলে আলোর গৌরব এবং দীপ্তি এসব কিছুই ম্লান হয়ে যেত।
শিক্ষা: প্রকৃতির এই বিপরীতধর্মী বৈশিষ্ট্যসমূহ পৃথিবীকে সুশোভিত করে তুলেছে। এই উপাদানসমূহের একটির অস্তিত্ব অন্যটিকে বাদ দিয়ে কল্পনা করা যায় না।
আশার অন্ত নাইকো বটে আর সকলের অন্ত ঘটে।
আমাদের বেঁচে থাকার অন্যতম অনুপ্রেরণা হলো আশা। এই আশার কারণেই আমরা স্বপ্ন দেখি, ভালো ভাবে বেঁচে থাকতে চাই এই ধরায়। আশা-আকাঙ্ক্ষায় না থাকলে মানবজীবন এত কর্মচঞ্চল হতো না। মানুষের সকল কর্মস্পৃহা স্থবির হয়ে পড়ত। মানুষের এই আশা-আকাঙ্ক্ষার কোনো শেষ নেই। একটির পর অন্য একটি দ্রব্য পাওয়ার আকাঙ্ক্ষায় মানুষ সর্বদাই তাড়িত। কারো যদি মাটির ঘর থাকে তবে তার আশা থাকে টিনের ঘর তৈরি করার। টিনের ঘর হওয়ার কিছুদিন পরই দালান করার বাসনা তার মনে জাগে। আবার দালান বাড়ি করার পর একটি গাড়ি কেনার স্বপ্ন দেখতে শুরু করে ঐ ব্যক্তি। প্রতিনিয়ত আশা পূর্ণতার স্বপ্ন নিয়েই তার সারাটি জীবন কাটে। এভাবে কোনো একটি জিনিস পাওয়ার পর তার মনের মধ্যে ঐ দ্রব্যটি নিয়ে আর তেমন আখাঙ্ক্ষা কাজ করে না। বর্তমান এই আধুনিক জগতে মানুষের আশা আকাঙ্ক্ষাকে আরো বাড়িয়ে তুলেছে। যেমন একজন মানুষ হয়তো ভালো একটি বস্তু পাওয়ার আশা করল। অনেক কষ্টে তা পেলেও কিছুদিন পর ঐ বস্তুর প্রতি তার আগের আগ্রহ থাকে না। নতুন অন্য বস্তু পাওয়ার জন্য সে ব্যাকুল হয়ে যায়। অর্থাৎ কোনো একটি নির্দিষ্ট বিষয় বা উপাদানকে পাওয়ার আশা একদিন সমাপ্ত হয় কিন্তু আশার কখনো সমাপ্তি ঘটে না। প্রতিক্ষণই নিত্যনতুনভাবে আশা তার অন্তরে জাগ্রত হয়।
শিক্ষা: মানুষ আশার পেছনে মরীচিকার মতো প্রতিনিয়তই ছুটে চলেছে। মৃত্যুৎ পর্যন্ত চলতে থাকবে তার এই অসীম আকাঙ্ক্ষার। তাই অল্প আশা-আকাঙ্ক্ষাতে তুষ্ট থাকাই শ্রেয়।
ইচ্ছা থাকলে উপায় হয়।
সভ্যতার উষালগ্ন থেকেই মানুষ ছিল অসহায়। সেই অসহায় অবস্থা উত্তরণে কাজ করেছে তার প্রবল ইচ্ছাশক্তি। এই ইচ্ছাশক্তির বলেই পৃথিবীতে মানুষ আজ অন্যান্য জীব থেকে শ্রেষ্ঠ। হিংস্র পশুর হাত থেকে বাঁচার তীব্র বাসনা থেকেই যখন মানুষ পাথরের হাতিয়ার ও আগুন আবিষ্কার করলো, তখন থেকেই মানুষের আবিষ্কারের নেশা তীব্রতর হয়। আবিষ্কারের সেই তীব্র বাসনা বা ইচ্ছা শক্তির কারণেই সভ্যতা আজ এই পর্যায়ে উন্নীত। বস্তুত ইচ্ছা শক্তির জোরেই মানুষ জ্ঞান-বিজ্ঞানের চরম-শিখরে পৌঁছেছে। এক গ্রহ থেকে অন্য গ্রহে গিয়ে বসবাস করার চিন্তা করছে। পাহাড় চূড়া থেকে সমুদ্র তলদেশ পর্যন্ত বিচরণ করছে। জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিক্ষা-সংস্কৃতির সব ক্ষেত্রে প্রতিটি আবিষ্কারের পেছনে কাজ করেছে তার ইচ্ছাশক্তি। নদীর উপর ভেসে থাকার ইচ্ছা থেকে মানুষ তৈরি করেছে ভেলা, নৌকা, জাহাজ। আকাশে ওড়ার বাসনা থেকে তৈরি করেছে বেলুন, উড়োজাহাজ। রোগ থেকে বাঁচার তীব্র বাসনা থেকে আবিষ্কৃত হয়েছে ঔষধ ও প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি। ইচ্ছা শক্তির বলে বলীয়ান হয়ে মানুষ অধ্যবসায়ে হয়েছে মনোযোগী, পেয়েছে চিত্তের একাগ্রতা। যা মানুষকে তার সাফল্যের চরম শিখরে পৌঁছে দিয়েছে। ইচ্ছাশক্তি মানুষের মনোবলকে দৃঢ় করে এবং কাজে সাফল্যের ইন্ধন যোগায়। ইচ্ছা না থাকলে এক ধরণের জড়তা কাজ করে মানব-হৃদয়ে। ফলে কোনো আকাঙ্ক্ষাও জাগে না। ইচ্ছাশক্তি প্রচন্ড শক্তিশালী হলে যেকোনো বাধা তার কাছে নতিস্বীকার করতে বাধ্য হয়। পৃথিবী জয় করার প্রবল ইচ্ছা থেকে নেপোলিয়ন ইউরোপ জয় করেছিলেন, আব্রাহাম লিংকন আমেরিকার রাষ্ট্রপতি হতে পেরেছিলেন। স্বাধীন হওয়ার তীব্র ইচ্ছা থেকেই আমরা স্বাধীনতা লাভ করেছি। তাই ইচ্ছাশক্তিই মানুষের কাজের ও সাফল্যের মূল শক্তি।
শিক্ষা: ইচ্ছাহীন জীবন অর্থহীন। ইচ্ছা থেকেই প্রয়োজনের সৃষ্টি হয় আর প্রয়োজন থেকেই বের হয় পাওয়ার উপায়। তাই ইচ্ছাকে উপায়ের মূলমন্ত্র বলা হয়।
উদয়ের পথে শুনি কার বাণী, ভয় নাই ওরে ভয় নাই নিঃশেষে প্রাণ যে করিবে দান, ক্ষয় নাই তার ক্ষয় নাই।
মানুষ পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করে এবং একটি নির্দিষ্ট সময় পর মৃত্যুবরণ করে। মানুষের মৃত্যুর পর স্বভাবতই তাকে আর কেউ মনে রাখে না। জন্ম ও মৃত্যুর এই মাঝামাঝি সময়ে মানুষ যে সময়টুকু পৃথিবীতে অবস্থান করে তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এই সময়ের কর্মফলই তার পরিচয়কে সুস্পষ্ট করে। জীবনে মানুষ নানা প্রতিবন্ধকতার মধ্য দিয়ে নিজের স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করতে সচেষ্ট হয়। এই প্রতিবন্ধকতাকে রুখতে তাদের নানা আয়োজন, উদ্যোগ চোখে পড়ে। লক্ষ্যকে পূরণ করতে গিয়ে কেউ বেছে নেয় অন্যায়ের পথ। ভোগ-বিলাসে মত্ত হয়ে তারা নিতান্ত আত্মকেন্দ্রিক হয়ে পড়ে। জীবনাবসানকালে পৃথিবীর বুকে তারা ঘৃণার পাত্র হিসেবে চিহ্নিত হয়। জীবনে ও মরণে উভয় কালেই তারা ঘৃণিত। অন্যদিকে যারা সৎ কাজ করে, মানবকল্যাণে নিজেকে বিলিয়ে দেয় তারা স্থান পায় গৌরবময় ইতিহাসের পাতায়। যুগে যুগে যেসকল মানুষ আত্মত্যাগ করে গেছেন তারা হয়েছেন মহামানব। এসব মহামানব সকল ভয়-ভীতি, বাধা-বিপত্তিকে উপেক্ষা করে মৃত্যুকে জয় করেছেন। তাঁদের দেখানো পথ সকল অন্ধকারকে দূরে ঠেলে দিয়েছে আলোর সন্ধান। মানব মুক্তির জন্য তারা দ্ব্যর্থহীন চিত্তে কাজ করে গেছেন। চে গুয়েভারা, নেলসন ম্যান্ডেলা, আব্রাহাম লিংকন প্রমুখ ব্যক্তিগণের অবদান চিরদিন পৃথিবীর বুকে লেখা থাকবে তাঁদের আত্মত্যাগের জন্য। সংকট উত্তরণে এসব মহামানবের আবির্ভাব ঘটেছিল, ভবিষ্যতেও ঘটবে। সমাজ দেশ ও জাতির কল্যাণে সামান্য একটু কাজই বদলে দিতে পারে জনসাধারণের সাধারণ জীবনপরিচয়। সমস্ত প্রতিবন্ধকতাকে উপেক্ষা করে ভয়-ভীতিকে বিসর্জন দিয়ে দ্বিধাহীন চিত্তে যাঁরা নিঃশেষ জীবন দান করতে পারেন তারাই সভ্যতার অগ্রগামী পথিক।
শিক্ষা: জীবনে সফলতা অর্জনের মূল চাবিকাঠি হলো উত্তম পথটি নির্বাচন করা। মানবকল্যাণে নিজেকে উৎসর্গ করাই হলো সেই উত্তম পথ। তাই আমাদের মানবকল্যাণে নিজেদের নিয়োজিত করা উচিত।
উত্তম নিশ্চিন্তে চলে অধমের সাথে তিনি মধ্যম যিনি চলেন তফাতে।
পৃথিবী অজস্র মানুষের সমারোহে প্রাণচঞ্চল। এ সব মানুষের ধর্ম, বর্ণ, বিশ্বাস, অভ্যাস পৃথক। কিন্তু চাল-চলন, আচার ব্যবহারে সমগ্র মানবসমাজকে তিনটি শ্রেণিতে বিন্যস্ত করা যায়Ñ উত্তম, মধ্যম, অধম। এদের শ্রেণি চরিত্র ভিন্নতর অভিধায় চিহ্নিত। উত্তম সকল ক্ষেত্রেই উৎকৃষ্ট। সকলের উপর তার অবস্থান। অধম সকল ক্ষেত্রেই নিকৃষ্ট। সকলের নিচে তার অবস্থান। এই দুই শ্রেণি সম্পর্কে সমাজে স্পষ্ট ধারণা পোষণ করে। এই দুয়ের মধ্যবর্তী মধ্যম শ্রেণিকে নিয়েই সমস্যা। মানুষ এ শ্রেণিকে নিয়েই ভ্রান্তির মধ্যে পড়ে। তাই সমাজ, তাদের ব্যাপারে সদা সতর্ক। কিন্তু যিনি উত্তম তাকে নিয়ে কারো কোনো ভয় বা শঙ্কা নেই। কারণ তার দ্বারা কোনো অকল্যাণ সাধিত হয় না। পাপ-পঙ্কিলতা তাঁকে স্পর্শ করতে পারে না। চরিত্রগুণে সে মানুষের ভালোবাসা অর্জন করে। তাই সব শ্রেণী- পেশার মানুষের সঙ্গে তাঁর সহজ অবস্থান লক্ষণীয়। সমাজ তাঁর ব্যাপারে শঙ্কামুক্ত। অধমের ক্ষেত্রেও মানুষ একইভাবে শঙ্কামুক্ত। কারণ সমাজ তার কাছ থেকে ভালো কিছু আশা করে না। তার অসৎ চরিত্র, খারাপ মনোবাসনা, মন্দ কাজ সম্পর্কে সকলেই জ্ঞাত। তার কাছে প্রতারিত হবার ভয়ে সবাই সচেতন। কিন্তু মধ্যম শ্রেণি নিয়ে সবাই সব সময় সংশয়াপন্ন। মধ্যম নিজ শ্রেণি থেকে অধমে রূপান্তরিত হয় না, আবার উত্তমে ও উত্তরণ ঘটাতে অক্ষম। শ্রেণিচ্যুতির আশঙ্কায় সতর্ক পদক্ষেপে তার অভিযাত্রা। দুর্বল মানসিকতা, দ্বিধা-দ্বন্দ্ব, এ অভিযাত্রার সঙ্গী। প্রয়োজনে সে নিকৃষ্ট কাজ করে। আবার প্রয়োজনে কখনো কখনো ভালো কাজেও তার সরব উপস্থিতি। প্রকৃত পক্ষে এ শ্রেণি সুবিধাবাদী হবার ফলে জনসাধারণের প্রতারিত হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা থাকে। বিশ্ব সমাজে ছদ্মবেশধারীর মতোই তার আচরণ। এ ধরণের শ্রেণি চরিত্রের কারণে অধম থেকে সে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখে, উত্তমের সঙ্গেও প্রাণখুলে হাসতে, মেলামেশা করতে পারে না।
শিক্ষা: মধ্যমের দ্বিধা-সংশয়, ভয়-ভীতি, দোলাচল একরকম অধমেরই নামান্তর। জীবনে সফলতা অর্জন করতে হলে মধ্যবিত্ত মানসিকতা পরিহার করতে হবে।
এ জগতে হায়, সেই বেশি চায় আছে যার ভূরি ভূরি রাজার হস্ত করে সমস্ত কাঙালের ধন চুরি।
বেঁচে থাকার তাগিদে অর্থের প্রয়োজন। কিন্তু সমাজের এক শ্রেণির মানুষ যাবতীয় অর্থসম্পদ নিজেদের কুক্ষীগত করতে সদা সচেষ্ট। এই বিত্তবান শ্রেণির লোকেরা নিজেদের অঢেল ধন-সম্পত্তি থাকা সত্ত্বেও সম্পদের লোভ ত্যাগ করতে পারে না। তাদের এই বিকৃত লোভের শিকার হয় দরিদ্র ও অসহায় মানুষেরা। প্রাচীনকাল থেকেই এই ধারা প্রচলিত হয়ে আসছে। জমিদাররা যেমন বিপুল সম্পদের মালিক হয়েও সামান্য খাজনার জন্য দরিদ্র প্রজার সহায়-সম্বলটুকু কেড়ে নিতে কুণ্ঠিতবোধ করতো না, তেমনি বর্তমানেও ক্ষমতাপিপাসু একটা শ্রেণি নিজেদের জন্য একের পর এক সম্পদের ইমারত গড়ে তুলছে। আর এই সম্পদ আহরণের নেশায় মত্ত হয়ে তারা নিজেদের মানবতাকে বিসর্জন দিতে দ্বিধা করে না। তারা সমাজের দরিদ্র শ্রেণির মানুষদের অধিকারবঞ্চিত করে নিজেদের সম্পদের পাহাড় বানিয়ে চলে ক্রমাগত। কেননা তাদের আরো সম্পদ, আরো ভোগ-বিলাসিতার প্রয়োজন। বিত্তবানদের এই ধরণের বিকৃত অর্থলিপ্সার কোনো সীমা নেই বরং দিনে দিনে তাদের লালসা বাড়তেই থাকে। অঢেল সম্পদের মালিক হয়েও, আরো পাওয়ার ইচ্ছা তাদেরকে অমানুষে পরিণত করে। নিজেদের সম্পদ আরো বাড়িয়ে তোলার নেশায় তারা ন্যায়-অন্যায়, ভালো-মন্দ, সাদা-কালো কোনো কিছুই বাছ-বিচার করে দেখে না। কেউ তিনবেলা খেয়ে-পরে বেঁচে থাকতে পারলেই খুশি, আবার কেউ হাজার কোটি টাকার মালিক হয়ে সন্তুষ্ট থাকতে পারে না; আরো সম্পদের অভাবে সে কাতর। আরো সম্পদশালী হতে গিয়ে তারা সুদ, ঘুষ, চুরির মতো নানারকম দুর্নীতির আশ্রয় নেয়। এমনকী অর্থলিপ্সায় কাতর এই বিত্তবান লোকগুলো গরিবের মুখের অন্ন, মাথা গোঁজার নিরাপদ আশ্রয়, ন্যূনতম শিক্ষা প্রভৃতি মৌলিক অধিকারগুলো হরণ করে নিজেদের সম্পদের পাহাড় আকাশচুম্বী করে তোলে। আর এভাবেই সমাজে ধনী-দরিদ্র বৈষম্য বাড়তে থাকে। দরিদ্রের সর্বস্ব কেড়ে নিয়ে ধনীরা হয় আরো ধনী, অন্যদিকে যারা দরিদ্র তারা আরো বেশি দরিদ্র হয়ে পড়ে। জীবনধারণের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের যোগান না দিতে পেরে তারা অনাহারে-অর্ধাহারে, বস্তির ঘুপচি ঘরে মানবেতর জীবনযাপন করতে বাধ্য হয়।
শিক্ষা: এ পৃথিবীতে ধনীদের পাশাপাশি গরিবদেরও বাঁচার অধিকার আছে। পুঁজিবাদী বিত্তবানদের উচিত গরিবের সম্পদ আত্মসাৎ করে নিজেদের সম্পদ বৃদ্ধির নিলর্জ্জ মোহ পরিহার করা এবং তাদের দিকে সাহায্য, সহানুভূতির হাত বাড়িয়ে দেয়া।
এক মাঘে শীত যায় না।
প্রকৃতিতে মাঘ মাস আসে প্রচন্ড- শীতের তীব্রতা নিয়ে। শীতের এই তীব্রতা মানুষকে জীর্ণশীর্ণ ও রিক্ত করে দেয়। কিন্তু শীত গেলেই তা মানুষ ভুলে যায়। এই শীতের মতোই মানুষের জীবনে অনেক দুঃখ কষ্ট আসে। কিন্তু বিপদ শেষে এই দুঃখ কষ্টকে ভুলে যাওয়া উচিত নয়। মানুষের জীবন সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনায় পরিপূর্ণ। জীবনের পথে নানারকম বাধা বিঘ্ন অতিক্রম করে এগিয়ে যেতে হয়। জীবনে চলার পথে নানাজনের সাহায্য সহযোগিতার দরকার হয়। অনেকে আছেন যারা একবার দুঃসময় পার হয়ে গেলে তা আর মনে রাখেন না। এমন কি বিপদের সময় যে ব্যক্তি তাকে সহায়তা করেছিল তার কথাও ভুলে যায়। এ কথা মনে করে না যে সে আবার বিপদে পড়তে পারে আবার ঐ ব্যক্তির প্রয়োজন হতে পারে। যারা সংকটময় সময়ে মানুষের পাশে এসে দাঁড়ান, তারাই মহৎ মানুষ। তাদের ঋণ কৃতজ্ঞতাভরে স্মরণ রাখা উচিত। আমাদের সমাজে অনেকে আছেন যারা নিজেদের পরোপকারী বলে দাবী করেন অথচ কারো উপকার করেন না। তারা ধন-সম্পদের ভারে বৈচিত্র্যময় জীবনের কথা ভুলে যান। পরোপকারী মনোভাব হারিয়ে ফেলেন। ঘটে যাওয়া বিপদের কথা ভুলে গিয়ে অকৃতজ্ঞতার পরিচয় দেন। তাদের সচেতন হওয়া দরকার যে, বিপদ যেকোনো সময় আসতে পারে।
শিক্ষা: মানুষের জীবন বড় বিচিত্র। ক্ষুদ্র এক জীবনে মানুষ নানা পরীক্ষায় পড়ে নানা অভিজ্ঞতা অর্জন করে। বৈচিত্র্যময় জীবনে বিপদ থেকে পরিত্রাণের অভিজ্ঞতা মানুষের ভোলা উচিত নয়।
কত বড় আমি, কহে নকল হীরাটি। তাইত সন্দেহ করি, নহ ঠিক খাঁটি।
নিজের আসল পরিচয় গোপন করে মিথ্যা পরিচয় দিলে জীবনের গৌরব বাড়ে না; বরং কমে। হীরা খুব দামি রত্ন। কিন্তু কৃত্রিম হীরার সেই মূল্য নেই। নকল হীরা যদি নিজেকে আসল হীরার চেয়ে বড় মনে করে তবে তা মিথ্যা অহংকার করা ছাড়া কিছু নয়। আর মিথ্যা অহংকার করে নিজেকে বড় প্রমাণ করা যায় না। খাঁটি হীরার গুণ আপনা-আপনিই প্রকাশ পায়। ভন্ড, কাপুরুষ অহংকারী ব্যক্তিরাই নিজেদের গুণ প্রচার করে বেড়ায়। কিন্তু মিথ্যা কখনোই গেপন থাকে না। একসময় তাদের ভন্ডামি প্রকাশ পেলে তারা ছোট মানুষ হিসেবে সমাজে গণ্য হয়। গুণী লোক ঢাক-ঢোল পিটিয়ে বা অন্যকে জানিয়ে নিজের গুণ প্রচার করে না। একমাত্র মিথ্যা অহংকারী নির্বোধ ব্যক্তিরাই নিজেদের আসল পরিচয় গোপন করে নিজেদের বড় বলে প্রচার করতে চায়। আচরণের মাধ্যমেই মানুষের চারিত্রিক গুণাবলীর প্রকাশ ঘটে। মিথ্যাচার করে নিজেকে বড় বলে জাহির করে বেড়ালে বড় হওয়া যায় না। পরবর্তীতে তাদের চরিত্রের আসল রূপ ঠিকই ধরা পড়ে। মহৎ ব্যক্তিরা নিজেদের মেধা ও গুণের ব্যাপারে কখনোই প্রচারণার দ্বারস্ত হননি। সংকীর্ণমনা, হীন চরিত্রের ব্যক্তিরাই নিজেদের সামান্য যোগ্যতা নিয়ে গর্ব প্রকাশ করে, যা প্রকৃতপক্ষে হাস্যকর ও উপহাসমূলক হয়ে থাকে।
শিক্ষা: মিথ্যা দিয়ে সত্য গোপন করা যায় না। আর তা করাটা বোকামি। মানুষের মহত্ত্ব তার কাজের মাধ্যমে প্রকাশ পায়। হীনপ্রাণ ব্যক্তিরা নিজের নীচ পরিচয় গোপন করার জন্যই মিথ্যার আশ্রয় নেয়, অযথা অহংকার করে। ভাল-মন্দের দিক সহজেই সাধারণের চোখে ধরা পড়ে।
কর্তব্যের কাছে ভাই বন্ধু কেহই নাই।
কর্তব্য বলতে আমরা সাধারণত বুঝি এমন কাজকে, যে কাজ শত বাঁধা-বিপত্তি সত্ত্বেও সম্পাদন করতে হয়। জীবন চলার পথে প্রতিটা মানুষ অবিরাম কাজের মাঝে ডুবে থাকে। দৈনন্দিন জীবনে কাজের যে বিরাট অংশ আমাদের ব্যস্ত রাখে সেই কাজই মানবজীবনকে পূর্ণতা দান করেছে। কর্মমুখর জীবনের মতো পরিপূর্ণ জীবন আর কিছু হতে পারে না। সভ্যতার সূচনালগ্ন থেকেই মানুষ পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের কিছু আবশ্যকীয় কাজ করে আসছে। এই ধরণের কাজকে আমরা কর্তব্য হিসেবে আখ্যা দিয়ে থাকি। কারণ মানুষ চাইলেও এমন কাজ করা থেকে নিজেকে বিরত রাখতে পারে না। শত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও আমরা আমাদের কাজগুলোকে সুন্দরভাবে শেষ করে থাকি। কর্তব্যে অবহেলা করে মানুষ কখনোই উন্নতির স্বর্ণ শিখরে আরোহন করতে পারে না। যেকোনো কর্তব্য সঠিকভাবে সম্পাদনের ক্ষেত্রে স্বজনপ্রিয়তা ও পক্ষপাতদুষ্টতা সম্পূর্ণরূপে পরিহার করতে হবে। যুদ্ধক্ষেত্রে সেনাপতি যদি তার কর্তব্য ভুলে যায় তাহলে পরাজয় সুনিশ্চিত। তেমনি মানব জীবনেও কেউ যদি নিজ কর্তব্য ভুলে যায় সেও জীবন যুদ্ধে পরাজিত সৈনিক। সচেতন মানুষ কখনোই নিজ কর্তব্যের ব্যাপারে উদাসীন থাকে না। তারা কর্তব্যের ব্যাপারে থাকে আপোষহীন। আর এ কারণেই কর্তব্যপরায়ণ প্রতিটি মানুষ সমাজের দর্পণ হিসেবে বিবেচিত হয়। কারণ বুদ্ধিমান, বিবেকবান মানুষ মাত্রই কর্তব্যপরায়ণ। তাদের কাছে কর্তব্যের সময় ভাই বন্ধু থাকে না। ক্রমান্বয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা মূলত এই কর্তব্যপরায়ণতা। দায়িত্বে অবহেলাকারী যেমন নিজে ক্ষতিগ্রস্ত হয় তেমনি সমাজ ও দেশকেও ক্ষতিগ্রস্ত করে। পৃথিবীতে যত সফল মানুষ রয়েছে তাদের সফলতার মূলে রয়েছে কাজে একনিষ্ঠতা ও কর্তব্যপরায়ণতা। যারা কর্তব্যপরায়ন তারা স্বজনদের মুখের দিকে না তাকিয়ে কর্তব্যকেই বড় করে দেখে।
শিক্ষা: সময় এবং স্রোত যেমন বাঁধা মানে না, তেমনি কর্তব্যও ভাই বন্ধু মেনে চলে না। সফলতার মূল চালিকা শক্তি হলো কাজে একনিষ্ঠতা, আর কাজের প্রতি একাগ্রতাই মানুষকে কর্তব্যপরায়ণ হতে সাহায্য করে।
করিতে পারি না কাজ সদা ভয় সদা লাজ। সংশয়ে সংকল্প সদা টলে পাছে লোকে কিছু বলে।
মানুষ জন্ম থেকেই কিছু কিছু বৈশিষ্ট্য নিয়ে পৃথিবীতে আসে। প্রতিটি মানুষই স্বতন্ত্র বৈশিষ্ঠের অধিকারী। ভয় ও লজ্জা তেমনি মানুষের দুটি স্বভাবজাত বিষয়। ভয় এবং লজ্জা নেই এমন কোনো মানুষ বিশ্ব সংসারে খুঁজে পাওয়া যাবে না। তাই বলে ভয় এবং লজ্জার জন্য নিজের কর্মস্পৃহাকে অবহেলা করা ঠিক নয়। সৃষ্টিকর্তা আমাদের জ্ঞান-বুদ্ধি দিয়েছেন কর্মময় জীবন-যাপন করার জন্য। মানুষ নিজের কর্মের দ্বারাই জগতে কীর্তিমান হয়। কর্মহীন মানুষ সমাজের অলস এবং অথর্ব হিসেবে পরিচিত। কাজকে যারা ভয় পায় তারা কখনোই সমাজে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। জগতের কোনো কাজই ছোট নয়। কাজকে যারা ছোট করে দেখে তারা ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হয়। সভ্যতা বিনির্মাণে কর্মঠ মানুষের অবদান অনেক। তাদের অক্লান্ত পরিশ্রম আর সীমাহীন ধৈর্যের বিনিময়ে সভ্যতার শুভ সূচনা হয়েছিল। আজ সেই সভ্যতা আলোকিত হয়েছে মানুষের কর্মমুখরতার কারণে। কোনো গন্তব্যে পৌঁছাতে হলে যেমন লক্ষ্য স্থির করতে হয়, তেমনি কোনো কাজ বাস্তবায়ন করতে প্রয়োজন দৃঢ় সংকল্প। লক্ষ্য স্থির না করে যেমন কিছু করা যায় না তেমনি, সংকল্প না থাকলে সফল হওয়া যায় না। মানুষের কাজের জন্য যেমন প্রশংসা জোটে তেমনি সমালোচনাও হয়। তাই বলে সমালোচনার ভয়ে কাজ থেকে বিরত হওয়া কিংবা সংকল্প থেকে দূরে সরে আসা ঠিক নয়। বুদ্ধিমান এবং সাহসী মানুষ সর্বদাই ভয় এবং সমালোচনাকে তুচ্ছ করে স্বীয় কাজে কীর্তিমান হয়। জগতের যত বড় বড় অভিযান সফলতার মুখ দেখেছে তার পিছনে ছিল দৃঢ় সংকল্প এবং সাহসী পরিকল্পনা। কর্মে সফল হওয়ার জন্য যেমন জড়তা ঝেড়ে ফেলতে হবে তেমনি দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ হতে হবে।
শিক্ষা: ভয় কে জয় না করতে পারলে কর্ম সম্পাদন সম্ভব হয় না। দৃঢ় সংকল্প না থাকলে মানুষের সমালোচনার ঝড় সামাল দিয়ে লক্ষ্যে পৌঁছানো যায় না। বুদ্ধিমান মানুষ মাত্রই কর্মঠ এবং প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়।
কাক কোকিলের এক বর্ণ, স্বরে কিন্তু ভিন্ন ভিন্ন।
কাক ও কোকিল দেখতে একই রকম। উভয়ের গায়ের বর্ণ কালো। কিন্তু পাখি দুটি আমাদের কাছে সমানভাবে সমাদৃত হয় না। কণ্ঠস্বরের কারণে তাদের মান আলাদা। কোকিলের কণ্ঠস্বর অত্যন্ত সুমধুর। কোকিল তার গানে মানুষের মন আনন্দে ভরিয়ে দেয়। অন্যদিকে কাক মানুষের কাছে অত্যন্ত অপ্রিয় একটি পাখি। কাকের কণ্ঠস্বর খুবই কর্কশ। কাকের ডাকাডাকিতে মানুষ বিরক্ত হয়। অনুরূপভাবে আমাদের সমাজেও অনেক মানুষ দেখা যায় যারা শুধু দৈহিক বৈশিষ্ট্যের কারণেই মানুষ। তাদের ভেতরটা মানুষ হয়ে উঠতে পারেনি। তাদের মনটা থেকে গেছে পশুর মতো। ত্যাগ, পরোপকার মহত্ত্ব প্রভৃতি মানবীয় গুণাবলীর সাথে তারা পরিচিত নয়। নিজেদের স্বার্থ চরিতার্থ করাই এদের মূল উদ্দেশ্য। এরা সমাজ ও জাতির কোনো উপকারেই আসে না। ফলে সমাজের কাছে এদের মান, মর্যাদা ও গ্রহণযোগ্যতা নেই। সমাজ সবসময় এদের হীন দৃষ্টিতে দেখে। পক্ষান্তরে আমাদের সমাজে এমন মানুষও আছে যাদের অন্তর ত্যাগের মহিমায় উদ্ভাসিত। তাদের দৈহিক বৈশিষ্ট্যকে ছাপিয়ে প্রকাশিত হয় তাদের মনুষ্যত্ব। মানবজাতির বৃহৎ কল্যাণের কাছে তারা জলাঞ্জলি দেয় নিজেদের ক্ষুদ্র স্বার্থ। লোভ-লালসা তাদের স্পর্শ করতে পারে না। সমাজে এসব মানুষদের স্থান তাই সবার উপরে। মৃত্যুর পরও তারা তাদের কর্মের মধ্য দিয়ে অম্লান থাকে মানুষের মনে।
শিক্ষা: বাহ্যিক চেহারা ও গুণাবলী পরিমাপের মাপকাঠি নয়। মানুষ হিসাবে জন্ম নিলেই প্রকৃত মানুষ হওয়া যায় না। উৎকৃষ্ট কর্মের মাধ্যমে ‘মানুষ’ পরিচয় অর্জন করে নিতে হয়।
কাঁটা হেরি ক্ষান্ত কেন কমল তুলিতে দুঃখ বিনা সুখ লাভ হয় কি মহিতে?
পদ্মকে তুলতে গিয়ে কাঁটার ভয় করলে চলবে না। কাঁটার ভয়ে বা কাঁটার আঘাতে যদি কেউ পদ্ম তুলতে না যায়, তাহলে তার পক্ষে পদ্ম আহরণ সম্ভব হবে না। তেমনি দুঃখকে বাদ দিয়ে জীবনে সুখের আশা করা যায় না। একটিকে চাইতে গেলে অপরটিকে মেনে নিতে হয়। ভাল-মন্দ, সুখ-দুঃখ জয়-পরাজয় ইত্যাদি নিয়েই আমাদের জীবন। একটি অপরটির পরিপূরক হিসেবে কাজ করে। দুঃখকে বাদ দিলে জীবনে সুখের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যায়। দুঃখের মধ্য দিয়েই জীবনে সুখের আস্বাদ লাভ করা যায়। দুঃখের ভয়ে যে তার নিজ কর্ম থেকে বিরত থাকে তার পক্ষে সুখ লাভ করা সম্ভব নয়। সফলতার পথ কণ্টকাকীর্ণ। এই কাঁটার ভয়ে যে সেই পথে হাঁটে না সে কখনো সফল হয় না। দুঃখ-যন্ত্রণা, পরিশ্রম, ত্যাগ-তিতিক্ষার মধ্য দিয়েই মানুষ তার গন্তব্যে পৌঁছায়। আর যারা দুঃখ-যন্ত্রণা, ক্লান্তির ভয়ে ভীত হয় তারা সহজেই ঝরে পড়ে সাফল্যের পথ থেকে। তাই সকল প্রতিকূলতাকে বরণ করেই মানুষকে সামনের দিকে অগ্রসর হতে হবে। পৃথিবীতে যাঁরা বড় হয়েছেন, সাধনায় সিদ্ধি লাভ করেছেন তাঁরা সবাই সাধনার দ্বারা দুঃখ-কষ্ট, বাধা-বিঘ্নকে অতিক্রম করেই হয়েছেন। পরাজয়ের গ্লানি, পরিশ্রমের কষ্টকে জয় করার মাধ্যমেই সফলতা অর্জন করা সম্ভব। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যথার্থই বলেছেন- “ব্যর্থতাই মানুষের জীবনের প্রথম সাফল্য।”
শিক্ষা: জীবন চলার পথে বাধা বিঘ্নকে ভয় করে পিছিয়ে পড়লে জীবনে সফলতা অর্জন করা যায় না। জীবনকে সাফল্যমন্ডিত করতে হলে সকল দুঃখ-কষ্ট, বাধা-বিঘ্ন জয় করে আমাদের সামনে এগিয়ে যেতে হবে। কারণ কষ্টের মাধ্যমে অর্জিত সুখ দীর্ঘস্থায়ী হয়।
গতিই জীবন, স্থিতিতে মৃত্যু।
এ বিশ্বজগত স্থিতিশীল নয়। অনন্তকাল ধরে এটি তার আপন নিয়মে চলছে। যেদিন এর ব্যত্যয় ঘটবে সেদিন মহাপ্রলয় সংগঠিত হবে। এ বিশ্বজগতের মতো মানুষের জীবনও চলমান। এই চলমান জীবনে বেঁচে থাকতে হলে মানুষকে প্রতি পদে পদে সংগ্রাম করতে হয়। কঠোর পরিশ্রম ও সংগ্রাম মানুষকে সাফল্যের স্বর্ণ শিখরে পৌছে দেয়। নদী যখন বয়ে চলে তখন তার বুকে ময়লা আবর্জনা জমে না। কিন্তু যদি নদীর গতি রোধ করা হয় তাহলে নদীটি ছোট হয়ে যেতে থাকে। এবং এক সময় এটি বিলীন হয়ে যায়। বিবর্তনবাদের জনক বিজ্ঞানী চার্লস ডারউইন বলেছেন- “প্রকৃতির জগতে যে অধিকতর যোগ্য সেই টিকে থাকবে।” অর্থাৎ সকল বাধা বিপত্তিকে পেছনে ফেলে সামনের দিকে যারা এগিয়ে যেতে পারে তারাই প্রকৃত পরিশ্রমী। তাদের হাতেই রয়েছে সাফল্যের চাবিকাঠি। আর যারা অলস, কর্মহীন তারা জড় পদার্থের মতো। এরা সমাজ সভ্যতার কোনো উপকারতো করেই না বরং গতিশীল জীবনকে ব্যাহত করে। কর্মহীন জীবন মৃত্যুরই নামান্তর। সুতরাং গতিশীলতা ছাড়া মানবজীবন যথার্থ পরিচয় বহন করে না। গতিশীলতাই মানুষের সকল কর্মকে সফল করে তোলে। মৃত্যু অবধি মানুষ এই গতিশীলতাকে পুঁজি করে জীবন পরিচালনা করে এবং সাফল্য লাভ করে।
শিক্ষা: ব্যক্তিজীবন ও জাতীয় জীবন উভয় ক্ষেত্রেই উন্নতির চাবিকাঠি গতিময়তা। যে জাতি পরিশ্রমী সে জাতির উন্নতি অগ্রগতি কেউ রুখতে পারে না। তাই কর্মহীন জীবন কখনোই কাম্য হতে পারে না।
কালো আর ধলো বাহিরে কেবল, ভিতরে সবারই সমান রাঙা।
শ্রেণি বিন্যাসের উদ্ভব হয়েছে কিছু স্বার্থান্বেষী মানুষের প্রচেষ্টায়। অন্যকে অধিকার থেকে বঞ্চিত করে নিজেরা কিছু অধিক সুযোগ সুবিধা পাওয়ার একটি মোক্ষম উপায় হলো শ্রেণিবিন্যাস। বহু বছর ধরে আমরা পশ্চিমা বিশ্বে দেখছি, কৃষ্ণাঙ্গ এবং শ্বেতাঙ্গদের মধ্যকার বৈরী সম্পর্ক। কালোরা, সাদাদের দ্বারা নির্যাতিত, নিপীড়িত হয়ে আসছে দিনের পর দিন। সাদা চামড়ার মানুষেরা নিজেদের উৎকৃষ্ট মনে করে, আর কালো চামড়ার মানুষদের শোষণ করে আসছে। সাদা চামড়ার মানুষেরা ভিত্তিহীনভাবে সমাজে এই বৈষম্যের সৃষ্টি করেছে। সৃষ্টিকর্তা মানুষকে পরিমাপের কোনো পরিমাপক আমাদের দেননি। তিনি সকলকে একইভাবে সৃষ্টি করেছেন। উপরে যে যেমনই দেখতে হোক না কেন সকলের রক্তের রঙই লাল। রক্তের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। পার্থক্য আমাদের মনের ভিতর। এই বিভেদ আমাদের বা আমাদের সমাজের দ্বারাই সৃষ্ট। আশরাফ, আতরাফ আমরাই সৃষ্টি করেছি, আল্লাহ সৃষ্টি করেননি। ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র আমরাই সৃষ্টি করেছি, ভগবান সৃষ্টি করেননি। বিধাতার কাছে সবাই সমান। ছোট-বড়, সাদা-কালো, সব আমাদেরই তৈরি। এটা শুধুমাত্র, ছোটকে ছোট করে রাখা, গরীবের রক্ত চুষে ধনীর আরো ধনী হওয়া। দুর্বলকে কব্জা করে, সবলের আরো সবল হওয়ার একটা কৌশল মাত্র। এই কৌশলকে পুঁজি করে স্বার্থপর মানুষেরা অপরকে ঠকিয়ে নিজের স্বার্থ উদ্ধার করে চলেছে বহুকাল ধরে। আর এই অবিচারের স্বীকার হচ্ছে সমাজের তথাকথিত নিকৃষ্ট শ্রেণির অসহায় মানুষ। এই শ্রেণি বিভাগের অন্তরালে চলছে শোষণ আর অবিচারের খেলা।
শিক্ষা: ঈশ্বর সকলকে সমানভাবে সৃষ্টি করেছেন। সমাজের পার্থক্য আমাদেরই উদ্ভব। কতিপয় লোক এই সূত্র ধরে সুযোগের সদ্ব্যবহার করছে মাত্র। শারীরিক গঠন বা বর্ণের মাধ্যমে মানুষকে মূল্যায়ন করা উচিত নয়, মানবিক গুণাবলি দিয়ে মানুষকে বিচার করা উচিত।
কেরোসিন শিখা বলে মাটির প্রদীপে, ভাই বলে ডাক যদি দেব গলা টিপে, হেন কালে আকাশেতে উঠিলেন চাঁদা, কেরোসিন শিখা বলে- “এসো মোর দাদা।”
মানুষ ভেদে চরিত্রে পার্থক্য থাকলেও পৃথিবীর সব মানুষের চরিত্র কিছু বৈশিষ্ট্যে সাদৃশ্যপূর্ণ। মানব চরিত্রের তেমনি একটি বৈশিষ্ট্যকে কেরোসিন শিখার মাধ্যমে রূপায়ণ করা হয়েছে। অর্থ-বিত্ত, সামাজিক পদমর্যাদা ইত্যাদির স্বপ্নে বিভোর হয়ে কখনও কখনও নিজের অতি আপনজনকেও চিনতে পারে না। মানুষ যখন টাকা-পয়সা, পদমর্যাদা প্রভৃতি দিক থেকে সমাজে উচ্চ অবস্থান অর্জন করে তখন সে তার আপন মানুষজন আত্মীয় স্বজনকে অবহেলা করে। অবহেলাই কোনো কোনো সময় অস্বীকারে রূপ নেয়। মানুষ যখন চিন্তা করে তার দরিদ্র আত্মীয়-স্বজনদের সাথে সম্পর্ক রাখলে তার পদমর্যাদা নষ্ট হতে পারে তখন তার দরিদ্র আপনজনদের আর স্বীকৃতি দিতে চায় না। অথচ এই মানুষটিই আবার তার চেয়ে উচ্চ পদস্থ কারও তোষামোদ করতেও দ্বিধাবোধ করে না। সেই উচ্চমর্যাদা সম্পন্ন ব্যক্তির সাথে সত্যিকার অর্থে কোনো সম্পর্ক না থাকলেও সে কাল্পনিক সম্পর্ক তৈরি করেই তা সবাইকে জানাতে চায়। সে মনে করে এতে সে সামাজিকভাবে আরও মর্যাদা পাবে, এবং অন্যরা তাকে আরও সমাদর করবে। এভাবে সে নিজেকে প্রচার করে গর্ববোধ করে। যেখানে নিজের দরিদ্র আত্মীয়-স্বজনদের যে স্বীকার করতেও কুন্ঠাবোধ করে সেখানে দূরের একজন উচ্চ-পদস্থ ব্যক্তির সাথে সে জোর করে কাল্পনিক সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টায় ব্যস্ত থাকে। মূলত মানুষ নিজের চেয়ে অবস্থানে ছোটদের চরমভাবে অস্বীকার করে, আর বড়দের তোষামদ করে আপন করে নিতে চায়।
শিক্ষা: পদমর্যাদা ও সামাজিক অবস্থান মানুষকে অন্ধ করে দেয়। এর প্রলোভনে মানুষ নিজের আপন মানুষকে দূরে ঠেলে দিয়ে, দূরের মানুষকে আপন করার চেষ্টা করে। এতে করে সে তার নিজস্বতাকে হারিয়ে ফেলে, কিছুই অর্জন করতে পারে না।
কোথায় স্বর্গ, কোথায় নরক, কে বলে তা বহুদূর মানুষের মাঝে স্বর্গ নরক, মানুষেতে সুরাসুর।
মানুষ পার্থিব জগতের বাইরেও মৃত্যুর পরে এক নতুন জগৎ কল্পনা করে। যা স্বর্গ ও নরকের সমন্বয়ে গঠিত। ধর্মীয় চিন্তা থেকে মানুষ পাপ-পুণ্য, ন্যায়-অন্যায়ের হিসাব করে থাকে। আর এই অনুভূতি থেকেই স্বর্গ ও নরক লাভের কথা ভাবে। নরক একটি ভয়ংকর জায়গা যেখানে শাস্তি দেয়া হয়। আর স্বর্গ হচ্ছে অনাবিল সুখ-শান্তির জায়গা। মানুষ পৃথিবীতে কৃতকর্ম অনুসারে স্বর্গ ও নরকে জায়গা করে নিবে। যারা ভালো কাজ করবে তারা স্বর্গে বাস করবে। আর যারা খারাপ কাজ করবে তারা নরকে বাস করবে। মূলত এই স্বর্গ-নরক আর কিছুই নয়, এটা মানুষের কর্মফলের উপর নির্ভর করে। মানুষের প্রতিদিনকার কাজের মাঝেই স্বর্গ-নরক বিরাজমান। লোভ-লালসা, ঝগড়া-বিবাদ, হিংসা মানুষকে পশুতে পরিণত করে। ফলে সে ন্যায় অন্যায়ের সীমারেখা ভুলে যায়। নিজেকে নানা রকম খারাপ কাজে জড়িয়ে ফেলে। আর এসব কারণেই সমাজে বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়। পৃথিবীতে নেমে আসে এক নরক যন্ত্রণা। এ সকল যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে মানুষকে অন্যায় ছেড়ে ন্যায়ের পথে আসতে হবে। মানুষে মানুষে ভ্রাতৃত্ব, ভালোবাসা, সৌহার্দ্য গড়ে তুলতে হবে। একে অন্যের বিপদে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে হবে। অন্যের কল্যাণ সাধনের জন্য সর্বদা চেষ্টা করতে হবে। এমন কোনো কাজ করা যাবে না যাতে অন্যের ক্ষতি হয়। সকলে যদি সৎ ও ন্যায়ের পথ অবলম্বন করে, তাহলেই কেবল এ পৃথিবীতে স্বর্গীয় সুখ লাভ করা সম্ভব।
শিক্ষা: স্বর্গ ও নরক পৃথিবীর বাইরের কিছু নয়। মানুষের ভালো কাজ এবং আচরণের মাঝেই স্বর্গ থাকে এবং খারাপ কাজের মাঝে থাকে নরক।
কৃষ্ণ বলিয়া যারে তুমি আজি কর হীন অপমান রুধির তাহারো নহেত কৃষ্ণ- বহে সে-ও একই প্রাণ।
কালো-সাদা সবাই স্রষ্টার সৃষ্টি। কালো ও সাদা হওয়ার পেছনে কারও হাত নেই। তা হয় স্রষ্টার ইচ্ছায়। তাই তাদের অবহেলা অপমান করার নির্বোধের কাজ। একটা সময় ছিল, যখন কৃষ্ণাঙ্গদের সঙ্গে পশুর মতো আচরণ করা হত। তাদের ভোটাধিকার ছিল না, উচ্চ মর্যাদার চাকরি করতে পারত না, উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে পারত না, সাদাদের সাথে একই টেবিলে বসতে পারত না। কিন্তু আধুনিক সমাজে কালো চামড়া মানুষ ও সাদা চামড়ার মানুষ বলে কাউকে বৈষম্য করা হয় না। কৃষ্ণাঙ্গরাও এখন পৃথিবীর শীর্ষ মর্যাদার পদে অধিষ্ঠিত হয়েছে। তার উজ্জ্বল উদাহরণ হলো যুক্তরাষ্ট্রের কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট বারাক হোসেন ওবামা, জাতিসংঘের সাবকে মহাসচিব কফি আনান। এছাড়া নেলসন মান্ডেলা, মার্টিন লুথার কিং, মাইকেল জ্যাকসন প্রমুখ কালো হলেও পৃথিবীর উচ্চ মর্যাদার আসন লাভ করেছেন। তাই কালো মানুষদের অবহেলা অপমান করা অযৌক্তিক। তাদের রক্ত, অস্তি-মজ্জা যেরকম, সাদা মানুষেরও ঠিক একইরকম। প্রতিটি মানুষকে যাচাই করা দরকার তার কর্ম দিয়ে। যারা মহৎ কর্ম সম্পাদন করেন, তারা সাদা না কালো সেটা মুখ্য বিষয় নয়। মূলত সাদা এবং কালো প্রত্যেকের শরীরে একই রক্তধারা বয়ে চলেছে। একই প্রাণের ধারা উভয়ের মাঝে বিরাজমান।
শিক্ষা: ধনী-গরিব, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, সাদা-কালো, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, ইত্যাদির মাধ্যমে মানুষের মধ্যে বৈষম্য করা উচিত নয়। প্রতিটি মানুষই স্রষ্টার সৃষ্টি, তাদের অবহেলা অপমান করা-স্রষ্টাকে অপমান করার শামিল।
ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বালুকণা, বিন্দু বিন্দু জল গড়ে তোলে মহাদেশ সাগর অতল।
আপাত দৃষ্টিতে একটি ক্ষুদ্র বালুকণা কিংবা এক বিন্দু জলকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হয় না। কারণ এর উপযোগিতা সামান্যই। কিন্তু এমন অজস্র বিন্দু বিন্দু জলই মহাসাগর সৃষ্টি করে। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বালুকণাই গড়ে তোলে বিশ্বসভ্যতা। মৌমাছির ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সঞ্চয়ের ফল বৃহৎ মৌচাক। তেমনি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মহৎ উদ্যোগই এনে দেয় জীবনের চুরান্ত সার্থকতা। তাই ক্ষুদ্র বলে কোনো বিষয়কেই অবহেলা করা উচিত নয়। সকল ছোট কাজই বড় কাজের প্রেরণা। সেটি ভালো কাজই হোক কিংবা মন্দ কাজ। একটি শিশুর মিথ্যা বলার অভ্যাস তার ভবিষ্যৎ জীবনকে অন্ধকারে পরিণত করতে পারে। ভবিষ্যতে মিথ্যার রূপটি আরো বৃহৎ হয়ে তার নিজের ও সমাজের ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। শিশুটি যদি ছোটবেলা থেকেই সত্য বলার অভ্যাস গড়ে তোলে তাহলে তার জীবন সুন্দর হয়ে উঠবে। তাই ছোট ছোট মন্দ কাজকে অবজ্ঞা না করে তা যথা সময়ে শোধরাতে হবে। আর ভালো কাজ যতই ক্ষুদ্র হোক তাকে অনুপ্রেরণা দিতে হবে। ছাত্রজীবনের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সফলতা একসময় মানুষকে বড় হতে সহায়তা করে। সেসময়ের ক্ষুদ্র একটি পরিকল্পনাই বদলে দিতে পারে বিশ্ব সমাজের গোটা চেহারাকে। পৃথিবীতে যারা স্মরণীয়-বরণীয় হয়ে আছেন তাদের জীবনী পর্যালোচনা করলে দেখা যায় তাদেরও সফলতার মূলে রয়েছে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রয়াস। তাই পৃথিবীর কোনো ক্ষুদ্র বিষয়ই আসলে ক্ষুদ্র নয়। ক্ষুদ্র থেকে বৃহৎ এর সৃষ্টি।
শিক্ষা: ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিষয়ে মনোযোগী হলে জীবন বৃহত্তর ব্যঞ্জনায় সার্থকতা লাভ করে। তাই ক্ষুদ্রকে তুচ্ছ জ্ঞান না করে বরং সেটি পরিচর্যার মাধ্যমে জীবনের সাফল্যকে ছিনিয়ে আনতে হবে।
ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময় পূর্ণিমার চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি।
মানুষ সৌন্দর্যপিয়াসী। তার এই সৌন্দর্যতৃষ্ণা জন্মগত। স্বীয় মননশীলতায় সুন্দরের আবিষ্কার করে মানুষ। জীবনধারণের জন্য প্রথম ও প্রধান জৈব উপাদান হলো খাদ্য। খাদ্যের অভাব মানুষের সুকুমারবৃত্তি চর্চার সূক্ষ্মবোধকে নষ্ট করে ফেলে। ক্ষুধার যন্ত্রণা মানুষের মননশীলতার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা। সভ্যতার সৃষ্টিলগ্ন থেকেই ক্ষুধা নিবৃত্তির জন্য নিরন্তর সংগ্রাম করে চলেছে মানুষ। কখনও প্রকৃতির সাথে কখনও মানুষের সাথে। অন্নসংস্থানসহ বস্ত্র ও বাসস্থানের মতো অন্যান্য প্রাথমিক চাহিদা পূরণের পর মানুষ সৌন্দর্য চর্চার অবকাশ পায়। মন তার প্রস্তুত হয় পৃথিবীর আশ্চার্য রূপ আস্বাদনের। তখন প্রকৃতির রূপ-রস তার কাছে প্রকাশিত হয় অধিকতর মনোমুগ্ধকর রূপে। তখন পূর্ণিমার চাঁদ হয়ে ওঠে প্রেম আর সৌন্দর্যের আধার। পৃথিবীটাকে মনে হয় অপরূপ সুন্দরের লীলাভূমি। কিন্তু যখন শুধু বেঁচে থাকাই হয়ে ওঠে শেষকথা; শুধুমাত্র জীবনধারণের জন্য অন্ন সংগ্রহই হয়ে পড়ে একমাত্র তাড়না তখন মানুষের সৌন্দর্যবোধ হয়ে পড়ে নিষ্ক্রিয়। ক্ষুধার অসহ্য যন্ত্রণায় লোপ পায় সুন্দরকে উপলব্ধি করার ক্ষমতা। তার সমস্ত চেতনা আচ্ছন্ন হয়ে থাকে অন্নচিন্তায়। সে হারিয়ে ফেলে সুন্দর ও অসুন্দরের মাঝে পার্থক্য করার বিচারবোধ। অপূর্ব এই পৃথিবীটাকে তার কাছে গদ্যের মতো রসহীন কঠোর মনে হয়। চারপাশের পরিবেশ হয়ে ওঠে অসহ্য-যন্ত্রণাময়। পূর্ণিমার জলজলে চাঁদকে মনে হয়ে অভুক্তের খাদ্যদ্রব্য- বহু কাঙ্ক্ষিত এক টুকরো ঝলসানো রুটি। বর্তমানে ভোগবাদী ধনতান্ত্রিক সভ্যতা বিপুল সংখ্যক মানুষের মুখ থেকে কেড়ে নিয়েছে ক্ষুধার অন্ন। পৃথিবীর বেশি সংখ্যক মানুষের জীবন ক্ষুধার নির্মম আঘাতে দুর্বিষহ; যেখানে অতি অল্প সংখ্যক কিছু মানুষের হাতে জিম্মি হয়ে আছে এই বিপুল অংশের মানুষের খাদ্য। তাদের নিকট পূর্ণিমার চাঁদ কোনো সুন্দরের বার্তা বহন করে না।
শিক্ষা: ক্ষুধার যন্ত্রণা সবচেয়ে বড় যন্ত্রণা। জীবন সংগ্রামে পর্যুদস্ত ক্ষুধার্ত মানুষের কাছে পৃথিবী কাব্যের মতো কোনো স্বপ্নময় আশ্রয় নয়। বরং গদ্যের মতো রসকষহীন ও একঘেঁয়ে।
গ্রন্থগত বিদ্যা আর পর হস্তে ধন নহে বিদ্যা, নহে ধন হলে প্রয়োজন।
মানুষের জ্ঞানের ধারক ও বাহক হচ্ছে গ্রন্থ। গ্রন্থ পাঠ করে মানুষ তার জ্ঞানের পরিধি বিস্তৃত করে, বুদ্ধিবৃত্তির বিকাশ ঘটায়। নিজের ও অন্যের প্রয়োজনে সেই বিদ্যাকে কাজে লাগায়। বিদ্যার আলোকে জগৎকে উদ্ভাসিত করে। শাশ্বত সত্য-সুন্দরের পথ নির্দেশ করে। কিন্তু বিদ্যা যদি কেবল গ্রন্থগতই হয় তবে তা কোনো কাজেই লাগে না। গ্রন্থগত বা পুঁথিগত বিদ্যা মানুষকে যথার্থ জ্ঞানী করে তুলতে পারে না। বিদ্যাকে জীবনের উপযোগী করে তোলার মধ্যেই এর যথার্থ উদ্দেশ্য নিহিত। কাজেই তত্ত্বীয় জ্ঞান অর্জনের সঙ্গে সঙ্গে ব্যবহারিক জ্ঞানও থাকা দরকার। বিদ্যা অর্জন করে তাকে কাজে লাগাতে হবে। কেবল মুখস্থ করে লেখাপড়া করলে তা প্রয়োজন মতো ব্যবহার করা যায় না। যে জ্ঞান ব্যবহারিক জীবনে কোনো কাজে আসে না সে জ্ঞান দ্বারা নিজেরও যেমন কোনো উপকার হয় না তেমনি জগতেরও কোনো কল্যাণসাধন হয় না। আর যে বিদ্যা প্রয়োজনের সময় কাজে ব্যবহার করা যায় না প্রকৃতপক্ষে সে বিদ্যার কোনো মূল্য নেই। তেমনি মানুষের জীবনে ধন-সম্পদেরও প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। এ ধন-সম্পদ অর্জনের জন্য প্রয়োজন হয় কঠোর পরিশ্রম। পরের ধন-সম্পদকে নিজের মনে করা কিংবা নিজের ধন-সম্পদ অন্যের কাছে জমা রেখে নিজের বলে হিসাব করা চরম বোকামি। কারণ অন্যের নিকট জমা রাখা ধনসম্পত্তি প্রয়োজনের সময় কাজে লাগানো সম্ভব হয় না। সুতরাং সার্থক ও সুন্দর জীবনের জন্যে বিদ্যাকে যেমন আত্মস্থ করতে হবে, ঠিক তেমনি ধন-সম্পদ অন্যের কাছে অহেতুক গচ্ছিত না রেখে নিজের আয়ত্তে রাখতে হবে। যাতে বৃহত্তর মানবকল্যাণে তা কাজে লাগানো যায় তথা দেশ ও দশের মঙ্গলে ব্যবহার করা যায়।
শিক্ষা: গ্রন্থগত বিদ্যা আর অন্যের আয়ত্বে থাকা ধন কোনো প্রয়োজনে আসে না। মানুষের প্রয়োজনে ব্যবহৃত হওয়ার মধ্য দিয়েই এসবের সার্থকতা।
গাইতে গাইতে গায়েন আর বাজাতে বাজাতে বায়েন।
মানবজীবন কর্মময়। কর্মক্ষেত্রে শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ মেলে তার কর্মকুশলতার ও সফলতার মধ্যে। কিন্তু কর্মক্ষেত্রে সর্বদাই সফলতা আসে না। ব্যর্থতাও মানবজীবনের একটি অংশ। কোনো কাজে ব্যর্থ হয়ে নিশ্চল ও নির্জীব হয়ে কর্মপ্রচেষ্টা ও মনোবল হারানো ঠিক নয়। অসীম সাহস ও কর্মোদ্যম নিয়ে একনিষ্ঠ সাধনার দ্বারা সামনে এগিয়ে যেতে হয়। তাহলে জীবনের কোনো বাঁধাই কখনো টিকতে পারবে না। আর তাই জীবনে সাফল্য ও দক্ষতা অর্জনের জন্য চাই অনুশীলন। একজন সঙ্গীত শিল্পী তার দীর্ঘ, নিরলস কণ্ঠ সাধনা বা সঙ্গীত সাধনার মাধ্যমে মানুষের ভাবাবেগ স্পর্শ করতে সমর্থ হয়। মানুষের কাছে খ্যাতনামা সঙ্গীতশিল্পী হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। মানুষ তাঁকে আর তার গানকে চিরদিন মনে রাখে। তেমনি একজন খ্যাতিমান বাদ্যযন্ত্রশিল্পী তাঁর বাদ্যযন্ত্রের বাজনার ঝংকার তুলে মানব মনে আলোড়ন সৃষ্টি করে। বাজনার দ্বারা মানব হৃদয়কে আনন্দিত ও খুশি করতে তাকে বারবার বাদ্যযন্ত্র বাজানোর অনুশীলন করতে হয়। তাই কোনো কাজ সুষ্ঠু ও সুচারুরূপে সম্পন্ন করে মানব হৃদয়ে স্থান পেতে একনিষ্ট সাধনা ও অনুশীলন প্রয়োজন। জীবন সংসারে প্রতিটি ক্ষেত্রে মহত্ত্ব, খ্যাতি ও সাফল্য লাভের পূর্বশর্তই হলো অনুশীলন। এর বিকল্প কোনো কিছুই নেই। নিবিড় চর্চা ও অনুশীলনের মাধ্যমেই একজন মানুষ নিজ কর্মক্ষেত্রে যথার্থতা ও পরিপূর্ণতা লাভ করে। পৃথিবীর মহান ব্যক্তিগণ তাঁদের জীবনে পূর্ণতা প্রাপ্তির জন্য পুনঃঅনুশীলনকেই গুরুত্ব দিয়েছেন। কোনো কাজে ব্যর্থ হয়ে মনোবল হারানো ঠিক নয়। কবি কালী প্রসন্ন ঘোষ বলেছেন- ‘একবার না পারিলে দেখ শতবার।’ তাই জীবনে মহত্ত্ব আর সাফল্য অর্জনের পথে ব্যর্থতার ধাক্কায় স্থবির হওয়া ঠিক নয়। আন্তরিক প্রচেষ্টা, কঠোর পরিশ্রম ও দৃঢ় মনোবলের সাথে বারবার অনুশীলন কাজকে নির্ভুল করে। কর্মক্ষেত্রে সাফল্য ও পরিপূর্ণতা আনে। সুন্দর ও সাফল্যমন্ডিত জীবনের জন্য সাধনা ও অনুশীলনের বিকল্প নেই।শিক্ষা: একনিষ্ঠ সাধনা ও বারবার অনুশীলনের মাধ্যমে মানবজীবনের কন্টকাকীর্ণ পথের সকল বাধাবিপত্তিকে অতিক্রম করে সাফল্যের স্বর্ণ শিখরে আরোহন সম্ভব।
গাহি সাম্যের গান মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নয় কিছু মহীয়ান।
‘সাম্য, মৈত্রী, স্বাধীনতা’ এই স্লোগানকে কেন্দ্র করে সংগঠিত হয়েছিল পৃথিবীর ইতিহাসের এক মহান বিপ্লব। যা ফরাসি বিপ্লব নামে পরিচিত। মানবতা আর মানুষের অধিকার রক্ষার এই বিপ্লবের কেন্দ্র বিন্দু ছিল মানুষ। স্বাধীনতা, ঐক্যবদ্ধতা আর সমতা মানুষকে দান করেছে স্বর্গীয় মহিমা। যে মহিমায় ভাস্বর পৃথিবীর প্রতিটি জনপদ। পবিত্র ধর্মগ্রন্থ সমূহে বর্ণিত তথ্য অনুযায়ী সকল সৃষ্টির মাঝে মানুষ শ্রেষ্ঠত্বের আসনে আসীন। মানুষের জ্ঞান তাকে করেছে বিকশিত, বুদ্ধির মাধ্যমে সে পেয়েছে স্বাতন্ত্র্য, আর চিন্তার ক্ষমতা মানুষকে করেছে পরিপূর্ণ। স্রষ্টার সৃষ্টি জীব হিসেবে প্রতিটি মানুষ পেয়েছে শ্রেষ্ঠত্বের মর্যাদা। কাজেই ধর্ম, বর্ণ, সম্পদায় বিবেচনায় কাউকে হেয় করার কোনো সুযোগ নেই। সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রতিটি মানুষ সমান মর্যাদার অধিকারী। সুতরাং মানুষ হিসেবে মানুষকে সম্মান করা মানব জীবনের অপরিহার্য অংশ। কারণ মানুষের চেয়ে বড় কিছুই নেই। আর মানুষ অপেক্ষা মহীয়ান কিছুই হতে পারে না। স্রষ্টা যেমন বিশেষ মর্যাদা দিয়ে মানুষকে সৃষ্টি করেছেন তেমনি সকল সৃষ্টির মাঝে মানুষকে করেছেন মহীয়ান। সুতরাং স্রষ্টার এই সৃষ্টিকে হেয় করে দেখা স্রষ্টাকে অবমাননার শামিল। সাম্য বা সমতাই হতে পারে সুখী, সমৃদ্ধ ও বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার অন্যতম হাতিয়ার। যে সমাজে সাম্যের বাণী ধ্বনিত হবে সম্মিলিত কন্ঠে।
শিক্ষা: মানুষকে সৃষ্টি করা হয়েছে শ্রেষ্ঠত্বের মর্যাদা দিয়ে, মহীয়ান করে পাঠানো হয়েছে পৃথিবীর বুকে। মহান সৃষ্টিকর্তার শৈল্পিক সত্ত্বার পরিচয় বহনকারী মানুষ তাই সবচেয়ে বড়। মানুষের মাঝে বৈষম্য থাকার কোনো সুযোগ নেই।
জ্ঞান যেখানে সীমাবদ্ধ, বুদ্ধি সেখানে আড়ষ্ঠ, মুক্তি সেখানে অসম্ভব।
অন্যান্য প্রাণীর সাথে মানুষের প্রধান পার্থক্য কেবল চিন্তা ও বুদ্ধিতে। আদিকাল থেকে মানুষ তার চিন্তাশক্তি ও বুদ্ধিবৃত্তিকে কাজে লাগিয়ে নানা প্রতিকূল পরিবেশ থেকে নিজেকে রক্ষা করে এসেছে। জ্ঞানচর্চার মাধ্যমে মানুষ বর্তমানে সভ্য জাতিতে পরিণত হয়েছে। নিজ বুদ্ধির মাধ্যমে মানুষ নানা যন্ত্রপাতি আবিষ্কারে সক্ষম হয়েছে। এতে দৈনন্দিন জীবনযাত্রা হয়েছে সহজ। যে মানুষ জ্ঞানচর্চা করে না, সমাজের নানা সংস্কার, সংকীর্ণতা ও সীমাবদ্ধতা এসে তাকে আঁকড়ে ধরে। তার জীবনে কোনো উন্নতিই হয় না। মানুষ হয়েও সে ভারবাহী জীব সাদৃশ্য জীবনযাপন করে। জ্ঞানহীন মানুষের কোনো মূল্য নেই। জ্ঞানচর্চা না করলে মানুষের বিবেক-বুদ্ধি জাগ্রত হতে পারে না। ফলে সে ঠিক বেঠিক, ন্যায়-অন্যায় অনুধাবন করতে পারে না। এরকম মানুষের দ্বারা যেকোনো অন্যায় কাজ করা স্বাভাবিক। একমাত্র জ্ঞানই মানুষকে প্রকৃত মুক্তি দিতে পারে। যে ব্যক্তি জ্ঞানতাপস সে তার বুদ্ধির পূর্ণ বিকাশ ঘটাতে পারে। তার নিজের দায়িত্ব ও কর্তব্যগুলো সম্পর্কে ধারণা লাভ করতে পারে। সে তার বুদ্ধি-বৃত্তির মাধ্যমে নিজের এবং আশপাশের মানুষের উন্নয়ন ঘটাতে পারে। জ্ঞানচর্চার গুরুত্ব ব্যক্তিজীবনে যেমন প্রয়োজন, তেমনি জাতীয় জীবনেও অত্যাবশ্যকীয়। জ্ঞানচর্চা একটি দেশ ও জাতিকে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে সাহায্য করে। সমাজ থেকে অন্যায়, অবিচার, কুসংস্কার মুছে দিয়ে ন্যায় ও সত্য প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা পালন করে। মুক্তবুদ্ধি চর্চা একটি দেশ ও জাতিকে পৃথিবীর বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর মতো ক্ষমতা দেয়। যে জাতির বুদ্ধির বিকাশ ঘটে না সে জাতি অন্ধকারে পড়ে থাকে। নানা অন্যায়, অবহেলা, কুসংস্কার তাদের ঘিরে ধরে। জ্ঞানহীন জাতির কোনো উন্নয়ন সম্ভব হয় না।
শিক্ষা: জ্ঞানের আলো মুক্তির পথ দেখায়। তাই অন্যায়-অবিচার, দুঃখ-দারিদ্র্য থেকে মুক্তির জন্য মানুষের জ্ঞানচর্চা করা উচিত।
জাতীয় অবিচার জাতীয় পতনের নিশ্চিত কারণ।
আইনের শাসনের অভাব জাতীয় অবিচারের মূল কারণ। আর জাতীয় অবিচার দেশ ও জাতিকে পতনের দিকে ঠেলে দেয়। সরকারের স্বেচ্ছাচারিতার ফলে জাতীয় অবিচার উদ্ভব হয়, যা ক্রমেই সকল পেশার মানুষের মধ্যে প্রবাহিত হয়। জাতীয় অবিচারে উৎসাহিত হয়ে বিভিন্ন পেশার মানুষও স্বেচ্ছাচারি হয়ে ওঠে। কেউ কোনো প্রকার অন্যায় করতে ভয় করে না। যে যার জায়গা থেকে কর্তব্যে অবহেলা করে। দুর্নীতিতে জর্জরিত হয় দেশ। জাতীয় অবিচারের ফলে অপরাধী বড় অপরাধের দিকে ধাবিত হয়। প্রতিটি মানুষ অপরাধের প্রতি উৎসাহিত হয়। রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব কলহ বেড়ে যায়। অর্থনৈতিক অবস্থা, শিক্ষার জগতের উন্নতি মুখ থুবড়ে পড়ে। খুন, অপহরণ, ধর্ষণ, নারী নির্যাতন, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি ইত্যাদি দিন দিন বাড়তে থাকে। মানুষের জীবনের কোনো নিরাপত্তা থাকে না। প্রতিটি মানুষের প্রতিটি মুহূর্ত কাটে আতঙ্কে। আইনের শাসন না থাকলে জনগণের সকল কার্যক্রমে তার খারাপ প্রভাব পড়ে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ও আদালত ক্ষমতার অপব্যবহার করা শুরু করে। ফলে দেশের সব ধরণের উন্নতি স্থবির হয়ে পড়ে। জোর যার মুল্লুক তার এর ভিত্তিতে দেশ পরিচালিত হয়। যার ফলে জাতির জীবনে পতন নেমে আসে। অন্ধকারে ঢাকা পড়ে দেশ ও জাতির ভবিষ্যৎ ।
শিক্ষা: দেশ ও জাতির উন্নতির জন্য ব্যক্তি ও সরকারের স্বেচ্ছাচারিতা রোধ করা প্রয়োজন। আইন শাসন প্রতিষ্ঠা করা অনিবার্য। তাহলে দেশ ও জাতি নিশ্চিত পতনের হাত থেকে রক্ষা পাবে।
জীবে প্রেম করে যেই জন, সেই জন সেবিছে ঈশ্বর।
মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব। চারপাশের জীব-জগৎ নিয়েই মানুষ জীবনযাপন করে। কেননা, সৃষ্টিকর্তা বহুরকম উপাদান দিয়ে পৃথিবীকে সাজিয়েছেন। প্রত্যেক জীবের সাথে অন্য জীবের কোনো না কোনোভাবে সম্পর্ক রয়েছে। জ্ঞান-বুদ্ধির অধিকারী মানুষও সেই সম্পর্ক বা বন্ধনে আবদ্ধ। যে সৃষ্টিকর্তা তাকে এই সুন্দর পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন মানুষের কর্তব্য তাঁর উপাসনা করা, তাঁকে খুশি করা। মানুষ তাঁকে খুশি করতে পারে উপাসনালয়ে প্রার্থনা করার মাধ্যমে এবং তাঁর সৃষ্টিকে ভালোবেসে সেবা করে। স্রষ্টার সৃষ্টিকে না ভালোবেসে, মসজিদ-মন্দিরে গিয়ে যদি আমরা সারা দিন রাত তাঁকে ডাকি তিনি খুশি হবেন না। কেননা, সৃষ্টিকর্তা সবকিছুই সৃষ্টি করেছেন পরম ভালোবেসে। ক্ষুদ্র থেকে বিশাল সবকিছুর প্রতিই তাঁর দৃষ্টি রয়েছে। আর সব কিছু তিনিই লালন-পালন করছেন। তাই তাঁর সৃষ্টির সেবার মাঝেই তাঁকে খুঁজে পাওয়া যায়। সৃষ্টির বৈচিত্র্যতার মাঝেই রয়েছে স্রষ্টার বিশালত্ব। সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টির সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করে, সংসার ত্যাগী হয়ে বনে জঙ্গলে ঘুরে তাঁকে খুঁজলে পাওয়া যায় না। আমাদের সমাজে যারা ঐশ্বর্যশালী মানুষ তাদের উচিত অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানো। এতে অসহায় মানুষগুলো খুশি হবে। মানুষের এই খুশিই সৃষ্টিকর্তাকে খুশি করবে। সমাজ হবে সুন্দর। শুধু মানুষ নয়, পশু পাখিকেও ভালোবাসতে হবে। তাকে পেতে হলে জীবে দয়া করতে হবে। তাইতো সব ধর্মের মূল কথা জীবে দয়া করা। স্রষ্টার সৃষ্টি যে কত মূল্যবান তা আমরা বৌদ্ধ ধর্মের ‘জীব হত্যা মহাপাপ’ এই বাণী থেকে বুঝতে পারি। হযরত মুহাম্মদ (স.) সব সময় জীবের সেবা করতেন এবং মানুষকে সবসময় জীবের প্রতি সদয় হতে উৎসাহিত করেতেন। সর্বোপরি সৃষ্টির মাঝেই স্রষ্টার বহিঃপ্রকাশ। তাই ঈশ্বরকে সেবা করতে হলে তাঁর সৃষ্টিকেই সেবা করতে হবে।
শিক্ষা: সৃষ্টিবিহীন যেমন স্রষ্টার কথা ভাবা যায় না, ঠিক তেমনি সৃষ্টিকে বাদ দিয়ে স্রষ্টাকে খোঁজা বৃথা চেষ্টা ছাড়া আর কিছুই নয়।
জ্ঞানহীন মানুষ পশুর সমান।
মানুষ সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব। এ শ্রেষ্ঠত্বের মর্যাদা মানুষ অজর্ন করেছে তার জ্ঞানের দ্বারা। জ্ঞানই মানুষের দেখার, জানার, বোঝার পরিসরকে বৃদ্ধি করে। জন্মগতভাবে মানুষ ও পশুর মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই কারণ তারা উভয়ই প্রাণী। কিন্তু মানুষকে শুধুমাত্র তার প্রাণ নিয়ে বেঁচে থাকলে হয় না। তাকে অর্জনকরতে হয় মনুষ্যত্ব নামক বিশেষ গুণ। জ্ঞান, বিদ্যা, বুদ্ধির সমন্বয়ে এ গুণ অর্জ করতে হয়। জন্মের পর থেকে জ্ঞানের বিকাশ ঘটানোর মাধ্যমে মনুষ্যত্ব ও মানবীয় গুণাবলীর পারস্পরিক ক্রিয়ায় গড়ে ওঠে প্রকৃত মানুষ। নির্জ্ঞান ব্যক্তি পশুরই নামান্তর। পশুর মতো জ্ঞানহীন প্রবৃত্তি তার মধ্যে লক্ষণীয়। পশুর মধ্যে যেমন কোনো নীতি- নৈতিকতা, ভাল-মন্দ বিচারবোধ নেই তেমনি জ্ঞান বিবর্জিত মানুষের মধ্যেও একই বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান। তার আর পশুর আচরণে কোনো ভিন্নতা দেখা যায় না। হিংসা-বিদ্বেষ, লোভ-লালসা, কামনা-বাসানায় সে চিরমগ্ন। অন্যের ক্ষতি করা, পর নিন্দা ইত্যাদি অসামাজিক কার্যকলাপ তার নিত্যকর্ম। এ ধরণের নৈতিক কাজেই সে আত্মসুখ খুঁজে পায়। এরূপ পশুসুলভ আচরণে প্রকৃতপক্ষে সে পশু থেকেও নিচুস্তর স্থানে অবস্থান করে। কারণ তার দ্বারা সভ্যতার যে ক্ষতি সাধিত হয় পশুর দ্বারা তা অসম্ভব। পক্ষান্তরে জ্ঞান নামক পরশ পাথর যার কাছে আছে সে নৈতিকতা বর্জিত কোনো কাজ করতে পারে না। তার জ্ঞানের আলোয় এগিয়ে যায় সমাজ, রাষ্ট্র, বিশ্ব। পৃথিবীর সকল ধর্মেই জ্ঞান অর্জনের প্রতি বিশেষ গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। জ্ঞানী মানুষের চিন্তা- চেতনা যতটা উন্নত, নির্জ্ঞান মানুষের চিন্তা- চেতনা ততটাই নিকৃষ্ট। অশুভ কাজে ব্যস্ত থাকায় জ্ঞানহীন ব্যক্তি সকলের স্নেহ-ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হয়। পশুদের মতো সেও সমাজবিচ্ছিন্ন হয়ে অন্ধকার জগতে বসবাস করে। তাই বলা হয়, জ্ঞানহীন ব্যক্তি পশুর সমতুল্য।
শিক্ষা: সভ্যতাকে উন্নতির দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দিতে জ্ঞানের বিকল্প নেই। তাই সঠিক পরিচর্যার মাধ্যমে মানুষের জ্ঞানের বিকাশ ঘটিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়া উচিত।
তরুলতা সহজেই তরুলতা, পশুপাখি সহজেই পশুপাখি, কিন্তু মানুষ প্রাণপণ চেষ্টায় তবে মানুষ।
পৃথিবীর সকল প্রাণীরই প্রাণ আছে। এই বিবেচনায় মানুষ এবং প্রাণীর মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। জন্মগুণে উভয়ই প্রাণী এবং তাদের মধ্যে কিছু স্বাভাবিক ও সাদৃশ্যপূর্ণ বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান। এই বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে পৃথিবীর সকল প্রাণী একই শ্রেণির। কিন্তু মানুষকে শুধুমাত্র প্রাণী হলেই চলে না। কারণ মানুষ সামাজিক জীব। সমাজে বসবাস করার জন্য তাকে কিছু মানবীয় গুণাবলীর অধিকারী হতে হয়। জন্ম থেকে মৃত্যু অবধি সমাজ থেকে বিভিন্ন শিক্ষাগ্রহণ করে মানুষকে মানবীয় গুণাবলী বিকশিত করতে হয়। এজন্য প্রয়োজন হয় কঠোর পরিশ্রম ও অধ্যবসায়ের। কিন্তু পশুপাখি ও তরুলতাকে এসব কোনো কিছুই করতে হয় না। তারা শুধুমাত্র নিজেদের অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখার জন্য কিছু কার্য সম্পাদন করে। তাদের কোনো জ্ঞান নেই, ভাল-মন্দ বিচারের ক্ষমতা নেই, নেই কোনো ন্যায়-অন্যায়বোধ। তারা কোনো খারাপ বা অন্যায় কাজ করলেও শাস্তির সম্মুখীন হতে হয় না। পক্ষান্তরে মানুষকে সমাজে বসবাস করার জন্য মানবীয় গুণাবলী অর্জনের পাশাপাশি তাকে শিখতে হয় অন্যকে জয় করার কৌশল, অর্জন করতে হয় নিজেকে ও বিশ্বসভ্যতাকে বদলে দেয়ার মন্ত্র। অমানবিক ও মনুষ্যত্বহীন কোনো কাজ করলে মানুষ হওয়া সত্ত্বেও সমাজ তাকে ‘অমানুষ’ হিসেবে আখ্যায়িত করে। মূলত মানুষ, পশুপাখি ও তরুলতা থেকে পৃথক হয়েছে বিদ্যা বুদ্ধি দ্বারা অর্জিত গুণাবলী ও মনুষ্যত্বের সমন¦য়ে। বিদ্যা-বুদ্ধি-বিবেক মানুষকে বিশ্বের অন্যসব প্রাণী থেকে পৃথক করেছে। বিবেকহীন মানুষ পশুর সমতুল্য।
শিক্ষা: জন্ম বৈশিষ্ট্যে পশুপাখি, তরুলতা ও মানুষে পার্থক্য না থাকলেও জ্ঞান ও বুদ্ধির জোরেই মানুষ স্বমহিমায় উজ্জ্বল। কঠোর সাধনা ও ত্যাগ-তিতিক্ষার মাধ্যমে মানবীয় গুণাবলী ও মনুষ্যত্বের বিকাশ ঘটিয়ে মানুষ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জীব হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। তাই মানুষ জন্মগুণে নয়, প্রাণপণ চেষ্টায় মানুষ।
তাই আজ প্রকৃতির উপর আধিপত্য নয় মানুষ গড়ে তুলতে চাইছে প্রকৃতির সঙ্গে মৈত্রীর সম্বন্ধ।
প্রকৃতি অপরূপ সৌন্দর্যে পরিপূর্ণ। মানুষ প্রকৃতিতে বসবাস করে বলেই তারা প্রকৃতির উপর নির্ভরশীল, প্রকৃতিই তাকে পরম যত্নে লালন পালন করে। আমাদের প্রয়োজনীয় সকল কিছুর আধার প্রকৃতি। জীবন ধারনের জন্য দরকারী সবই প্রকৃতিতে পাওয়া যায়। কিন্তু মানুষ অতিরিক্ত পাওয়ার আশা করে। ফলে শুরু হয় প্রকৃতির উপর আধিপত্য বিস্তারের খেলা। অতিবিলাসিতা, সম্পদের প্রতি লোভ, অতিরিক্ত সুযোগ সুবিধা পেতে মানুষ প্রতি মুহূর্তে প্রকৃতিকে ব্যবহার করছে। সম্পদের প্রতি অতিমাত্রায় লোভ মানুষকে নির্মম করেছে। এতে মানুষ প্রকৃতি ধ্বংসের লীলায় মেতে উঠেছে। এর ফলে প্রতিনিয়ত ঘটছে ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, টর্নেডো বায়ুদূষণ, জলবায়ু পরিবর্তন ইত্যাদির মতো ঘটনাগুলো। এছাড়া বায়ুমন্ডলে কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে, ওজন স্তর ক্ষয়ে যাচ্ছে। মেরু অঞ্চলের বরফ গলে পানির উচ্চতা বেড়ে যাচ্ছে। প্রকৃতির এই রুদ্রমূর্তি দেখে মানুষ এখন বুঝতে পেরেছে যে প্রকৃতির উপর আধিপত্য করে বেশিদিন টিকতে পারবে না; বরং প্রকৃতির সঙ্গে সহাবস্থান করতে হবে। গড়ে তুলতে হবে মৈত্রীর বন্ধন। তবেই পৃথিবী হয়ে উঠবে মানুষের বসবাসের উপযোগী। সৃষ্টিকর্তাই মূলত মানুষের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের জন্য প্রকৃতির সকল উপাদান সৃষ্টি করেছেন। মানুষও প্রকৃতির সাথে মেলবন্ধন স্থাপন করে তা থেকে উপকৃত হয়। প্রকৃতির সাথে শত্রুতা বা আধিপত্য বিস্তার কখনই সুখকর নয়।
শিক্ষা: প্রকৃতির তার নিজস্ব নিয়মে চলে। প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই করে জয়ী হওয়া সম্ভব নয়। বরং প্রকৃতির সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুললেই কেবল মানুষ, সমাজ, সভ্যতা ও সংস্কৃতিকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবে।
তুমি অধম তাই বলিয়া আমি উত্তম হইব না কেন?
সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে মানুষ তার স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখে চলে। এজন্য সে মানবতার কল্যাণে কাজ করে, পাশাপাশি যাবতীয় অন্যায় কাজ থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখে। সমাজে মানুষ তার কর্মের কারণে দুই ভাগে বিভক্ত। উত্তম এবং অধম। উত্তম সর্বদাই মানব কল্যাণে নিয়োজিত। যাবতীয় ভালো এবং জনহিতকর কাজ সে সম্পাদন করে থাকে। অপরদিকে অধম কখনোই মানবকল্যাণে নিয়োজিত হয় না। মানবধর্ম ভুলে সে আপন কাজে ব্যস্ত হয়। সমাজ-সংসার তাদের কাছ থেকে কিছুই পায় না। কোনো সমাজেই সে অনুকরণীয় হতে পারে না। সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে আমাদের রয়েছে বিবেকবোধ, চিন্তার ক্ষমতা এবং ভাল-মন্দ নির্ণয়ের ক্ষমতা। যে তার স্বাভাবিক জ্ঞান-বুদ্ধি দিয়ে ভাল-মন্দের বিচার না করে খারাপ কাজে লিপ্ত হয় সে সমাজে অধম হিসেবে বিবেচিত হয়। উত্তম স্বভাবের মানুষ সমাজের অন্য মানুষদের উত্তম হওয়ার প্রেরণা যোগায়। দুনিয়ার সর্বত্রই উত্তম মানুষগণ শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসার সাথে স্মরণীয়। অন্যদিকে অধম কোনো সমাজেই সমাদৃত নয়। একজন মানুষ তার জ্ঞান, বুদ্ধি, চিন্তাশীল মনের প্রখরতা দিয়ে সমাজে নিজের অবস্থান সৃষ্টি করে। অধম সব সময়ই অকল্যাণকর কাজে রত। উত্তম এবং অধমের মধ্যে পার্থক্য গড়ে দেয় তাদের কাজ, চিন্তার বহিঃপ্রকাশ। আর সেজন্যই উত্তম সর্বদা অধমের চেয়ে আলাদা। সে কখনোই অন্যের সাথে নিজের তুলনা করে না। উত্তম তাই অধম থেকে নিজেকে ভিন্নভাবে উপস্থাপন করে এবং সমাজে দৃষ্টান্ত হয়ে থাকে। মূলত ঐকান্তিক ইচ্ছা থাকলে মানুষ শত অধমের সঙ্গে থেকেও ভালো মানুষ তথা উত্তম হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।
শিক্ষা: উত্তম স্বভাবের মানুষই সমাজে দৃষ্টান্ত হয়ে থাকে। তাই উত্তম হওয়ার সাধনাই হওয়া উচিত মানবজীবনের প্রকৃত সাধনা, প্রধান লক্ষ্য।
তোমার মাপে হয়নি সবাই, তুমিও হওনি সবার মাপে তুমি মর কারো ঠেলায়, কেউ-বা মরে তোমার চাপে।
মানুষের চাহিদা অফুরন্ত। এই অফুরন্ত চাহিদা পূরণে মানুষ পরস্পরের সাথে এক বিচিত্র প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। একে অপরকে পেছনে ফেলার ষড়যন্ত্রে ব্যস্ত। এভাবে অন্যের প্রতি লোভ ও ঈর্ষা মানুষকে করে তোলে আক্রমণাত্মক। নিজের স্বার্থ সিদ্ধির জন্য অন্যের ক্ষতি করতেও মানুষ পিছপা হয় না। কোনো মানুষই সর্বগুণ সমৃদ্ধ নয়। দৈহিক সৌন্দর্য ও ধন সম্পদ সবার সমান থাকে না। এটাই বাস্তবতা। কিন্তু অধিকাংশ মানুষই এ বাস্তবতা মেনে নিতে পারে না। তাই প্রত্যেক মানুষই নিজের অবস্থানে হয় অসুখী। যা নিজের নেই সেটার প্রতিই মানুষের আকর্ষণ তীব্র। এই না থাকা জিনিসগুলো অর্জন করার জন্য মানুষ ব্যগ্র হয়ে ওঠে। আমৃত্যু মানুষ ছুটতে থাকে স্বপ্ন পূরণের আশায়। একটি স্বপ্ন পূরণ হলে আবার ধাওয়া করে অন্য স্বপ্নের পেছনে। এভাবে মানুষের আকাখ্ক্ষা শুধু বাড়তেই থাকে। এর কোনো শেষ হয় না। যেন অবিরাম চলছে মানুষের পাওয়া না পাওয়ার যুদ্ধ। আর এই যুদ্ধে মানুষ একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বী। সবাই মনে প্রাণে চেষ্টা করে প্রতিদ্বন্দ্বীকে হারিয়ে নিজে বিজয়ী হতে। এই বিজয়ের নেশায় মানুষ তার বিবেক, বুদ্ধি, মনুষ্যত্ব সব বিসর্জন দেয়। নিজের চাহিদা মিটাতে অন্যের ওপর চালায় নির্যাতন। অপরকে পদদলিত করে নিজের অবস্থানে পৌঁছাতে দ্বিধাবোধ করে না।
শিক্ষা: স্বল্প পরিসরের এই জীবনে মানুষ যদি শুধুমাত্র অর্থ-সম্পদ, মান-মর্যাদা অর্জনের পেছনে ছুটতে থাকে তাহলে তারা এই সুন্দর পৃথিবীর কোনো আনন্দ উপভোগ করতে পারবে না। তাই মানুষের উচিত নিজের যা আছে তাই নিয়েই সুখী হওয়ার চেষ্টা করা।
তৃষ্ণার জল যখন আশার অতীত মরীচিকা তখন সহজে ভোলায়।
মানুষ সমাজে বাস করে। এই সমাজ অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা ও বিনোদন এর মতো মৌল মানবিক চাহিদাগুলো পূরণ করে থাকে। তথাপি প্রাপ্তির মাঝেও কিছু অপ্রাপ্তি থেকে যায়। অনেক সময় কাঙ্ক্ষিত চাহিদা পূরণে সমাজ ব্যর্থ হয়। আর ক্রমাগত ব্যর্থতা মানুষকে হতাশায় জর্জরিত করে তোলে। সে তার বিবেক বুদ্ধি হারিয়ে ফেলে। তপ্ত মরুভূমিতে পথিক যখন তৃষ্ণার্ত হয় তখন সে চারদিকে হন্যে হয়ে জল খুঁজে বেড়ায়। কিন্তু সূর্যের প্রখর তাপে মরুভূমিতে জল পাওয়া সহজ নয়। মরুভূমির বালিতে তীর্যকভাবে সূর্যকিরণ পতিত হলে তা দূর থেকে পানির মতো দেখা যায়, যাকে মরীচিকা বলে। পথিকের কাছে মনে হয় সামনে পানি দেখা যাচ্ছে, কিন্তু যখন সে সামনে এগিয়ে যায় তখন পানির মতো দেখতে মরীচিকা আরও দূরে সরে যায়। মানুষের জীবনও এরকম মরুভূমির মরীচিকার মতো। মরীচিকার পেছনে যেমন মরুভূমির পথিক বুদ্ধি-জ্ঞানহীনের মতো ছুটতে থাকে তেমনি কাক্সিক্ষত বস্তু না পাওয়ার বেদনায় মানুষ বিবেকহীন হয়ে পড়ে। এর ফলে অপরাধ প্রবণতা বেড়ে যায়। সমাজে সৃষ্টি হয় চরম বিশৃংখলা।
শিক্ষা: অভাব মানুষকে বিভ্রান্ত করে অনিশ্চিত জীবনের পথে ছুটতে বাধ্য করে। যা তাকে চূড়ান্ত ধ্বংসের দিকে নিয়ে যায়। অতিরিক্ত প্রাপ্তিও আবার মানুষকে বিপথের দিকে ঠেলে দেয়। তাই মানুষের জীবনে প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি দুই-ই থাকা উচিত।
দশে মিলে করি কাজ হারি জিতি নাহি লাজ।
পৃথিবীর ছোট বড় যেকোনো কাজে সম্মিলিত অংশগ্রহণের মধ্যেই সর্বোত্তম সফলতা নিহিত। সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাঝে আছে বিপুল উৎসাহ, বিজয়ের দুর্দমনীয় নেশা আর অফুরন্ত উদ্দীপনা। ঐক্যবদ্ধ প্রয়াসে সফলতার সম্ভাবনাই থাকে বেশি। অন্তত পরাজিত হওয়ার আগে পরাজয়ের নেতিবাচক মানসিকতা স্থান পায় না মিলিত শক্তিতে। সবাই মিলেমিশে কাজ করতে গিয়ে পরস্পরের মাঝে তৈরি হয় একতা, সম্প্রীতি ও ভ্রাতৃত্ববোধ। সভ্যতার শুরু থেকেই মানুষ নিজেদের প্রয়োজনে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। এক সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে সৃষ্ট সম্প্রীতি আর ভ্রাতৃত্ববোধের বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে তৈরি করেছে সমাজ ও রাষ্ট্রের মতো ঐক্যবদ্ধ শক্তিশালী সংগঠন। ঐক্যবদ্ধ মানুষের কাছে তুচ্ছ হয়ে যায় অস্ত্রের ক্ষমতা। একক ব্যক্তিসত্তা একতাবদ্ধ হয়ে পৃথিবীর যেকোনো পরাক্রমশালী শক্তিকে হারিয়ে দিতে পারে। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ যার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। আধুনিক সমরাস্ত্রে সুসজ্জিত বিশাল পাক হানাদার বাহিনীকে হারিয়ে দিয়েছিলেন ঐক্যমন্ত্রে দীক্ষিত আমাদের বীর মুক্তিযোদ্ধারা। আর সমবেতভাবে কাজ করার মাঝে হার-জিত মুখ্য বিষয় নয়। সমবেত কাজ জয় পরাজয়কে ছাপিয়ে মহত্তম হয়ে ওঠে সম্মিলনের সৌন্দর্যে। তাছাড়া সমবেত কাজে বিজয়ের আনন্দ যেমন সকলের, তেমনি ব্যর্থতার দায়ভার ও গ্লানিও সকলের। একক কাজের ক্ষেত্রে পরাজয়ের গ্লানিও একাকী নিজেকে বহন করতে হয়। সম্মিলিত কাজ ব্যর্থতার গ্লানিও সমভাবে সবার ওপরে বর্তায় বলে গ্লানিবোধ তীব্র হয় না।
শিক্ষা: সকলের সম্মিলিত অংশগ্রহণে কাজের সফলতা ব্যর্থতা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। মিলেমিশে কাজ করে ব্যর্থ হলেও লজ্জা কিংবা অগৌরব নেই।
জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস।
একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার জন্য প্রধানত চারটি উপাদানের যথাযথ সমন্বয় প্রয়োজন। উপাদানগুলো হচ্ছে একটি নির্দিষ্ট ভূখন্ড, সার্বভৌমত্ব, সরকার ও জনগণ। কোনো জনগোষ্ঠী যখন একটি নির্দিষ্ট ভূ-খন্ডে একটি নির্দিষ্ট সরকার গঠনের মাধ্যমে তাদের সার্বভৌম ক্ষমতা ব্যবহার করে একটি বৃহত্তর সমাজ গঠন করে তখনই একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা লাভ করে। এই রাষ্ট্র গঠন প্রক্রিয়ায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনকারী উপাদান হচ্ছে জনগণ। জনগণই একটি দেশ পরিচালনার জন্য সরকার গঠনে মূল ভূমিকা রাখে। জনগণের যথাযথ সমর্থন ছাড়া কেউ কখনো ক্ষমতার ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারে না। রাষ্ট্রের সরকারই সাধারণ অর্থে সকল ক্ষমতার অধিকারী এবং গোটা রাষ্ট্র শাসনের ভার সরকারের উপরেই ন্যস্ত থাকে। কিন্তু সরকার এই অধিকার লাভ করে জনগণের সহযোগিতা থেকে। জনগণই আসলে সরকারের হাতে রাষ্ট্রের সার্বভৌম ক্ষমতা অর্পণ করে। আধুনিক গণতান্ত্রিক সমাজে জনগণ আক্ষরিক অর্থেই সকল ক্ষমতার উৎস। তারা অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের মাধ্যমে নেতৃত্ব গুণসম্পন্ন ব্যক্তিকে সমর্থন জানায় এবং তার হাতে ক্ষমতা অর্পণ করে। একটি রাষ্ট্রকে নেতৃত্ব দেওয়ার মতো যোগ্য ব্যক্তি উঠে আসে সাধারণ জনগণের মধ্য থেকেই। ক্ষমতার আসনে থাকাকালীন সরকার জনগণের সুবিধা-অসুবিধা বিবেচনা না রেখে কোনো নীতি গ্রহণ করতে পারে না। জনগণের বিরোধিতার মুখে অনেক সময় সরকার তার গৃহীত সিদ্ধান্ত বাতিল বা পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়। একটি দেশের জনগণ সর্বদা তাদের নেতা বা সরকার কর্তৃক সম্পাদিত কাজ ও গৃহীত সিদ্ধান্তের গঠনমূলক সমালোচনা ও পরামর্শ দেওয়ার অধিকার রাখে। কোনো দেশের সরকার মূলত সেই দেশের সর্বসাধারণের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটায় জনকল্যাণমূলক কাজের মাধ্যমে। সর্বোপরি জনগণ তাদের সার্বভৌম ক্ষমতার প্রয়োগ ঘটায় তাদের সমর্থিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে যারা জনমতের ভিত্তিতে জনকল্যাণার্থে বিভিন্ন নীতি গ্রহণ করে ও তার বাস্তবায়ন ঘটায়। অতএব সার্বভৌম ক্ষমতার মূল উৎস হচ্ছে একটি দেশের জনগণ।
শিক্ষা: আপাতদৃষ্টিতে সরকার জনগণের ওপর ক্ষমতার প্রয়োগ ঘটালেও জনগণই মূলত সরকারকে ক্ষমতা প্রদান করে। আবার একমাত্র জনগণই পারে কোনো গণবিরোধী সরকারকে ক্ষমতার আসন থেকে অপসারণ করতে।
গেঁয়ো যোগী ভিখ পায় না।
তিনিই গুণী, যিনি মানবীয় গুণাবলীর ধারক ও বাহক। তার মধ্যে মানব চরিত্রের এমন কিছু গুণ প্রতিফলিত হয়, যা দ্বারা তিনি অন্য সাধারণ মানুষের চেয়ে আলাদা সম্মান পান। গুণী ব্যক্তি তার মেধা, প্রজ্ঞা দ্বারা মানুষের, সমাজ তথা রাষ্ট্রের বিকাশ সাধন করেন। পৃথিবীর মহান কবি, দার্শনিক, বৈজ্ঞানিক তারা সবাই তাদের নিজ নিজ গুণের দ্বারা মানব সম্প্রদায়ের উপকার করেছেন। তারা সবাই সম্মানের পাত্র। একটা বিষয় পরিলক্ষিত যে, এসব গুণী ব্যক্তিরা তাদের সমসাময়িক সময়ে খ্যাতি অর্জন করতে পারেননি। মানুষ গুণী ব্যক্তিদের কদর করতে শুরু করে যখন তারা জীবনের শেষ পর্যায়ে চলে আসেন, নতুবা মারা যান। মহাকবি ফেরদৌসী মহাকাব্য ‘শাহনামা’ রচনার প্রতিটি শ্লোকের জন্য স্বর্ণ মুদ্রা পাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সুলতান মাহমুদ তাকে স্বর্ণ মুদ্রার পরিবর্তে রৌপ্য মুদ্রা দেন। ফেরদৌসী রৌপ্য মুদ্রা নিতে অস্বীকার করে রাগ করে চলে যান। সুলতান যখন তাঁর ভুল বুঝতে পারেন, তখন ফেরদৌসী আর জীবিত ছিলেন না। গুণী ব্যক্তিরা যখন আমাদের সাথে সমাজে চলাফেরা করেন, তখন আমরা তাকে সমাদর করি না। তাদেরকে অবহেলা করি। তাদের গুণকে আমরা সম্মানের চোখে দেখি না। তাদের সামাজিক স্বীকৃতি ও সামাজিক মর্যাদা দিতে আমরা দ্বিধাবোধ করি। অথচ তারা তাদের মেধা, প্রজ্ঞা ও দূরদর্শীতা দ্বারা মানুষের উপকার করে থাকেন। তাই তাদের যথাযথ সম্মান করা উচিত। ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ বলেছেন- “যে দেশে গুণের সমাদর নেই, সে দেশে গুণী জন্মাতে পারে না।” তাই সমাজে তথা রাষ্ট্রে যেসব গুণী ব্যক্তি বাস করেন তাদের প্রাপ্য সম্মানটুকু দেয়া আমাদের কর্তব্য।
শিক্ষা: মানবীয় গুণে গুণান্বিত ব্যক্তি শ্রদ্ধার পাত্র। তাকে যথাযথ মর্যাদা দিয়ে সমাজে স্থান করে দিতে হবে। তার গুণের কদর করতে হবে।
ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা সব শিশুরই অন্তরে।
আজকের শিশুরাই আগামী দিনের কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, ডাক্তার, প্রকৌশলী, বৈজ্ঞানিক প্রভৃতি। আজকের দিনে যারা শিশু তারাই হবে আগামী দিনের জাতির পথ প্রদর্শক। তারা বড় হয়ে জাতীয় উন্নয়নে অবদান রাখবে। তাদের সুনাম দেশ ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ছড়িয়ে পড়বে। প্রতিটি শিশুর মধ্যে লুকিয়ে আছে সুপ্ত প্রতিভা। তাকে খুঁজে বের করে কাজে লাগাতে হবে। পৃথিবীর মহামানব ও মনীষীদের জীবন লক্ষ করলে দেখা যায় যে, তারা শিশুকাল থেকেই নানা বিষয়ে আগ্রহী ও প্রতিভাবান ছিলেন। হযরত মুহাম্মদ (সঃ), কাজী নজরুল ইসলাম, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, আইনস্টাইন, নিউটন ও আব্রাহাম লিংকন প্রমুখের মধ্যে সম্ভাবনার বীজ শিশুকাল হতেই দেখা দিয়েছিল। শিশুরা উপযুক্ত পরিবেশ পেলে বিশ্বকে নতুন করে গড়ে তুলতে পারে। ইংরেজ কবি ওয়ার্ডসওয়ার্থ বলেছেন- ‘শিশুরাই জাতির পিতা’। কাজেই শিশুরা যদি উপযুক্ত শিক্ষা অর্জন করতে পারে তাহলেই দেশের মঙ্গল, জাতির উন্নতি। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, আমাদের দেশের অধিকাংশ ছেলেমেয়েই শিক্ষার উপযুক্ত পরিবেশ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। আমাদের দেশের অনেক শিশু অবহেলা-অনাদরে, অশিক্ষা-কুশিক্ষা এবং অপুষ্টিসহ নানা সমস্যায় জর্জরিত। আবার অনেক শিশু বেঁচে থাকার তাগিদে শিশু শ্রমে জড়িত হচ্ছে। শিশুরা নানাভাবে তাদের মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। অথচ এই শিশুরাই আগামী দিনের নেতৃত্ব দিবে। কেবল শিশুর স্বার্থেই নয় জাতির কল্যাণ ও দেশের উন্নতির জন্যই শিশু বিকাশের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ একান্ত জরুরী।
শিক্ষা: আজকের শিশুরাই জাতির ভবিষ্যৎ পিতার দায়িত্ব পালন করবে। তাই শিশুদের উপযোগী পরিবেশ গড়ে তোলা উচিত। শিশুদের সঠিক পরিচর্যাই ভবিষ্যতে উন্নত জাতি গঠনের প্রধান শর্ত।
চকচক করলেই সোনা হয় না।
পৃথিবীতে খাঁটি বস্তুর চেয়ে নকল বস্তুর পরিমাণই বেশি। আসল বস্তুর প্রাপ্য মর্যাদা হরণের জন্য নকল বস্তু সর্বদা সচেষ্ট। নকল তার দোষ-ত্রুটি সৌন্দর্যের আবরণে লুকিয়ে নিজেকে আসল রূপে পৃথিবীর কাছে প্রকাশ করতে ব্যস্ত। কিন্তু শুধু বাইরের আবরণ দিয়েই বেশিদিন সবাইকে আকৃষ্ট করে রাখা যায় না। এক সময় মিথ্যা আবরণের ভেতর থেকে বের হয়ে আসে নকল বস্তুর বৈশিষ্ট্য। তখন তার চূড়ান্ত পরাজয় ঘটে আসল বস্তুর কাছে। সোনা অতি মূল্যবান একটি ধাতু। এর বর্ণ উজ্জ্বল। কিন্তু একমাত্র এই উজ্জ্বলতাই সোনাকে মূল্যবান করে তোলেনি। সোনা প্রকৃতপক্ষে মূল্যবান এর অভ্যন্তরীণ গুণের কারণে। এমন অনেক ধাতু আছে যেগুলো ঘষা-মাজা করলে বা রং করলে সোনার বর্ণ ধারণ করে। কিন্তু তাই বলে এসব ধাতু সোনা হতে পারে না। কারণ ঘষা-মাজার ফলে এগুলো কেবল সোনার বাহ্যিক বর্ণটিই ধারণ করতে পারে, তার অভ্যন্তরীণ গুণগুলো আয়ত্ত করতে পারে না। তাই বাহিরের চাকচিক্যই কেবল কোনো বস্তুকে পূর্ণাঙ্গভাবে চেনার মাপকাঠি হতে পারে না। আমাদের সমাজেও এমন অনেক মানুষ আছে যাদের ভেতরটা প্রকৃত অর্থে ফাঁপা। কিন্তু বাহিরে তারা একটি পরিপূর্ণ ভালো মানুষের মুখোশ এঁটে থাকে। তারা কখনো মহৎ নয়, মহৎ হওয়ার অভিনয় করে মাত্র। তাদের বাহিরের ভালোমানুষী দেখে অনেকেই প্রভাবিত হয়। আকর্ষণীয় চেহারা ও মিষ্টি কথায় আকৃষ্ট হয়ে অনেকেই তাদের সম্মানের আসনে বসায়। কিন্তু এসব তথাকথিত ভালো মানুষদের সত্যিকার রূপ যখন প্রকাশ পায় তখন তাদের বীভৎসতায় সকলে বিমূঢ় হয়ে যায়। তাই বাহ্যিক সৌন্দর্য নয় ভেতরের গুণাবলির মাধ্যমেই মানুষকে বিচার করা উচিত।
শিক্ষা: দেখতে কুৎসিত অনেক মানুষের মন পবিত্র হতে পারে। আবার সুন্দর চেহারা ও আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বের অধিকারী অনেক মানুষও হতে পারে চরম ভয়ংকর। তাই একটি মানুষের ভেতরকে পরিপূর্ণভাবে না জেনে তার সম্পর্কে কোনো ধারণা পোষণ করা ঠিক নয়।
চরিত্রহীন মানুষ পশুর সমান।
মানব জীবনের সর্বোৎকৃষ্ট গুণাবলির মধ্যে চরিত্র অন্যতম। এটি মানব জীবনের ভূষণ হিসেবে কাজ করে। কথায় আছে, ‘সম্পদ হারালে কোনো ক্ষতি হয় না, স্বাস্থ্য হারালে কিছুটা ক্ষতি হয় কিন্তু চরিত্র হারালে সব কিছুই খোয়া যায়।’ তাই বিখ্যাত ইংরেজ লেখক স্যামুয়্যাল স্মাইলস তাঁর "Character" নিবন্ধে বলেছেন- "The crown and glory of life is character." মনীষী বাকী বলেছেন- ‘অর্থের প্রয়োজন নেই, পদমর্যাদার প্রয়োজন নেই, প্রয়োজন আছে শুধু চরিত্রের, যা মানুষের জীবনের সর্বাপেক্ষা প্রয়োজনীয়।’ বস্তুত চরিত্র শ্রেষ্ঠ সম্পদ। নামমাত্র নৈতিকতা বা ন্যায়নিষ্ঠাই চরিত্র নয়। চরিত্রের মধ্যে সমন্বয় ঘটবে মানুষের যাবতীয় গুণাবলি ও আদর্শের। সততা, সত্যনিষ্ঠা, প্রেম, পরোপকারিতা, দায়িত্ববোধ, শৃঙ্খলা এবং কর্তব্যপরায়ণতা হলো চরিত্রের মৌলিক উপাদান। এসব সদগুণ তাকে চরিত্র শক্তিতে বলীয়ান করে তোলে। স্পর্শ-মণির ছোঁয়ায় লোহা যেমন সোনায় পরিণত হয়, তেমনি সচ্চরিত্র মানুষের পশুবৃত্তি ঘুচিয়ে দেয়। সে হয়ে ওঠে বিবেকের কাছে কলুষমুক্ত, পরোপকারী, নির্লোভ, ন্যায়, সত্য ও সুন্দরের সেবক। কিন্তু চরিত্র শক্তিতে বলীয়ান না হলে মানুষ সহজেই অপকর্মে লিপ্ত হয় নৈতিক অধঃপতন ও মূল্যবোধের অবক্ষয় ঘটে। ফলে জ্ঞান-বিজ্ঞানে উন্নত হলেও সে জাতির জীবন হয়ে ওঠে কলঙ্কিত। চরিত্রহীন লোককে সবাই ঘৃণা করে, সমাজের কারো কাছে এদের দাম নেই। এরা সমাজের কোনো উপকারে আসে না, বরং ক্ষতি করে। এ জন্য সবাই তাদের এড়িয়ে চলে। চরিত্র দোষেই তাদের স্থান হয় পশুস্তরে। পক্ষান্তরে চরিত্রবান লোক কেবল জীবনে মহত্ত্বই অর্জন করেন না, মৃত্যুর পরও তারা স্মরণীয় বরণীয় হয়ে থাকেন। সচ্চরিত্র বলে তারা সমাজ ও জাতীয় জীবনের অগ্রগতি ও উন্নতির পথে আলোকবর্তিকার মতো কাজ করেন। পৃথিবীর সকল ধর্মগুরু ও মনীষীগণ তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ। বস্তুত সচ্চরিত্রের কারণেই মানুষ হয় মহৎ, গৌরবান্বিত মর্যাদার অধিকারী। তা না হলে তার স্থান হয় নিম্নস্তরে। স্বাস্থ্য, অর্থ, বিদ্যা মানুষকে পরিপূর্ণ মানুষ করে তুলতে পারে না। পরিপূর্ণ মানুষ হতে হলে তাকে সচ্চরিত্রবান হতে হয়। এজন্য প্রতিটি মানুষের সচ্চরিত্র ভালো মানস গঠনের সহায়ক আর ভালো মানস ভালো সমাজ ও জাতি গঠনের সহায়ক। চরিত্রহীন জনগোষ্ঠী জাতির উন্নতির অন্তরায়।
শিক্ষা: মানব জীবনে চরিত্র অমূল্য সম্পদ। কোনো মূল্যেও এর পরিমাপ করা যায় না। চরিত্রের কারণেই মানুষ পশুত্ব থেকে মুক্তি পায়, অর্জন করে সত্যিকারের গৌরব ও মর্যাদা।
চন্দ্র কহে, বিশ্বে আলো দিয়েছি ছড়ায়ে কলঙ্ক যা আছে তাহা আছে মোর গায়ে।
পৃথিবীর একমাত্র উপগ্রহ হচ্ছে চাঁদ। রাতে আলো ছড়িয়ে চাঁদ পৃথিবীর অন্ধকার দূর করে। সুন্দর, মনোমুগ্ধকর এই চাঁদের বুকেও দাগ রয়েছে, যা তার কলঙ্ক বলে কবি মনে করেন। এ কলঙ্ক থাকা সত্ত্বেও চাঁদ নিঃস্বার্থভাবে তার আলো বিলিয়ে দেয়। চাঁদের এ আলোয় গোটা পৃথিবী হয় আলোকিত, তার সৌন্দর্যে চারদিক হয় উদ্ভাসিত। নিজের কলঙ্ককে ছাপিয়ে আলো ছড়ানো যেন ত্যাগেরই মহান শিক্ষা। পৃথিবীতে মহৎ জ্ঞানী ব্যক্তিরা চাঁদের সমতুল্য। চাঁদের মতো করে মহৎ ব্যক্তিরাও তাদের জ্ঞানের আলোয় সমাজের অন্ধকার দূর করেন। তাদের ত্যাগ-তিতিক্ষা, পরিশ্রম-সাধনায় পৃথিবী এগিয়ে যায়। তারা কখনো নিজের সুখের কথা ভাবেন না। ব্যক্তিগত জীবনে তারা নানা দুঃখ, ক্লেশ, গ্লানি, নিন্দা, কালিমা নীরবে নিঃশব্দে সহ্য করেন। কখনও তা প্রকাশ করেন না। অপরের হিতসাধনে দুঃখ-কষ্টকে তারা স্বীকার করে নেন। নিজের সবকিছু বিলিয়ে দিয়ে অপরের কল্যাণ, পৃথিবীর কল্যাণ সাধনে রত থাকেন। হৃদয়ের বিশালতায় তারা জয় করে নেন সংকীর্ণতা, ক্ষুদ্রতা ও অশুভকে। পৃথিবীর সকল মহামনীষী ও ধর্মীয় মহাপুরুষগণ তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ। পরহিত সাধনের মাঝে তারা জীবনের সার্থকতা ও প্রকৃত সুখ খুঁজে পান।
শিক্ষা: নিজের সুখ অপরের মাঝে বিলিয়ে দেয়ার মাঝেই প্রকৃত সুখ ও মাহাত্ম্য। সকলকেই এ শিক্ষা নিয়ে মানব সেবায় এগিয়ে আসতে হবে।
চিরসুখী জন ভ্রমে কি কখন, ব্যথিত বেদন বুঝিতে কি পারে? কি যাতনা বিষে বুঝিবে সে কিসে, কভু আশীবিষে দংশেনি যারে।
সুখ এবং দুঃখ দুটি বিপরীত বিষয়। এরা একে অপরের সাথে গভীরভাবে সম্পর্কিত। একটি না থাকলে অন্যটির মর্ম বোঝা যায় না। অন্ধকার না থাকলে যেমন আলো বোঝা যায় না। যখন কারো হাত কাটে তার ব্যাথা কেবল ঐ ব্যক্তিই বুঝে অন্য কেউ নয়। কষ্ট বা বেদনার যে অনুভূতি তা কেবল ব্যক্তি নিজেই বোঝে। আমরা পাশের মানুষ শুধু সমবেদনাই জানাতে পারি। তার কষ্টটা কখনো অনুভব করতে পারি না। পৃথিবীতে মানুষের জীবন সুখ-দুঃখ মিলিয়েই গড়ে উঠেছে। কিন্তু কিছু মানুষ আছে যারা দুঃখের চেয়ে সুখটাই বেশি ভোগ করে। তাই দুঃখী ব্যক্তির দুঃখ তারা বুঝতে পারে না। আমাদের সমাজে অনেক ধনী লোক আছে সোনার চামচ মুখে নিয়ে যাদের জন্ম হয়েছে। কখনো কখনো তারা দরিদ্র মানুষদের গণ্যই করে না। যারা সুখী এবং সম্পদশালী তারা গরীবের কষ্ট কখনো বুঝতে পারে না। তাই গরীবকে তারা অবহেলা করে, অবজ্ঞা করে। গরীবের কষ্ট তারা কখনও বোঝার চেষ্টাও করে না। তারা ধনী ও গরীবের মাঝে এক বিভেদের দেয়াল তৈরি করেছে। সমাজে উঁচুতলার লোকেরা গরীব খেটে খাওয়া মানুষের দিকে সাহায্যের হাত বাড়াতে চায় না। বরং তাদেরকে আরও বেশি কষ্টে ভোগায়। ধনীরা কখনোই গরীবের কষ্টে সামিল হতে চায় না। কারণ তারা এই কষ্টের মূল্যায়নই করে না। তারা ভুলে যায়, যে সুখের পাহাড় তারা গড়েছে সেটা ঐ গরীব মানুষেরই কষ্টের ফসল। যাকে শাপে কামড় দেয় কেবল সে-ই বিষের যন্ত্রনা অনুভব করতে পারে। সুখে থেকে কখনো অন্যের দুঃখকে অনুভব করা যায় না।
শিক্ষা: যে মানুষ প্রতিনিয়ত দুঃখ-কষ্ট পাচ্ছে সে-ই কেবল এর যন্ত্রণা উপলব্ধি করতে পারে। কেউ কেউ হয়তো দায়বোধ থেকে দুঃখী মানুষকে কখনো সমবেদনা জানায়। কিন্তু তা কেবল সমবেদনাতেই সীমাবদ্ধ থাকে।
জগৎ জুড়িয়া এক জাতি আছে, সে জাতির নাম মানুষ জাতি; একই পৃথিবীর স্তন্যে লালিত, একই রবি-শশী মোদের সাথী।
পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, মানুষ “আশরাফুল মাখলুকাত” অর্থাৎ সৃষ্টির সেরা। অন্যদিকে, বাইবেলে আছে, "God made man after His own image." প্রতিটি ধর্মেই মানুষকে শ্রেষ্ঠত্বের মর্যাদা দেয়া হয়েছে। স্রষ্টার সৃষ্টিতে জাতি, ধর্ম, বর্ণের কোনো ভেদাভেদ নেই। তিনি প্রত্যেক মানুষকেই মেধা, মনন ও হৃদয় এর সমন্বয়ে অনন্য সাধারণ করে সৃষ্টি করেছেন। সভ্যতার শুরু থেকে এ পর্যন্ত মানুষ প্রতিটি পর্যায়ে তার এই শ্রেষ্ঠত্বের পরিচয় দিয়ে আসছে। মূলত মানবগোষ্ঠীর জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে আলাদা আলাদা কোনো পরিচয় নেই। প্রকৃতপক্ষে, মানুষের একমাত্র পরিচয় হলো সে মানুষ। সে পৃথিবীর যেকোনো দেশের অধিবাসী হোক, যেকোনো ধর্মাবলম্বী হোক, সাদা-কালো-তামাটে যে বর্ণের হোক, ধনী-গরীব যে শ্রেণীরই হোক, নারী হোক কিংবা পুরুষ এগুলো তার প্রকৃত পরিচয় নয়। তার সত্যিকার পরিচয় হচ্ছে মানব পরিচয়। বৈষ্ণব কবি চন্ডীদাস তাই যথার্থই বলেছেন- “সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপর নাই।” কিন্তু নিচু মনের অধিকারী মানুষেরা এই সত্যকে মানতে চায় না। তারা নিজেদের স্বার্থে পৃথিবীতে জাতভেদ, বর্ণবৈষম্য, শ্রেণিবৈষম্য প্রভৃতি কুপ্রথা তৈরি করেছে। এ ধরণের স্বার্থপর মানুষেরা নিজেদের অর্থ-বিত্তের দম্ভে দরিদ্র, অসহায় মানুষকে তুচ্ছ জ্ঞান করে সমাজে কৃত্রিম শ্রেণিবৈষম্য তৈরি করতে সচেষ্ট। সকল মানুষ একই পৃথিবী হতে উৎপন্ন খাদ্য গ্রহণ করে, একই চন্দ্র, সূর্যের আলোয় উদ্ভাসিত হয়। তাই প্রকৃতপক্ষে মানুষের আলাদা কোনো জাতি, ধর্ম, বর্ণ পরিচয় নেই; মানুষ স্রষ্টার শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি। এটিই তার সর্বশ্রেষ্ঠ এবং একমাত্র পরিচয়।
শিক্ষা: পৃথিবীর সকল ধর্ম-কর্ম, মত ও পথের ঊর্ধ্বে মানুষের স্থান। সামান্য অর্থ-সম্পদ কিংবা জাতি, ধর্ম, বর্ণের মাপকাঠিতে মানুষকে উঁচু-নিচু শ্রেণিতে বিভক্ত করা যায় না। সেই শ্রেষ্ঠ মানুষ, যে হৃদয়ধর্মে উদার এবং মানুষে মানুষে কোনো ভেদাভেদ না রেখে মানবকল্যাণে নিজেকে নিয়োজিত রাখে।
জন্ম হোক যথা তথা কর্ম হোক ভালো ।
মানুষ “আশরাফুল মাখলুখাত” অর্থাৎ সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে বিবেচিত। মানুষ তার এই শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেছে জন্মের শ্রেষ্ঠত্বের মধ্য দিয়ে নয়, কর্মের শ্রেষ্ঠত্বের দ্বারা। জন্মের ব্যাপারে মানুষের নিজের কোনো হাত নেই। উঁচু বা নিচু, ধনী বা দরিদ্র পরিবারে তার জন্ম হওয়াটা তার ইচ্ছার ওপর নির্ভর করে না। তবুও মানুষকে বংশ বা ধর্মের ভিত্তিতে মূল্যায়ন করা হয়। যা ন্যায়সঙ্গত নয়। কারণ সমাজের নিচুতলায় জন্মগ্রহণ করেও অনেকে কর্মের মাধ্যমে অনেক বড় হতে পারেন। মানব সমাজের ইতিহাসে তার বহু প্রমাণ আছে। আমেরিকার জর্জ ওয়াশিংটন, আব্রাহাম লিংকন, ফ্রান্সের নেপোলিয়ান বোনাপার্ট, ভারতের এ.পি.জে আবুল কালাম আজাদ, প্রমুখ ব্যক্তি অতি সাধারণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেও অসাধারণ ব্যক্তিত্বের অধিকারী হয়েছেন। পদ্মফুলের সৌন্দর্যই বড়। পঙ্কে জন্মেছে বলে তাকে ছোট করে দেখার সুযোগ নেই। নিচুকুলে জন্মগ্রহণ করলেই যে নিচু হতে হবে এমন কোনো নিয়ম নেই। তার কৃতকর্মই তাকে উঁচু নিচুর পরিচয় করিয়ে দেয়। তাই মানুষ যেখানেই জন্মগ্রহণ করুক, যে কাজই করুক, সে সততা ও নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালন করছে কি না সেটাই বিবেচ্য বিষয়। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা, বংশগৌরবই মানুষের যথার্থ পরিচয় নয়। তাই জন্ম কোথায় হলো এ বিষয়টা একেবারে অযৌক্তিক ও অবান্তর। বরং মানুষের মহৎ কর্মই তার আসল পরিচয় বহন করে।
শিক্ষা: মানুষের জন্ম পরিচয়ের চেয়ে তার কর্মই সর্বাপেক্ষা তাৎপর্য বহন করে। তাই মানুষকে তার কর্মগুণের মাধ্যমে মূল্যায়ন করা উচিত।
জন্মিলে মরিতে হবে, অমর কে কোথা কবে?
সৃষ্টিকর্তা এই মহাবিশ্ব সৃষ্টি করেছেন। সবুজ শ্যামলে সুন্দর করে সাজিয়েছেন পৃথিবী। তবে তার সেরা সৃষ্টি হলাম আমরা মানুষ জাতি। তিনি আমাদেরকে জীবন দিয়েছেন। আমাদের জীবন বড় ক্ষণস্থায়ী আর তা আটকে আছে সুনির্দিষ্ট বাঁধাধরা কিছু নিয়মে। এই জীবনের আয়ু অসীম নয়, অনন্তকালের নয়; এর শেষ আছে। আমাদের জীবন অবিনশ্বর নয় বরং তা নশ্বর। জীবনের শুরু হয় জন্ম দিয়ে আর এর পরিসমাপ্তি ঘটে মৃত্যুর মাধ্যমে। যার জন্ম হয়েছে তার মৃত্যু নিশ্চিত। পৃথিবীতে এমন কোনো সৃষ্টি নেই, যার জন্ম হয়েছে কিন্তু মৃত্যু হবে না। মৃত্যুকে থামানো যায় না বলেই মানুষ কখনো অমর হতে পারে না। মানুষের পঁচনশীল শরীর মৃত্যুর পর ধীরে ধীরে মিশে যায় পৃথিবীর মাটিতে। মানুষ হয়তো অন্যের স্মৃতিতে বেঁচে থাকতে পারে কিন্তু স্বশরীরে কেউ কোনোদিন অমর হতে পারে না। মানুষ মৃত্যুকে না চাইলেও মৃত্যুই মানুষকে কেঁড়ে নিয়ে যায় এই সুন্দর বসুধা থেকে। মৃত্যু কাউকে কখনো অমর হতে দেয় না। মৃত্যু প্রত্যেক জীবের জন্য অবধারিত সত্য। সৃষ্টিকর্তা নির্দিষ্ট সময় বেধে দিয়ে মানুষকে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। কখনোই এই নিয়মের ব্যত্যয় ঘটেনি, ঘটে না আর ঘটবেও না। মানুষ পৃথিবী ছেড়ে চলে যায় কিন্তু অমর থেকে যায় কেবল তার সৃষ্টিকর্ম।
শিক্ষা: মানুষ মরণশীল, প্রতিনিয়ত সে মৃত্যুর দিকে ধাবমান। মৃত্যু এড়িয়ে অমর হওয়া তাই অসম্ভব।
দুর্নীতি জাতির সকল উন্নতির অন্তরায়।
পৃথিবীর প্রত্যেক জাতির জাতীয় উন্নয়নের প্রধান বিষয়গুলো হলো- মানব উন্নয়নে বিনিয়োগ, রাজনীতিতে সুশাসন ও স্বচ্ছতা। জাতীয় জীবনের উন্নতির জন্য প্রত্যেক জাতিকে তাই সত্য ও ন্যায়ের পথে চলতে হয়। ন্যায়নীতি, সততা ও স্বচ্ছতা জাতিকে উন্নতির শীর্ষে পৌঁছে দেয়। পৃথিবীর ইতিহাসে সৎ, ন্যায়নিষ্ঠ ও পরিশ্রমী জাতিই উন্নতির শিখরে আরোহণ করেছে। কিন্তু জাতীয় জীবনে দুর্নীতি প্রবেশ করলে জাতির সকল উন্নতির পথ বন্ধ হয়ে যায়। কারণ দুর্নীতি হলো অপরাধমূলক খারাপ কাজ যা সমাজের প্রচলিত রীতিনীতি, মূল্যবোধ ও আদর্শের পরিপন্থী। দুর্নীতি জাতির সকল অর্জনকে এবং জাতীয় উন্নয়নের সকল সম্ভাবনাকে নষ্ট করে দেয়। অন্যায় ও দুর্নীতির কারণে জাতি নানাবিধ অনাচার, হিংসাত্মক ও অপরাধমূলক কাজে লিপ্ত হয়। জাতি তখন জাতীয় উন্নতির কথা ভুলে গিয়ে ব্যক্তিগত হীনস্বার্থ লাভের জন্য ক্ষমতার অপব্যবহার করে। ফলে জাতির সামগ্রিক উন্নয়নে দুর্নীতি বাধা হয়ে দাঁড়ায়। দুর্নীতিবাজ মানুষ প্রতিনিয়ত ভাবে কীভাবে অন্যের সাথে প্রতারণা করে নিজের লাভের পরিমাণ বাড়ানো যায়। ব্যক্তিগত সুবিধা অর্জনে দুর্নীতিবাজরা বলপ্রয়োগ, ভয়প্রদর্শন ও ঘুষ প্রদান করে থাকে। দেশ, জাতি ও মানবকল্যাণের কথা দুর্নীতিবাজের চিন্তায় আসে না। অসহায় ও দরিদ্রদের অবস্থার উন্নয়নের জন্য যে সম্পদ ব্যবহৃত হওয়া উচিত তা দুর্নীতিবাজরা নিজেদের পকেটে ঢোকায়। এতে উন্নয়ন ও প্রবৃদ্ধির বদলে অসহায় ও দরিদ্রের সংখ্যা বহুগুণে বেড়ে যায়। দুর্নীতির করাল গ্রাসে একটি সম্ভাবনাময় জাতির ভবিষ্যৎ ধীরে ধীরে ধ্বংসের দিকে ধাবিত হয়। দুর্নীতি সামাজিক বৈষম্য, স্বার্থপরতা, অবিশ্বাস, ষড়যন্ত্র প্রভৃতির মাধ্যমে জাতীয় অনৈক্য ও অস্থিরতা সৃষ্টি করে। এই সর্বনাশা সামাজিক ব্যধির মরণ ছোবল থেকে দেশ ও জাতিকে বাঁচাতে পারলেই জাতির উন্নয়ন সম্ভব। এজন্য প্রত্যেক জাতিকে দুর্নীতির ভয়াবহতা সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। দুর্নীতি সৃষ্টির কারণ খুঁজে বের করতে হবে। দুর্নীতি মোকাবিলায় সবাইকে এক সাথে কাজ করতে হবে।
শিক্ষা: সর্বনাশা ও সর্বগ্রাসী দুর্নীতির মূল উৎপাটন করে জাতীয় উন্নয়নের মাধ্যমে একটি সমৃদ্ধিশালী ও মর্যাদাবান জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ সম্ভব। তাই দুর্নীতিকে প্রতিরোধ করে জাতির উন্নয়নে সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে।
দন্ডিতের সাথে দন্ড-দাতা কাঁদে যবে সমান আঘাতে সর্বশ্রেষ্ঠ সে বিচার।
পাপ-পূণ্য নিয়েই মানুষের জীবন। যিনি ন্যায়বান তাকে সবাই পছন্দ করেন। অপরদিকে অন্যায়কারী ব্যক্তিকে তার অপরাধের জন্য বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়। তাকে শাস্তি পেতে হয়। তবে অনেক সময় দেখা যায় বিচার সঠিক হয় না। আবার একজনের অপরাধে অন্যজন দন্ড প্রাপ্ত হয়। এক্ষেত্রে বিচারককে সুকঠিন ও অত্যন্ত বিচক্ষণ হতে হয়। তিনি তার প্রজ্ঞা ও মেধার সাথে সহানুভূতি ও মমত্ববোধের সংমিশ্রণ ঘটিয়ে দন্ড দান করবেন। দন্ডের ভয়ে অনেক সময় অপরাধী পাপকর্ম থেকে দূরে থাকে কিন্তু তার মানসিকতার পরিবর্তন হয় না। এ জন্য বিচারককে দয়া প্রদর্শন ও সহানুভূতির মাধ্যমে অপরাধীর বিবেককে জাগিয়ে তুলতে হবে এবং তাকে দন্ড দিতে হবে। বিচারক মানবিক বিবেচনা ও সাক্ষ্য প্রমাণের সমন্বয়ের মাধ্যমে বিচারকার্য করবেন। এতেই অপরাধীর অন্তরে অন্যায়ের প্রতি ঘৃণাবোধ জন্মাবে। অপরাধীকে শাস্তি নয় বরং তাকে সঠিক পথে আনাই বিচারকের মূল লক্ষ্য। এতে সমাজে অপরাধ কমে আসবে। শুধুমাত্র কঠোরতা নয় দয়া, মমত্ববোধ, নমনীয়তা প্রভৃতি বিষয়ের নিশ্চবয়তাই সর্বশ্রেষ্ঠ বিচারের নিদর্শন।
শিক্ষা: পবিত্র বাইবেলে রয়েছে ‘পাপকে ঘৃণা করো, পাপীকে নয়’। তাই অপরাধীকে শুধু শাস্তি দিলেই দায়িত্ব শেষ হয় না। বরং তার ভেতরের মানুষটাকে সজাগ করে তার মূল্যবোধ জাগিয়ে তোলাই সমাজ ও জাতির কর্তব্য।
দাও ফিরে সে অরণ্য লও এ নগর।
আধুনিক সভ্যতার অগ্রগতির পেছনে সবচেয়ে বড় অবদান বিজ্ঞানের। আজ বিজ্ঞানের অভাবনীয় উন্নতির ফলে পৃথিবীর সাথে সাথে মানুষের মনও বদলে গেছে। বিজ্ঞান মানুষকে যন্ত্রে পরিণত করছে। শহরের চার দেয়ালে বন্দি হয়ে মানুষ হারিয়ে ফেলছে গ্রামীণ জীবনের নিসর্গ রূপ। যান্ত্রিক সভ্যতা মানুষকে আরাম আয়েশ ও প্রাচুর্য দিয়েছে। এছাড়াও ভোগ-বিলাস ও লালসার অবারিত দ্বার উম্মোচন করে দিয়েছে। কিন্তু প্রকৃত সুখ এসবের মাঝে নেই। আজ সভ্যতার নামে মানুষ বন উজাড় করে গড়ে তুলছে শহর। নষ্ট করছে পরিবেশের ভারসাম্য। সভ্যতার সর্বনাশা স্রোত আমাদেরকে আমাদের সংস্কৃতি থেকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে। মানব সভ্যতা আজ এক ভয়ানক সংকটের মুখোমুখি। শহরের কৃত্রিম জীবন মানুষের শান্তি কেড়ে নিয়েছে, মানুষকে বন্দি করেছে কৃত্রিমতার শৃঙ্খলে। এ পরাধীনতা থেকে মানুষ এখন মুক্তি চায়। বর্তমান শহুরে জীবনে মানুষ আজ ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত। অতি আধুনিকতার মোড়কে আবৃত জনজীবনের প্রতি মানুষ আজ বিমুখ। তারা ফিরে পেতে চায় প্রকৃতি প্রদত্ত নির্মল আলো বাতাস। মানুষ পেতে চায় অতীতের সেই জীবন যেখানে কোনো ব্যস্ততা আর কোলাহল নেই, আছে প্রকৃতির দানে পরিপূর্ণ খোলা মাঠ, মুক্ত বাতাস আর পাখির কলকাকলি।
শিক্ষা: প্রাকৃতিক পরিবেশকে বিপন্ন করে যান্ত্রিক সভ্যতার বিকাশ কখনোই কাম্য নয়। সুতরাং আমরা ফিরে পেতে চাই সেই জীবন, যেখানে কৃত্রিম হৃদয়হীনতা নয়, প্রাকৃতিক আরণ্যক প্রশান্তি বিরাজমান।
দুঃখের মতো এত বড় পরশ পাথর আর নাই।
সুখ-দুঃখের উপস্থিতিতেই মানুষের জীবনচক্র। দুঃখ মানুষকে জাগ্রত ও আলোকিত করে তোলে। দুঃখবোধ থেকেই প্রজ্ঞার পরিচয় পাওয়া যায়। এটি মানুষকে সঠিক জীবনবোধের পথ দেখায়। দুঃখ আছে বলেই মানুষ দুঃখকে জয় করতে চেষ্টা করে। দুঃখ মানুষের কর্মক্ষমতা, জ্ঞান, অভিজ্ঞতা বৃদ্ধি করে। এটি মানুষকে সকল বাধা অতিক্রম করে খাঁটি মানুষ হিসেবে গড়ে উঠতে সহায়তা করে। তাই শেক্সপিয়র বলেছেন, "Life is not a bed of rose" পৃথিবীতে যা কিছু মহান কল্যাণকর সবকিছুই দুঃখ ও ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে। দিন আছে বলেই আমরা রাতকে চিনতে পারি, তেমনি দুঃখ আছে বলেই আমরা সুখের গুরুত্ব বুঝতে পারি। দুঃখের দহন শেষে মানব মনে যে আনন্দ আসে সেটাই স্বর্গীয় সুখ। এটি সঠিক, সত্য ও সুন্দরের পথ দেখায়। দুঃখ মানুষকে ধ্যানী, জ্ঞানী, পরিশ্রমী ও ঈশ্বরমুখী করে তোলে। এ কারণেই মহামানবরা দুঃখকে পরশ পাথরের সঙ্গে তুলনা করেছেন। কবির ভাষায়, "Seeetest songs are those that tell a suddest thought" মানুষ চিরদিনই সুখের অন্বেষণকারী। আর সুখ পেতে হলে দুঃখ কষ্টকে বরণ করে সম্মুখে এগিয়ে যেতে হবে। দুঃখবোধের জন্যে অনেকের জীবন ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। কিন্তু যারা সাহসী তারা দুঃখকে জয় করে সুখ খুঁজে নেয়। দুঃখকে পরিত্রানের মাধ্যমেই মহানবী (স.) হতে পেরেছিলেন মানবত্রাতা, যীশু খ্রিস্ট, গৌতম বুদ্ধ হয়েছিলেন মানব মুক্তির সাধক। জীবনে দুঃখ আছে বলেই আমরা সুখের অন্বেষণ করি। পরশ পাথর যেমন লোহাকে মহামূল্যবান স্বর্ণে পরিণত করে, তেমনি দুঃখরূপ পরশ পাথরের ছোঁয়ায় মানুষও রূপান্তরিত হয় সোনার মানুষে।
শিক্ষা: দুঃখের মধ্য দিয়েই প্রকৃত মানবসত্ত্বার বিকাশ ঘটে। দুঃখ মানুষকে সংগ্রামী, বিবেকবান আত্মপ্রত্যয়ী ও উদার হতে শিক্ষা দেয়।
দুঃখের মতো এত বড় পরশ পাথর আর নাই।
সুখ-দুঃখের উপস্থিতিতেই মানুষের জীবনচক্র। দুঃখ মানুষকে জাগ্রত ও আলোকিত করে তোলে। দুঃখবোধ থেকেই প্রজ্ঞার পরিচয় পাওয়া যায়। এটি মানুষকে সঠিক জীবনবোধের পথ দেখায়। দুঃখ আছে বলেই মানুষ দুঃখকে জয় করতে চেষ্টা করে। দুঃখ মানুষের কর্মক্ষমতা, জ্ঞান, অভিজ্ঞতা বৃদ্ধি করে। এটি মানুষকে সকল বাধা অতিক্রম করে খাঁটি মানুষ হিসেবে গড়ে উঠতে সহায়তা করে। তাই শেক্সপিয়র বলেছেন, "Life is not a bed of rose" পৃথিবীতে যা কিছু মহান কল্যাণকর সবকিছুই দুঃখ ও ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে। দিন আছে বলেই আমরা রাতকে চিনতে পারি, তেমনি দুঃখ আছে বলেই আমরা সুখের গুরুত্ব বুঝতে পারি। দুঃখের দহন শেষে মানব মনে যে আনন্দ আসে সেটাই স্বর্গীয় সুখ। এটি সঠিক, সত্য ও সুন্দরের পথ দেখায়। দুঃখ মানুষকে ধ্যানী, জ্ঞানী, পরিশ্রমী ও ঈশ্বরমুখী করে তোলে। এ কারণেই মহামানবরা দুঃখকে পরশ পাথরের সঙ্গে তুলনা করেছেন। কবির ভাষায়, "Seeetest songs are those that tell a suddest thought" মানুষ চিরদিনই সুখের অন্বেষণকারী। আর সুখ পেতে হলে দুঃখ কষ্টকে বরণ করে সম্মুখে এগিয়ে যেতে হবে। দুঃখবোধের জন্যে অনেকের জীবন ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। কিন্তু যারা সাহসী তারা দুঃখকে জয় করে সুখ খুঁজে নেয়। দুঃখকে পরিত্রানের মাধ্যমেই মহানবী (স.) হতে পেরেছিলেন মানবত্রাতা, যীশু খ্রিস্ট, গৌতম বুদ্ধ হয়েছিলেন মানব মুক্তির সাধক। জীবনে দুঃখ আছে বলেই আমরা সুখের অন্বেষণ করি। পরশ পাথর যেমন লোহাকে মহামূল্যবান স্বর্ণে পরিণত করে, তেমনি দুঃখরূপ পরশ পাথরের ছোঁয়ায় মানুষও রূপান্তরিত হয় সোনার মানুষে।
শিক্ষা: দুঃখের মধ্য দিয়েই প্রকৃত মানবসত্ত্বার বিকাশ ঘটে। দুঃখ মানুষকে সংগ্রামী, বিবেকবান আত্মপ্রত্যয়ী ও উদার হতে শিক্ষা দেয়।
দুর্জন বিদ্বান হলেও পরিত্যাজ্য।
শিক্ষা মানুষকে আলোকিত করে। কিন্তু কোনো মানুষ যদি আচরণগত বা চরিত্রগতভাবে খারাপ হয় তবে সে শিক্ষিত হলেও সমাজের বা মানুষের উপকার করে না বরং ক্ষতি করে। যেহেতু শিক্ষা গ্রহণের অধিকার সবার আছে তাই খারাপ লোকেরা চাইলেই শিক্ষিত হতে পারে। কিন্তু শিক্ষা গ্রহণ করেও তারা প্রকৃতপক্ষে গুণী বা ভালো মানুষ হয়ে উঠতে পারে না। দুর্জন তার অর্জিত বিদ্যাকে ভালো কাজে ব্যবহার না করে খারাপ কাজে ব্যবহার করে। দুর্জন ব্যক্তি যেকোনো ধরণের খারাপ কাজ করতে দ্বিধা করে না। বিদ্বানকে সবাই সমাদর করে কিন্তু শিক্ষিত ব্যক্তি যদি মানুষ হিসেবে ভালো না হয়, তবে তার সান্নিধ্য কেউ কামনা করে না। বিদ্বান হয়েও যে বিদ্যার মূল্য দিতে পারে না, সে সবদিক থেকে নিকৃষ্ট। তার কাছ থেকে দূরে থাকাই ভালো। দুর্জন বিদ্বান হলেও তার ভেতরের কু-প্রবৃত্তিগুলো তাকে খারাপ কাজের প্ররোচনা যোগায়। চারিত্রিক গুণাবলি বিদ্যার চেয়েও দামী। তাই প্রকৃত অর্থে দুর্জন বিদ্বানের চেয়ে চরিত্রবান অশিক্ষিত ব্যক্তি অনেক ভালো। সব বিষয়েরই দুটো দিক থাকে একটা ভালো অপরটি মন্দ। তেমনি বিদ্যার মাধ্যমে মানুষ সুশিক্ষা যেমন গ্রহণ করতে পারে আবার কুশিক্ষাও গ্রহণ করতে পারে। দুর্জন শিক্ষিত হয়ে তার বিদ্যাকে আরও সহজে খারাপ কাজে ব্যবহার করতে পারে। দুর্জনেরা বিদ্যাকে অসৎ উদ্দেশ্যের হাতিয়ার হিসেবেও ব্যবহার করে। দুর্জনের সাথে থেকে ভালো মানুষও খারাপ হয়ে যেতে পারে বলে দুর্জনের সঙ্গ পরিত্যাজ্য। প্রবাদ আছে- “সৎ সঙ্গে স্বর্গবাস অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ।” এক ঝুড়ি আমে একটি পঁচা আম থাকলে একসময় সব আমই পঁচে পায়। তেমনি সমাজে একজন অসৎ ব্যক্তির দ্বারা অনেক ভালো মানুষ প্রভাবিত হবার সম্ভাবনা থাকে। তাই তাদেরকে পরিত্যাগ করেই চলতে হয়।
শিক্ষা: কোনো ব্যক্তি যত শিক্ষিত বা জ্ঞানীই হোক না কেন, যদি ব্যক্তিগতভাবে অথবা চারিত্রিক দিক থেকে ভালো মানুষ না হয় তবে তার কাছ থেকে দূরে থাকাই শ্রেয়।
দুধ কলা সমৃদ্ধ সোনার খাঁচা অপেক্ষা ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ অজানা আকাশ পাখির অনেক প্রিয়।
পাখি মুক্ত আকাশে স্বাধীনভাবে উড়ে বেড়ায়। সকালবেলা অজানা স্থানে খাদ্যের সন্ধানে বের হয়। তার খাদ্য পাওয়ার কোনো নিশ্চয়তা না থাকলেও সারাদিন নানা প্রতিকূলতা, বিপদ-আপদ উপেক্ষা করে খাদ্য সংগ্রহ করে নীড়ে ফেরে। এতেই তার আনন্দ, এতেই তার স্বাধীনতা। পাখিকে সোনার খাঁচায় বন্দী করে দামী খাদ্য দেয়া হলেও এটি খাঁচায় বন্দী হয়ে থাকতে চাইবে না। বন্দী হয়ে থাকার চেয়ে স্বাধীনভাবে সংগ্রাম করে বেঁচে থাকা তার কাছে বেশি প্রিয়। মানব সম্প্রদায়ের মধ্যেও এ বিষয়টা পরিলক্ষিত হয়। এক শ্রেণির মানুষ স্বাধীনভাবে পরিশ্রম করে, সংগ্রাম করে জীবিকা নির্বাহ করে। তারা কারো দাসত্ব স্বীকার না করে নিজ হাতে তাদের কর্ম সম্পাদন করতে ভালোবাসে। জগতে তারাই বড় হয়েছেন যারা বাধা-বিপত্তিকে ভয় না পেয়ে তাদের লক্ষ্য অর্জনে সচেষ্ট হয়েছেন। আরেক শ্রেণির লোক আছে যারা কাজ করতে পছন্দ করে না। তারা অন্যের ওপর নির্ভরশীল। তাদের জীবন চলার পথে প্রয়োজনীয় সব জিনিসের জন্য অন্যের উপর নির্ভর করে থাকতে হয়। তারা স্বাধীন কোনো চিন্তা-ভাবনা করতে পারে না। তাদের জীবনে ধন-সম্পদের প্রাচুর্য থাকলেও তারা স্বাধীনতার স্বাদ পায় না। তাদেরকে একটা সীমাবদ্ধতার মধ্যে বাঁচতে হয়। অন্যদিকে যারা স্বাধীনচেতা মানুষ তারা মুক্ত বিহঙ্গের ন্যায় থাকতে অধিক পছন্দ করে। তাদের ধন-সম্পদের নিশ্চয়তা না থাকলেও তারা সকল প্রতিকূলতা জয় করে তাদের জীবিকা অর্জন করে। এটাই তাদের বেঁচে থাকার আনন্দ। এমন জীবনই তাদের কাছে অধিক প্রিয়।
শিক্ষা: পরিশ্রম না করে অন্যের উপর নির্ভর করে জীবন ধারণের চেয়ে সংগ্রাম করে স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকার আনন্দ বেশি। এমন জীবনই সবার কাম্য।
দ্বার বন্ধ করে দিয়ে ভ্রমটারে রুখি সত্য বলে, আমি তবে কোথা দিয়ে ঢুকি ?
দিন-রাত যেমন এক সাথে গাঁথা, ভাল-মন্দ, সত্য-মিথ্যা তেমনি একই সাথে গাঁথা। মন্দ ছাড়া ভালো অর্থহীন, মিথ্যা ছাড়া সত্য অর্থহীন। আমাদের সমাজে এমন অনেক মানুষ আছেন যারা, কুপথে চলে যাবার ভয়ে জীবনের পথে বের হতে চান না। তারা তাদের চারপাশে সব দ্বার রুদ্ধ করে দিয়ে শুধু সত্যের, চর্চা করতে চান। কিন্তু তারা বুঝতে পারেন না, এভাবে কখনও সত্যকে ধরা যায় না। সত্য কখনও নিজে নিজে কারও জীবনে ধরা দেয় না। যে মানুষ মিথ্যাকে চেনে না, মন্দকে চেনে না, সে কখনো সত্যের মূল্য বুঝতে পারে না। সে ভালোর মর্ম অনুধাবন করতে পারে না। সাতাঁর শিখতে হলে যেমন পানিতে নামতে হয়, তেমন জীবনে সত্য ও সুন্দরের বিকাশ ঘটাতে চাইলে সত্য-মিথ্যা, ভাল-মন্দ প্রভৃতি অভিজ্ঞতার পথে জীবনকে চালিত করতে হয়। ভালো-মন্দ, সত্য-মিথ্যা, সুন্দর-অসুন্দর, পাপ-পুণ্য সব পাশাপাশি বিচরণ করবে সেটাই স্বাভবিক। সত্যিকারে খাঁটি মানুষ যে, সেই তো মিথ্যার কুহক থেকে সত্যকে টেনে বের করে আনবে। সে জন্যে জীবনে বাস্তব অভিজ্ঞতার দরকার। মন্দের কদর্য যার অজানা, ভালোর সৌন্দর্য উপলদ্ধি করা তার পক্ষে মোটেই সম্ভব না। কুহকের ভয়ে যে জীবন দ্বার রুদ্ধ করে রাখে, বাস্তবের সাথে তার জীবনের কোনো সংযোগই ঘটে না। সুতরাং তার পক্ষে কখনই সত্য দিয়ে জীবন সুসজ্জিত করা সম্ভব নয়। তাই সত্যকে পেতে গেলে মিথ্যার অভিজ্ঞতা প্রযোজন।
শিক্ষা: জীবনকে আলোকিত করার জন্যই অন্ধকারকে জানতে হয়। তাই সত্যের পথে থাকতে গিয়ে মিথ্যার ভয়ে জীবন দ্বার রুদ্ধ করা সঠিক সিদ্ধান্ত নয়।
ধনের মানুষ, মানুষ নয় মনের মানুষই মানুষ।
মানুষ জন্ম থেকেই দুটি পরিধির মধ্যে বাস করে। একটি আত্মপরিধি অন্যটি বিশ্বপরিধি। একদিকে থাকে আত্মসুখ ও ঐশ্বর্য আকাক্সক্ষা অন্যদিকে থাকে ত্যাগ ও মানবকল্যাণের চিন্তা। আত্মপরিধি সম্পন্ন মানুষ প্রকৃত মানুষ হতে পারে না। কারণ প্রকৃত মানুষ যারা তারা অপরের হিতকামনা করেন। সহানুভূতি, পরার্থপরতা ও সমষ্টিগত কল্যাণবোধ ছাড়া মনুষ্যত্ব থাকে না। এ গুণগুলো মানুষকে সুন্দর মনের অধিকারী করে তোলে। পরোপকারী ও ত্যাগী মনের মানুষই প্রকৃত মানুষ। জনসাধারণের কাছে সংকীর্ণ মনসম্পন্ন প্রবল অর্থশালী লোকের কোনো মূল্য নেই। তারা আপাত সম্মান পেলেও হৃদয়ের শ্রদ্ধাবোধ পায় না কখনই। মৃত্যুর সাথে সাথে তার নামও বিলীন হয়ে যায় পৃথিবী থেকে। মৃত্যুর পর মানুষ আর তাকে স্মরণ করে না কখনই। একমাত্র পরোপকারী মনের অধিকারী বিত্তবান মানুষ সাধারণ মানুষের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে। কথায় বলে ‘বিত্তের চেয়ে চিত্ত বড়।’ সুন্দর মনের মানুষ সম্পদহীন হলেও অপরের ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা পায়। মানুষ তাকে মৃত্যুর পরেও অনন্তকাল মনে রাখে। মৃত্যুর পরও সে মানুষের শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায় হয় সিক্ত।
শিক্ষা: ধন-ঐশ্বর্য নয়, মানবকল্যাণকামী সহানুভূতিশীল মনই মানুষকে প্রকৃত মানুষে পরিণত করতে পারে। এ ধরণের মানুষই প্রকৃত মানুষ।
ধ্বনিটিরে প্রতিধ্বনি সদা ব্যাক্ত করে ধ্বনির কাছে ঋণী সে যে পাছে ধরা পড়ে।
ধ্বনি থেকে প্রতিধ্বনির সৃষ্টি বলে প্রতিধ্বনি ধ্বনির কাছে ঋণী। ধ্বনি সৃষ্টি না হলে প্রতিধ্বনি সৃষ্টি হতো না। কিন্তু প্রতিধ্বনি এ উপকার স্বীকার না করে নিজেকে গোপন রেখে নকলটিকে আসল বলে প্রচার করতে চায়। প্রতিধ্বনি মনে করে সে নিজে নিজেই উৎপত্তি লাভ করেছে; কেউই তাকে জন্ম দেয়নি। সে ধ্বনির উপকারের কথা স্বীকারই করতে চায় না। আমাদের মানব সমাজে প্রতিধ্বনির মতো অকৃতজ্ঞ লোকের অভাব নেই। যেসব মানুষদের কারণে তাদের উপকার হয়েছে, যাদের কারণে তাদের স্বার্থরক্ষা হয়েছে, সেসব মানুষদের প্রতি কৃতজ্ঞতা স্বীকার করতে তাদের বিবেকে বাধে। তারা মহৎ মানুষদের মহত্ত্বকে শ্রদ্ধার চোখে দেখে না। তারা সর্বদা অপরের মহত্ত্বকে খাটো করে দেখে। অপরের দ্বারা উপকৃত হয়ে তার প্রতি সামান্যতম কৃতজ্ঞতাবোধও প্রকাশ করে না। এ জগতে যারা পরের কল্যাণের জন্য কাজ করেন, অপরের উদ্দেশ্যে নিজের স্বার্থ উৎসর্গ করেন, তারা অকৃতজ্ঞ লোকের নানা অপমান, ব্যাঙ্গ-বিদ্রুপ, অবজ্ঞা-অবহেলা পাওয়া সত্ত্বেও নিজেদের আদর্শ থেকে পিছপা হয় না। শ্রম, শক্তি ও মেধা দ্বারা কল্যাণে রত এসব মহৎ লোক পৃথিবীতে পরম পূজনীয়। যে মানুষ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে না, তার মধ্যে মানবীয় গুণাবলীর ঘাটতি আছে। যার দ্বারা উপকৃত হবে, তার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করাই মহৎ মানুষের বৈশিষ্ট্য।
শিক্ষা: পৃথিবীতে মহৎ ব্যক্তিরা জীবন বাজি রেখে হলেও মানুষের উপকার সাধন করেন। এসব পরহিতব্রতী লোকদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে তাদের প্রাপ্য সম্মান দিতে হবে।
ফ্যাশনটা হল মুখোশ, স্টাইলটা হল মুখশ্রী।
সৃষ্টি ও ধ্বংসের সুপরিকল্পিত প্রভাবে গড়ে ওঠেছে আমাদের আজকের যুগের সভ্যতা ও সংস্কৃতি। সভ্যতা ও সংস্কৃতিকে ধরে রাখতে প্রতিটি জাতিই কম বেশি অনুকরণ করে থাকে। তাই সভ্যতার ধারক ও বাহক মানুষও অনুকরণপ্রিয়। তবে অনেক সময় মানুষ অন্ধ অনুকরণের মাধ্যমে তার নিজস্বতা ও স্বাতন্ত্র্য ভুলে যায়। কোনো জাতি যদি কখনো তার নিজস্ব কৃষ্টি, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ভুলে যায়, অনুকরণে নিজের আত্মতৃপ্তি খুঁজে পায়, তখন তার অন্তরের হীনতাই প্রকাশ পায়। কারণ প্রতিটি জাতির নিজস্ব সত্তার সাথে তার কৃষ্টি সংস্কৃতি, সভ্যতার যোগ অভিন্ন। কারণ একটি জাতির বৃহৎ অর্জনগুলো সংস্কৃতি ও সভ্যতার দ্বারাই নির্ণীত হয়। তাই মানুষের অন্ধ অনুকরণপ্রিয়তা একটি জাতির জন্য নীতি বিগর্হিত কাজ। এটা আসলে মুখোশের আড়ালে নিজেকে ঢেকে রাখার মতোই। তবে অনুকরণ সবক্ষেত্রেই নেতিবাচক প্রভাব ফেলে না। অন্যের ভালো গ্রহণ করা বা চর্চা করা কোনো দূষনীয় বিষয় নয়। কারণ এ সমাজ সংসারে উন্নত জাতির কাছ থেকে গ্রহণ করার মতো অনেক কিছু আছে। তবে আমাদের কাজ হলো তাদের মন্দটুকু বাদ দিয়ে ভালোটুকু যা আছে তা গ্রহণ করা। আর এ কাজটি যদি আমরা সফলভাবে করতে পারি এবং তা আমাদের সভ্যতা ও সংস্কৃতির সাথে আত্তীকরণ করি তাহলে আমাদের দেশ ও জাতির জন্য কল্যাণকরই হবে। এতে আমাদের সভ্যতা ও সংস্কৃতি অনেক বেশি পরিমার্জিত এবং পরিশোধিত হবে। সর্বদাই খেয়াল রাখতে হবে আমরা যেন আমাদের শিকড়কে ভুলে না যাই। যেকোনো বিষয়কে ভাল-মন্দ বিচার করে অনুকরণ বা অনুসরণ করলে মানুষের নিজস্ব চিন্তা চেতনার বিকাশ ঘটে। সমস্যা হয় তখনই যখন আমরা ভালোমন্দ বিচার না করে অন্ধভাবে অপরকে অনুকরণ করতে থাকি। এতে ব্যক্তির হীনতা তৈরি হয় এবং নিজের স্বকীয়তা ধ্বংস হয়। তাই নিজের হীনতা-দীনতা প্রকাশ না ঘটিয়ে স্বকীয়তা প্রকাশ করাই আমাদের কর্তব্য।
শিক্ষা: অপরের অনুকরণের মুখোশ না পরে নিজের ব্যক্তিত্বকে নিজের মতো করে বিকশিত করতে হবে। নিজের ব্যক্তিত্ব, পছন্দ-অপছন্দ প্রকাশ করা অনেক জটিল হলেও আমরা নিয়মিত চর্চার মাধ্যমে এ কাজটি যথাযথভাবে সম্পন্ন করতে পারি।
প্রয়োজনীয়তাই উদ্ভাবনের জনক।
সৃষ্টির আদিকালে, যখন মানুষ বিশৃঙ্খল ও নিরাপত্তাহীন জীবন-যাপন করতো। তখনই তারা একটা শৃঙ্খলাবদ্ধ, নিরাপদ ও সভ্য সমাজ জীবন গঠনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। আর তখন থেকেই মানুষের উদ্ভাবন ক্ষমতার সূচনা ঘটে যার ধারাবাহিকতা বর্তমানে অব্যাহত আছে এবং অনাদিকাল পর্যন্ত চলতে থাকবে। সমাজে জীবনধারণ করতে অনেক কিছুর প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। মানুষকে সর্বদা সচেষ্ট থাকতে হয় সেই প্রয়োজন মিটানোর জন্য। বিচিত্রমুখী উদ্ভাবনের জন্য সমাজে সভ্যতার বিচিত্র রূপ পরিলক্ষিত হয়। মানুষের সীমাহীন চাহিদা মিটাতে তৈরি হয়েছে নানা রকম জিনিসপত্র। প্রয়োজনের তাগিদেই মানুষ রেডিও, টেলিভিশন, কম্পিউটার, বিদ্যুৎ, এরোপ্লেন, ট্রেন ইত্যাদি আবিষ্কার করেছে। মানুষ স্বাচ্ছন্দ্যপূর্ণ জীবনযাপন করতে চায় এবং দুঃখ-কষ্ট থেকে পরিত্রাণ পেতে চায়। এক্ষেত্রে বিলাস বহুল উপাদান আবিষ্কারের মাধ্যমে মানুষ তার অনাকাঙ্ক্ষিত সুখী জীবন পেয়েছে। মানুষের প্রয়োজনের গভীরতাই তার উদ্ভাবনের নেশাকে বাড়িয়ে দিয়েছে। প্রয়োজন ছাড়া মানুষ কখনো কোনো কিছু সৃষ্টির তাগিদ অনুভব করেনি। তারা দুঃখ ও যন্ত্রণা সঙ্কুল দুর্গম পথে অগ্রসর হয়েছে প্রয়োজন নিবারণের জন্য। এভাবে মানুষ তার অত্যাবশ্যক সব চাহিদা মিটাতে হাজারো জিনিসের উদ্ভাবন করেছে। যখন যে জিনিসের অভাব ও প্রয়োজনবোধ করেছে তখন সে অনুযায়ী শক্তি, সাধনা, মেধা ও কর্মদক্ষতা দিয়ে নতুন নতুন প্রয়োজনীয় জিনিস তৈরি করে। জ্ঞান আহরণের কৌতূহল মানুষের প্রয়োজনকে মহাকাশ পর্যন্ত বিস্তৃত করেছে। প্রয়োজনের কোনো শেষ নেই তাই উদ্ভাবনের অন্ত নেই। প্রয়োজন ও উদ্ভাবন পরস্পর বিপরীতমুখী হলেও একে অপরের পরিপূরক। প্রয়োজন আছে বলেই মানুষ প্রতিনিয়ত উদ্ভাবন করে চলেছে।
শিক্ষা: প্রয়োজন পূরণ করার তাগিদেই উদ্ভাবনের প্রক্রিয়া এগিয়ে চলে। তাই উদ্ভাবনের জনক হিসেবে প্রয়োজনীয়তাকে আখ্যায়িত করা হয়। যখনই প্রয়োজন দেখা দেয় তখনই উদ্ভাবনের সূচনা ঘটে।
প্রাণ থাকলেই প্রাণী হয়, কিন্তু মন না থাকলে মানুষ হয় না।
পৃথিবীর সকল প্রাণীকে সৃষ্টি করেছেন মহান সৃষ্টিকর্তা। তিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন ‘আশরাফুল মাখলুকাত’ বা সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব হিসেবে। এই শ্রেষ্ঠত্বের কারণ মানুষের প্রাণ ছাড়াও রয়েছে মন ও বুদ্ধিমত্তা। গাছপালা, পশুপাখি ও অন্যান্য প্রাণীর শুধু প্রাণ আছে। তারা খাদ্য সংগ্রহ করে, বেড়ে উঠে, পূর্ণতা লাভ করে ও বংশবিস্তার করে। এতে তাদের কোনো কৃতিত্ব নেই। অনেক প্রাণী যথেষ্ট বুদ্ধিসম্পন্ন হলেও তাদের মন নেই। তারা ভালো-মন্দ, ন্যায়-অন্যায়ের পার্থক্য করতে পারে না। কিন্তু মানুষ পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করে পশুপাখির মতো জীবনধারণ করলে প্রকৃত মানুষ হতে পারে না। মানব মনের বিকাশের মাধ্যমে মনুষ্যত্ব নামক মহৎ গুণাবলি অর্জন করতে হয়। মন ও হৃদয় আছে বলেই মানুষ বিবেকবোধের অধিকারী হয়। ভালো-মন্দ, ন্যায়-অন্যায়ের বিচার করতে পারে। মনের সৎ চিন্তা, আবেগ ও প্রেম জীবনকে পূর্ণতা দেয়। মনের শক্তির জোরেই মানুষ বিজ্ঞান, সভ্যতা ও সংস্কৃতি সৃষ্টি করেছে। জলে, স্থলে, অন্তরীক্ষে উড়িয়েছে বিজয় পতাকা। মননশক্তি ও মনুষ্যত্ব অর্জনের মাধ্যমেই মানুষ সকল প্রাণীর উপর স্থান পেয়েছে। এই মনুষ্যত্ব অর্জন করতে হলে মনকে নির্লোভ, সংযমী, অহিংস ও মঙ্গলকামী করে তুলতে হয়। এজন্য মানুষকে অনেক প্রচেষ্টা, জ্ঞানসাধনা ও ত্যাগ স্বীকার করতে হয়। মানবিক গুণাবলি মানুষকে পশুত্ব থেকে মুক্তি দেয়। একজন সত্যিকারের মানুষ অসহায়কে সাহায্য করে, সহানুভূতি দেখায়। দেশ, জাতি ও মানুষের কল্যাণে নিজেকে উৎসর্গ করে। সততা, সত্যবাদিতা, ন্যায়নিষ্ঠা ও বিবেকবোধ প্রভৃতি সদগুণ মানুষকে সম্মানিত করে। এসব গুণাবলি অর্জন ছাড়া মানুুষ প্রকৃত মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেতে পারে না।
শিক্ষা: মানবজীবনের শ্রেষ্ঠ সাধনা হলো মনুষ্যত্ব অর্জনের সাধনা, এর মাধ্যমে প্রকৃত মানুষ হওয়া সম্ভব। মানুষকে প্রাণিকুলের মধ্যে শ্রেষ্ঠত্ব বজায় রাখতে হলে তার চিন্তাচেতনা, মানবিক গুণাবলি, মহৎকর্ম প্রভৃতির উৎকর্ষ সাধন করতে হবে।
প্রয়োজন ব্যতিত বন্ধু ও শত্রু চেনা যায় না।
শিক্ষা: বন্ধু নির্বাচন করতে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। বন্ধু জীবনে চলার পথে অপরিহার্য অঙ্গ। অপ্রকৃত বন্ধুদের থেকে দূরে থাকতে হবে।
প্রয়োজনে যে মরিতে প্রস্তুত, বাঁচিবার অধিকার তাহারই।
মানবজীবন ক্ষণস্থায়ী। এ জন্য মৃত্যু ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে থাকলে জীবনকে পরিপূর্ণভাবে উপভোগ করা যায় না। মৃত্যু ভয়ে সদা ভীত যে ব্যক্তি সে বেঁচে থেকেও মৃত। বাঁচার মতো বাঁচতে হলে মহৎ ত্যাগের মধ্য দিয়ে জীবনকে সার্থক করে তুলতে হবে। মৃত্যুঞ্জয়ী মানুষের ত্যাগের মধ্য দিয়েই গড়ে উঠেছে সমাজ ও সভ্যতা। এই সকল ব্যক্তিরাই পৃথিবীতে বেঁচে থাকার যোগ্য। প্রতি মুহূর্তে মৃত্যু ভয়ে ভীত যে ব্যক্তি তার জীবন অর্থহীন। জীবনকে সার্থক করে তুলতে হলে মৃত্যু ভয় পরিত্যাগ করতে হবে। বস্তুত কাজের মধ্যেই জীবনের প্রকৃত মর্যাদা। আর যেকোনো কাজই কমবেশি ঝুঁকিপূর্ণ। তবে কোনো কোনো কাজে এই ঝুঁকি অনেক বেশি থাকে। যারা প্রকৃত মানুষ তারা কোনো কাজেই ভয় করে না বরং সাহসের সঙ্গে এগিয়ে যায়। জীবনকে হাতের মুঠোয় নিয়ে এরাই খনি থেকে মূল্যবান সম্পদ তুলে আনে। এরাই স্বাধীনতা ও মুক্তি সংগ্রামের ডাকে সাড়া দিয়ে ঘর ছেড়ে যুদ্ধের ময়দানে গিয়ে অকাতরে প্রাণ দেয়। পৃথিবীকে মানুষের বাসযোগ্য করে তুলতে এইসব মৃত্যুঞ্জয়ী মানুষেরাই যুগে যুগে প্রাণ দিয়েছে বন্য প্রাণীর হাতে, প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে পড়ে। এসব মরণজয়ী সাহসী বীরের হাত ধরেই সমাজ ও জাতীয় জীবনে সফলতা আসে। যারা প্রকৃত বীর তারা মৃত্যুকে তুচ্ছ করে সফলতার পথে এগিয়ে যায়। এ পথে যদি তাদের মৃত্যু আসে তবু তারা হাসিমুখে সেই মৃত্যুকে বরণ করে নেয়। বেঁচে থাকা তাঁদের জীবনের একমাত্র লক্ষ্য নয় বরং আসন্ন মৃত্যুকে হাসিমুখে বরণ করার মধ্যে দিয়ে তারা লাভ করে অমরত্ব। যেমনিভাবে পৃথিবীর বুকে অমর হয়ে আছেন সক্রেটিস, আইনস্টাইন, নিউটন, নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু, চিত্তরঞ্জন দাশ প্রমুখ। এই অমরত্ব লাভের জন্য প্রয়োজন সাহসী মনোভাব, মহৎ কর্ম এবং প্রয়োজনবোধে আত্মত্যাগ।
শিক্ষা: মৃত্যুর মতো ভয়াবহ সত্যকে অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। কিন্তু তাই বলে জীবনের প্রতিটি আনন্দঘন মুহূর্ত মৃত্যুভয়ে নষ্ট করা বোকামী। বরং মৃতুকে তুচ্ছ জ্ঞান করে জীবনকে যে উপভোগ করতে পারে একমাত্র সে-ই বেঁচে থাকার স্বাদ নিতে সক্ষম।
প্রীতিহীন হৃদয় আর প্রত্যয়হীন কর্ম দুই-ই অসার্থক।
মানুষের হৃদয় তৈরিই হয়েছে একে অপরের মধ্যে প্রীতি ভালোবাসা আদান-প্রদানের জন্য। এ কারণেই দুঃখে, দুর্দিনে, বিপদে-আপদে মানবহৃদয় কেঁদে ওঠে। তাই একে অপরের দুর্দিনে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়। মানব হৃদয়ে প্রীতি আছে বলে পৃথিবীতে আজ মানুষ টিকে আছে, তার নিজস্ব সৌন্দয্য নিয়ে। যার হৃদয়ে অপরের জন্য প্রেম-ভালোবাসা আছে সে হৃদয় শুধু মানুষের কষ্টেই কাঁদে না, পৃথিবীর প্রতিটি জীবের জন্য তার হৃদয় কেঁদে ওঠে। আর যে হৃদয়ে প্রীতি নেই, তার কাছে পৃথিবীর কোনো জীবই নিরাপদ নয়। যেকোনো ধরণের অকল্যাণকর কাজ সে নির্দ্বিধায় করতে পারে। প্রীতিও ভালোবাসার অভাবেই জাতিতে জাতিতে হয় রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ, প্রাণহানি হয় লক্ষ কোটি মানুষের। মানব হৃদয়ে প্রীতি যত বাড়বে তত সুখ শান্তিতে মানুষ বসবাস করতে পারবে। অন্যদিকে সফলভাবে যেকোনো কাজ সম্পাদনের পূর্বশর্ত হলো কাজের প্রতি প্রত্যয় অর্থাৎ বিশ্বাস। আত্মবিশ্বাস ছাড়া কোনো কাজে সফলতা আসে না। কোনো কাজ শুধু করার জন্য না করে, কাজকে ভালোবেসে আত্মবিশ্বাস নিয়ে করতে হয়। যদি অত্যন্ত কঠিন কাজ করার জন্য কেউ প্রতিজ্ঞা করে এবং ‘আমি পারব’ এই বিশ্বাস নিয়ে কাজ শুরু করে, তাহলে সে অবশ্য ঐ কাজে সফল হবে।
শিক্ষা: প্রীতিহীন হৃদয় শুধু যে মানুষের জন্য অকল্যাণকর তাই না; তার চেয়ে বড় কথা সে হৃদয় পশুর হৃদয়ের সমতুল্য। আবার প্রত্যেক কাজে সফলতার ভিত্তি হলো আত্মবিশ্বাস। আত্মবিশ্বাস অর্থাৎ প্রত্যয় ছাড়া কর্মে সার্থকতা অসম্ভব।
ফুলের বাগান সবার মনেই আছে ফুল ফোটাতে সবাই নাহি পারে।
মানুষের জীবন ফুল বাগানের মতো। বাগানে গাছ লাগালেই কাজ শেষ হয়ে যায় না। বাগানের পরিচর্যা না করা হলে তা জঙ্গলে পরিণত হয়। আগাছা বাগানের সৌন্দর্য নষ্ট করে দেয়। বাগানের লাগানো গাছ মালির নিবিড় পরিচর্যায় সৌন্দর্য ছড়ায়। তেমনি বিধাতা প্রদত্ত মানবিক গুণাবলী উপযুক্ত জ্ঞান ও অধ্যবসায় দ্বারা জাগিয়ে তোলার মধ্যেই রয়েছে সার্থকতা। মানুষ মাত্রই সুন্দরের পূজারী। কিন্তু সুন্দর কিছু কল্পনা করা সহজ হলেও বাস্তবে তা অর্জন করা কঠিন। এর জন্য প্রয়োজন কঠোর পরিশ্রম ও নিরলস সাধনা। মানুষের মানবিক গুণাবলীর যথাযথ বিকাশ সাধন হলে জীবন হবে ফুলের মতো। ফুল বাগান ফুলে ফুলে ছেয়ে আছে দেখে সবারই ভালো লাগে। তবে এই সৌন্দর্য এমনি এমনি সৃষ্টি হয় না। এর পেছনে থাকে ফুল বাগানের মালির ধারাবাহিক কর্মপ্রচেষ্টা। উপযুক্ত পরিচর্যার অভাবে যেমন ফুল বাগানে ফুল ফোটে না তেমনি উপযুক্ত জ্ঞান ও অধ্যবসায়ের অভাবে মানুষের গুণাবলী অঙ্কুরে বিনষ্ট হয়। মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব। মানুষ ও পশুর মধ্যে পার্থক্য হলো মানুষের মানবিকতা ও চিন্তাশক্তি আছে আর পশুর তা নেই। এই মানবিকতা যখন অকার্যকর হয়ে যায় তখন মানুষ আর পশুর মধ্যে কোনো পার্থক্য থাকে না। মানুষের একটা সাধারণ বৈশিষ্ট্য হলো তারা স্বল্প পরিশ্রমে সুখ লাভ করতে চায়। কিন্তু ভালো কিছু পেতে হলে প্রয়োজন ধৈর্য, সাধনা ও ত্যাগ। মানুষের মনের সৌন্দর্য ও স্বার্থকতা যথাযথভাবে বিকশিত করতে শিক্ষা ও অধ্যবসায়ের কোনো বিকল্প নেই।
শিক্ষা: ফুলের বাগান যেমন যত্নে ও পরিচর্যার মাধ্যমে ফুলে ফুলে পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে তেমনি পরিশ্রম, ধৈর্যের মাধ্যমে প্রতিভার বিকাশ ঘটলে মানুষের জীবন সার্থক হয়।
বই কিনে কেউ কোনো দিন দেউলিয়া হয় না।
বই এমন এক সঙ্গী যা কখনও ফাঁকি দেয় না। বই নিজে নিরব কিন্তু মানুষের মনকে সরব করতে অর্থাৎ জাগাতে প্রধান ভূমিকা রাখে। মানুষ জীবনে দুই ভাবে জ্ঞানার্জন করে। প্রথমতঃ বই পড়ে, দ্বিতীয়তঃ অভিজ্ঞতা থেকে। বই পড়ে বিশ্বের অনেক কিছু জানা যায়। কিন্তু বই পাঠ করে যে পরিমাণ জ্ঞান আহরণ করা সম্ভব সেই তুলনায় অর্থ নগন্য। জীবনের সব সম্পদ ভাগ বা নষ্ট হয়ে গেলেও জ্ঞান কখনও নষ্ট হয় না। বই যুগের সাথে যুগের বন্ধন তৈরি করে। প্রাচীন কাল থেকে বর্তমানের সাথে সংযোগ স্থাপন করে বই। বই এর মাধ্যমে আমরা মনের আনন্দ পেয়ে থাকি। তবে বই কিনতে অনেকে অনীহা প্রকাশ করে। কারণ এতে অর্থ ব্যয় হয়। কিন্তু তারা এটা ভাবে না যে, বই কিনলে যতটা আর্থিক ক্ষতি হয় তার চেয়ে অনেক গুণ বেশি জ্ঞানার্জন হয়। বই হচ্ছে জানা-অজানা তথ্যের ভান্ডার। বর্তমান যুগ হলো তথ্যের যুগ। তথ্য অর্জন করে সমৃদ্ধ শক্তিশালী হতে হলে বই পড়তে হবে। যে জাতি যতবেশি বই পড়ে জ্ঞানার্জন করে সে জাতি ততবেশি এগিয়ে যায়। তাই বই পড়ার কোনো বিকল্প নেই। বই এমনি এক অমূল্য সম্পদ যা মানুষের মনকে সাজিয়ে তোলে। বই থেকে প্রাপ্ত জ্ঞান অমূল্য বলেই বই কিনে কেউ দেউলিয়া হয় না। বই পৃথিবীর সকল বিষয়ের জ্ঞানের আধার। বই থেকে মানুষ তুলনামূলক কম অর্থ ও শ্রমের বিনিময়ে অধিক পরিমাণ জ্ঞান আহরণের সুযোগ লাভ করে। জগতের বিখ্যাত সকল মনীষীগণ তাদের মতবাদ, তত্ত্ব ও দর্শন বইয়ের মধ্যে ধারণ করে গেছেন। অনেক সহজেই এসব বই পাঠ করে আমরা তাদের কর্ম ও জীবন সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করতে পারি।
শিক্ষা: মানুষ যে অবস্থাতেই থাকুক না কেন বই এর গুরুত্ব অপরিসীম। বই কিনলে মানুষ কখনও নিঃস্ব হয় না বরং মানসিক ও আর্থিক দিক থেকে আরো স্বচ্ছল হয়। সুতরাং বই কিনে পড়ার মাধ্যমেই প্রত্যেক ব্যক্তি স্ব স্ব জায়গায় সফলতা অর্জন করে।
বড় যদি হতে চাও ছোট হও তবে।
বিনয় পরম ধর্ম। বিনয়ী হতে পারা যেকোনো মানুষের মহৎ গুণ। যারা অহংকারকে পরিত্যাগ করে বিনয়ী হতে পারে তারাই অন্যদের কাছ থেকে যথাযথ মর্যাদা লাভ করতে পারে। উচ্চাভিলাস বা বড় হওয়ার বাসনা মানুষের স্বভাবগত বৈশিষ্ট্য। মান-সম্মান, বংশ-মর্যাদা এবং সুনাম অর্জনের ক্ষেত্রে সকলেই চায় অন্যদের থেকে উচ্চ স্থানের অধিকারী হতে। এই লক্ষ্য অর্জনে তারা প্রতিযোগিতায় মেতে ওঠে। কেউ হয়তো জননেতার বেশে সাধারণ মানুষকে আশার আলো দেখিয়ে আবার কেউ হয়তো অর্থ-সম্পদ ও ক্ষমতার দ্বারা প্রভাব বিস্তার করে নিজেদেরকে বড় ও মহৎ হিসেবে জাহির করতে চায়। কিন্তু বাস্তবতা হলো এটাই যে, এসবের কোনো কিছুই মানুষকে প্রকৃত অর্থে বড় করে তুলতে পারে না। এই ধরণের ব্যক্তি কখনও কারো কাছ থেকে সম্মান পায় না। সাধারণ মানুষ মুখে সমর্থন করলেও মন থেকে তাদেরকে ঘৃণা করে। নম্রতা, কোমলতা এবং সৌজন্যবোধ ছাড়া কেউ সমাজে প্রতিষ্ঠা লাভ করতে পারে না। চিন্তা- চেতনায় উদার হওয়া এবং বিনয়ের সাথে জীবন পরিচালনা করলে মানুষের মন জয় করা সম্ভব। এই পৃথিবীর ইতিহাসে যেসব মহৎ ব্যক্তি অমর ও চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন, তাদের জীবনী পর্যবেক্ষণ করলে জানা যায়, তাঁরা সকলেই বিনয়ী ছিলেন। মুসলিম সম্প্রদায়ের অবিসংবাদিত নেতা হযরত মুহম্মদ (স.) তাঁর বিনয় দ্বারা মানুষকে ধর্মের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। গৌতম বুদ্ধ, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, হাজী মুহম্মদ মুহসীন প্রমুখ মনীষীগণ বিনয়ের বাস্তব উদাহরণ। বিনয়ই তাদেরকে মানুষের কাছে আসতে এবং তাদের অকৃত্তিম ভালোবাসা অর্জন করতে সাহায্য করে। কাউকে সম্মান করার মাধ্যমে নিজের ক্ষুদ্রতা প্রকাশ পায় না। অন্যকে অবজ্ঞা করে কেউ বড় হতে পারেনি এ জগতে। যে সব রাজা-বাদশা এবং সেনানায়কগণ অহংকার আর ক্ষমতার বলে অন্ধ ছিলেন তারা ইতিহাসে আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছে। পৃথিবীর মানুষ ঘৃণাভরে সারাজীবন তাদের নাম উচ্চারণ করবে।
শিক্ষা: নিজেকে সম্মানিত করতে হলে অপরকে সম্মান দিতে হবে, বিনয় প্রদর্শন করতে হবে। আপন কর্মই মানুষকে সমাদৃত করে। অন্যকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করলে প্রকৃতপক্ষে নিজের বড় হওয়ার পথ অবরুদ্ধ হয় এবং নিজেকেই হেয় প্রতিপন্ন করা হয়।
বন থেকে জানোয়ার তুলে আনা যায় কিন্তু জানোয়ারের মন থেকে বন তুলে ফেলা যায় না।
মানুষ ও বন্য জানোয়ারের মাঝে মূল পার্থক্য হলো স্বভাব ও প্রকৃতিগত। অবস্থানের পরিবেশ এখানে মুখ্য নয়। অবস্থানগত দিক থেকে বন্য প্রাণীর আবাসস্থল হচ্ছে বন-জঙ্গল। অন্যদিকে মানুষ বাস করে লোকালয়ে। স্রষ্টা যেমন মানুষ ও জানোয়ারের মাঝে পরিবেশগত ভিন্নতা দিয়েছেন, তেমনি তাদের মনোজগতে দিয়েছেন স্বভাব ও প্রকৃতিগত ভিন্নতা। বন্য প্রাণী কিংবা মানুষ- উভয়কেই নিজ পরিবেশ থেকে তুলে এনে অন্য পরিবেশ ভুক্ত করা যায়। কিন্তু তাতে শুধু দৈহিকভাবে অবস্থানের পরিবর্তন ঘটে। আচরণের কোনো পরিবর্তন ঘটে না। হিংস্র বন্য জন্তুকে লোকালয়ে এনে সভ্য করার চেষ্টা করা হলেও তার জান্তব আচরণ দূর করা সম্ভব নয়। কেননা সে প্রাকৃতিকভাবেই হিংস্র ও বন্য। তার দেহ লোকালয়ে অবস্থান করলেও মনোজাগতিকভাবে সে বনে বাস করে। মানুষ সুষ্টির শ্রেষ্ঠ হলেও কিছু মানুষ আছে যারা প্রকৃতগতভাবে অসৎ। এইসব মানুষদের পরিবেশের পরিবর্তন ঘটিয়ে সুন্দর ও আলোকিত পরিবেশে অন্তর্ভুক্ত করা যায়। সৎ ও ভালো মানুষের সাহচর্যে রেখে সৎ মানুষে পরিণত চেষ্টা করাও অসম্ভব নয়। কিন্তু তাদের সহজাত প্রবৃত্তির কোনও ইতিবাচক উন্নয়ন ঘটে না। কেননা মনোজগতে প্রকৃতিগত কোনোও পরিবর্তন হয় না। যারা স্বভাবগতভাবে অসৎ নয়, বরং সঙ্গদোষে কিংবা কুপ্রবৃত্তির তাড়নায় অসৎ হয় তারা সুস্থ্য-সুন্দর পরিবেশের প্রভাবে সৎ মানুষে পরিণত হতে পারে।
শিক্ষা: মানুষ কিংবা অন্যান্য প্রাণীর মনোজাগতিক প্রকৃতি, স্বভাব, স্বধর্ম অপরিবর্তনশীল। জীবনের নিরাপত্তার জন্য মানুষ হিংস্র-বন্য প্রাণী থেকে নিজেদের নিরাপদ দূরত্বে রাখে। তেমনি সুস্থ্য-সুন্দর জীবনের জন্য অসৎ মানুষদের ব্যাপারে সব সময় সচেতন থাকা জরুরী।
পরিশ্রম সৌভাগ্যের প্রসূতি
মেধা, বুদ্ধি, কর্মশক্তি ইত্যাদি বৈশিষ্ট্য মানুষকে অন্যান্য প্রাণী থেকে স্বাতন্ত্র্য দান করেছে। এসব বৈশিষ্ট্যকে কাজে লাগিয়ে, পরিশ্রমের মাধ্যমে মানুষ সফলতা বা সৌভাগ্যের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়। সৌভাগ্য ঈশ্বর প্রদত্ত কোনো বিষয় নয়, তাকে শ্রমের দ্বারা অর্জন করে নিতে হয়। মানবজীবনে সাফল্য লাভ করতে হলে অলসতায় গা না ভাসিয়ে কঠোর পরিশ্রম করতে হবে। প্রাচীনকাল হতে বর্তমানকাল পর্যন্ত যত মনীষী সাফল্যের স্বর্ণশিখরে আরোহণ করেছেন প্রত্যেকেই কঠোর পরিশ্রম করেছেন। তাইতো বলা হয় সফলতা অর্জনের মূলে রয়েছে পরিশ্রম। ব্যক্তিগত ও জাতীয় জীবনে সফলতা অর্জনের জন্য শ্রম অপরিহার্য। দেখা যায়, পৃথিবীতে যে জাতি যত পরিশ্রমী তারা তত উন্নত। তাই পরিশ্রমকে সৌভাগ্যের চাবিকাঠি বলা হয়। অন্যদিকে, মেধা থাকা সত্ত্বেও যদি কেউ তা কাজে লাগানোর চেষ্টা না করে, তাহলে দুর্ভাগ্য তার জীবনকে অক্টোপাসের মতো ঘিরে ফেলে। আমরা যদি ভালো ক্রিকেট খেলোয়াড় হতে চাই তাহলে আমাদেরকে মাঠে অনুশীলন করতে হবে, ঘরে বসে শুধু স্বপ্ন দেখলে হবে না। তেমনি জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সফল হতে হলে শ্রম, সাধনা ব্যতীত বিকল্প কোনো পথ নেই। তাই বলা হয়ে থাকে, হাত জোড় করে নয়, হাত মুঠো করে নয়, পেতে হলে হাত লাগাতে হবে।
শিক্ষা: জীবনে সফল ও সৌভাগ্যবান হওয়ার মূলমন্ত্র পরিশ্রম। যেকোনো লক্ষ্য পূরণের ক্ষেত্রে প্রচেষ্টা বা পরিশ্রম মূলশক্তি হিসাবে কাজ করে। তাই জীবনকে সফল করার জন্য আমাদের নিরন্তর পরিশ্রম করা প্রয়োজন।
পথের প্রান্তে আমার তীর্থ নয় পথের দু’ধারে আছে মোর দেবালয়।
তীর্থ পবিত্র স্থান ও পুণ্যক্ষেত্র। অনেক মানুষ মনে করে সৃষ্টিকর্তার স্থান তীর্থে বা মন্দিরে। মানুষ তাই পরম করুণাময় সৃষ্টিকর্তার সান্নিধ্য লাভের জন্য তীর্থে তীর্থে ভ্রমণ করে। পুণ্য প্রত্যাশী মানুষ লোকালয় থেকে বহুদূর পথের প্রান্তে নির্জন স্থানে বা মন্দিরে পবিত্র মনে স্রষ্টাকে স্মরণ করে। স্রষ্টার করুণা লাভের চেষ্টা করে। মানুষ ভাবে তীর্থই বুঝি সৃষ্টিকর্তার সাথে মিলনের একমাত্র পবিত্র স্থান। এই ভুল বিশ্বাসের বশবর্তী হয়ে যারা পথের দু’পাশের অসহায় মানুষকে অবহেলা করে অন্ধভাবে চলে, পথের শেষে সৃষ্টিকর্তার সান্নিধ্য লাভে তারা শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়। কেননা দেবতার অধিস্থান শুধু মন্দিরে বা তীর্থে নয়, তিনি সর্বত্রই বিরাজমান। সুঃখ-দুঃখের এই মানব সংসারে সৃষ্টিকর্তা বহুরূপে তার সৃষ্টির মধ্যেই বিরাজ করেন। তাঁকে পথের দু’পাশেও পাওয়া যায়, গহীন অরণ্যেও পাওয়া যায়, আবার জনাকীর্ণ লোকালয়েও পাওয়া যায়। সব মানুষকে একটি গভীর সত্য মনে রাখতে হবে যে, মানুষকে ভালোবাসা ও সেবার মাধ্যমেই সৃষ্টিকর্তাকে পাওয়া সম্ভব। যিনি মানুষকে ভালোবাসতে পেরেছেন পৃথিবীর সকল স্থানই তার কাছে তীর্থভূমি মনে হয়। মানুষকে ভালোবেসে জগৎ সংসারকে তীর্থক্ষেত্রে পরিণত করাই মানুষের বড় ধর্ম। মনুষ্যত্ত্বের গুণে মানুষ যখন নিজের স্বার্থের কথা ভুলে পরার্থে, মানুষের কল্যাণে, অসহায়ের সাহায্যে, আর্ত-পীড়িতের সেবার নিজেকে বিলিয়ে দেয় তখনই সৃষ্টিকর্তার সন্ধান পায়। স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন “জীব সেবাই ঈশ্বর সেবা।” অর্থাৎ সৃষ্টিকর্তাকে পেতে হলে প্রথমেই তাঁর সৃষ্টিকে ভালোবাসতে হবে। মানব সমাজের প্রত্যেক জীবকে ভালোবাসাই সৃষ্টিকর্তাকে পাওয়ার একমাত্র উপায়। সমাজ বিচ্ছিন্ন কোনো দূরবর্তী স্থানকে তীর্থ বা দেবালয় ভাবা ভুল।
শিক্ষা: সৃষ্টিকর্তার কাছে পৌঁছাতে বহু দূরের তীর্থ ভ্রমণ নয়, সৃষ্টিকর্তার প্রত্যেক সৃষ্টিকে ভালোবাসা, সেবা করা ও মানব কল্যাণে জীবন বিলিয়ে দেওয়াই একমাত্র উপায়।
পরের অনিষ্ট চিন্তা করে যেই জন নিজের অনিষ্ট বীজ করে সে বপন।
মানুষ একা বাস করতে পারে না। তাকে সমাজের মধ্যে বাস করতে হয়। সমাজে প্রতিটি মানুষ পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে বাস করে। মানুষের অন্যতম মানবিক এবং নৈতিক গুণ হচ্ছে একে অপরের কল্যাণসাধন করা। মানুষ শুধু নিজের কথা চিন্তা করে পৃথিবীতে বেঁচে থাকে না। মানুষকে তার চারপাশের জগৎ নিয়েও ভাবতে হয়। যে ব্যক্তি সর্বদা অন্যের কল্যাণ এবং উপকারের কথা চিন্তা করে, সেই ব্যক্তি সমাজে সম্মানিত ব্যক্তি হিসেবে বিবেচিত হন। তিনি সমাজের সর্বস্তরের মানুষের কাছে ভালোবাসা এবং শ্রদ্ধার ব্যক্তি হিসেবে গণ্য হন। কিন্তু লোভের বশবর্তী হয়ে কেউ যখন নিজের ব্যক্তিস্বার্থকে প্রাধান্য দেয়, তখন সে অন্যের ক্ষতি করতেও পিছপা হয় না। অন্যের ক্ষতি করে নিজের স্বার্থ উদ্ধার করা চরম অন্যায় হিসেবে বিবেচিত। অন্যায়কারীরা নিজের স্বার্থসিদ্ধি করতে গিয়ে সমাজ, দেশ এবং জাতির চরম ক্ষতিসাধন করে। এরা সমাজের মানুষের নিকট ঘৃণ্য ব্যক্তি হিসেবে চিহ্নিত হয়। অন্যায়কারীরা সব সময় হীনমন্যতায় ভোগে। তাই তাদের মন-মানসিকতায় শুদ্ধি আসে না। ফলে তারা তাদের কর্মক্ষেত্র তথা জীবনে উন্নতি করতে পারে না। পরের অনিষ্টকারী ব্যক্তিরা অপরের জন্য পাতা ফাঁদে নিজেরাই পতিত হয়। নিজ স্বার্থ উদ্ধার করতে গিয়ে মহাবিপদ ডেকে আনে।
শিক্ষা: প্রত্যেক মানুষেরই উচিত জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে অপরের মঙ্গল কামনা করা, অপরের মঙ্গল করার চেষ্টা করা। তবেই নিজের কল্যাণ সাধিত হবে।
পাপকে ঘৃণা কর, পাপীকে নয়।
মানুষ ‘আশরাফুল মাখলুকাত’ বা সৃষ্টির সেরা জীব। স্বীয় বিবেক-বুদ্ধি, মেধা-মননের গুণেই সে শ্রেষ্ঠ। কোনো মানুষই অপরাধী হয়ে পৃথিবীতে আসে না। প্রতিটি মানুষই নিষ্পাপ অবস্থায় জন্মগ্রহণ করে। জন্মের পর বিরূপ পরিবেশ, নেতিবাচক পারিপার্শ্বিকতার প্রভাবে অনেক সময় তার বিবেক-বুদ্ধি, ন্যায়-অন্যায়, বিচারবোধ অনিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়ে। তখন সে পাপাচারে লিপ্ত হয়। মানুষের এই পাপকার্যে লিপ্ত হওয়ার পেছনে মুখ্যত সে নিজে দায়ী নয়। তাই পাপকার্য ঘৃণিত ও বর্জনীয় হলেও পাপীকে বর্জন করা উচিত নয়। বরং তাকে কলুষতামুক্ত জীবনে ফিরে আসার সুযোগ দেয়া অন্য সকল মানুষেরই দায়িত্ব এবং কর্তব্য। পাপ এক ধরণের ব্যাধি। মানুষ রোগ-ব্যাধিকে ঘৃণা করলেও রোগাক্রান্ত মানুষকে ঘৃণা করে বর্জন করতে পারে না। পাপ ময়লা-আবর্জনা স্বরূপ। ময়লা-আবর্জনা ধারণকারী ডাস্টবিনকে কেউ সযত্নে ঘরে তুলে রাখে না। পাপরূপী আবর্জনাকে ধারণ করলেও মানুষ কিন্তু ডাস্টবিন নয়। ডাস্টবিন জন্ম থেকেই ডাস্টবিন। আর মানুষ জন্ম থেকেই মানুষ। আবর্জনা পরিষ্কার করলেও ডাস্টবিন গ্রহণীয় নয়। কিন্তু মানুষ পাপমুক্ত হলে সভ্যসমাজে সাদরে গ্রহণীয়। দিনের পর দিন অপরাধ করলেও মহান স্রষ্টা তাঁর প্রিয় সৃষ্টি মানুষকে ঘৃণায় ছুঁড়ে ফেলেন না। আত্মশুদ্ধি অর্জনের মাধ্যমে সুস্থ-সুন্দর জীবনে ফিরে আসার পর্যাপ্ত সময় ও সুযোগ দান করেন। ভয়ঙ্কর অপরাধীকেও অনুতপ্ত হয়ে আইনের কাছে আত্মসমর্পণ করতে দেখা যায়। ইতিহাসে এরূপ বহু নজির আছে। বস্তুত পাপী বড় অসহায়, দুঃখী। তাকে ঘৃণায় দূরে ঠেলে দিলে সে আরও অপরাধপ্রবণ হয়ে পড়তে পারে। আলোকিত জীবনে ফিরে আসার সুযোগ না পেয়ে সে গভীর অন্ধকারে চিরতরে হারিয়ে যেতে পারে।
শিক্ষা: পাপকাজ অবশ্যই ঘৃণিত ও পরিত্যাজ্য। কিন্তু পাপীকে ঘৃণায় দূরে না ঠেলে তাকে সংশোধনের সুযোগ দিতে হবে। স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে তাকে সহানুভূতির সঙ্গে সহায়তা করতে হবে।
পুষ্প আপনার জন্য ফোঁটে না।
মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব। এ পৃথিবীতে যা কিছু আছে সবই মানুষের জন্য সৃষ্টি হয়েছে। ফুল প্রকৃতির একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। ফুলের সৌরভ ও সৌন্দর্য সকলকে মোহিত করে। আর সেই সৌরভ ও সৌন্দর্য অপরের জন্য বিলিয়ে ফুল তার জীবনকে সার্থক করে তোলে। বিনিময়ে সে কিছুই চায় না। মানুষের চারিত্রিক মাধুর্যও হওয়া উচিত ফুলের মতোই সুন্দর, পবিত্র ও নির্মল। জগতের মহৎ, সাধু ও জ্ঞানী ব্যক্তিরা অন্যের মঙ্গলে নিজের জীবন অবলীলায় উৎসর্গ করেছেন। তাঁরা ফুলের মতোই নিজের সর্বস্ব মানবকল্যাণে বিলিয়ে দিয়ে তৃপ্তি লাভ করেন। জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত তারা মানুষের কল্যাণের জন্যে কাজ করে থাকেন। বস্তুত নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকা জীবনের সার্থকতা নয়। মানুষ শুধু ভোগ-বিলাস ও নিজ স্বার্থ রক্ষার জন্যই জন্ম নেয়নি। সে তার জ্ঞান ও ক্ষমতার দ্বারা অপরের সাহায্যার্থে এগিয়ে আসতে পারে। প্রতিটি মানুষ যদি পরের কল্যাণসাধন ও আনন্দদানের জন্য কাজ করে তাহলে সমাজ সুন্দর ও সার্থক হয়ে উঠবে। যেদিন আমরা ফুলকে আদর্শ ভেবে পরের কল্যাণে জীবনকে বিলিয়ে দিতে পারবো সেদিনই আমাদের সমাজজীবনে দুঃখ, যন্ত্রণা, বৈষম্যের অবসান ঘটবে। মানুষের জীবন হয়ে উঠবে আনন্দঘন ও কল্যাণময়। যে ব্যক্তি আত্মকেন্দ্রিক এবং নিজের স্বার্থের জন্য যেকোনো অপকর্ম করতে দ্বিধাবোধ করে না সে দেশ ও জাতির জন্য অভিশাপস্বরূপ। সে জন্যে মানুষ যদি নিজেকে পুষ্পের মতো বিকশিত করে এবং নিজ যোগ্যতা ও ক্ষমতা অনুযায়ী কল্যাণকর কাজের মাধ্যমে নিজেকে নিয়োজিত করে তাহলেই মানবজীবন সার্থক হয়। তাই ব্যক্তি স্বার্থের কথা চিন্তা না করে সবার কথা ভাবতে হবে। পরার্থে জীবন উৎসর্গ করতে পারলে, মানুষের জীবনও পুষ্পের মতো সুন্দর ও সৌরভময় হয়ে ওঠবে।
শিক্ষা: পরের কল্যাণে নিজেকে উৎসর্গ করার মধ্যেই প্রকৃত সুখ নিহিত। আত্মস্বার্থ চিন্তা কখনোই মানুষকে মহৎ করে তোলে না। তাই আমাদের মানবকল্যাণে নিজেদের নিয়োজিত করতে হবে।
পেচাঁ রাষ্ট্র করে দেয় পেলে কোনও ছুতা, জান না আমার সাথে সূর্যের শত্রুতা।
অন্ধকারের প্রাণী পেঁচা। আঁধারেই তার জন্ম, জীবন-যাপন ও বসবাস। সূর্যের প্রখর আলো সহ্য করার ক্ষমতা তার নেই। এজন্য সে দিনের বেলায় আত্মগোপন করে থাকে। নিজের এ অক্ষমতাকে ঢাকতে সে প্রতিহিংসামূলক বুলি আওড়ে বেড়ায়। বিভিন্ন ছল-ছুতোয় সে ঢাকঢোল পিটিয়ে প্রচার করে বেড়ায় যে, সূর্যের সাথে তার আজন্ম শত্রুতা রয়েছে। এজন্যই সে ঘৃনায় দিনের বেলায় বাসা থেকে বের হয় না। এখানে হীনমন্য মানবচরিত্রের বাস্তব চিত্র ফুটে ওঠেছে। হীন ও নীচ, দুর্বল ও অক্ষম ব্যক্তিরা মহান ব্যক্তিদের ঈর্র্ষা করে। তাদের সম্মান ও গৌরব দেখে আত্মবঞ্চনার আগুনে জ্বলে-পুড়ে মরে। অযোগ্যতা সত্ত্বেও তারা নিজেদেরকে মহৎ মানুষদের কাল্পনিক প্রতিদ্বন্দ্বী ভেবে আত্মপ্রসাদ লাভ করতে চায়। এইসব ক্ষুদ্র মানুষেরা লজ্জা ও হিংসায় জনসম্মুখে খুব একটা বের হয় না। মহৎ ব্যক্তিদের কাছাকাছি যাওয়ার সাহসও তাদের নেই। অথচ তারা তাদের এই হীনতা-দীনতা, ক্ষুদ্রতা-ভীরুতা উচ্চভিলাসী ঈর্ষাকাতর বক্তব্যের মোড়কে ঢেকে রাখার ব্যর্থ চেষ্টা করে। শুধু তাই নয় তার এই অলীক-হাস্যকর মানসিকতা সে আবার সমাজে প্রচার করে বেড়ায়। যে ক্ষুদ্র পেঁচা সূর্যের ক্ষীণতম আলোর মুখোমুখি হওয়ার যোগ্যতাও রাখে না, সে সূর্যকে নিজের শত্রু হিসেবে প্রচার করে নিজেকেই বরং আরও ক্ষুদ্র, অনুদার ও হাস্যরসের পাত্র করে তোলে।
শিক্ষা: মহৎ ব্যক্তিত্বের প্রতি শত্রুভাবাপন্ন মনোভাব পোষণ এবং মহত্ত্বের অপপ্রচারের মাধ্যমে হীন প্রকৃতির লোকেরা আত্মতুষ্টি লাভ করে থাকে। এতে মানুষের মনে তার সম্পর্কে কোনও উচ্চ ধারণা তৈরি হয় না। বরং সে আরও অবজ্ঞার পাত্র হয়ে ওঠে।
পুণ্য পাপে দুঃখে সুখে পতনে উত্থানে মানুষ হতে দাও তোমার সন্তানে।
মানুষের জীবনে চলার পথ মসৃণ নয় বরং তা কাঁটায় ভরা। প্রতিটি পদে পদে রয়েছে কষ্ট-দুঃখ, বাধা-বিপত্তি, সংঘর্ষ, সংঘাত। প্রতিটি পদক্ষেপ সংগ্রামের। মানুষের জীবনে বেদনা আছে, কষ্ট আছে, অপমান আছে, ব্যর্থতা আছে, পরাজয় আছে। এসব জীবনের অঙ্গ এবং বৈশিষ্ট্য। এই সকল বিরোধী শক্তির সাথে অত্যন্ত সহনশীলতা এবং নিষ্ঠার সাথে যুদ্ধ করে জয়ী হতে হয়। বাঁধাকে জয় করার মধ্যেই রয়েছে জীবনের তাৎপর্য। মানবজীবনের সার্থকতা লুকিয়ে থাকে বাধা জয়ের মধ্যে। দুঃখ, কষ্ট, শোক, আঘাত মানুষের মধ্যে লুকিয়ে থাকা মনুষ্যত্বকে জাগিয়ে তোলে। আগুনে পুড়ে সোনা যেমন খাঁটি হয়, তেমনি দুঃখ-দুর্দশার মধ্য দিয়ে একজন মানুষ জীবনের সকল বাধাকে জয় করার শক্তি অর্জন করে। মানুষের জীবন মানেই সংগ্রামের ইতিহাস। পৃথিবীতে যুগে যুগে যোগ্যতম প্রাণীগুলো টিকে থাকতে পেরেছে কিন্তু দুর্বল প্রাণীগুলো বিলুপ্ত হয়ে গেছে সংগ্রামের সাথে খাপ খাওয়াতে না পেরে। কেউ যদি জীবনে সফল একজন মানুষ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়, তবে তাকে দুঃখ, কষ্ট, বেদনা, অপমান, পরাজয়ের স্বাদ গ্রহণ করতে হবে। মনীষীদের জীবনী পাঠ করলে দেখা যায়, তারা কষ্ট, দুঃখ, সংগ্রাম, সংঘাতের মধ্য দিয়ে পথ চলেছেন। অনেক বিপদের সম্মুখীন হয়েছেন। কিন্তু তারা তাদের অটুট মনোবল এবং সাহসের মাধ্যমে সকল বাধাকে অতিক্রম করেছেন। সফলতার খাতায় নিজেদের নামকে লিপিবদ্ধ করেছেন। ইতিহাসের পাতায় নিজেদের নামকে অঙ্কিত করেছেন এবং হয়েছেন অনুকরণীয় চরিত্র।
শিক্ষা: জীবনে চলার পথে কঠিন বাস্তবতাকে মোকাবেলা করেই মানুষ, প্রকৃত মানুষ হিসেবে গড়ে উঠে। মানুষের জীবনের পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটানোর জন্যে দুঃখ, কষ্ট, বেদনা, আঘাত, সংগ্রাম, উত্থান-পতন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
প্রকৃত বীর একবারই মরে, কিন্তু কাপুরুষেরা মরে বারবার।
এই পৃথিবীটা বিশাল এক কর্মক্ষেত্র বলে এখানে রয়েছে অনেক কর্তব্য। জীবনে চলার পথে অনেক বাধা বিপত্তির সম্মুখীন হতে হয়। এসব বাধা বিপত্তিকে ভয় পেলে চলবে না। জীবনে প্রকৃতভাবে বেঁচে থাকতে হলে সংগ্রাম করেই বাচঁতে হবে। একজন প্রকৃত বীর কখনো বিপদ দেখে ভয় পায় না। তারা বিপদকে তুচ্ছ করে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যায়। দেশের যেকোনো প্রয়োজনে তারা জীবন বাজি রেখে ঝাপিয়ে পড়ে। মৃত্যুকে তারা তুচ্ছ জ্ঞান করে যুদ্ধে, সংগ্রামে, জাতীয় উন্নয়নে জীবন উৎর্সগ করে। পরাজয় মেনে নিতে তারা কখনও রাজী নয়, তা মেনে নেয়া প্রকৃত বীরের র্ধমও নয়। মৃত্যুর মধ্য দিয়ে তাদের জীবনকে দেশের ইতিহাসে সার্থক করে তোলে। কেননা তারা জানে, শৃগালের ন্যায় হাজার বছর বেঁচে থাকার চেয়ে সিংহের ন্যায় একদিন বেঁচে থাকাটাই শ্রেয়। অপরপক্ষে যারা কাপুরুষ তারা নিজের জীবনের বিপদ-আপদ এমনকি দেশের প্রয়োজনের সময়ও কখনো কাজে আসে না। তারা দেশের দুর্যোগময় অবস্থার সময় ঘরের কোণে চুপ করে বসে থাকে। বিপদের আভাস পেলেই ভয়ে একেবারে ভেঙ্গে পড়ে। তারা মনে করে বিপদের সময় সামনে এগিয়ে গেলেই মৃত্যু নিশ্চিত। তাই তারা সামনে এগোতে চরমভাবে ভয় পায়। জীবনে চলার পথে সামান্য বাধাটুকুও অতিক্রম করতে চায় না। এ ধরণের মানুষ জাতির কাছে কলঙ্ক। নিজ দেশে বাস করেও যারা দেশের প্রয়োজনের সময় কোনো ভূমিকা রাখতে পারে না, তাই তারা বেঁচে থেকেও মৃত। কিন্তু যারা দেশের প্রকৃত বীর সন্তান তারা দেশের যেকোনো প্রয়োজনে সর্বদা প্রস্তুত থাকে। ‘হয় করব, না হয় মরব’- এই মূলমন্ত্রে উজ্জীবিত হয়। মৃতুকে তারা হাসি মুখে বরণ করে নিয়ে জাতির কাছে অমর হয়ে থাকে যুগ যুগ ধরে। মৃত্যু তাদের একবারই আসে, আর ভীতু কাপুরুষের জীবনে মৃত্যু এসে হানা দেয় বার বার।
শিক্ষা: বৈচিত্র্যময় জীবনে কর্তব্য পালন করতে গিয়ে যারা মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে তারাই প্রকৃত বীরের মর্যাদা লাভ করে। আর কাপুরুষেরা মৃত্যুকে ভয় পেয়ে পিছিয়ে যায়। তাই মৃত্যুকে ভয় না পেয়ে, কর্তব্য পালন করাই প্রত্যেক মানুষের ধর্ম হওয়া উচিত।
প্রথম যেদিন তুমি এসেছিলে ভবে তুমি মাত্র কেঁদেছিলে, হেসেছিল সবে। এমন জীবন হবে করিতে গঠন, মরণে হাসিবে তুমি কাঁদিবে ভুবন।
প্রত্যেক শিশুই জন্ম গ্রহণ করে একইভাবে। একই শারীরিক গঠন নিয়ে। তাই সবাই শিশুর জন্মের সংবাদে সমানভাবে খুশি হয়। প্রত্যেকেই পর অসহায় এবং পরনির্ভরশীল থাকে। ক্রমে ক্রমে নিজের পায়ের ওপর ভর করে দাঁড়াতে শেখে। এক সময় নিজের বিবেক-বুদ্ধি দিয়ে জীবন চালানোর সক্ষমতা অর্জন করে। কেউ সৎ কাজ করে, কেউ অসৎ কাজ করে। কেউবা নিজের স্বার্থে কাজ করে, কেউ আবার মানবজাতির স্বার্থে কাজ করে। যারা সৎ গুণাবলী অর্জন, কঠোর পরিশ্রম ও সাধনার মাধ্যমে পৃথিবীর সব জীবের কল্যাণসাধন করে, তারাই জগৎশ্রেষ্ঠ। যারা মানবতার কল্যাণে নিজের ক্ষুদ্র স্বার্থ ত্যাগ করে, তারা তাদের কর্মের দ্বারা পৃথিবীকে আরো সুন্দর করে তোলে। মহৎ মানুষ নিজের জীবন তিলে তিলে ক্ষয় করে দেশ ও জাতির কল্যাণার্থে। জীবনের মূল্যবান সময়ে সুখ-আহলাদ থেকে নিজেকে বঞ্চিত রাখে শুধু মানব কল্যাণে। এমন মহৎ, আত্মত্যাগী মানুষদের মৃত্যুতে সব দেশের সব মতের, সব ধর্মের মানুষ সমানভাবে ব্যথিত হয়। গোটা জাতি দুঃখে শোকে কান্নায় ভেঙে পড়ে। কিন্তু যে নিজের স্বার্থ ছাড়া কিছুই ভাবতে পারে না, তাদের দিয়ে দেশ জাতির কোনো কল্যাণ হয় না। বরং ঐসব স্বার্থপর মানুষ নিজের স্বার্থের জন্য জাতিকে অন্ধকারে ঠেলে দেয়। তারা নিজের সুখের জন্য সব ধরণের অন্যায় করে, দুর্নীতির সাথে জড়িয়ে পড়ে। সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, হত্যা, চোরাচালান, যুদ্ধ, সংঘর্ষ ইত্যাদি অপরাধ কর্ম তাদের দ্বারাই সংঘটিত হয়। এসব অপরাধী মানবজাতির কলঙ্ক। সবাই তাদের ক্ষমতাকে ভয় করলেও মন থেকে সম্মান করে না। যখন তাদের মৃত্যু হয় তখন তাদের ক্ষমতারও অবসান হয়। তাদের মৃত্যুতে কেউ দুঃখিত হয় না। অশ্রু বিসর্জন তো দূরের কথা, ঐসব স্বার্থপর মানুষদের মৃত্যুতে সবাই স্বস্তির নিঃশ্বাস নেয়। কারণ তারা হাজার বছর বেঁচে থকলেও মানবজাতির ক্ষতি ছাড়া কোনো লাভ হতো না।
শিক্ষা: নিজের জন্য হাজার বছর বেঁচে থাকার মধ্যে সার্থকতা নেই। জীবনে সার্থকতা খুঁজে পাওয়া যায় মানব কল্যাণে একদিন বেঁচে থাকার মধ্যেও। যারা সৎ চিন্তা, কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে সব সৃষ্টির কল্যাণসাধন করে, তারা মানবজাতির মন জয় করতে পারে, তাদের মৃত্যু সবাইকে ব্যথিত করে।
প্রাচীরের ছিদ্রে এক নাম গোত্র হীন ফুটিয়াছে ফুল এক অতিশয় দীন। ধিক্ ধিক্ বলে তারে কাননে সবাই, সূর্য উঠি বলে তারে ভালো আছো ভাই?
নিজ জন্মের ওপর মানুষের কোনো হাত নেই। সে সমাজের একেবারে নিম্ন স্তরে জন্মগ্রহণ করতে পারে আবার সমাজের উঁচু স্তরেও জন্ম গ্রহণ করতে পারে। তেমনি ভাঙ্গা প্রাচীরের গায়ে এক অখ্যাত ফুল ফুটেছে যার আকার ছোট, রঙের কোনো বাহার নেই, নেই কোনো গন্ধ, নেই শোভা। তার স্বজাতি ফুলগুলোও তাকে পরিচয় দিতে নারাজ। এমন কি সে ছোট বলে তার কোনো নাম নেই বলে তাকে ধিক্কার জানাতে দ্বিধাবোধ করে না। কিন্তু সেই অবহেলিত ফুলকে সূর্য প্রতিদিন সম্মান জানিয়ে মহত্ত্বের পরিচয় দিয়েছে। আমাদের সমাজে এমন অনেক ব্যক্তি আছেন যারা ধন সম্পদের অঢেল মালিক, তাদেরকে সবাই শ্রদ্ধা করে, সম্মান করে। অথচ তারাই সমাজের নিরীহ ও গরিবদের মানুষ হিসেবে মনে করে না। তাদেরকে সবসময় এড়িয়ে চলে। এমনকী প্রয়োজনে ঘৃণা করতেও কুণ্ঠাবোধ করে না। সমাজে সাধারণ মানুষের অর্থ, প্রতিপত্তি না থাকায় সমাজ থেকে তারা কখনো সম্মান পায় না। সকলেই তাদের আড় চোখে দেখে, ঘৃণা করে, তিরস্কার করে। কিন্তু তারা ভাবে না যে সমাজের সে স্তর থেকেও যে তারা বড় কিছু হতে পারে। তারপরও সমাজে সব মানুষ সমান নয়। যারা প্রকৃত মহৎ এবং উদার তাদের মন সবসময় সুন্দরের আলোয় আলোকিত। তাদের চোখে সমাজে ছোট বড় বলে কিছুই নেই। সকলকেই তারা সমানভাবে মূল্যায়ন করে। সূর্যের মতোই তাঁরা মহৎ এবং উদার। সূর্য যেমন অখ্যাত ফুলকে সবসময় কুশল জানায় তেমনি সমাজের মহৎ ব্যক্তিবর্গ নিরীহ ও গরিবদের পাশে থাকে। তাদের যেকোনো প্রয়োজনে মহৎ ব্যক্তিগণ এগিয়ে আসেন। এই উদারতার আলোকেই তারা সমাজের সবাইকে সমানভাবে মর্যাদা দিয়ে থাকেন।
শিক্ষা: সমাজে যাঁরা প্রকৃত উদার মনের অধিকারী তারা ধনী-গরিব সবাইকে সমানভাবে মূল্যায়ন করেন। কোনো ব্যক্তি বা সম্প্রদায়ের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরন থেকে তারা বিরত থাকে।
ধৈর্য ধর, ধৈর্য ধর, বাধ বাধ বুক সংসারে সহস্র দুঃখ আসিবে আসুক।
জগত সংসারে সুখ-দুঃখ মিলিয়েই মানবজীবন। জীবনের প্রতি ক্ষেত্রেই আছে বিপদ-আপদ, বাধা-বিঘ্নে, দুঃখ কষ্ট। এসব প্রতিকূলতাকে জয় করে টিকে থাকতে হলে মানুষকে ধৈর্য ও সহ্যশক্তি প্রদর্শন করতে হয়। দুঃখ আর ব্যর্থতাকে জয় করতে পারলেই জীবনে সুখ ও সাফল্য লাভ সম্ভব। দুঃখ দারিদ্র্য, অন্যায়-অত্যাচার, বিপদ আপদ কখনো কখনো মানব জীবনকে থামিয়ে দেয়। মানুষকে এসব প্রতিরোধ করে ধৈর্য নিয়ে সামনের দিকে অগ্রসর হতে হয়। সাফল্য আর ব্যর্থতায় ভরা কর্মক্ষেত্রে মানুষ যদি ব্যর্থতাকে গ্রহণ করে পরবর্তীকালে সাফল্য অর্জনে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়, তাহলে সে শেষ পর্যন্ত বিজয়ী হয়। সহনশীল ও ধৈর্যশীল লোক জীবন সংগ্রামে পরাজয়ের মধ্যেও শক্তি সঞ্চয় করে সাফল্যের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছায়। পরাজয়, ব্যর্থতার কাছে সে নতি স্বীকার করে না। তাই ধৈর্য ও সহনশীলতার মাধ্যমে প্রতিকূল অবস্থার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে নিজের অধিকার আদায়সহ যেকোনো কঠিন কাজ করা সম্ভব। এ জগত সংসারে দুর্বল আর অসহায়কে সবলের সাথে প্রতিযোগিতায় টিকতে হলে জীবনে ধৈর্য ধারণ করতে হবে। কেননা যার সহ্য ক্ষমতা নেই তার জীবন ব্যর্থতা আর হতাশায় পর্যবসিত হয়। কোনো কাজেই সে সাফল্য লাভ করতে পারে না। ধৈর্যের অভাবে তার জীবন নিয়ন্ত্রণহীন ও দুর্বিষহ হয়ে পড়ে। তার পারিবারিক জীবনে দুঃখ-কষ্ট, লাঞ্ছনা-গঞ্জনার মতো তিক্ততা নেমে আসে। মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সঃ), ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, কাজী নজরুল ইসলাম, রবার্ট ব্রুস প্রমুখ মহান ব্যক্তিত্ব জীবনে কখনো পরাজয়ের কাছে নতি স্বীকার করেননি। ধৈর্য সহকারে সকল প্রতিকূল পরিস্থিতিতেই সামনে এগিয়ে গেছেন এবং শেষ পর্যন্ত বিজয়মাল্য পরেছেন। তাঁরা যুগ যুগ ধরে মানুষের মনে বেঁচে আছেন ও বেঁচে থাকবেন। কাজেই ধৈর্যসহকারে স্থির মস্তিষ্কে জীবনের সকল কঠিন কাজের সমাধান করতে হবে। মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে এসেও সুন্দর জীবনের স্বপ্নে বুক বাঁধতে হবে। তবেই মানুষ সকল কঠিন কাজে সফল হবে। জগতসংসারে সম্মান ও খ্যাতি নিয়ে বেঁচে থাকবে।
শিক্ষা: মানবজীবনে টিকে থাকতে ও সাফল্য লাভ করতে কঠিন বাস্তবতা ও বাধাবিপত্তির সাথে লড়াই করে সামনে অগ্রসর হতে হবে। ধৈর্য ও সহনশীলতার অনুশীলনই সাফল্যের চাবিকাঠি।
নগর পুড়িলে দেবালয় কি এড়ায়?
মানব সভ্যতার বিবর্তনের অন্যতম হাতিয়ার হলো আগুন। প্রাচীনকালে মানুষ ও পশুর মধ্যে খুব একটা পার্থক্য ছিল না। মানুষ পশুর মতো কাঁচা মাংস খেত। আগুনের আবিষ্কার সবকিছু বদলে দিয়েছিল। আগুন আবিষ্কারের ফলে মানুষ খাবার সিদ্ধ করে খেতে শেখে। আগুনে পুড়িয়ে বিভিন্ন অস্ত্র তৈরি করতে শেখে, বন্য প্রাণীকে ভয় দেখাতে আগুন ব্যবহার করতে শেখে। সর্বোপরি আগুন আবিষ্কারের ফলে মানুষের জীবনযাত্রাই পুরো পাল্টে গিয়েছিল। সভ্যতার প্রতিটি আবিষ্কারেই আশীর্বাদের পাশাপাশি কিছু অভিশাপ থাকে। আগুন এমন একটি পদার্থ যার সাধারণ ধর্ম হলো দহন। ভুল করে আগুনে হাত দিলেও আগুন পোড়াতে ভুল করবে না। আগুনের কাছে মসজিদ, মন্দির, প্যাগোডা, ঘর-বাড়ি, দোকান-পাট সবই সমান। আমাদের সমাজ জীবনেও আগুনের মতো কিছু ধ্বংসাত্মক জিনিস রয়েছে। সমাজে যখন কোনো অপরাধ দানা বাঁধে তখন তা গোটা সমাজকেই গ্রাস করে। সমাজে ভাল-মন্দ উভয় শ্রেণির মানুষই থাকে। তথাপি অন্যায়ের জোরই বেশি। আগুন ও অপরাধ এ দুটো বিষয়ের মধ্যে একটি মিল রয়েছে। উভয়ই ছোট থেকে বড় হতে থাকে এবং ক্রমশ বিপজ্জনক হয়ে ওঠে। আগুনের যেমন দহন ছাড়া কোনো ধর্ম নেই, তেমনি অপরাধেরও ধ্বংস ব্যতীত অন্য কোনো ধর্ম নেই। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে আগুন রূপে অপরাধকে বিঘ্নত হতে দেখি। আগুনের মতোই অপরাধ ভালো-মন্দ সব কিছুকেই গ্রাস করে। কারো প্রতি তার পক্ষপাত নেই।
শিক্ষা: আগুন ও অপরাধ অতিদ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। আগুন যেমন ভাল-মন্দ সবকিছু পোড়ায়, তেমনি অন্যায় পাপকে গ্রহণ করে ভালোকে ধ্বংস করে দেয়। সুতরাং ব্যক্তি ও সমাজজীবনে অপরাধ যত দ্রুত সম্ভব প্রতিরোধ করতে হবে।
নহে আশরাফ আছে যার শুধু বংশ পরিচয় সেই আশরাফ জীবন যাহার পূণ্য কর্মময়।
মানুষের যশ, গৌরব, সম্মান, প্রতিপত্তি সবই নির্ভর করে কর্মের ওপর, জন্মের ওপর নয়। সামন্তবাদী সমাজব্যবস্থায় আশরাফ ও আতরাফ-এ দুই শ্রেণির মধ্যে সামাজিক বৈষম্য থাকলেও আধুনিক সভ্যতায় তা একেবারে অর্থহীন। বর্তমান সমাজব্যাবস্থায় বংশ পরিচয়ের ভূমিকা গৌণ। এখানে কর্মময় জীবনের অবদানই মুখ্য ভূমিকা পালন করে। পদ্মফুলের সৌন্দর্যই বড়। পঙ্কে জন্মেছে বলে তাকে ছোট করে দেখার কোনো অবকাশ নেই। মানুষের জন্মের ব্যাপারে নিজের কোনো হাত থাকে না। নিচু কুলে জন্মগ্রহণ করে জগতে এমন অনেক মানুষ আছেন যারা নিজ মহৎ কর্মের মাধ্যমে বিশ্বের বুকে চির স্মরণীয় হয়ে আছেন। আমেরিকার জর্জ ওয়াশিংটন, আব্রাহাম লিংকন, ফ্রান্সের নেপোলিয়ান বোনাপার্ট, ভারতের এ. পি. জে আবুল কালাম আজাদ প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করেও নিজ কৃতকর্মের দ্বারা বিশ্বে আজও চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন। অর্থাৎ পৃথিবীতে কর্মের মাধ্যমেই মানুষের প্রকৃত বিচার হয়। নিচুকুলে জন্মগ্রহণ করে যে নিচু হতে হবে এমন কোনো নিয়ম নেই। তার কৃতকর্মই তাকে পরিচয় করিয়ে দেয় বিশ্বের দরবারে। মহৎ কার্যাবলির মাধ্যমে সে সবার কাছে প্রশংসা অর্জন করতে সক্ষম হয়। তার মহৎ গুণাবলীর জন্যই সে প্রশংসিত হয় যুগ যুগ ধরে। তখন তার জন্ম কোথায় হলো দেখা হয় না, তার কর্মই মুখ্য ভূমিকা পালন করে। আবার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা, বংশ গৌরব বা ধর্ম মানুষকে যথার্থ পরিচয় দিতে পারে না। তার কৃতকর্ম ভালো না হলে সকলেই তাকে ঘৃণার চোখে দেখে। পৃথিবীতে এমন অনেক উদাহরণ মেলে যারা উঁচু বংশে জন্মগ্রহণ করেও বিভিন্ন পাপকর্মের কারণে সমাজে বারবার ধিকৃত হয়েছেন। সাধারণ মানুষের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। তাই মানুষের উচিত বংশ গৌরবের বড়াই না করে আপন কর্মের মাধ্যমে নিজেকে সাফল্যের সর্বোচ্চ চূড়ায় প্রতিষ্ঠিত করা। এতেই জীবনের সার্থকতা নিহিত।
শিক্ষা: জগতে সাধু ও মহৎ ব্যক্তিবর্গ স্মরণীয় ও বরণীয় হয়েছে বংশ পরিচয়ের মধ্য দিয়ে নয় বরং পূণ্য-কর্ম সম্পাদনের মধ্য দিয়ে। মানুষের প্রকৃত মূল্য তার বংশ পরিচয়ের মধ্য দিয়ে নয়, মহৎ কর্মই তার একমাত্র আসল পরিচয়।
নদীর এপার কহে ছাড়িয়ে নিঃশ্বাস ওপারেতে সর্বসুখ আমার বিশ্বাস।
সুখ-দুঃখ, বেদনা নিয়েই মানুষের জীবন। কেউই চিরন্তন সুখী বা দুঃখী নয়। সে সব সময় নিজের চেয়ে অন্যকে সুখী ভাবে। কারণ মানুষ তার অসীম চাহিদার সমন্বয় করতে পারে না। ক্ষুদ্র জীবন পরিসরে মানুষ যখন যেটি চায় সেটিই তার একমাত্র আরাধ্য বস্তু নয়। একটি জিনিসের অভাব মেটানোর পর অন্য জিনিসের প্রতি তার আকাক্সক্ষা জন্মে। এই অাকাঙ্ক্ষা অনেক সময় পূর্ণ হয় না। অনুরূপ নদীর এক তীর ভাবে অপর তীরে সুখ-শান্তি, সমৃদ্ধিতে পরিপূর্ণ। অপর তীরের ধারণা একই। তাই উভয়কেই অতৃপ্ত এবং অসন্তুষ্ট দেখা যায়। নদীর এক কূল ভাবে যাবতীয় শোভা- সৌন্দর্যের প্রাণকেন্দ্র ওপারে। অন্য কূল তার নিজের সুখের কথা ভুলে একই রকম অতৃপ্তির যন্ত্রণায় কাতর হয়। ফলে এমন চিন্তা সুখ শান্তির ব্যাঘাত ঘটায়। মানুষের ক্ষেত্রেও বিষয়টি ঠিক তেমনি। সে নিজের চেয়ে অন্যকে বেশি সুখী মনে করে। মানুষ আসলে নিজে কী চায়, কী তার কাম্যবস্তু তা নিজেই সে জানে না। সে যা চায়-তা পাওয়ার পর তার প্রতি তার আগ্রহ হারিয়ে ফেলে এবং আরও নতুন কিছু চায়। অপরের প্রাপ্তি দেখে হিংসাবোধ করে। পরকে সুখী মনে করে পরশ্রীকাতর হয়ে পড়ে। আর তখনই মানুষ অন্যের অকল্যাণ প্রত্যাশা করে। তার কাছে অন্যের সুখই বড় হয়ে উঠে। নিজের সুখে তৃপ্তি হয় না। এ ধরণের লোকেরা সর্বদাই না পাওয়ার অতৃপ্তিতে ভোগে। নিজের প্রাপ্তির মধ্যে সুখ না খুজে অপরের প্রাপ্তি দেখে হা-হুতাশ করে। ফলে কোনো কিছুই তাদের কাছে তৃপ্তিদায়ক হয় না।
শিক্ষা: মানুষের ক্ষুদ্র জীবনের আশা আকাক্সক্ষার শেষ নেই। জীবনে সকল চাহিদা মিটিয়ে সুখের সন্ধান করা বোকামি। তাই অন্যের প্রতি ঈর্ষান্বিত না হয়ে নিজের যা আছে তা নিয়ে সন্তুষ্ট থাকার মধ্যেই সর্বোচ্চ সুখ লাভ করা সম্ভব। মূলত মনের সুখই প্রকৃত সুখ।
নানান দেশের নানান ভাষা বিনে স্বদেশী ভাষা, পুরে কি আশা ?
স্বদেশি ভাষা বলতে সাধারণত নিজস্ব ভাষা বা মাতৃভাষাকেই বুঝানো হয়। বিশ্বের প্রতিটি জাতিরই নিজস্ব ভাষা আছে। সেই ভাষার মাধ্যমেই মনের ভাব প্রকাশ করে। প্রতিটি শিশুই পরিবারে জন্ম গ্রহণ করে। বড় হয়ে মাতৃভাষায় তার মনের ভাব আদান-প্রদান করে। এজন্যই মাতৃভাষা সকলের কাছে প্রিয় হয়ে উঠে। আমরা বাঙালি বাংলা আমাদের মাতৃভাষা। আবার পৃথিবীতে অনেক মানুষ আছে যারা মাতৃভাষাকে গুরুত্ব দেয় না। অনেকে আবার ব্যক্তিগতভাবে বিদেশি ভাষায় বিদ্যা চর্চায় উৎসাহী হয়। কিন্তু বিদেশি ভাষা তাদের মনে তৃপ্তি দিতে পারে না। মায়ের বুকের দুধ ছাড়া যেমন শিশুর স্বাভাবিক বিকাশ হয় না। মাতৃভাষা ছাড়াও তেমনি মানুষ তার মনের ভাব পরিপূর্ণভাবে প্রকাশ করতে পারে না। এ প্রসঙ্গে কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের কথা বলা যায়। তিনি মাতৃভাষাকে অবহেলা করে ইংরেজি সাহিত্য চর্চা শুরু করেছিলেন। কিন্তু সফল হতে পারেননি। শেষে স্বদেশি ভাষায় সাহিত্য চর্চায় খ্যাতি অর্জন করেন। বিখ্যাত ভাষাপন্ডিত. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বলেছেন- ‘মা, মাতৃভাষা এবং মাতৃভূমি এ তিনটি মানুষের সবচেয়ে প্রিয় বস্তু।’ যে জাতি তাদের ভাষা সম্পর্কে সচেতন সে জাতির দেশ ও সংস্কৃতি অনেক উন্নত। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ভাবে বিভিন্ন দেশের সাথে সম্পর্ক রক্ষা করে চলার ক্ষেত্রে বিদেশি ভাষা সম্পর্কিত জ্ঞান আবশ্যক। তথাপি স্বদেশি ভাষা বা মাতৃভাষার সঠিক চর্চা এবং সর্বস্তরে এর প্রয়োগ না করা যেকোনো জাতির উন্নয়ন ও অগ্রগতির পথে প্রধান অন্তরায়।
শিক্ষা: মাতৃভাষার উন্নতি ছাড়া কোনো জাতির স্বাভাবিক বিকাশ ও জাতীয় উন্নতি সম্ভব নয়। তাই মাতৃভাষায় পূর্ণ জ্ঞান লাভ করার পাশাপাশি বিদেশি ভাষাকে গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন।
নাম মানুষকে বড় করে না মানুষই নামকে বড় করে তোলে।
অনেক মানুষই তার সন্তানের নাম বিখ্যাত ও মহাপুরুষদের নামের সাথে মিল রেখে রাখেন। তাদের আশা থাকে তার সন্তানও একদিন বিখ্যাত ব্যক্তি হিসেবে সমাজে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে। কিন্তু তাদের সে আশা অনেক সময় পূরণ হয় না। যে সকল ব্যক্তি শ্রম ও মেধা দ্বারা নিজেকে বিকশিত করতে পারে তার নামটিই মানুষের মুখে মুখে আলোচিত হয়। নামের কোনো বিশেষত্ব নেই। বরং স্বীয় কর্মের দ্বারা মানুষই নামকে বিখ্যাত করে তোলে। সেই নাম বেঁচে থাকে মানুষের হৃদয়ে যুগের পর যুগ। পবিত্র কুরআনে আছে- ‘প্রতিটি প্রাণীই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে (সূরা- মায়িদা-২৯)।’ মৃত্যুর পর ব্যক্তির নাম যত সুন্দরই থাকুক না কেন সেটা কেউ মনে রাখে না। মানুষকে মৃত্যুর পর অমর করে রাখে তার কর্ম। যে ব্যক্তির কোনো কীর্তি নেই, মৃত্যুর পর কেউ তাকে স্মরণ রাখে না। কিছুদিন পর তার নাম মানুষের মন থেকে বিলীন হয়ে যায়। কিন্তু যারা তাদের জ্ঞান, বুদ্ধি, প্রজ্ঞা দিয়ে কাজ করে গেছেন তারা আজও পৃথিবীতে বেঁচে আছেন। তাঁরা তাদের গৌরবময় কীর্তির জন্য চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন। কবি কাজী নজরুল ইসলাম এক সাধারণ দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করেও তার কর্মের মাধ্যমে সবার কাছে ভালোবাসা আর শ্রদ্ধার পাত্র হয়ে আছেন। এরকম হাজারো মনীষী মানব সভ্যতাকে আলোর পথ দেখিয়ে পৃথিবীতে তাদের নামকে অমর, অক্ষয় ও বিখ্যাত করে গেছেন।
শিক্ষা: কাজই মানুষকে পৃথিবীতে অমরত্ব দান করে। কাজের মাধ্যমেই মানুষ তার নাম পৃথিবীর ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে খোদাই করে। তার নাম যে রকমই হোক না কেন সেটাই সবার কাছে শ্রুতিমধুর হয়ে উঠে।
নিরক্ষরতা দুর্ভাগ্যের প্রসূতি।
শিক্ষা: নিরক্ষরতা হচ্ছে অন্ধকার এবং শিক্ষা হচ্ছে আলো। নিরক্ষর ব্যক্তি যেমন একটি দেশের বোঝা এবং অভিশাপস্বরূপ। তেমন শিক্ষিত ব্যক্তি একটি দেশের সম্পদ। তাই নিরক্ষরতার অভিশাপ থেকে জাতিকে মুক্ত করতে হবে, শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে হবে সর্বত্র।
নিতান্ত নির্বোধ শুধু সেইজন অমূল্য সময় করে বৃথায় যাপন।
সময় চিরসিত্য, অনন্ত এক দুর্লভ সম্পদ। এ বিশ্বের সকল কর্মকান্ড বৃহৎ বা ক্ষুদ্র, সব কিছুরই আধার সময়। সময়ের সদ্ব্যবহার মানুষকে সত্যিকারের মানুষ হতে, জীবনকে অর্থপূর্ণ করে তুলতে সাহায্য করে। কারণ এ ক্ষণস্থায়ী মানবজীবনকে গৌরবময়, স্মরণীয় ও বরণীয় করে তোলার একমাত্র উপায় হচ্ছে বহমান সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে কাজ করা। জীবনের কর্মকান্ডের মধ্যেই মানুষের নাম, যশ, পতিপত্তি, খ্যাতি, সব কিছুই নির্ভর করে। হযরত আলী (রা.) বলেন- ‘যারা সময়ের সদ্ব্যবহার করে তারাই জীবনে সফলতা লাভ করে।’ তাই সময়ের সদ্ব্যবহারই জীবনের সফলতার মূলমন্ত্র। মানবজীবন সীমিত সময়ের হলেও তা শুধু জন্ম আর মৃত্যুর জন্যে নয়। তার উপর দায়িত্ব আছে মহৎ কিছু করবার, সময় কে যথার্থভাবে ব্যবহার করার। কারণ পৃথিবীতে যারা স্মরণীয়, বরণীয় হয়েছেন, তাঁরা কখনোই সময় বৃথা নষ্ট করেননি। ডা. লুৎফর রহমান বলেন- ‘জ্ঞানী যারা তারা নিরন্তর সময়ের প্রান্তর হতে মণিমুক্তা কুড়িয়ে নিচ্ছেন।’ কিন্তু তারাই অত্যন্ত বোকা যারা কখনোই সময়ের সদ্ব্যবহার করে না। এসব অমিতব্যয়ী লক্ষ্মীছাড়া মানুষগুলো আজকের কাজ আগামী দিনের জন্যে ফেলে রাখে। ফলস্বরূপ, পৃথিবীতে এদেরকে নিঃস্ব, বঞ্চিত ও পরমুখাপেক্ষী হয়ে জীবনযাপন করতে হয়। অসময়ে কপাল চাপড়ায় আর ভাগ্যকে দোষ দেয়। অর্থাৎ এই নির্বোধ মানুষগুলো প্রথমে জীবনের সুবর্ণ সময়কে অপচয় করে। আর পরে তার জন্যে অনুশোচনা করে। কিন্তু ততক্ষণে তাদের জীবনাকাশ ঘন কালো মেঘে ঢেকে যায়। আমরা জানি ওয়াটার লু যুদ্ধে নেপোলিয়নের সেনাপতি নির্দিষ্ট সময়ের কিছুক্ষণ পরে সসৈন্যে যুদ্ধক্ষেত্রে হাজির হওয়ায় নেপোলিয়ানের শোচনীয় পরাজয় হয়েছিল। সময়ের সদ্ব্যবহার মানুষকে উন্নতির শিখরে পৌঁছে দেয় আবার সেই সময়ের অবহেলাতেই জীবনে আসে ঘোর অনিমশা।
শিক্ষা: সময়ের অবহেলা মানে জীবনকে অবহেলা করা। সেই বোকা যে সময়কে মূল্য দিতে জানে না। সুতরাং সময়ের সদ্ব্যবহার যেকোনো ব্যক্তির জন্য উন্নতির শিখরে আরোহণের প্রধান চাবিকাঠি।
নিন্দুকেরে বাসি আমি সবার চেয়ে ভাল, যুগ জনমের বন্ধু আমার আঁধার ঘরের আলো।
মানুষ মাত্রেই ভুল করে। আর সেই ভুলের সুযোগ নেয় নিন্দুক। মানুষের ছোট বড় দোষ ত্রুটি নিয়ে কুৎসা রটনা করে বেড়ানোই নিন্দুকের কাজ। ফলে আমরা নিন্দুকের কাছ থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করি। প্রকৃত পক্ষে নিন্দুক আমাদের ক্ষতির চেয়ে উপকারই বেশি করে। আমাদের দোষ-ত্রুটি ধরিয়ে দিয়ে নিন্দুক আমাদেরকে খাঁটি মানুষ হয়ে উঠতে সাহায্য করে। নিন্দুকেরা মানুষের ভুল গুলো নিয়ে সমালোচনায় মুখর হয়ে উঠে। এর দ্বারা মূলত ভুলকারী ব্যক্তিকে সে সচেতন করে তোলে। যা প্রকৃত অর্থেই ইতিবাচক। যে ব্যক্তি বন্ধুর ভুল ধরিয়ে না দিয়ে কেবল প্রশংসা করে চলে, সে কখনই প্রকৃত বন্ধু হতে পারে না। কারণ ঐ বন্ধুর এক তরফা প্রশংসা তার জীবনকে ভুল পথে পরিচালিত করতে পারে। কিন্তু নিন্দুক সারাক্ষণই ওঁৎ পেতে থাকে, মানুষ কখন কি ভুল করে, সেই ভুলের সূত্র ধরে সে নানা কথা বলে বেড়ায়। সকলের কাছে নিন্দা করে বেড়ায়। ফলে নিন্দুকের ভয়ে মানুষ সাবধান থাকে। সকল প্রকার দোষ ত্রুটি থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করে। কোনো কাজ করার আগে নিন্দুকের ভয়ে মানুষ অনেক বার চিন্তা করে। নিন্দুক যদি না থাকত, তাহলে মানুষ কোনো ভুল করার আগে চিন্তা করার প্রয়োজনবোধ করতো না। তাই মানুষকে ভুল থেকে দূরে রাখতে এবং অকল্যাণ কর্মতৎপরতা থেকে মুক্তি দিতে নিন্দুকের তুল্য কেউ নেই।
শিক্ষা: নিন্দুক আমাদের ভুল ধরিয়ে দিয়ে সংশোধিত হবার সুযোগ করে দেয়। ফলে আমাদের ব্যক্তি জীবন ও সমাজজীবনে ত্রুটি বিচ্যুতির পরিমাণ অনেকাংশেই কমে যায়।
পথ পথিকের সৃষ্টি করে না, পথিকই পথের সৃষ্টি করে।
পথ ও পথিক, এ দুটি আলাদা বস্তু হলেও পরস্পর অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। পথিক তার দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতায় নতুন পথ সৃষ্টি করে। মানুষ ঠিক একইভাবে তার চেষ্টা ও সাধনা দিয়ে জীবনে সফলতা অর্জন করতে সক্ষম হয়। মানুষের সৃষ্টিশীলতার মূলে নিহিত রয়েছে বিরামহীন অধ্যবসায় ত্যাগ-তিতিক্ষা এবং ধৈর্য। তীব্র ইচ্ছা শক্তি আর প্রচেষ্টা দিয়ে মানুষ অসাধ্যকে জয় করতে পারে। সৃজনশীল মানুষ তার চলার পথ নিজেই তৈরি করে নেয়। অন্যের পথে সে হাঁটে না। একটা লক্ষ্যকে সামনে রেখে তারা জীবনে অগ্রসর হতে চায়। প্রতি পদক্ষেপেই তারা একটা নতুন উপায়ের সন্ধান করে। আর জীবনে নানা ব্যর্থতা অতিক্রম করে একদিন সে ঠিকই তার লক্ষ্যে পৌঁছানোর পথটি তৈরি করে নেয়। অন্যের প্রদর্শিত পথে অগ্রসর হওয়ার মধ্যে কোনো আনন্দ নেই, নেই কোনো গৌরব। আর এ পথে কাঙ্ক্ষিত সফলতা অনেক সময়ই অর্জিত হয় না। তাই কৌতূহলী পথিক অবিরাম নতুন পথের সন্ধান করে। গন্তব্যে পৌঁছানোর জন্য প্রয়োজন সঠিক পথ। এরকম অনেক পথই এ পৃথিবীতে তৈরি হয়ে আছে। কিন্তু প্রতিটি পথই যে মানুষকে সঠিক গন্তব্যে পৌঁছে দিবে এমনটি নয়। কারণ প্রতিটি মানুষই একে অপরের থেকে পৃথক এবং তাদের মেধা ও চিন্তাশক্তিও পৃথক। তাই গতানুগতিক পথে গন্তব্যে পৌঁছাতে চাইলে অনেককেই মাঝ পথে থেমে যেতে হয়। এমন দৃষ্টান্তের শেষ নেই। কারো অভিভাবক হয়তো আশা করে যে তাদের সন্তান ডাক্তার হবে। কিন্তু সন্তানটি হয়তো তার মেধা এবং সৃজনশীলতাকে বৈজ্ঞানিক গবেষণার কাজে লাগাতে চায়। এ ক্ষেত্রে অভিভাবক যদি সন্তানের ওপর তাদের ইচ্ছাটাকে চাপিয়ে দেয় তবে দেখা যাবে যে সে মাঝপথেই থমকে গেছে। অন্যদিকে সে যদি নিজের মেধা ও সৃজনশীলতাকে কাজে লাগিয়ে নিজ পথের সন্ধান করে লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারে তবে সে প্রকৃত অর্থেই সফল। এরকম প্রতিটি মানুষেরই সফলতার পথ আলাদা। তাই প্রকৃত পথিক প্রতিনিয়ত নতুন পথের সন্ধান করে।
শিক্ষা: অন্যের প্রদর্শিত পথ নয়, নিজের সৃষ্ট পথেই প্রতিটি মানুষ সফলতা অর্জন করে। তাই প্রতিটি মানুষেরই উচিত নতুন পথের সন্ধান করা এবং সে পথ ধরে এগিয়ে চলা।
মা এবং মায়ের মুখের ভাষা দুটোর মূল্যই সমান।
মনের ভাব প্রকাশের মাধ্যম হচ্ছে ভাষা। ভাষা না থাকলে সুন্দরভাবে মনের কথা অন্যের কাছে বলা সম্ভব ছিল না। মা, মাতৃভাষা ও মাতৃভূমি প্রতিটি মানুষের কাছেই অমূল্য সম্পদ। যেকোনো সন্তানের কাছে মায়ের ঋণ অপরিশোধযোগ্য। সন্তানকে লালন পালন করতে গিয়ে একজন মা অনেক ত্যাগ স্বীকার করেন। সন্তাানের মঙ্গল কামনায় নিরলস সেবা যত্ন করেন। তাই সন্তানের কাছে মা সব সময়ই মঙ্গলময়ী, স্নেহময়ী, মহিমাময়ী। তেমনি মাতৃভাষাও মানুষের অস্তিত্বের এক অপরিহার্য অনুষঙ্গ। মা ছাড়া কোন শিশুর জীবন কখনও পরিপর্ণ হয় না। তেমনি মাতৃভাষা ছাড়াও কোন জাতির পূর্ণ পরিচয় ফুটে উঠে না। বিদেশী ভাষায় কথা বলে মনের শান্তি পাওয়া যায় না। এ জন্যই পৃথিবীর সকল জাতি তার মাতৃভাষা চর্চা করে থাকে। মায়ের অমর্যাদা বা অপমান যেমন কোন সন্তান সহ্য করতে পারে না তেমনি মাতৃভাষার অপমানও কোনো জাতি মেনে নেয় না। তাই ১৯৫২ সালে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করা দাবিতে প্রাণ দিতেও পিছপা হয়নি এদেশের সাহসী সন্তানেরা। আর এর স্বীকৃতি হিসেবে ২০০০ সাল থেকে ২১ ফেব্রুয়ারি পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। বিদেশী ভাষা কখনও কারো মন ও প্রাণের মুক্তি দিতে পারে না। মানুষ কথা বলে মায়ের ভাষায়, স্বপ্ন দেখে মায়ের ভাষায়; তাই মাতৃভাষা অদ্বিতীয়। মায়ের কাছে যেমন সন্তান তৃপ্তি পায়, তেমনি মাতৃভাষাও যে কোন জাতির জাতীয় পর্যায়ে পরিতৃপ্তির অন্যতম উৎস।
শিক্ষা: প্রত্যেক জাতি যেমন মায়ের কাছে ঋণী। তেমনি মাতৃভাষার কাছেও ঋনী। মা জন্মদান করে আর মাতৃভাষা বিশ্ব দরবারে স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত করে। সকল জাতি এবং সভ্যতা মা এবং মায়ের ভাষার প্রতি কৃতজ্ঞ ও শ্রদ্ধাশীল থাকা আবশ্যক।
মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে। মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই।
পৃথিবীতে প্রেম-প্রীতি,স্নেহ-ভালোবাসা, চাওয়া-পাওয়া নিয়ে প্রত্যেক মানুষই সম্পর্কের বেড়াজালে বন্দী। মৃত্যুকে সত্য জেনেও মানুষ সেই বেড়াজাল ছিন্ন করতে চায় না। পারস্পরিক বন্ধন মানুষের মাঝে বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখায়। বিশ্বপ্রকৃতির মাঝে মানুষ বেঁচে থাকতে চায়। পৃথিবীর সৌন্দর্যের মাঝে সবুজ-শ্যামল প্রকৃতির কোলে মানুষ হেসে খেলে বেড়ে উঠেছে। আনন্দ-বেদনা নিয়ে পরস্পরের সাথে মিশেছে। জগতের বিচিত্র কর্ম কোলাহলে নিজেকে নিয়োজিত করেছে। চিরচেনা, চির আনন্দ ও চির বসন্তের সেই জীবন ছেড়ে সে যেতে চায় না। মানুষ পৃথিবীতে যে সৌন্দর্য উপভোগ করে, মায়ার বন্ধনে জড়ায়, তা ছিন্ন করে কোথাও যেতে চায় না। জগতের মোহ মানুষ কিছুতেই ত্যাগ করতে পারে না। ব্যক্তি, সমাজ ও প্রকৃতির মায়ার জালে সে আবদ্ধ হয়ে পরে। মৃত্যু নামক অমোঘ সত্যের প্রতি তার বিতৃষ্ণা জন্ম নেয়। ক্ষণস্থায়ী পৃথিবীর প্রেম তাকে বিমোহিত করে রাখে। এ জগৎ সংসারই মানুষের কাছে স্বর্গরূপে রূপায়িত হয়। তাই পৃথিবীতে চিরকাল বেঁচে থাকার স্বপ্নে বিভোর হয়ে মানুষ মৃত্যুর কথা ভুলে মানুষের মাঝে চির অমর হয়ে থাকতে চায়।
শিক্ষা: মানুষ মরণশীল। অবশ্যম্ভাবী এই পরিণাম সম্পর্কে সচেতন থেকেও মানুষ পৃথিবীকে অকৃত্রিমভাবে ভালোবাসে প্রকৃতির অনাবিল সৌন্দর্যে আকৃষ্ট হয়ে চিরকাল পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে চায়। তবে মানুষ তার কর্মের মধ্য দিয়ে চিরকাল বেঁচে থাকতে পারে।
মাটি হতে হে মানব তোমার জনম, আগুনের মতো কেন হও হে গরম।
মানুষ মরণশীল। কোনো এক অজ্ঞাত জগত থেকে মানুষের জন্ম, আবার সেই অচেনার দিকেই মানুষের যাত্রা। মাটি থেকে শ্রষ্টা মানুষকে সৃষ্টি করেছেন, মৃত্যুর পর এ দেহ আবার মাটিতেই মিশে যাবে। মাঝখানে কিছু দিন মানুষ এই রঙিন পৃথিবীর মায়ায় নিজেকে জড়িয়ে ফেলে। ক্ষণিকের এ পৃথিবীর প্রতি মানুষের আজন্ম টান। নিজের অপ্রতিরোধ্য পরিণাম ভুলে মানুষ এই পৃথিবীতে টিকে থাকার লড়াইয়ে সর্বদা লিপ্ত, সকলেই ব্যস্ত তার অফুরন্ত ক্ষুধা মিটাতে। নিজের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের কথা মানুষ সারাক্ষণ চিন্তা করে। তার চাহিদার কোনো শেষ হয় না। প্রতিনিয়ত ছুটতে থাকে নিজের স্বপ্ন পূরণের নেশায়। যখন কেউ উন্নতির শীর্ষে পৌঁছে যায় তখন ধন-সম্পদ, মান-মর্যাদার মোহে সে হয়ে যায় অন্ধ। আত্ম অহংকারের বিষে আকণ্ঠ নিমজ্জিত হয়ে থাকে। এই অহংকারের জালে পড়ে মানুষ হারিয়ে ফেলে তার মনুষ্যত্ব। তার চেয়ে অপেক্ষাকৃত নিচু শ্রেণির মানুষের প্রতি ঘৃণা দেখায়। মানুষকে মানুষ বলে গণ্য করে না। কিন্তু বিধাতা এতটা সহ্য করেন না। অহংকারীর পতন অনিবার্য। নিয়তির অনিবার্য নির্দেশে এক সময় তাকে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে পাড়ি জমাতে হয় নিরুদ্দেশের পথে। মাটির শরীর আবার মাটিতেই মিলিয়ে যায়। তাই এই নশ্বর জীবন নিয়ে মানুষের অহংকার করা উচিত নয়। নশ্বর এ জীবন তখনই সার্থক হয়ে ওঠে যখন তা মানবতার সেবায় ব্যয় করা হয়। অহংকারী মানুষের মৃত্যুর সাথে সাথে তার নাম হারিয়ে যায় মহাকালের স্রোতে। কিন্তু যারা মানব কল্যাণে নিবেদিতপ্রাণ তারা মৃত্যুঞ্জয়ী। তাদের ক্ষুদ্র দেহটি মাটিতে মিলিয়ে গেলেও তারা অক্ষয় হয়ে থাকে মানুষের মনের মন্দিরে।
শিক্ষা: মানুষের জীবন অতি সীমিত ও অনিশ্চিত। এ অনিশ্চিত জীবন নিয়ে অহংকার করা উচিত নয়। এ ক্ষুদ্র জীবনকে অর্থবহ করে তুলতে প্রয়োজন মানবতার সেবায় জীবন উৎসর্গ করা।
মানুষ বাঁচে তার কর্মের মধ্যে, বয়সের মধ্যে নয়।
মানুষের জীবনকে বয়সের সীমারেখা দিয়ে পরিমাপ করা যায় না। দীর্ঘজীবন মানুষের বড়ত্বকে প্রকাশ করে না। মৃত্যু মানুষের জীবন যাত্রাকে থামিয়ে দেয়। কিন্তু কর্মের ফল এবং গুণাগুণ বিদ্যমান থাকবে পৃথিবী ধ্বংসের পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত। মানুষের ক্ষণস্থায়ী জীবন থেমে যেতে পারে যেকোনো মুহূর্তে। কিন্তু নিজ কর্মের মাধ্যমে মানুষ বেঁচে থাকে অনন্তকাল। কর্মের দ্বারাই মানব মনে স্থায়ীভাবে জায়গা করে নেয়া যায়। মানুষ যেকোনো ব্যক্তিকে তার কর্মফল বা কর্মগুণ দ্বারা বিখ্যাত বা কুখ্যাত হিসাবে মূল্যায়ন করে দীর্ঘকাল যাবত। মহৎ কর্মই মানুষকে অমরত্ব দান করে। মহৎ সৃষ্টিশীলতার জন্যই মানুষ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জীব হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। ভাল কাজই মানুষকে এক যুগ থেকে অন্য যুগে পৌঁছে দেয়। মানুষকে শ্রদ্ধা, ভক্তি ভালোবাসায় সিক্ত করে। পৃথিবীতে অসংখ্য মানুষ এসেছে, অনেকে চলে গেছে, কিন্তু মহাকালের যাত্রায় স্থান করে নিয়েছে খুব অল্প সংখ্যক মানুষ। তাঁদেরকে বাঁচিয়ে রেখেছে তাঁদের মহৎকর্ম। মানবজীবনের সবচেয়ে বড় অর্জন হলো তার মহৎকর্ম। মৃত্যুর পরও মানুষ তার মহৎ কর্মগুণে অমরত্ব লাভ করে। মহামানবদের দৈহিক মৃত্যু ঘটলেও তাদের মহৎ কর্ম আজও শাশ্বত অম্লান। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, মাদার তেরেসা, বিজ্ঞানী আইনস্টাইন, নিউটন প্রমুখ তাঁদের কর্মের মাধ্যমে আজও স্মরণীয় হয়ে আছেন। মৃত্যুর পরেও তাঁরা মানুষের হৃদয়ে শ্রদ্ধায়, ভালোবাসায় বেঁচে আছেন। তাঁদের কর্মই তাদের বাঁচিয়ে রেখেছে। তাঁদের কল্যাণধর্মী চিন্তা ও কর্ম মানুষকে যতদিন প্রাণিত করবে, পথ দেখাবে তাঁরা ততদিন বেঁচে থাকবেন।
শিক্ষা: কর্মই মানুষের প্রকৃত পরিচয়। মহৎ কাজের মাধ্যমেই মানুষ চিরকাল বেঁচে থাকে। ফলে জগতের কল্যাণকর কাজে নিজেকে নিয়োজিত করা উচিত।
মানুষকে ভুল করিতে না দিলে মানুষকে শিক্ষা লাভ করিতে দেওয়া হয় না।
শিক্ষা মানবজীবনকে সামনে এগিয়ে নেয়, এনে দেয় পরিপূর্ণতা। শিক্ষা লাভের জন্য মানুষ বিভিন্ন কাজের মাধ্যমে অভিজ্ঞতা অর্জন করে। সব কাজই নির্ভুল হয় না। কারণ মানুষের অভিজ্ঞতা লাভের পথে ভুল ভ্রান্তি হওয়াটা স্বাভাবিক। নির্ভুলভাবে কাজ করতে হবে এই শর্ত কাজের বেলায় আরোপ করা ঠিক নয়। কারণ ভুল করাই মানুষের স্বভাব। তাই কারো পক্ষেই কাজের নির্ভুলতার অঙ্গীকার করা সম্ভব নয়। নেপোলিয়ান বলেন- “যদিও আমি ইউরোপের একজন বিশিষ্ট সৈনিক তবু আমি দিনে দশটি ভুল করি।” কাজের ভুল ভ্রান্তি থেকেও মানুষ নতুন করে শিক্ষা লাভ করে। কেননা পৃথিবীর যত বড় বড় আবিষ্কার সবই সম্ভব হয়েছে ভুল থেকে অর্জন করা নতুন শিক্ষা লাভের ফল হিসেবে। বার বার ভুল করেও তারা থেমে যাননি বরং ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে নতুন প্রত্যয়ে কাজ শুরু করেছেন। ফলস্বরূপ পেয়েছেন সত্যের দেখা আর সফলতা। শেখ সাদী বলেন- “যার জীবনে যত ভুল তার জীবনে তত মঙ্গল। অন্ধকারের অলিগলি পার হয়েই তো আমরা আলোর সন্ধান পাই।” তাই কাজে কোনো ভুল হলে তা অপরাধ হিসেবে নেওয়া ঠিক নয়। শিক্ষা লাভের জন্য কেউ ভুল করলে তাকে ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখতে হবে। তাকে ভুল সংশোধনের জন্য সুযোগ দিতে হবে। এ ভুল অভিজ্ঞতা থেকে নিজেকে সংশোধন করলেই সে সফলতা অর্জন করতে পারবে। ভুল সংশোধন না করে ভুলকে অন্যায়ের দৃষ্টিতে বিচার করলে শিক্ষা লাভের পথযাত্রা থেমে যাবে। তাই ভুলকে বিবেচনায় রেখেই শিক্ষা লাভ করতে হবে। তবেই শিক্ষা অর্থবহ হয়ে উঠবে।
শিক্ষা: ভুল থেকেই সাহসের জন্ম হয়। কেননা ভুল সংশোধন করার সর্বাত্মক চেষ্টার মাধ্যমেই শিক্ষা লাভের পথ সুগম হয়।
মানুষের সর্বাপেক্ষা ভারী বোঝা হচ্ছে ক্রোধ।
তীব্র অসন্তোষের বহিঃপ্রকাশকে ক্রোধ বলে। ক্রোধ মনুষ্য চরিত্রের এক অস্বাভাবিক অবস্থা যা সুনির্দিষ্ট কারণে হয়ে থাকে। মানবচরিত্রের একটি খারাপ দিক ক্রোধ। কারো ক্রোধ যখন মাত্রা ছাড়িয়ে যায় তখন সেটা ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ক্রোধের কারণে মনের মধ্যে প্রতিশোধের আগুন জ্বলে ওঠে। তখন মানুষ খুন খারাবি পর্যন্ত করে বসতে পারে। তাই ক্রোধ নিবারণ অপরিহাযর্, নচেৎ জীবনের সমূহ বিপর্যয় অনিবার্য। ক্রোধ বা রাগ জীবনের একটি বড় অনুষঙ্গ। কেউ অল্পতে রেগে যায়, কেউ সহজে রাগই করে না। মনের মধ্যে জমিয়ে রাখা অবদমিত ক্রোধ আমাদের ভালো থাকার পেছনের শত্রু। এটি মানুষের সঙ্গে মানুষের সৌহার্দ্য ও সুসম্পর্ক নষ্ট করে। ক্রোধ আসলে একটি সাধারণ সুস্থ আবেগ। তবে অনিয়মিত ও অনিয়ন্ত্রিত ক্রোধ ক্ষতিকারক যা প্রায়ই দৈনন্দিন সাংসারিক সম্পর্ক ও জীবনের স্বাভাবিক গুণগতমান নষ্টসহ বিভিন্ন ধরণের সমস্যা সৃষ্টি করে। ক্রোধ এমন ধরণের আবেগ যা বিরক্তিবোধ থেকে গভীর আক্রোশ ও উম্নোক্ত উত্তেজনা পর্যন্ত বিস্তৃত। কিছু লোক সত্যিকার অর্থে ক্ষেপাটে প্রকৃতির। তারা সহজেই সামান্য কারণে প্রচন্ড উত্তেজিত হয়ে পড়ে। হতাশা, বিড়াম্বনা ও বিরক্তি সহজেই তাদের বিচলিত করে; কোনো কিছুই তারা সহজভাবে নিতে পারে না। তখন ক্রোধ হয়ে ওঠে তার জীবনের বোঝা স্বরূপ। এই ক্রোধ মানুষের স্বভাবজাত। স্বভাব থেকে তা দূর করা সম্ভব নয়। কিন্তু নিজে ক্রোধের বশবর্তী না হয়ে ক্রোধকে নিজের বশে আনতে পারলেই তার কুফল থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। তাই মনীষীরা বলেন- ‘প্রকৃত বীরপুরুষ ঐ ব্যক্তি নয়, যে প্রতিপক্ষকে ধরাশায়ী করে ফেলে বরং প্রকৃত বীরপুরুষ ঐ ব্যক্তি যে ক্রোধের মুহূর্তে নিজেকে সংযত রাখতে পারে।’
শিক্ষা: ক্রোধের মুহূর্তে মানুষ হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলে এবং অনেক সময় এমন কাজ করে যা তার জন্য বিশেষ গ্লানি বয়ে আনে। তাই ক্রোধের মুহূর্তে নিজেকে সংযত রাখার চেষ্টা করতে হয়।
মানুষের সর্বোৎকৃষ্ট শিক্ষকই হল মহৎ ব্যক্তিদের জীবনী।
পার্থিব বস্তুজগতে সকল প্রাণীকূলের মধ্যে একমাত্র মানবজাতি জ্ঞান সাধনা বা বিদ্যা অর্জন করার ক্ষমতা রাখে। আদিকাল থেকে শুরু করে আধুনিক সভ্যতা পর্যন্ত যা কিছু উদ্ভাবিত হয়েছে তার পেছনে বিশেষ ব্যক্তিদের অবদান অনস্বীকার্য। জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখা যেমন- ধর্মতত্ত্ব, অর্থনীতি, রাষ্ট্র ও সমাজবিজ্ঞান, চিকিৎসাবিজ্ঞান, সাহিত্য ও সংস্কৃতি প্রভৃতি ক্ষেত্রে বিভিন্ন মনীষী অসংখ্য অবদান রেখে গেছেন। এসব বিষয়গুলো চর্চার মাধ্যমে আমরা সভ্যতাকে ক্রমশ সমৃদ্ধ করে চলেছি। অপরের তৈরি দৃষ্টান্ত অনুসরণ করেই মানুষ নিজ জ্ঞান সাধনায় ব্রতী হয়। মানুষের জ্ঞান সাধনাকে যুক্তিসম্মত ও মর্যাদাপূর্ণ করতে হলে মহৎ ব্যক্তিদের রেখে যাওয়া শিক্ষা, আদর্শ, নির্দেশিত পথ এবং উপদেশ অনুসরণ করতে হয়। এর সমন্বয়সাধন ব্যতিত সকল শিক্ষা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। তাদের প্রদর্শিত পথই মানুষকে সঠিক পথে পরিচালিত করে। জ্ঞানের পথ সুপ্রশস্ত ও অবধারিত। জ্ঞানের রাজ্যে প্রবেশ করতে হলে অবশ্যই জ্ঞানী মানুষদের সৃষ্টিকর্মের সাথে সংযোগ রাখতে হবে। তাদের অবদানকে বাদ দিলে জ্ঞানচর্চা অসম্পূর্ণ থেকে যায়। এই পৃথিবীতে যারা জগদ্বিখ্যাত এবং জ্ঞানপিয়াসী মানুষ তারা অবশ্যই চিরস্মরণীয় ও সম্মানিত। তারা যদি জ্ঞানের নতুন নতুন শাখা আবিষ্কার, জ্ঞান আহরণের নতুন নতুন রীতি ও পদ্ধতি সৃষ্টি করে না যেতেন, তাহলে কোনক্রমেই মানুষ সফলভাবে জ্ঞানচর্চা অব্যাহত রাখতে পারত না। মহান ব্যক্তিরা জ্ঞানের রাজ্যে নতুন দিগন্তের সূচনা করে গেছেন। জ্ঞান মানুষকে সচেতন করে, মানুষের মানসিক গুণাবলির বিকাশ ঘটায়। জ্ঞানচর্চা আলোকিত মানুষের জন্ম দেয়। এর ফলে মানুষের অন্ধকার জীবনের অর্থাৎ নিরক্ষরতার অবসান ঘটে। দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত জ্ঞান অর্জনের প্রক্রিয়া প্রবাহমান থাকে। জ্ঞান ও সুশিক্ষা আমাদেরকে ভালো-মন্দ, ন্যায়-অন্যায় প্রভৃতি সম্পর্কে ধারণা দেয়। জ্ঞানের সঠিক চর্চা এবং সফল প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হলে এক্ষেত্রে যারা বিজ্ঞ ও বরণীয় তাদেরকে অনুসরণ করা আমাদের কর্তব্য। মহৎ ও জ্ঞানী ব্যক্তিদের রেখে যাওয়া পথই জীবনের সকল ক্ষেত্রে আমাদের উন্নতি ও সমৃদ্ধি নিশ্চিত করে। তাদেরকে অনুসরণ করলে মানুষ মহৎ, উদার ও সুশিক্ষিত হওয়ার সুযোগ পাবে।
শিক্ষা: জ্ঞানের অথৈ সমুদ্রে মহৎ ব্যক্তিরাই মানুষের জন্য দিক নির্দেশক ভূমিকা পালন করে। তাদেরকে অনুসরণ করলে পরবর্তী প্রজন্মও সফলতা লাভ করতে পারবে।
মিত্রত্ব সর্বত্রই সুলভ, মিত্রত্ব রক্ষা করাই কঠিন
সামাজিক জীব হিসেবেই একজন মানুষ আর একজন মানুষের সাথে সম্পর্কে আবদ্ধ হয়। এ সম্পর্ক বন্ধুত্বের, আত্মীয়তার, রক্তের, পারস্পরিক নির্ভরশীলতার। পরস্পরের ওপর নির্ভরশীল মানুষের মধ্যে থাকে সৌহার্দ্য, সম্প্রীতি, সহমর্তিতা, ভ্রাতৃত্ববোধ ও আস্থা। এগুলোর সমন্বয়ে মানুষের মধ্যে গড়ে ওঠে বন্ধুত্ব। সত্যিকারের মানুষ হিসেবে গড়ে উঠতে বন্ধুত্বের ভূমিকা অনেক। একজন সত্যিকারের বন্ধু পারে কারো জীবন বদলে দিতে এবং সুন্দও ও সমৃদ্ধ করতে। কিন্তু পৃথিবীতে এই সত্যিকারের বন্ধু পাওয়া সহজ কথা নয়। আমাদের চারপাশে যে শত শত বন্ধুরা ঘোরাফেরা করে তাদের বেশিরভাগই প্রয়োজনের তাড়নায়, স্বার্থ সিদ্ধি কিংবা অসৎ উদ্দেশ্য সাধনের জন্য বন্ধুত্ব করে। উদ্দেশ্যপ্রবণ মানুষেরা কখনো ব্যক্তির অধিকারে থাকা অর্থের জন্য, কখনো খ্যাতির জন্য, শক্তির জন্য আবার কখনো বা ক্ষমতার জন্য বন্ধুত্ব করে। বন্ধুত্বের দোহাই দিয়ে তারা ব্যক্তির সেই অর্থ-বিত্ত, খ্যাতি, ক্ষমতা ও শক্তিকে নিজের প্রয়োজনে ব্যবহার করে। বন্ধুর সুসময়ে সে সারাক্ষণ বন্ধুর পাশে থাকে। চাটুকারিতায় বন্ধুকে মুগ্ধ করে তার কাছ থেকে সুবিধা আদায় করে। একই সাথে তারা বন্ধুর সাফল্যে ঈর্ষান্বিত হয়, পরশ্রীকাতর হয়ে পড়ে। বন্ধুর বিনাশ চায়। নিজের স্বার্থসিদ্ধি হওয়া মাত্রই তারা বন্ধুত্বে ফাটল ধরায়, অস্বীকার করে। তাই এত দিনের বন্ধুটি যখন কোনো বিপদে পড়ে বা কোনো সাহায্য প্রয়োজন হয় তখন উদ্দেশ্যপ্রবণ বন্ধুকে আর কোথাও পাওয়া যায় না। অন্যদিকে প্রকৃত বন্ধুরা কখনোই বন্ধুর বিপদে তাকে এড়িয়ে চলে না, কিংবা সুসময়ে তার থেকে কোনো সুবিধাও নেয় না। বরং সকল পরিস্থিতিতে তারা বন্ধুর পাশে থাকে। কোনো রকম স্বার্থ ছাড়াই, কেবলমাত্র নিখাঁদ বন্ধুত্বের টানে তারা সবার আগে বন্ধুর বিপদে ঝাপিয়ে পড়ে। কিন্তু এমন বন্ধুদের সংখ্যা নিতান্তই কম। তাছাড়া হাজারো স্বার্থপরের ভিড়ে আমরা প্রকৃত বন্ধুকে চিনতে পারি না। ভুল মানুষের প্ররোচনায় তাদেরকেই সত্যিকারের বন্ধু ভেবে আস্থা রাখি। বিনিময়ে তারা প্রয়োজন মিটিয়ে বন্ধুত্ব বিনষ্ট করে। ফলে বন্ধুত্ব রক্ষা করা দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে।
শিক্ষা: স্বার্থপর বন্ধুদের হিংসা, লোভ ও পরশ্রীকাতরতা বন্ধুত্ব নষ্ট করে। শুধুমাত্র নিঃস্বার্থ প্রকৃত বন্ধুরাই বন্ধুত্বের মর্যাদা দেয় এবং তা রক্ষা করে। তাই আমাদেরকে প্রকৃত বন্ধু বাছাই করতে শিখতে হবে।
মিথ্যা শুনিনি ভাই এই হৃদয়ের চেয়ে বড় কোন মন্দির-কাবা নাই।
সনাতন ধারণা অনুযায়ী মসজিদ, মন্দির, গির্জা, প্যাগোডা এসবই হচ্ছে মানুষের জন্য প্রার্থনার মহাপবিত্র স্থান। এগুলোতে গিয়ে আরাধনা করলে সৃষ্টিকর্তার নাগাল পাওয়া সম্ভব বলে সবার বিশ্বাস। কিন্তু মানুষের হৃদয় হচ্ছে তার প্রকৃত উপাসনালয়। সৃষ্টিকর্তা সর্বত্র বিরাজমান, তিনি সর্বজ্ঞ এবং সর্বশ্রোতা। শুধু উপাসনালয়ের মধ্যেই তাঁর অস্তিত্ব সীমাবদ্ধ নয়। স্রষ্টা মানুষকে ‘সৃষ্টির সেরা জীব’ উপাধি দিয়ে সম্মানিত করেছেন। তিনি আমাদেরকে ভাল-মন্দ বিচার-বিবেচনা করার জন্য বিবেক বুদ্ধি দিয়েছেন। যে ব্যক্তির মনে হিংসা, অহংকার বা কলুষতা থাকে তার উপাসনা কোনো কাজে আসে না। মনকে কালিমালিপ্ত রেখে ঐসব পবিত্র স্থানে গিয়ে সৃষ্টিকর্তার সান্নিধ্য লাভের চেষ্টা করলে তা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। মানুষের মনই যদি পবিত্র না থাকে তাহলে ধর্মীয় পবিত্র স্থানে আসা তার জন্য অর্থহীন। ঈশ্বর প্রদত্ত বিবেক, বিচার-বুদ্ধিকে কাজে লাগিয়ে মানুষ তার হৃদয়কে কলুষমুক্ত করতে পারে এবং মনকে সঠিক পথে পরিচালিত করতে পারে। হৃদয়ের পরিপূর্ণ শুদ্ধতা বজায় থাকলে অনায়াসে প্রভুর সন্ধান পাওয়া যায়। তাঁর অনুগ্রহ লাভের মাধ্যমে ধন্য হওয়া যায়। মানসিকতা যেখানে বিনষ্ট সেই মানব হৃদয় পবিত্র নয়। মানুষের হৃদয়কে পবিত্র রাখতে হলে সৃষ্টিকর্তার প্রতি নিবেদিত হতে হবে। সৃষ্টির সকল জীবকে ভালোবাসতে হবে। মানুষ হিসেবে একে অপরের প্রতি করণীয় দায়িত্বটুকু সঠিকভাবে পালন করতে হবে। তবেই কেউ প্রকৃত মানুষের গুণাবলী অর্জন করতে পারবে। অন্যের কল্যাণ কামনা, অন্যের প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শন ও প্রয়োজনে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়া মানুষের প্রথম এবং প্রধান কর্তব্য। পাপ-পঙ্কিলতা থেকে মানব হৃদয়কে রক্ষা করে মনের পবিত্রতা বজায় রাখার মাধ্যমে একজন প্রকৃত মানুষ হয়ে ওঠা যায়।
শিক্ষা: অন্যের প্রতি কল্যাণকামী চেতনা জাগ্রত রেখে হৃদয়কে উপাসনালয়ের মতো পবিত্র রাখা যায়। মানুষের হৃদয়ের শুদ্ধতাই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। পরিশুদ্ধ হৃদয় ছাড়া প্রার্থনা অর্থহীন। সুতরাং মানুষের হৃদয়ই সবচেয়ে বড় উপাসনালয়।
মুক্ত কর ভয়, আপনা মাঝে শক্তি ধর, নিজেরে কর জয়।
মানুষকে পৃথিবীতে প্রেরণ করা হয়েছে পৃথিবীর শাসনভার দিয়ে। সৃষ্টিকর্তা পৃথিবীকে মানুষের বসবাসের উপযোগী করে দিয়েছেন। মানুষের দায়িত্ব হল এই সবুজ গ্রহটাকে নিজেদের মতো করে সাজিয়ে তোলা। বিবেক-বুদ্ধিহীন অন্যান্য প্রাণীদের সাথে মানুষের পার্থক্য হল কাজের দক্ষতা এবং অজেয়কে জয় করা। সৃষ্টির সূচনা লগ্ন থেকেই মানুষ একের পর এক নতুন নতুন আবিষ্কারের দ্বার উম্মেচিত করে যাচ্ছে। আদিম অন্ধকার গুহা মানব থেকে মানুষ এখন নভোচারী। মানুষের মধ্যে রয়েছে অসম্ভব প্রাণশক্তি, কাজ করার অদম্য স্পৃহা আর জয় করার নেশা। যে মানুষ ভীতু, চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে ভয় পায় সে কখনো সমাজে দৃষ্টান্ত হতে পারে না। ভয়কে জয় করে নতুন পথের সূচনা করাই হল সাহসী মানুষের কাজ। যারা চন্দ্র, মহাসমুদ্র কিংবা হিমালয় জয় করেছেন তাদের প্রত্যেকেই অসীম সাহসী। ইতিহাসের পাতায় কাপুরুষদের স্থান কোন কালেই হয়নি। যুগ যুগ ধরে যত বীরত্ব গাঁথা লেখা হয়েছে তার সবই সাহসী মানুষের গল্পে। মহাকালের অন্ধকারে হারিয়ে যায় সেইসব মানুষ যারা প্রকৃত অর্থে ভীরু। সমাজে কীর্তিমান হয়ে বাঁচতে হলে অবশ্যই সাহসের সাথে বাঁচতে হবে। ইতিহাস লিখিত হয় সাহসীদের দূরন্তপনায়। ইতিহাসে যারা মহানায়ক তাদের কখনো মৃত্যু হয় না। ভয়কে আঁকড়ে ধরে বিজয় ছিনিয়ে আনা যায় না। বিজয়ের বরমাল্য থাকে দূরন্তপথের বাঁকে। যে মানুষ নিজের ভয়কে জয় করতে পারে না সে কখনোই সমাজে স্মরণীয় হয় না। কীর্তিমানের যেমন মৃত্যু নেই তেমনি কাপুরুষও দৃষ্টান্ত হয়ে থাকার উদাহরণ নেই। জীবন সংগ্রামে উত্তীর্ণ হতে হলে ভয়কে দূরে ঠেলে সামনে এগিয়ে যেতে হবে, নিজের উপর বিশ্বাস রাখতে হবে। কারণ আস্থা হারানো মানুষ আর কান্ডারীহীন নৌকা সমান। কেউই কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে পৌঁছাতে পারে না।
শিক্ষা: ভয়কে আঁকড়ে ধরে রাখলে জীবনে সফলতা আসবে না। জগতের যত বিজয়ের কাহিনী আছে তার সবই সাহসের সোনালি কালিতে লিপিবদ্ধ। সাহসই হতে পারে বিজয়ের মূলমন্ত্র।
ভবিষ্যতের ভাবনা ভাবাই জ্ঞানীর কাজ।
প্রাণীকূলের মধ্যে সবচেয়ে পরিশ্রমী প্রাণী ধরা হয় পিপড়া এবং মৌমাছিকে। শুধু কর্মই যদি শ্রেষ্ঠত্বের মানদন্ড হত তবে মানুষের আগে শ্রেষ্ঠত্ব পেত পিপড়া এবং মৌমাছি। মানুষকে অন্য সকল প্রাণী থেকে শ্রেষ্ঠ করেছে তার জ্ঞান, বিবেক, বুদ্ধি এবং চিন্তা করার ক্ষমতা। পরিশ্রমের পাশাপাশি এই তিনের সমন্বয় প্রতিটি মানুষকে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য দান করেছে। মানুষ মাত্রই ভবিষ্যৎ নিয়ে পরিকল্পনা করবে। প্রতিটা মানুষের বর্তমান জুড়ে থাকে তার ভবিষ্যতের ভাবনা। কাজেই ভবিষ্যতই হল মানব জাতির একমাত্র চিন্তার স্থল। ভবিষ্যতের কর্ম-পরিকল্পনাই ঠিক করে দেয় জাতি হিসেবে শ্রেষ্ঠত্বের আসনে কারা বসবে। কে নেতৃত্ব দেবে আগামীর পৃথিবীকে। ক্ষুদ্র পিপীলিকা আর মৌমাছি যদি আগত শীতের জন্য সারা বছর খাদ্য সঞ্চয় করে ভবিষ্যতকে নিরাপদ করতে পারে; তবে মানুষ হিসেবে আমাদেরও উচিত ভবিষ্যতের ভাবনা ভাবা। সাধারণ মানুষ আর জ্ঞানীজনদের মধ্যে পার্থক্য গড়ে দেয় কর্ম পরিকল্পনা। আজকের পৃথিবী উন্নত বিশ্ব আর তৃতীয় বিশ্বে বিভক্ত শুধু ভবিষ্যতের কর্মপন্থা আর তার বাস্তবায়নের জন্য। প্রকৃত জ্ঞানী যারা তারাই ঠিক করে রাখে আগামী দিন কি করবে। ভবিষ্যতের ভাবনায় যাদের বর্তমান কাটে তারাই প্রকৃত জ্ঞানী। কারণ, বলা হয়ে থাকে “একটি ভাল পরিকল্পনা কর্ম সম্পাদনের অর্ধেক পথ অতিক্রম করে।” কাজেই ভবিষ্যৎ নিযে যে যত ভাবে তার উন্নতি তত বেশি বেগবান হয়।
শিক্ষা: মানুষ অতীত থেকে শুধু অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতে পারে। জীবনকে সার্থক ও সুন্দর করে তোলার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতকে সাজানোর কোন বিকল্প নেই। আর তাই ভবিষ্যতের ভাবনা ভাবাই সকল উন্নয়নশীল জাতির অগ্রগতির ক্ষেত্রে প্রধান হাতিয়ার।
বিত্ত হতে চিত্ত বড়
বিত্ত অর্থ ধন-সম্পদ, টাকা-পয়সা, আর চিত্ত অর্থ মন বা অন্তর। ধন-সম্পদ মানুষকে বাহ্যিক সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য দেয়। কিন্তু মনের প্রশান্তির জন্য বিত্তের প্রয়োজন হয় না। এক শ্রেণির মানুষ অর্থের মোহে উদারতা, সহানুভূতি, মানবতাকে হারিয়ে ফেলেছে। তারা নিজেদের ভোগ, বিলাসিতা নিয়ে ব্যস্ত। অথচ প্রচুর অর্থ উর্পাজন করেও তারা মানসিক ভাবে সুখী নয়। আবার পৃথিবীতে এমন মানুষও আছে যারা নিজেদের সম্পদ মানবতার খাতিরে ব্যয় করেন। তারা ধনকে নয় মনকে গুরুত্ব দেন। সম্পদের মোহ না থাকায় তারা কোনো সংকটের মুখোমুখী হন না। মানুষের কল্যাণই এসব ব্যক্তির মূল লক্ষ্য। কৃপণ ধনী ব্যক্তির সম্পদের পাহাড় থাকলেও পৃথিবীর মানুষ তাদের মনে রাখে না। কারণ তাদের সম্পদ কারো উপকারে আসে না। তাই কৃপণ ধনী ব্যক্তি মারা যাবার সাথে সাথে মানুষ তাকে ভুলে যায়। অথচ অনেক রাজা বাদশা আভিজাত্য ও ঐশ্বর্যের পথ ত্যাগ করে মানবতার তরে কাজ করে গেছেন। একারণে তাদের কথা মানুষ মনে রাখে। উদাহরণ হিসেবে রয়েছে গৌতম বুদ্ধ, হাজী মুহাম্মদ মুহসীন, শ্রীচৈতন্যসহ অনেক মহান ব্যক্তি। এসব মানুষই প্রকৃত মানুষ। কারণ তারা বিত্তকে তুচ্ছ করে হৃদয়ের ডাকে সারা দিয়েছেন। আর তাই সভ্যতার ইতিহাসে তারাই স্মরণীয় হয়ে আছেন। পৃথিবীতে অনেক দেশে সম্পদের অভাব নেই কিন্তু সেখানে মানুষের মনের শান্তি নেই। উন্নত দেশগুলোর মানুষের মাঝে পারিবারিক বন্ধন অনেক দুর্বল। তাই আজ তাদের মাঝেও দেখা যায় পারিবারিক বন্ধনকে দৃঢ় করার নানা উদ্যোগ। কারণ তারা বুঝতে পেরেছে অর্থ নয় মানসিক প্রশান্তিই প্রকৃত শান্তি।
শিক্ষা: বাহিরের চাকচিক্যতে বড় না হয়ে, মনকে বড় করতে হবে। মনের প্রশান্তি না থাকলে জীবন অর্থহীন। মনের সম্পদে ধনবান মানুষই প্রকৃত মানুষ।
বুদ্ধি যার বল তার।
মানুষই একমাত্র প্রাণী যে কেবলমাত্র প্রাণেরই অধিকারী নয়, একই সঙ্গে মেধা, মনন ও বুদ্ধিমত্তারও অধিকারী। গোটা প্রাণীকূলে মানুষের শ্রেষ্ঠত্বের প্রধান কারণ তার বুদ্ধিমত্তা। সৃষ্টির সূচনা লগ্নে মানুষ প্রতিকূল প্রকৃতি ও বন্য জীবজন্তুর আক্রমণের কাছে অসহায় ছিল। আদিম অসহায় মানুষ জ্ঞান ও বুদ্ধির চর্চার মাধ্যমে প্রতিনিয়ত সভ্যতার নতুন নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে যাচ্ছে। কেননা সে জানে, জ্ঞান ও বুদ্ধির চর্চার জোরেই মানুষ আজ সভ্যতার শীর্ষে অবস্থান করছে। এটিই মানুষের সব থেকে বড় শক্তি। আপাতদৃষ্টিতে, শারীরিক শক্তির ক্ষমতা বেশী মনে হলেও বস্তুত, কৌসলি ও বুদ্ধিমান মানুষই অধিক শক্তিশালী। শারীরিক শক্তি দ্বারা যা অর্জন করা যায় তা অত্যন্ত স্বল্প সময়ের জন্য স্থায়ী হয়। ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, হিটলারের মতো শাসকের শারীরিক ও অস্ত্র শক্তির বলে ক্ষমতা লাভ করলেও পৃথিবীর ইতিহাসে তারা বরণীয় হয়ে থাকতে পারেনি বরং ইতিহাসের কলঙ্কিত অধ্যায়ে তাদের নাম লেখা হয়েছে। স্বল্প সময়ের জন্য তারা গোটা পৃথিবীর শাসন ক্ষমতা নিজ হাতে নিলেও, পরবর্তীতে তারা নিন্দিত হয়েছে। তাদের অপশাসন বেশিদিন টিকে থাকতে পারেনি। অন্যদিকে, যুগে যুগে যারা লড়াইয়ের পথ পরিহার করে, জ্ঞান ও বুদ্ধির চর্চা দ্বারা মানবকল্যাণে অবদান রেখেছেন, ইতিহাসে তাদের নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা হয়েছে। শারীরিক শক্তি প্রয়োগে সমাজে, দেশে সর্বোপরি গোটা পৃথিবীতে দাঙ্গা-হাঙ্গামা, বিশৃঙ্খলা-অশান্তি লেগেই থাকে। কিন্তু বুদ্ধিমান ব্যক্তি বিশৃঙ্খলতার পথ পরিহার করে বুদ্ধির জোরে সকল সমস্যার সহজ ও শান্তিপূর্ণ সমাধান করতে পারে। জগতের সকল প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে মানুষের সব থেকে বড় অস্ত্র জ্ঞান ও বুদ্ধিমত্তা।
শিক্ষা: পরম স্রষ্টা একমাত্র মানুষকেই জ্ঞান ও বুদ্ধির সমন্বয়ে সৃষ্টি করেছেন। নিজ নিজ বুদ্ধিমত্তা দ্বারা পৃথিবীর কল্যাণ সাধনের জন্য স্রষ্টা মানুষকে জ্ঞান-বুদ্ধি দিয়েছেন। প্রত্যেকের উচিত নিজ বুদ্ধিমত্তাকে সৎপথে ব্যবহার করে মানবকল্যাণ সাধনে সচেষ্ট হওয়া।
বেঁচেও মরে যদি মানুষ দোষে মরেও বাঁচে যদি মানুষ ঘোষে।
মানুষ মরণশীল। এ জগতে জন্মিলে অবশ্যম্ভাবীভাবে তাকে মৃত্যুবরণ করতে হবে। আর মৃত্যুর মধ্য দিয়েই সে পৃথিবী ছেড়ে চলে যায়। কিন্তু মহৎব্যক্তিরা মরেও বেঁচে থাকে। মানুষের জীবন সংক্ষিপ্ত। এ সংক্ষিপ্ত জীবনে মানুষ যদি কল্যাণমূলক কাজ না করে, নিজেকে সত্যের পথে পরিচালিত না করে তবে সে বেঁচেও মরে থাকে। তার জীবন ব্যর্থ, বিফল। এ বিফল জীবনের মানুষটিকে কেউ মনে রাখে না। কেউ তাকে গুরুত্ব দেয় না। তার মৃত্যুর সাথে সাথে সে মাটির সাথে নিঃশেষ হয়ে যায়। পৃথিবীর মানুষ তাকে মনে রাখার মতো সে কিছুই করতে পারেনি। অথচ যে মানুষ নিজেকে মহৎ কাজে নিযুক্ত করে, অপরের কল্যাণে নিজেকে উৎসর্গ করে তাকে পৃথিবীর মানুষ শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে। সে মৃত্যুবরণ করলে তার শুধুমাত্র দৈহিক ধ্বংস সাধন হয়, কিন্তু মৃত্যুর পর সে তার মহৎকর্মের মধ্যে বেঁচে থাকে। এখানেই মানুষের জীবনের প্রকৃত সার্থকতা নিহিত। কর্মের সাফল্য তাকে মৃত্যুর পর শত শত বছর বাঁচিয়ে রাখে। জন্ম ও মৃত্যুর সময়সীমার মধ্যে মানুষ যদি গৌরবময় ও মানবকল্যাণমূলক কাজ করে তবে সে মরেও অমর থাকে। তার দেহের মৃত্যু হলেও তার কীর্তি মৃত্যুহীন। তিনি তার কর্মের মধ্যেই অমর হয়ে থাকেন।
শিক্ষা: মানুষের নশ্বর দেহের বিনাশ আছে। কিন্তু মানুষের সুকীর্তির বিনাশ নেই। একমাত্র মহৎ কর্মই মানুষকে অমর করে রাখে। প্রত্যেক মানুষেরই উচিত নিজ কর্মের প্রতি গভীরভাবে মনোনিবেশ করা।
বৈরাগ্য-সাধনে মুক্তি, সে আমার নয় অসংখ্য বন্ধন মাঝে মহানন্দময় লভিব মুক্তির স্বাদ।
সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না নিয়েই মানুষের জীবন। একজন মানুষের সাফল্য তখনই আনন্দদায়ক হয় যখন তাতে সকলের অংশগ্রহণ থাকে। পৃথিবীতে কেউই পরিপূর্ণভাবে সুখী হতে পারে না। জীবনে চলার পথে অনেক বাধা বিপত্তি আসতে পারে। তাই বলে ভেঙ্গে পড়া উচিত নয়। সমাজে এক শ্রেণির মানুষ আছে যার দুঃখ-কষ্টকে ভয় পায়। তারা মনে করে সংসার হল একটি বিষাদময় স্থান। সংসারের যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাওয়ার উত্তম উপায় হল সংসার ধর্ম ত্যাগ করা। কিন্তু বৈরাগ্য সাধন করলেই মুক্তি মেলে না। কোনো কিছুই সহজে পাওয়া যায় না। মানুষ তা জানলেও বুঝতে চায় না। সুখ-দুঃখ একই মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ মাত্র। কষ্টের পরই সুখ আসে। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় দশ বছর সন্ন্যাসে ছিলেন। কিন্তু তিনি সুখী হতে পারেননি। যে সুখ বিনাকষ্টে অর্জিত হয় তা স্থায়ী হয় না। যারা সংসারের দুঃখ-কষ্ট সহ্য করার ভয়ে সংসার ত্যাগ করে তারা কাপুরুষ ছাড়া কিছু নয়। কথায় আছে “পরাজয়ে ডরে না বীর”। একজন মানুষের উচিত সকলকে সাথে নিয়ে বিপদ-আপদ মোকাবেলা করা এবং অনুরূপভাবে সকলের সাথে আনন্দ ভাগাভাগি করা। সংসারের সকলের সাথে সুখ-দুঃখ ভাগাভাগি করে নেওয়ার মাধ্যমেই মানুষ প্রকৃত মুক্তির স্বাদ উপলব্ধি করে। অন্যদিকে দুঃখ-কষ্ট থেকে বাঁচতে যারা সংসার ত্যাগ করে তারা কখনো মুক্তির সন্ধান পায় না।
শিক্ষা: সংসার ত্যাগ করে মানুষ কখনও সুখী হতে পারে না। মানুষ সামাজিক জীব। সমাজ ও সংসারের সকলকে নিয়েই মানুষকে সুখী হতে হয়।
ভোগে নয়, ত্যাগেই প্রকৃত সুখ।
জীবনধারণের জন্য প্রত্যেক মানুষকেই কিছু চাহিদা পূরণ করতে হয়। আর ভোগের মাধ্যমে তা সম্পন্ন হয়। পৃথিবীতে মানুষের চাহিদারও যেমন সীমা নেই, তেমনই ভোগ্য জিনিসেরও সীমা নেই। কিন্তু সম্পদের সীমাবদ্ধতার কারণে কাঙ্ক্ষিত সবকিছু ভোগ করা সম্ভব হয় না। যখন তা সম্ভব হয় না তখন ভোগবাদী মানুষ কাঙ্ক্ষিত বস্তু ভোগ করার জন্য যেকোনো কিছু করতে প্রস্তুত থাকে। তখন ন্যায়-অন্যায়, সত্য-মিথ্যা, ভালো-খারাপ ইত্যাদির মধ্যকার পার্থক্য করার বোধশক্তি লোপ পায়। নিজেকে অন্যায়, অপকর্ম, দুর্নীতির চাদরে মুড়িয়ে ফেলে। ফলে ভোগবাদী লোভী মানুষের কাছে সামাজিক মূল্যবোধের কোনো গুরুত্ব নেই। ভোগ মানুষকে যেমন লোভী করে তোলে, তেমনই স্বার্থপর করে তোলে। সমাজের গরীব-অসহায় মানুষেরা জীবনধারণের জন্য ন্যূনতম অবলম্বন পাচ্ছে কি না তা ভাবার সময় ভোগবাদীদের নেই। তাদের ধ্যান-জ্ঞানের কেন্দ্রবিন্দু হল নিজের জীবন, আপন পরিবার। ভোগবাদী মানুষেরা সমাজকে কিছু দিতে পারে না, শুধু নিয়েই যায়। এসব মানুষকে কেউ কখনো সম্মান করে না, মর্যাদার চোখে দেখে না। অপর দিকে, ভোগের বিপরীত মেরুতে ত্যাগের অবস্থান। পৃথিবীর সব ভালো কাজের মূলে রয়েছে কারো না কারো ত্যাগ। ত্যাগ ছাড়া কোনো ভালো কাজ সম্পন্ন হয় না। মানবকল্যাণের জন্য যাঁরা শত শত বছর আগে ত্যাগ করে গেছেন, আজও আমরা তাদের শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি। তারা ত্যাগের মূর্ত প্রতীক হিসেবে আজও আছেন, ভবিষ্যতেও থাকবেন। হযরত মুহাম্মদ (সা.), যিশু খ্রিষ্ট, গৌতম বুদ্ধ, রামকৃষ্ণ, সক্রেটিস, নেলসন ম্যান্ডেলা, মাদার তেরেসা, মার্টিন লুথার কিং, তিতুমীর, ক্ষুদিরাম, মাস্টার দা সূর্যসেন, মহাত্মা গান্ধী প্রমুখের নাম আজও ত্যাগের মহিমায় ভাস্বর। ১৯৫২ সালে ২১শে ফেব্রুয়ারিতে সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার প্রমুখ সূর্যসন্তানরা যদি রাজপথে তাদের বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়ে জীবন উৎসর্গ না করতো তাহলে হয়তো আমরা মাতৃভাষা বাংলাকে আর রাষ্ট্রভাষা হিসেবে পেতাম না। এছাড়া বাংলাদেশও স্বাধীনতা লাভ করেছে ত্রিশ লাখ শহিদের রক্ত, দুই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রম ও ত্যাগের বিনিময়ে। জাতি হিসেবে আমরা আজ সেই ত্যাগের মহিমায় উজ্জ্বল।
শিক্ষা: ভোগ করার ইচ্ছা মানুষকে অন্যায়ের দিকে ধাবিত করে। ত্যাগ মানুষকে মহৎ করে তোলে, এনে দেয় অপার সম্মান। ত্যাগী মানুষের নাম পৃথিবীর বুকে অমর হয়ে থাকে সম্মানের সাথে।
মঙ্গল করিবার শক্তিই ধন, বিলাস ধন নহে।
মানুষের কঠোর পরিশ্রম ও ত্যাগের বিনিময়ে গড়ে উঠেছে আজকের সভ্যতা। তাই পৃথিবীর সকল ধন সম্পদে প্রত্যেক মানুষের অধিকার আছে। কিন্তু কোটি কোটি অসহায় মানুষকে বঞ্চিত করে কিছু মানুষ সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছে। তারা আত্মসুখ, ভোগ, চিত্তবিনোদন ও বিলাসিতায় এই সম্পদের অপব্যবহার করে। তাই তাদেরকে প্রকৃত ধনী ও ক্ষমতাবান বলা যায় না। প্রকৃত ধনী হতে হলে দেশ, সমাজ ও মানবকল্যাণে সম্পদ ব্যয় করার মহৎ চিন্তা থাকতে হবে। কেননা বিত্তবানের সম্পদের সার্থকতা নির্ভর করে সম্পদের সদ্ব্যবহারের ওপর। মহৎ ব্যক্তিরা সম্পদকে মানুষের কল্যাণে ব্যবহার করে। তারা অসহায়কে সাহায্য করতে, আর্ত-পীড়িতদের সেবা করতে, দুঃস্থ মানবতার পাশে দাঁড়াতে সম্পদ ব্যয় করে। ব্যক্তি বিশেষের সুখভোগ ও বিলাসিতায় ব্যবহৃত ধন শুধু অপব্যয় নয়, তা সমাজে অকল্যাণ বয়ে আনে। পবিত্র কোরআনে আছে- ‘অপব্যয়কারী শয়তানের ভাই।’ সম্পদশালীর অঢেল সম্পদ অর্জিত হয়েছে দরিদ্র-নিপীড়িত জনগণের শ্রমে। যে সমাজে মানুষ নিরন্ন ও নিরাশ্রয় অবস্থায় ধুকে মরে, বিনা চিকিৎসায় রোগযন্ত্রণায় ও ক্ষুধায় ছটফট করে, সেখানে বিলাসবহুল জীবনযাপন অন্যায়। এমন সমাজে মনুষ্যত্ব টিকে থাকতে পারে না। মানবকল্যাণ ও সমাজের অগ্রগতিতে সম্পদের ব্যবহারেই সম্পদের প্রকৃত মূল্যায়ন হয়। ধনসম্পদ দুঃখী আর অসহায় মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে যতো বেশি কাজে লাগে তার সার্থকতা ততো বেশি। প্রকৃত সম্পদশালী তার সঞ্চিত সম্পদ দেশ ও জাতির উন্নয়নে কাজে লাগায়। সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সাফল্য বয়ে আনে। অনেক মানুষ নিজের স্বার্থের কথা না ভেবে কেবল দরিদ্র, অসহায় ও আর্তপীড়িতদের কথা ভাবেন। মানুষের কল্যাণে তারা জীবন উৎসর্গ করতেও প্রস্তুত থাকেন। তাই অর্থ বিত্ত থাকলেই হবে না, মানুষের কল্যাণে তা ব্যয় করার ইচ্ছাশক্তি থাকতে হবে। মহৎ কাজে ধন সম্পদের ব্যবহার মানুষের মনুষ্যত্বের বিকাশ ঘটিয়ে জীবনকে সার্থক করে তোলে।
শিক্ষা: সঞ্চিত ধন-সম্পদ আত্মসুখভোগ ও বিলাসিতায় অপব্যয় না করে মানবতার কল্যাণে ব্যয় করা প্রয়োজন। যে ধন মানবকল্যাণে ব্যয়িত হয় না সে ধনের কোনো মূল্য নেই।
মধুর চেয়েও আছে মধু, সে এই আমার দেশের মাটি, আমার দেশের পথের :ধূলা, খাঁটি সোনার চাইতে খাঁটি।
‘জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপী গরীয়সী’ অর্থাৎ জন্মভূমি স্বর্গের থেকেও শ্রেষ্ঠ। মানুষের আশা-আকাক্সক্ষা, স্বপ্ন-কল্পনা সবকিছুর মধ্যে স্বদেশ চেতনার বীজ নিহিত। নিজের মায়ের প্রতি ভালোবাসা যেমন মানুষের জš§লব্ধ বৈশিষ্ট্য, তেমনি জন্মভূমির প্রতি টানও মানুষের সহজাত। দেশের আলো, বাতাস, ধূলিকণার প্রতি মানুষ একটা সুতীব্র ভালোবাসা অনুভব করে। দেশের মাটি, পানি দেহকে শীতল ও উৎফুল্ল করে, দান করে অফুরন্ত প্রাণশক্তি। দেশ-মাতা গর্ভধারিনী মায়ের মতোই নিজের সুশীতল ছায়ায় মানুষকে বড় করে তোলে। স্বদেশ ছেড়ে কিছুদিন বাইরে থাকলে মানুষের মন ছটফট করে নিজ দেশের জন্য। দেশের সাথে প্রত্যেক মানুষ যেন এক স্বর্গীয় বন্ধনে আবদ্ধ। স্বদেশকে ভালোবাসার মধ্য দিয়ে মানুষের জীবন প্রকৃত সার্থকতা লাভ করে। প্রকৃত দেশপ্রেমিক তার দেশের মানুষ, ভূপ্রকৃতি সবকিছু নিয়েই চিন্তা করে। সকলের উপকারে নিজেকে নিয়োজিত রাখে। দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় প্রাণ বিসর্জন দিতেও কুণ্ঠাবোধ করে না। দেশের উন্নয়নে ও নিজ দেশকে গোটা পৃথিবীর কাছে পরিচিত করতে তারা সবসময় কাজ করে যায়। দেশপ্রেমের দীক্ষায় উজ্জীবিত হয়ে ১৯৭১ সালে আমাদের দেশমাতৃকার বীরসন্তানরা যুদ্ধ করে ছিনিয়ে এনেছে স্বাধীনতা। দেশপ্রেমের এমন আরো অনেক দৃষ্টান্ত ইতিহাসে দেখা যায়। দেশপ্রেম মানুষকে সাহস দেয়, শক্তি দেয়, অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর। নিজ দেশের প্রতি যার ভালোবাসা নেই, সে সত্যিকার মানুষ হতে পারে না। দেশের মানুষের কষ্ট ও হাহাকার যার হৃদয় ছুঁয়ে যেতে পারে না সে পশুর সমান।
শিক্ষা: দেশপ্রেম ঈমানের অঙ্গ। যে মানুষ তার দেশকে ভালোবাসে না তার জন্ম বৃথা। তাই আমাদের উচিত নিজ দেশকে ভালোবাসা ও দেশের কল্যাণে নিয়োজিত থাকা।
মনের আজ কহ যে ভাল-মন্দ যাহাই আসুক সত্যরে লও সহজে।
মানবজীবন বিচিত্র বর্ণিল। এই জীবন বিকাশে সুখ-দুঃখ, বিরহ-বেদনা, উত্থান-পতনের মতো প্রতিকূল পরিবেশের প্রাচীর ডিঙিয়ে মানুষকে তার অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে হয়। মানবজীবনে চলার পথে বাধা-বিঘ্ন থাকবেই। মানুষকে ধৈর্যধারণ করে কঠিন সত্য ও প্রতিকূল পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়। জীবনের রূঢ় বাস্তবতাকে মেনে নিয়ে জীবন সংগ্রামে টিকে থাকতে হয়। এজন্য বিপদশঙ্কুল পথ অতিক্রমে, জীবনের কঠিন দুঃসময়ে টিকে থাকতে সর্বাগ্রে দরকার মনোবল। সত্যকে আয়ত্ব করা ও মেনে নেওয়া যদিও খুব সহজ নয়, তবুও পৃথিবীতে সাহস, মনোবল ও মনুষ্যত্বের প্রকৃত পরিচয় মেলে সত্যকে সহজে গ্রহণ ও প্রকাশ করার মধ্যেই। সত্যের ভয়ে ভীত হওয়া দুর্বল চিত্তের নিত্য চিত্র। কিন্তু মানুষের জীবনে দুঃসময় চিরস্থায়ী নয়। অন্ধকারের পরে যেমন আলো আসে, দুঃসময়ের পরে তেমনি মানবজীবনে সুখ ও সুদিন আসে। মানুষ দুঃখ, মন্দ আর বিপদকে ভয় করে। সামান্য বিপদেই সে বিচলিত হয়ে পড়ে। বাস্তব জীবনে বিপদ ও দুঃখের প্রয়োজন আছে। দুঃখের অগ্নিপরীক্ষার মধ্য দিয়েই মানুষের চিত্ত ও মন শুচিশুভ্র হয়। আত্মজিজ্ঞাসায় সত্যের সন্ধান মিললে তবেই জগতে নিজেকে জানতে পারা যায়। আর সত্যের কারণে সামনে আসতে পারে বঞ্চনা, সবশেষে মৃত্যু। মিথ্যার বিস্তারে সত্য সাময়িক ক্ষীণ হলেও কালক্রমে সত্যের ঔজ্জল্য প্রস্ফূটিত হয়। অর্থাৎ বাস্তবতা ও সত্য যত কঠিনই হোক, সেটিকে ভালোবেসে মনের শক্তি দিয়ে অতিক্রম করতে পারলেই জীবনে সাফল্য লাভ করা সম্ভব। জীবনে চরম দুঃখ-কষ্টের মাঝেও কঠিন বাস্তবকে সহজ সত্য হিসেবে গ্রহণ করে সকল বাধা বিপত্তি অতিক্রম করাই মানব জীবনের পরম সার্থকতা।
শিক্ষা: জীবনের চরম ক্রান্তিকালে দুঃখ, বিপদ, বেদনায় ভীত না হয়ে যুক্তি দিয়ে বিচার করে সহজে সত্যকে মেনে নিয়ে অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানো সম্ভব।
মন্ত্রের সাধন কিংবা শরীর পাতন।
সর্বশক্তিমান আল্লাহ বলেছেন- ‘তিনি সেই জাতির উন্নতিতে সাহায্য করেন না, যে জাতি নিজেকে সাহায্য করে না।’ যেকোনো ব্যক্তি, সমাজ বা রাষ্ট্রের উন্নতির পূর্বশর্ত হলো নিয়মতান্ত্রিকভাবে পরিশ্রম করা। সুপ্রাচীন কালেই মানুষ অনুধাবন করতে সমর্থ হয়েছিল যে, পরিশ্রমের সঙ্গে ধনের, এবং আলস্যের সঙ্গে দারিদ্রের নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। যে জাতি যত বেশি পরিশ্রমী সে জাতি তত বেশি সফল। উন্নয়নের জন্য সংক্ষিপ্ত কোন পথ নেই। অলস, কর্মবিমুখ ব্যক্তিরা সর্বদাই নিয়তিকে আঁকড়ে ধরে বসে থাকে কোনো পরিশ্রম না করেই। ফলে তারা কিছুই পায় না এবং তাদের জীবনে নেমে আসে দুঃখ-যন্ত্রণা। ইতিহাসের দিকে তাকালে এর অনেক উদাহরণ পাওয়া যায়। বাংলাদেশের মানুষ- বৃহত্তরভাবে ভারতবর্ষের মানুষ আরাম-আয়েশ পছন্দ করে। এরা অধিকাংশ শ্রমবিমুখ, আড্ডাবাজ ও আমুদে। তাই এ অঞ্চলে তেমন কোন উন্নয়ন বা অগ্রগতি হয়নি। সে তুলনায় ইউরোপ-আমেরিকার মানুষ অনেক বেশি পরিশ্রমী, অনেক বেশি কষ্টসহিষ্ণু। তাই তারা এত উন্নতি লাভ করেছে। এশিয়ার জাপানিরা সবার চেয়ে এগিয়ে আছে এই কারণে যে, তারা অত্যন্ত পরিশ্রমী। যেকোনো জাতির উন্নয়ন ও অগ্রগতির প্রথম এবং প্রধান শর্ত হলো নিজ নিজ কাজে পরিপূর্ণ মনোনিবেশ করা। আত্মবিশ্বাস নিয়ে যথাযথ পরিশ্রমের মাধ্যমেই আসে কাক্সিক্ষত সফলতা।
শিক্ষা: পরিশ্রম হলো উন্নতির পূর্বশর্ত। তাই উন্নতি লাভের জন্য জীবনের লক্ষ্যকে বাস্তবায়নের জন্য হতে হবে কঠোর পরিশ্রমী এবং আত্মপ্রত্যয়ী।
অল্প সুখে কাতর অধিক সুখে পাথর ভাবসম্প্রসারনটা নাই
উত্তরমুছুন