ভাব সম্প্রসারণ-২
বুধবার, ২৬ জুন, ২০১৯
1 Comment
বিদ্যার সঙ্গে সম্পর্কহীন জীবন অন্ধ এবং জীবনের সঙ্গে সম্পর্কহীন বিদ্যা পঙ্গু।
বিদ্যার সাথে মানব জীবনের সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। কারণ বিদ্যা মানবজীবনের অজ্ঞতা, কুসংস্কার ও হৃদয়ের অন্ধকার দূর করে। মানবজীবনকে অন্ধকার থেকে আলোর পথে পরিচালিত করে। বিদ্যাহীন মানুষ কখনোই সত্য ও আলোর পথ দেখতে পারে না। ফলে তারা অন্ধের মতো বসবাস করে। একমাত্র বিদ্যার আলোয় মানুষ প্রকৃত মানুষ হয়ে ওঠে। বিদ্যার আলোয় সে অজ্ঞতা ও সংকীর্ণতার অন্ধকার থেকে মুক্তি পায়। সেই আলোয় সমাজ, জাতি, দেশ হয় উপকৃত। তাই মানবজীবনের সাথে বিদ্যার সম্পর্ক অপরিহার্য। বিদ্যাহীন জীবনকে অন্ধের জীবনের সাথে তুলনা করা যায়। তবে অর্জিত বিদ্যাকে জীবনমুখী হতে হয়, জীবন বিবর্জিত নয়। বিদ্যা জীবনমুখী না হলে তা মানুষ, দেশ ও জাতির কোনো উপকারে আসে না। তাই বিদ্যার সাথে জীবনের নিবিড় সম্পর্ক থাকা চাই। যে বিদ্যা কেবল সার্টিফিকেট সর্বস্ব তার কোনো মূল্য নেই। এ বিদ্যা দেশ ও জাতির কোনো উপকারে আসে না। বস্তুত যে বিদ্যার সাথে বাস্তব জীবনের সম্পর্ক নেই, সে বিদ্যা কখনো ফলপ্রসূ হতে পারে না। তাই জীবনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক যে বিদ্যার সেটাই আসল বিদ্যা। এ বিদ্যা জীবনকে সুন্দর ও গতিশীল করার পাশাপাশি সমাজকে উন্নত করার প্রয়াস চালায়। তাই ব্যক্তিজীবন ও সমাজজীবনের বিকাশের জন্য বিদ্যাকে জীবনঘনিষ্ঠ ও বাস্তবানুসারী করে তুলতে হবে।
শিক্ষা: জীবনকে গতিময়, বাস্তব ও কর্মমুখী করতে হলে যেমন বিদ্যার্জন অত্যাবশ্যক তেমনি অর্জিত বিদ্যাও হতে হবে জীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত।
বন্যেরা বনে সুন্দর, শিশুরা মাতৃক্রোড়ে।
প্রত্যেক প্রাণীই একটি নির্দিষ্ট পরিবেশে জন্ম গ্রহণ করে। সেই পরিবেশেই সে ধীরে ধীরে বেড়ে ওঠে। আপন পরিবেশের সাথে তার এক ধরণের সম্পর্ক গড়ে উঠে সেখানেই তাকে সবচেয়ে ভালো মানায়। প্রতিটি প্রাণীই আপন পরিবেশ ছাড়া চলতে পারে না। বন্য প্রাণীর জন্য সুন্দর স্থান হলো বনভূমি। বন্য প্রাণীরা মানুষের সাথে বসবাস করতে পারবে না। নিজস্ব পরিবেশই তাদের সুখ দিতে পারে। বনের পাখিদের বৈশিষ্ট্য হলো আকাশে উড়ে বেড়ানো। সেই পাখিকে দামী খাঁচায় ভরে রাখলেও সে আনন্দ পাবে না। আবার শিশুদের জন্য মায়ের কোলই হলো উপযুক্ত স্থান। মায়ের কোল ছাড়া অন্য কারো কোলে রাখলে সে তৃপ্তি পায় না। লিওনার্দো দ্যা ভিঞ্চি, পাবলো পিকাসো প্রমুখ বিখ্যাত শিল্পীরা তাদের শিল্পকর্মে শিশুকে মায়ের কোলেই স্থান দিয়েছেন। কৃষকদের জন্য উপযুক্ত স্থান গ্রাম। জমিতে ফসল ফলানোই তাদের কাজ। শহর তাদের কাছে খাপছাড়া মনে হবে। জলের পরিবেশেই মাছের বৃদ্ধি, জল থেকে ডাঙ্গায় তুললে মাছ মরে যায়। এভাবে পৃথিবীর প্রতিটি প্রাণীই নিজস্ব বাসস্থান ব্যতীত স্বাধীনভাবে চলতে পারে না। পৃথিবীকে সুন্দরভাবে টিকিয়ে রাখতে হলে প্রতিটি প্রাণীর আপন আপন পরিবেশের প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে। কারণ পরিবেশের বিভিন্ন উপাদান এবং প্রতিটি প্রাণী পরিপূরক হিসেবে কাজ করে।শিক্ষা: উপযুক্ত পরিবেশের অভাবে অনেক সুন্দর জিনিসও অসুন্দর হয়ে যায়। তাই প্রতিটি প্রাণীকে তার নিজ নিজ পরিবেশে বিকাশের সুযোগ দেওয়া উচিত।
বলিতে না পার যাহা চোখের উপরে বলিওনা বলিওনা তাহা অগোচরে।
সমাজে ভালো-মন্দ, সৎ-অসৎ, উঁচু-নীচু, বোকা-ধূর্ত প্রায় সব ধরণের মানুষ বাস করে। সামাজিক জীব হিসেবে সমাজে বসবাসকারী প্রত্যেক মানুষকেই পরস্পরের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলতে হয়। প্রত্যেক মানুষই স্বতন্ত্র স্বভাবের অধিকারী। সেক্ষেত্রে একজনের কাছে অন্যজনের কোনো একটি বৈশিষ্ট্য খারাপ লাগতেই পারে। কিন্তু তাই বলে ঐ ব্যক্তির অনুপস্থিতিতে সেটি নিয়ে নিন্দা বা সমালোচনা করা উচিত নয়। প্রতিটি ধর্মেই পরনিন্দা করতে নিষেধ করা হয়েছে। মহান আল্লাহ তায়ালা পরনিন্দা করাকে মৃত ভাইয়ের গোস্থত খাওয়ার সাথে তুলনা করেছেন। অন্যদিকে, হযরত মুহম্মদ (স.) বলেন- ‘পরনিন্দাকারী জান্নাতে প্রবেশ করবে না।’ পরনিন্দা কেবল ধর্মেই নিষিদ্ধ নয়, এটি সমাজের জন্যও ক্ষতির কারণ। পরনিন্দাকারী সমাজের শান্তি নষ্ট করে এবং সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে। মহৎ এবং উদার মনের ব্যক্তিরা কখনো পরচর্চা করেন না। বরং অন্যের দোষত্রুটি যথাসম্ভব গোপন রাখার চেষ্টা করেন। কিন্তু সংকীর্ণমনা কিছু মানুষ অন্যের দোষ ত্রুটি নিয়ে কুৎসা রটনা করে আত্মসুখ লাভ করতে সর্বদা ব্যস্ত থাকে। পরচর্চারত থেকে সে কেবল সমাজেরই ক্ষতি করে না, একই সাথে নিজের হীনতা, নীচতা এবং নিকৃষ্টতা প্রকাশ করে। পরনিন্দাকারী ব্যক্তিকে সবাই এড়িয়ে চলে। প্রকৃতপক্ষে অন্যের দোষত্রুটি প্রচার করে বেড়ানোর মধ্যে কোনো গৌরব নেই। সমাজে শান্তি বজায় রাখতে এবং নিজেকে সমাজের সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তুলতে হলে পরনিন্দা পরিহার করতে হবে। কোনো ব্যক্তির দোষত্রুটি চোখে পড়লে সেটি ঐ ব্যক্তিকে সরাসরি এবং নম্রভাবে, বিনয়ের সাথে বুঝিয়ে বলা উচিত। কিন্তু বুঝিয়ে বলা সম্ভব না হলেও কোনো অবস্থাতেই ঐ ব্যক্তির অনুপস্থিতিতে বিষয়টি নিয়ে অন্যের সাথে সমালোচনা করা উচিত নয়। এতে সমাজের শান্তি এবং পারস্পরিক সুসম্পর্ক নষ্ট হয়।
শিক্ষা: মানুষ মাত্রই দোষত্রুটি থাকবে। তা মেনে নিয়েই পরস্পর মিলেমিশে সমাজে বাস করতে হয়। সমাজে শান্তিপূর্ণভাবে বাস করতে হলে ভালোকে প্রশংসা করার এবং মন্দের দোষত্রুটি গোপন রাখার মানসিকতা তৈরি করতে হবে। মন্দ লোকের দোষত্রুটি প্রচার করে বেড়ানোর মধ্যে কোনো মহত্ত্ব নেই। ব্যক্তির অনুপস্থিতিতে তার দোষত্রুটি নিয়ে সমালোচনা করা থেকে বিরত থাকতে হবে।
বিদ্যার সাধনা শিষ্যকে নিজে অর্জন করতে হয়, গুরু উত্তরসাধক মাত্র।
শিক্ষা বা জ্ঞান অর্জন হলো সাধনার ব্যাপার। তবে এই সাধনার সাধক হতে হবে শিষ্যের নিজেকেই। একজনের সাধনা কখনও অন্য কেউ করে দিতে পারে না। যার সাধনা তাকেই সাধন করতে হয়। অন্যথায় সাধনার ফলাফল কখনই আশানুরূপ হয় না। আমাদের অনেকের মধ্যেই একটি বিশেষ প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়, তা হলো গুরু বা শিক্ষকের উপর সম্পূর্ণ ভরসা করে বসে থাকা। আমাদের এই প্রবণতার কারণেই আমাদের শিক্ষা শতভাগ পরিপূর্ণ হয় না। গুরু কিংবা শিক্ষক নিঃসন্দেহে একজন ছাত্রের নিকট ভরসার পাত্র হবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, গুরুই তার শিক্ষাকে অন্তরে গেঁথে দেবেন। অন্তরে গেঁথে দেওয়ার দায়িত্ব গুরুর নয়। গেঁথে নেওয়ার দায়িত্ব শিষ্যের। গুরু বড়জোর পথ দেখিয়ে দিতে পারেন। গুরু শুধুমাত্র শিষ্যকে বলে দিতে পারেন কোন পথ তার জন্য উত্তম, কোন পথে, কিভাবে হেটে গেলে সে তার কাঙ্ক্ষিত বস্তুর দেখা পেতে পারে। কিন্তু এরপরের সব দায়িত্বই শিষ্যের। গুরুর দেখানো পথে, গুরুর নির্দেশিত পন্থায় হেটে যেতে হবে শিষ্যের নিজেকেই। সঠিকভাবে সে পথ পাড়ি দিয়ে কাঙ্ক্ষিত বস্তুটি অর্জন করে আনা শিষ্যেরই দায়িত্ব। আমরা প্রায়ই ছাত্রের খারাপ ফলাফলের জন্যই শিক্ষককেই দোষারোপ করি। কিন্তু খারাপ ফলাফলের জন্য কখনও শিক্ষক দায়ী নয়, বরং ছাত্ররাই দায়ী। কিন্তু শিক্ষকের দেখানো পথে ছাত্র যদি হাঁটতে না পারে সে অযোগ্যতা শুধুমাত্র ছাত্রের। শিষ্য পথভ্রষ্ট হলে সে ত্রুটির ভার শিষ্যকেই বহন করতে হয়। সে ভার গুরুর উপর চাপিয়ে দিলে তা কখনও সুবিচার হয় না। গুরু সর্বদাই শিষ্যের মঙ্গল কামনা করেন এবং কল্যাণের পথই দেখিয়ে থাকেন। কিন্তু সেই কল্যাণ সাধনে যদি শিষ্যের সাধনায় ত্রুটি থাকে, তবে তা একান্তই শিষ্যের অপারগতা।
শিক্ষা: বিদ্যা অর্জনের জিনিস। আর অর্জন করতে হলে চাই সাধনা। সে সাধনায় গুরু উত্তরসাধক হতে পারেন বটে। তবে তার বেশি কিছু নয়। নিজের জ্ঞানকে সমৃদ্ধ করতে, এবং নিজের শিক্ষাকে চিরস্থায়ী করতে, যে সাধনার প্রয়োজন তা শিষ্যকেই সঠিকভাবে করতে হয়।
বিনয় উন্নতি পথে প্রধান সোপান বিনয়ে মানব হয় মহামহীয়ান।
মহান সৃষ্টিকর্তা মানুষের মধ্যে এমন কতগুলো গুণাবলী দান করেছেন যার ফলে মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব। এ সমস্ত গুণাবলীর মধ্যে বিনয় অন্যতম। তবে পৃথিবীর সকল মানুষ সমান নয়। কেননা সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত গুণাবলী সবার মাঝে সমান বিকশিত হয় না। পৃথিবীতে যে জাতি যত উন্নত ও শিক্ষিত তাদের বিনয় তত বেশি। বিনীত মানুষকে বৃক্ষের সাথে তুলনা করা যায়। ফলবান বৃক্ষ যেমন ফলাভারে দম্ভ না করে নুয়ে পড়ে তেমনি জগতের মহৎ মানুষেরা দাম্ভিকতার পরিবর্তে বিনয় প্রদর্শন করে। বিনয়হীন মানুষ আর পশুর মধ্যে পার্থক্য নেই। পশু যেমন যেকোনো সময় হিংস্র হয়ে উঠতে পারে তেমনি বিনয়হীন মানুষেরাও বিবেকহীন নিষ্ঠুরতায় মেতে ওঠে। বর্তমান যুগে শিক্ষাকে উন্নয়নের পূর্বশর্ত হিসেবে ধরা হয়। শিক্ষায় আচরণের কাক্সিক্ষত ও ইতিবাচক পরিবর্তন আসে। আর এই কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন বলতে মূলত বিনয়কেই বোঝানো হয়। সুতরাং এ কথা পরিষ্কার করে বলা যায় যে বিনয় ব্যতিত মানবিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব হযরত মুহাম্মদ (স.) সহ পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠিত সকল মহৎ ব্যক্তি ও দার্শনিকগণ বিনয়ের শিক্ষা দিয়ে গেছেন। পৃথিবীর সকল ধর্মের মূলনীতির মধ্যে বিনয় স্থান পেয়েছে। বিনয় না থাকলে এই পৃথিবী মস্ত বড় কসাইখানায় পরিণত হত। মানুষে মানুষে হানাহানি, সংঘর্ষ, খুন, রাহাজানি ইত্যাদি বেড়ে যেত। ফলে সমগ্র পৃথিবী অস্থিতিশীল হয়ে উঠত। আর স্থিতিশীলতাই উন্নয়নের চাবিকাঠি। মানুষ তখনই মহৎ হয় যখন তার আচার-আচরণে যথেষ্ট বিনয় প্রকাশ পায়।
শিক্ষা: মনুষ্যকূলে জন্মগ্রহণ করলেই তাকে মানুষ বলা যায় না। প্রকৃত মানুষ হতে হলে তার চরিত্রে অবশ্যই বিনয় থাকা চাই। সৎ, পরিশ্রমী ও বিনয়ী ব্যক্তিরাই জীবনে সফল হতে পারে।
বিশ্রাম কাজেরই অঙ্গ এক সাথে গোঁথা নয়নের অংশ যেন নয়নের পাতা।
মানবজীবন নানা কর্তব্যে পরিপূর্ণ। জীবনে বাঁচার মতো বাঁচতে হলে, সফলতা ও সুখলাভ করতে হলে মানুষকে সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত কাজ করতে হয়। মানুষ কাজ করে সুখী ও শান্তিময় জীবন যাপনের জন্য। তবে প্রকৃত সুখ উপভোগ করতে কাজের পাশাপাশি অবসর নিতে হয়। কেননা নিরবচ্ছিন্ন কর্ম-সাধনায় জীবনে নেমে আসে ক্লান্তি, জীবন হয়ে পড়ে একঘেয়ে। কর্মের প্রতি আসে বিরক্তি ও অনীহা। ফলে মানুষের কর্ম-সম্পাদন ব্যাহত হয়। এজন্য কর্মের সাথে কর্ম-বিরতি আর কর্মজীবনে অবকাশ থাকেত হবে। চোখের পাতা যেমন চোখের একটা অবিচ্ছেদ্য অংশ। চোখের কাজ দৃষ্টিশক্তি দিয়ে পৃথিবীর মনোরম দৃশ্য দেখা। কিন্তু চোখের পাতা চোখকে মাঝে মাঝে বন্ধ করে চোখকে অবসর দেয়। এতে চোখ আরো বেশি দেখার সুযোগ পায়, পৃথিবীর সৌন্দর্যকে নতুনভাবে নতুন আকর্ষণ নিয়ে দেখে। আমরা যদি একটানা কাজ করি। আমাদের দেহ-মন ক্লান্ত হয়ে পড়ে, কর্মক্ষমতা কমে যায়। শরীর তখন বিশ্রাম চায়। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিলে ক্লান্তি দূর হয়, মন প্রশান্ত হয়, কর্মে নতুন উদ্দীপনা ও শক্তি ফিরে পাই। নতুন করে কাজে আত্মনিয়োগ করতে সক্ষম হই। জীবনধারণের জন্য মানুষের কর্ম সম্পাদন গুরুত্বপূর্ণ। এদিক থেকে মানুষের জীবন কর্মচক্রের অনিবার্য বন্ধনে আবদ্ধ। এ বন্ধন থেকে মানুষের মুক্তি নেই। আর কর্মে যদি সফলতা আসে, কর্মের মধ্যে আনন্দ পাওয়া যায় তাহলে জীবন হয়ে উঠে সুন্দর ও মনোরম। কিন্তু বিরতিহীন কর্ম সম্পাদনে মানুষের জীবন হয় দুর্বিষহ। তাই পরিশ্রমের পর নিয়মিত বিশ্রাম মানুষের কর্মময় জীবনে আনে বৈচিত্র্য, কর্মকে করে গতিময়।
শিক্ষা: কর্মময় জীবনে কাজের পরপরই বিশ্রাম প্রত্যেক মানুষের দেহ ও মনে নতুন কর্মশক্তি ও প্রেরণা জোগায় ও কাজে সাফল্য আনে। তাই কাজের মধ্যে বিরতি নেয়াকেও গুরুত্ব দিতে হবে।
বিশ্ব জোড়া পাঠশালা মোর সবার আমি ছাত্র নানাভাবে নানান জিনিস শিখছি দিবারাত্র।
শিক্ষা মানুষের অমূল্য ধন। শিক্ষার মাধ্যমে মানুষের চিন্তা-চেতনার পরিস্ফুটন ঘটে। শিক্ষায় মানুষ পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠে। শিক্ষার মাধ্যমে ব্যক্তির অন্তর্নিহিত গুণাবলীর পূর্ণ বিকাশ ঘটে এবং সমাজের একজন উৎপাদনশীল সদস্য হিসেবে গড়ে ওঠে। শিক্ষা একটি জীবনব্যাপী প্রক্রিয়া। শুধুমাত্র প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাতেই মানুষের শিক্ষা পূর্ণতা লাভ করে না। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত মানুষ জীবনের নানা ক্ষেত্রে নানা অভিজ্ঞতার মাধ্যমে শিক্ষা লাভ করে। মানুষ তার জন্মের পর থেকে নানাভাবে শিক্ষা লাভ করে। এই শিক্ষা তার সমাজের কাছ থেকে হয়, পরিবারের কাছ থেকে হয় আবার গুরুজন বা বন্ধু-বান্ধবের মাধ্যমেও হতে পারে। আবার প্রকৃতির কাছ থেকেও মানুষ শিখতে পারে। প্রতিনিয়ত তার শেখার চেষ্টা অব্যাহত থাকে। ইচ্ছা এবং অনিচ্ছা সত্ত্বেও সে শেখে। জন্মের পর একটি শিশু কীভাবে কথা বলতে হবে তাকে তা শেখাতে হয় না। সে নিজে নিজে তার পরিবারের সবাইকে দেখে শিখে নেয় নিজের অজান্তেই। তেমনিভাবে সামাজিক রীতি-নীতিগুলোও সে শিখে নেয় আপনা থেকেই। নিজের জীবনকে খাপ খাইয়ে নিতে পারে সমাজের সঙ্গে, সময়ের সঙ্গে। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় বলা চলে- ‘শিক্ষা হলো তাই যা আমাদের কেবল তথ্য পরিবেশনই করে না, বিশ্বসত্তার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে আমাদের জীবনকে গড়ে তোলে।’ বাস্তবিকই মানুষ জীবন থেকে নানামুখী শিক্ষা গ্রহণ করে জীবনকে বিশ্বজগতের সঙ্গে মিলিয়ে নেয়। মানুষ শিশুকাল থেকে মৃত্যুকাল পর্যন্ত জীবনের প্রতিটি ধাপে নতুন নতুন শিক্ষা গ্রহণ করে নিজেকে উপযুক্ত মানুষ হিসেবে প্রস্তুত করে। বাস্তবিকই এই পৃথিবী তাই মানুষের জন্য একটি বিরাট পাঠশালাস্বরূপ, যেখান থেকে সে দিবা-রাত্র শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে।
শিক্ষা: মানুষ মানুষের মতো জীবন যাপন করে শিক্ষাকে ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করে। আর এই শিক্ষা সে গ্রহণ করে প্রকৃতিগতভাবেই, কোনো বাধ্যবাধকতা ছাড়াই। মানুষের এই শিক্ষা প্রক্রিয়া চলে জীবনব্যাপী অর্থাৎ জš§ থেকে মৃত্যু পর্যন্ত।
বিশ্ব যখন এগিয়ে চলেছে, আমরা তখন ব’সে বিবি তালাকের ফতওয়া খুঁজেছি, ফিকাহ হাদিস চষে।
বর্তমান বিশ্বায়নের যুগে জ্ঞান-বিজ্ঞানের পরিধি প্রসারিত হওয়ার সাথে সাথে পরিবর্তিত হচ্ছে মানবসমাজের নানা অন্ধসংস্কার। অগ্রগতির এই ধারাকে অব্যাহত ও বেগবান রাখতে পুরুষদের পাশাপাশি নারীদেরও রয়েছে সমান প্রচেষ্টা ও অবদান। এই পৃথিবীতে নারী ও পুরুষ একে অপরের পরিপূরক সত্তা। তা সত্ত্বেও আমাদের সমাজ থেকে নারীদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ ও দৃষ্টিভঙ্গি মুছে যায়নি। ধর্মীয় গোঁড়ামি এখনো আঁকড়ে রেখেছে সমাজকে। ধর্মের দোহাই দিয়ে নারীদের বন্দি করে রাখা হচ্ছে। সমাজে এখনো নারীদের মনে করা হয় পুরুষদের ইচ্ছাপূরণের হাতিয়ার। ধর্মীয় পুরুষতান্ত্রিকতার কাছে জিম্মি হয়ে আছে নারীজাতির স্বাধীনতা। ইচ্ছেমত বিয়ে করা আর তালাক দেওয়া এখনো পুরুষের ব্যক্তিগত ব্যাপার। এক্ষেত্রে তারা ব্যবহার করার চেষ্টা করে ধর্মীয় নীতির অপব্যাখ্যা। প্রত্যেক ধর্মে নারীদের মর্যাদার কথা বলা হলেও তারা নিজেদের মতো ব্যাখ্যার মাধ্যমে স্বীয় স্ত্রীর কর্তৃত্ব রাখছে নিজেদের হাতে। পৃথিবী যখন সভ্যতার শিখরে আরোহণ করতে যাচ্ছে তখন কিছু ধর্মীয় গোঁড়ামি আঁকড়ে ধরে হরণ করে চলেছে নারীর অধিকার। নারীর ক্ষমতায়নের যুগেও তারা স্ত্রী তালাকের ফতওয়া খুঁজে বের করার অদ্ভুত চেষ্টায় রত। এহেন গোঁড়ামি পরিহার করে তারা এখনো সামাজিক উন্নতি সাধনের স্বপ্ন সারথীদের সঙ্গী হতে পারছে না। বিশ্ব যখন এগিয়ে যাচ্ছে অগ্রগতি ও বৈষম্যহীনতার দিকে তখন তারা ব্যস্ত তাদের স্ত্রীদের সেবা গ্রহণ করতে। একদিকে বিশ্বের উন্নতি অবিরাম থাকলেও অন্যদিকে ধর্মীয় গোঁড়ামির কারণে সমাজে নারীর অবস্থানের উন্নতি হচ্ছে না। সভ্যতার ধারা তার আপন গতিতে সামনের দিকে ধাবিত হচ্ছে। কিন্তু নারীরা এখনো আবদ্ধ রয়েছে ধর্মীয় গোঁড়ামির শৃঙ্খলে।শিক্ষা: নারী-পুরুষ উভয়ের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় সাধিত হচ্ছে মানব বিশ্বের অগ্রগতি। ধর্মীয় গোঁড়ামি এই পথ চলাকে বাধাগ্রস্ত করে ফলে সামগ্রিক উন্নতি ব্যাহত হয়।
বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি, চির কল্যাণকর অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।
শিক্ষা: আধুনিক কল্যাণকামী সভ্যতা সৃষ্টিতে নারী ও পুরুষ উভয়ের অবদান অনস্বীকার্য। তাই নারীদের মর্যাদা সমুন্নত রেখে তাদের সাথে নিয়ে জগতের কল্যাণে আত্মনিয়োগ করতে হবে।
বিদ্বানের দোয়াতের কালি শহিদের রক্তের চেয়েও পবিত্র।
বিদ্যা অমূল্য সম্পদ। আর বিদ্বান ব্যক্তি মানবতার মুক্তির পথপ্রদর্শক। বিদ্বান ব্যক্তির দেখানো পথেই সমাজ ও রাষ্ট্র উন্নতির পথে এগিয়ে চলে। অন্যদিকে সত্য ও ন্যায়ের প্রতিষ্ঠায় যাঁরা অকাতরে প্রাণ বিসর্জন দেন তাঁরা শহিদ। সকল ধর্মে এবং সমাজে শহিদ ব্যক্তি মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত। ইসলাম ধর্মে শহিদদের মর্যাদার কথা স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে। হযরত মুহাম্মদ (স.) শহিদের রক্তের চেয়েও বিদ্বানের কলমের কালিকে পবিত্র বলে আখ্যায়িত করেছেন। বিদ্বান ব্যক্তিকে গভীর সমুদ্রে ভাসমান জাহাজের নাবিকের সাথে তুলনা করা যায়। নাবিক যেমন জাহাজকে নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছে দিতে পারে, তেমনি সমাজের মধ্যে বিদ্যমান বৈষম্যকে লাঘব করতে পারেন একজন বিদ্বান ব্যক্তি। তিনি তাঁর জ্ঞানের আলোয় সমাজের অন্ধকার দূর করতে পারেন। বিদ্যাই মানুষের মধ্যে ভালো-মন্দ, ন্যায়-অন্যায়, উচিত-অনুচিতের বোধ তৈরি করে। সক্রেটিস, প্লেটো, এরিস্টটল, জন কীটস, শেকস্পিয়র, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, গ্যাব্রিয়েল গর্সিয়া মার্কেজ, বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন, সুকান্ত ভট্টাচার্য প্রমুখ মহান ব্যক্তি সময়ে সময়ে কালে কালে এসে মানবতার মুক্তির গান গেয়েছেন। বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন যেমন নারী জাগরণে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন তেমনি ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল, মাদার তেরেসাও মানবতার মুক্তির জন্য কাজ করে গেছেন। বিদ্বান ব্যক্তিরা শুধুমাত্র তাদের লেখনীর মাধ্যমে নয় বরং কর্ম দ্বারা নিজেদের ভূমিকার অপরিহার্যতা প্রমাণ করে দিয়ে গেছেন। বিদ্বান ব্যক্তি গোটা সমাজটাকেই পরিবর্তন করে দিতে পারেন, পারেন নতুন নতুন সম্ভাবনার দ্বারকে উন্মুক্ত করতে। অন্যদিকে একজন শহিদ ব্যক্তি কেবল সত্য ও ন্যায়কে প্রতিষ্ঠা করতে পারেন। এ কারণে বিদ্বান ব্যক্তির গুরুত্ব শহিদের চেয়ে বেশি।শিক্ষা: মানবতার মুক্তির অগ্রপথিক বিদ্বানের ভূমিকা শহিদের চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তাই আমাদের সকলকেই প্রকৃত বিদ্বান হতে হবে।
শিক্ষাই জাতির মেরুদন্ড
মানুষের সমুন্নত দেহ গঠনের মূলে রয়েছে মেরুদন্ড মানবদেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলোর মধ্যে মেরুদন্ডর ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মেরুদ-হীন মানুষ চলৎশক্তিহীন, দাঁড়াতে-বসতে অক্ষম। তাই মেরুদ-হীন মানুষের জীবন অর্থহীন ও গ্লানিময়। একটি জাতি যখন অন্যান্য জাতির সাথে সমানভাবে দাঁড়াতে না পারে বা চলতে না পারে তখন সেই জাতির উন্নতির পথ থেমে পড়ে। হালবিহীন নৌকা যেমন তীরে পৌঁছাতে পারে না তেমনি শিক্ষা ছাড়া কোনো জাতি উন্নত হতে পারে না। শিক্ষা এবং উন্নয়ন পরস্পর পরস্পরের সঙ্গে নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত। কোনো জাতির উন্নয়নের পূর্বশর্ত হচ্ছে শিক্ষা। উন্নয়ন কোনো প্রাকৃতিক ব্যাপার নয়, স্বয়ংক্রিয় কোনো ব্যাপারও নয়, তা সরাসরি শিক্ষার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। যে জাতি যত-শিক্ষিত সে জাতি তত উন্নত। সর্বোত্তম শিক্ষা মানুষের মস্তিষ্কবৃত্তিকে সজাগ করার পাশাপাশি হৃদয়বৃত্তিকেও জাগ্রত করে। শুধু মস্তিষ্কবৃত্তি জাগ্রত হলে কোনো জাতি হয়তো কেবল প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ সাধন করতে পারে, অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ হতে পারে। কিন্তু কোনো জাতির হৃদয়বৃত্তি জাগ্রত না হলে সে জাতির সার্বিক উন্নয়ন সাধন হয় না। প্রকৃত শিক্ষা মানুষকে মানুষের স্তরে উন্নীত করে। আর মানুষ যখন প্রকৃত মানুষের স্তরে উন্নীত হয়, তখন তাদের চূড়ান্ত উন্নয়ন সম্পন্ন হওয়ার পথে কোনো বাধা থাকে না। শিক্ষা হচ্ছে সেই শক্তি যে শক্তিতে বলীয়ান হয়ে মানুষ সমাজ ও জাতির প্রভূত উন্নতি সাধন করতে পারে। মনীষী ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বলেছেন- ‘শিক্ষাই হচ্ছে মানুষের শক্তি।’ এই শক্তিবলে বলীয়ান হয়ে একটি জাতি পরিপূর্ণ জাতি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। শিক্ষার মাধ্যমে সংস্কারমুক্ত হয়ে একটি জাতি সমস্ত প্রতিকূলতাকে অতিক্রম করে উন্নতির চরম শিখরে আরোহণ করতে পারে। অন্য সকল উন্নত জাতির পাশাপাশি মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে।
শিক্ষা: একটি জাতিকে আদর্শ জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করতে হলে শিক্ষিত একটি জনগোষ্ঠীর প্রয়োজন আর তার জন্য অপরিহার্য হলো শিক্ষা। তাই সর্বস্থানে সর্বাগ্রে শিক্ষাকে অবশ্যই গুরুত্ব দিতে হবে।
রাখি যাহা তাহা বোঝা, কাঁধে চেপে রহে দিই যাহা তার ভার বরাবর বহে।
আদিম যুগের মানুষ শুধু নির্ভরশীল ছিল খাদ্য সংগ্রহ আর ভোগ করার উপর। সঞ্চয় না থাকাতে তাদের পোহাতে হত নিদারুন কষ্ট। মানুষ যখনই সঞ্চয় করতে শিখেছে সভ্যতার যাত্রা শুরু তখনই। খাদ্য এবং সম্পদের সংরক্ষণ মানুষকে আধুনিক সভ্যতার পথ দেখিয়েছে। সঞ্চয়ের উপর ভিত্তি করে মানুষ গড়ে তুলেছে সুরম্য প্রাসাদ, অতিকায় অট্টালিকা। সমাজের দিকে তাকালেই আমরা দেখতে পাই মানুষের মাঝে বৈষম্য। কেউ মনোরম প্রাসাদে বিলাসী জীবন যাপন করছে, আর কেউ পথের পাশে পড়ে আছে অনাহারে। মানুষ যখনই সঞ্চয়ের গুরুত্ব বুঝতে পেরেছে বৈষম্যের সূচনা হয়েছে তখনই। সঞ্চয়ের মানসিকতা মানুষকে ভোগবাদী হতে শিখিয়েছে। আর ভোগবাদী মানসিকতাই সমাজে বৈষম্যের সূত্রপাত করে। স্রষ্টার সৃষ্টি হিসেবে আমরা শ্রেষ্ঠত্ব পেয়েছি। কিন্তু এর নির্দশন আমরা রাখতে সক্ষম হইনি। মানবতাবোধ না থাকলে মানুষ যেমন পরম আত্মার সন্ধান পায় না। তেমনি অন্যের উপকার না করলে জীবাত্মা ও সন্তুষ্ট হয় না। আমরা যা কিছু সঞ্চয় করি তা সম্পূর্ণ নিজের জন্য। কিন্তু সঞ্চয়ের অংশ বিশেষ যদি আমরা সমাজ, রাষ্ট্রের কাজে ব্যয় করি, তবে তার ফল পুরো বিশ্ব ভোগ করে। সম্পদ একা ভোগ করে যেমন আনন্দ নেই তেমনি তাতে অন্যের উপকারও হয় না। মানব কল্যাণে, মানবতার উপকারে ব্যয় করা সম্পদ সমগ্র মানবজাতির কল্যাণে আসে। প্রকৃত মহৎ মানুষ তার সম্পদ মানব কল্যাণেই ব্যয় করে। এর ফলে মানজবজাতি যেমন উপকৃত হয় তেমনি স্রষ্টার সন্তুষ্টিও অর্জিত হয়।শিক্ষা: সম্পদ বা সঞ্চিত ধন যদি কেউ অন্যের উপকারে ব্যয় করে, তখন তার সুফল দ্বারা সমগ্র দেশ, জাতি সর্বোপরি সারাবিশ্ব উপকৃত হয়। মানুষের এই জনকল্যাণকর কাজ প্রকৃতিকে করে তোলে সমৃদ্ধ। মানবতা হয়ে উঠে সুশোভিত।
রাতে যদি সূর্য শোকে ঝরে অশ্রুধারা, সূর্য নাহি ফেরে, শুধু ব্যর্থ হয় তারা।
প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মানুসারে প্রতিদিন সূর্য অস্ত যায়, রাত্রি নামে পৃথিবীর বুকে। অগণিত নক্ষত্র রাতের আকাশে মোহনীয় রূপে আবির্ভূত হয়। তখন কেউ যদি রাতের সৌন্দর্যকে উপভোগ না করে সূর্য শোকে কাতর ও বিমর্ষ হয়ে পড়ে, তবে সূর্য তো ফিরে পায়ই না, বরং রাত্রির আকাশে তারকারাজি ও ছায়াপথের সৌন্দর্য এবং আলো-ছায়ার খেলার মাধুর্য দর্শন থেকেও বঞ্চিত হয়। তখন মানুষ দুকূলই হারায়। মানুষের জীবনে সুখ-দুঃখ আসে পর্যায়ক্রমে। সময়ের কালস্রোতে মানুষের জীবন-যৌবন, ধন-মান সবই ভেসে যায়। কালগর্ভে যা বিলীন হয়েছে তা আর ফিরে আসে না। অতীতের দিনগুলো যত মধুর, যত আনন্দঘনই হোক না কেন, বর্তমানে তার জন্য আফসোস করে কোনো লাভ নেই। অতীতের চিন্তায় মগ্ন থাকলে বর্তমানে যতটুকু সুখ ও আনন্দ লাভের সুযোগ পাওয়া যায়, তাও নষ্ট হয়ে যায়। তাই অতীতের সুখের কথা স্মরণ করে বৃথা সময় নষ্ট না করে বর্তমানকে পরিপূর্ণভাবে উপভোগ করার চেষ্টা করতে হবে। বর্তমানের কাছ থেকে যতটা সম্ভব সুখ ও আনন্দ লাভের উপকরণ আদায় করে নিতে হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে। যে সময় অতিবাহিত হয়ে গেছে তা আর ফিরে পাওয়া যাবে না। অতীতের আশায় মশগুল থেকে বর্তমানকে উপেক্ষা করাও বুদ্ধিমানের কাজ নয়। যারা অতীতের জন্য হা-হুতাশ করে, তাদের জীবন ব্যর্থতা ও হতাশায় আচ্ছন্ন হয়। তাই অতীতের সুখ-স্বপ্নে বিভোর না থেকে বর্তমানকে সহজভাবে মেনে নিয়ে তাকে পরিপূর্ণ কাজে লাগাতে হবে এবং জীবনকে উপভোগ করতে হবে। অতীতের অভিজ্ঞতার আলোকে বর্তমানকে নির্মাণ করে জীবনকে সমৃদ্ধ করাই বুদ্ধিমানের কাজ।শিক্ষা: সময় ও নদীর স্রোত কারো জন্য অপেক্ষা করে না। তাই যা চলে গেছে, তাকে নিয়ে আফসোস না করে বর্তমানকে মেনে নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে।
রৌদ্রে পুড়ে বৃষ্টিতে সে ভিজে দিবা-রাতি মোদের ক্ষুধার জন্য যোগায়, চায় নাকো সে খ্যাতি।
চাষীরা দেশের সেবক। রোদে পুড়ে ঝড় বৃষ্টিতে ভিজে তারা ফসল উৎপাদন করে। সে ফসলে আমাদের অন্ন যোগায়। সারা দেশের খাদ্যাভাব দূর করে কৃষকেরা। যদি অকাতরে তারা বিলিয়ে না দিতো, মাথার ঘাম পায়ে ফেলে ফসল না ফলাত তা হলে আমাদের বেঁচে থাকা সম্ভব হতো না। অক্লান্ত পরিশ্রমে নিজের দেহের রক্তকে পানি করে জাতীয় অর্থনীতিকে তিলে তিলে গড়ে তুলেছে। কৃষকের উৎপাদিত কাঁচামাল বিদেশে রফতানি করে দেশের অর্থনীতি সমৃদ্ধ হয় বৈদেশিক মুদ্রায়, সম্ভব হয় শিল্পায়ন। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম ‘জীবন-বন্দনা’ কবিতায় তাই কৃষকদের সম্পর্কে বলেছেন- ‘গাহি তাহাদের গান, ধরণীর হাতে দিল যারা আনি ফসলের ফরমান।’ রাজিয়া খাতুন চৌধুরাণী ‘চাষী’ কবিতায় বলেছেন- ‘মুক্তিকামী মহা সাধক মুক্ত করে দেশ, সবারই সে অন্ন যোগায় নাইকো গর্ব লেশ।’ এই উক্তিটি থেকেই স্পষ্টতই কৃষকদের সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। কঠোর সাধকের মতো কৃষকও কঠিন পরিশ্রম করে সবার জন্য ফসল ফলায়। অর্থাৎ ফসল ফলিয়ে সকলের অন্নসংস্থান করাটা তার সাধনা। কিন্তু সমগ্র মানবজাতির জন্য এত বড়ো উপকার সাধন করেও তার বিন্দুমাত্র অহংকার নেই। তারা জাতির কল্যাণে নিজেকে নিয়োজিত রাখে কোনো স্বার্থ ও গর্ব ছাড়াই।শিক্ষা: কৃষকেরা রোদ বৃষ্টি ঝড় উপেক্ষা করে দিনরাত পরিশ্রম করে কঠিন মাটির বুকে লাঙ্গল চালিয়ে ফসল উৎপাদন করে। তাদের উৎপাদিত ফসলে ধনী গরীব সকলের অন্ন সংস্থান হয়। তাদের মধ্যে নেই কোনো হিংসা, বিদ্বেষ কিংবা গর্ব। তাদের এসব গুণ ও মহানুভবতা দেখে আমাদের সকলের উচিত তাদের প্রতি সম্মান দেখানো।
লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু।
পার্থিব জগতে কোনো কিছু অর্জনের জন্য মানুষের মধ্যে যে, দুর্দমনীয় বাসনার সৃষ্টি হয় তার নামই লোভ। লোভ মানব জীবনের সবচেয়ে ক্ষতিকর এক রিপু। মানুষ লোভের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে বাহ্যিক জ্ঞান শূন্য হয়ে পড়ে। তখন ভাল-মন্দের বিচার-বিবেচনা জ্ঞান থাকে না। মানুষের মতো মনুষ্যত্ববোধ অন্য পশু পাখির মধ্যে নেই। লোভ মানুষের সেই মনুষ্যত্বকে বিনষ্ট করে দেয়। আর মনুষ্যত্বহীন মানুষের পশুর মতো বিচার, বুদ্ধি, বিবেক লোপ পায়। লোভ এমনই এক তাড়না যা মানুষকে পশুতে রূপান্তরিত করে। লোভের কারণে মানুষ পাপ পুণ্যের কথা পর্যন্ত ভুলে যায়। তাই সে কিছুই বুঝে উঠতে পারে না। ধীরে ধীরে সে ধ্বংসের পথে, পাপের পথে এগিয়ে যায়। লোভী ব্যক্তি যে শুধু নিজের ক্ষতি করে তাই নয়। সে নিজের সাথে সাথে সমাজেরও ক্ষতি করে। অপরদিকে লোভহীন মানুষ পাপ থেকে দূরে থাকে। স্বাভাবিক ও সুন্দর জীবনযাপন করে। লোভী মানুষের পক্ষে কখনই এমন নির্মল সুন্দর জীবন পাওয়া সম্ভব হয় না। লোভের তাড়নায় মানুষ গর্হিত কাজে লিপ্ত হয়। এসকল নীতি বিবর্জিত কাজ পাপ কাজ বলে বিবেচিত হয়। এর ফলে সৃষ্টিকর্তা মানুষের প্রতি চরম অসন্তুষ্ট হন। আর এই নীতি বিবর্জিত পাপ কাজের কারনে মানুষের মানবিকতার আত্মিক মৃত্যু ঘটে।
শিক্ষা: লোভ মানুষের স্বাভাবিক ও নির্মল জীবন-যাপনের পথে বড় অন্তরায়। লোভে পড়ে মানুষ সর্বনাশের দিকে এগিয়ে যায় এবং ধ্বংস ও মৃত্যুর মধ্য দিয়ে তার জীবনের অবসান ঘটে। এককথায় লোভই মানুষের সকল অপরাধের উৎস।
শুনহে মানুষ ভাই সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই।
সৃষ্টিকর্তা মানুষকে শ্রেষ্ঠ করে গড়েছেন। গায়ের বর্ণ সাদা-কালো কিংবা বাঙালি, ইংরেজ, চীনা, জাপানি যা কিছুই হোক না কেন মানুষের প্রকৃত পরিচয় সে মানুষ। সত্যিকার অর্থে মানুষে মানুষে কোনো জাতিভেদ নেই। একই পৃথিবীর আলো-বাতাস আর সম্পদ ভোগ করে মানুষ বেঁচে আছে। এক আদি পুরুষ থেকেই সবার সৃষ্টি। তা সত্ত্বেও স্বার্থপর মানুষ সৃষ্টি করেছে মানুষে মানুষে কৃত্রিম বিভেদ। জগতের যত কলঙ্কময় রক্তপাত, দ্বন্দ্ব-সংঘাত, তার মূলে আছে এই ভেদাভেদ। কিন্তু এই জাতিভেদ প্রথা আর ধর্মীয় সীমারেখা অতিক্রম করেও মানুষ ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছে। দেশে দেশে যুগে যুগে নিত্য নতুন অভিযান পরিচালনা করছে। বিরূপ প্রকৃতিকে নিজেদের বশে এনেছে। গড়ে তুলেছে গ্রাম-নগর সভ্যতা। জয় করেছে পাহাড়-সাগর। পাড়ি দিয়েছে মহাকাশে, পদচিহ্ন এঁকে দিয়েছে চাঁদের বুকে। নিত্য নতুন আবিষ্কারের নেশায় মানুষ দশ দিগন্তে ছুটছে। বৈচিত্র্যময় মানুষের জীবন। মানুষের জন্মই হয়েছে অসুন্দর পৃথিবীকে সুন্দর সুশোভিত করতে। মানুষ সভ্যতাকে টিকিয়ে রাখতে সৃষ্টি করেছে জ্ঞান-বিজ্ঞান, দর্শন, শিল্প, সাহিত্য। এতসব কর্মের দ্বারাই মানুষ পৃথিবীতে তার শ্রেষ্ঠত্ব ধরে রাখে। অন্য কোনো প্রাণী মানুষের এই কৃতিত্বকে ছাড়িয়ে যেতে পারে না। শত পরিচয়ের উপরে মানুষের একটাই পরিচয়- সে মানুষ। পৃথিবীর সকল মানুষের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে একই রক্ত। তাই মানুষের এই পরিচয়ই শ্রেষ্ঠ। এই পরিচয়েই সকল কিছুর ঊর্ধ্বে তার অবস্থান। ধনে মানে মানুষ অপরাজেয়। উর্বর পৃথিবীতে ফসল ফলিয়ে মানুষ আনে সুখ সমৃদ্ধি। এস. ওয়াজেদ আলীর ভাষায়- “আমি মুসলমান সমাজের বটে, কিন্তু তারও উপর আমি মানুষ। আমি বাঙালী বটে, কিন্তু তারও উপর আমি মানুষ।” তাইতো সবার উপরে মানুষ সত্য তার উপরে নাই।শিক্ষা: মানুষ তার আপন বৈশিষ্ট্যে পৃথিবীর সকল প্রাণী থেকে শ্রেষ্ঠ। ধর্ম-বর্ণ-জাতি কখনো মানুষের পরিচয়কে নির্দিষ্ট করে দিতে পারে না। সে যে মানুষ এটাই সত্য। আর তাই সকল পরিচয়ের ঊর্ধ্বে মানুষই সত্য।
শুধালো পথিক ‘সাগর হতে কী অধীক ধনবান ?’ জ্ঞানী বলেন, ‘বাছা তুষ্ট হৃদয় তারো চেয়ে গরীয়ান।’
মানুষের জীবনের চাওয়া-পাওয়া এবং অভাববোধ একে অপরের সাথে সরাসরি জড়িত। প্রতিটি অভাব পূরণের পর মানুষের মনে নতুন নতুন অভাবের সৃষ্টি হয়। এ অভাব মানুষের মনে অতৃপ্তির জন্ম দেয়। তার চাওয়া এবং পাওয়ার কোনো সীমা থাকে না। সে যত পায়, তত চায়। মহাসমুদ্রে লুকিয়ে থাকা মনিমুক্তা, ধনসম্পদের মতো অফুরন্ত ভা-ারের মালিক সে হতে চায়। তিল তিল করে গড়ে তোলা সম্পদের পাহাড় তাকে সন্তুষ্টি দিতে পারে না। সে কোনো কিছুতেই তৃপ্তি পায় না। সুখ-শান্তি তার কাছে সোনার হরিণ বনে যায়। ধন সম্পদের প্রতি লোভ তাকে করে তোলে যান্ত্রিক। সে সম্পদের নেশায় অন্ধ হয়ে যায়। সম্পদ আহরণের জন্য সে পৃথিবীর সকল কিছু ত্যাগ করে। সম্পদের লোভে সে ভুলে যায় মানুষের জীবনের প্রকৃত উদ্দেশ্য। সম্পদ আহরণের উদ্দেশ্যে সে দুর্নীতি, অন্যায়,অবিচার, খুন ইত্যাদি জঘন্য কাজে লিপ্ত হতেও দ্বিধাবোধ করে না। কিন্তু তার এই অতৃপ্ত হৃদয় সুখ-শান্তির দেখা পায় না। সুখ তার কাছে মরীচিকার মতো ধরা দেয়। কিন্তু একজন প্রকৃত জ্ঞানী ব্যক্তি অল্প সম্পদেই তুষ্ট থাকেন। কারণ তিনি জানেন কীভাবে জ্ঞানের মাধ্যমে আত্মাকে সন্তুষ্ট করতে হয়। তিনি জানেন অতৃপ্ত মন বিনাশের কারণ। তার এই অল্পতেই তুষ্টি বা আত্মতৃপ্তি তার মনোবলকে করে অটুট। এই আত্মতৃপ্তিই তাকে জীবনের মূল লক্ষ্য সম্পর্কে সচেতন করে তোলে। আর এ কারণেই ধনী ব্যক্তির চেয়ে তুষ্ট হৃদয় অনেক বেশি মহৎ।শিক্ষা: পার্থিব জীবনে চাওয়া-পাওয়া এবং অভাববোধ চিরন্তন সত্য। মানুষের উচিত ধনসম্পদের লোভে মত্ত না হয়ে, কীভাবে অল্পতে তুষ্টির মাধ্যমে সুখী হওয়া যায় সেই লক্ষ্যে এগিয়ে যাওয়া। একমাত্র আত্মতৃপ্তিই পারে একজন মানুষকে প্রকৃত সুখের সন্ধান দিতে।
শৈবাল দীঘিরে বলে উচ্চ করি শির লিখে রেখো এক ফোঁটা দিলেম শিশির।
মহৎ মানুষ হিংসা, দীনতা, হীনতা ও স্বার্থপরতা থেকে নিজেকে দূরে রাখেন। উদার, মানব প্রেমিক এসব মানুষ সর্বদা সকল মানুষের মঙ্গল চিন্তা করেন। তাদের জ্ঞান-প্রজ্ঞা ও কর্ম দিয়ে দেশ ও জাতির কল্যাণসাধন করেন। তারা কখনো আপন গৌরবের কথা, উপকারের কথা অন্যের কাছে গর্ব করে প্রচার করেন না। সমাজের মানুষকে তারা বটবৃক্ষ হয়ে আগলে রাখেন। তারা নিঃস্বার্থভাবে অপরের জন্য কাজ করে যান। বিপরীতে আমাদের সমাজে কিছু হীন, স্বার্থপর মানুষ আছে যারা সর্বক্ষণ নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকে। অন্যের উপকারের কথা স্বীকার করতে চায় না। বরং কখনো যদি উপকারীর সামান্যতম উপকার করতে পারে, তবে তা অতিরঞ্জিত করে প্রচার করে। তারা কখনোই বুঝতে চেষ্টা করে না যে তারা কতটা ক্ষুদ্রমনা। এই অকৃতজ্ঞতাবোধের পরিচয় পাওয়া যায় শৈবালের জীবনে। শৈবালের জন্ম দিঘীর জলে, দিঘীর জলেই তার অবস্থান। দিঘী তাকে পরম মমতায় তার জলে স্থান দেয়। সেই জলেই শৈবালের বেড়ে ওঠা। শৈবালের উচিত দিঘীর প্রতি কৃতজ্ঞ হওয়া। কিন্তু তা না করে মিথ্যে বাহাদুরি দেখায়। কেননা, শৈবালের ডগায় রাতের শিশির বিন্দু জমে। এক সময় তা দীঘির জলে পড়ে। অকৃতজ্ঞ শৈবাল তখন অহংকার করে এই বলে যে, সে দীঘিকে এক ফোঁটা পানি দিয়েছে। তার এই এক ফোঁটা পানি নিতান্তই তুচ্ছ যা দীঘির তেমন কোনো উপকারে আসে না। বরং এতে শৈবালের হীনমন্যতার পরিচয় পাওয়া যায়। আমাদের সমাজের অকৃতজ্ঞ মানুষগুলোও শৈবালের মতোই।শিক্ষা: মহৎ তারাই যারা মিথ্যে বাহাদুরির আশ্রয় নেন না। পরের কল্যাণ সাধনেই তাদের সুখ। আর অকৃতজ্ঞ ব্যক্তি সমাজের কাছে সব সময়ই মূল্যহীন। তারা কখনোই সমাজে বড় কিছু হতে পারে না।
সকল পাথর হলে মহামূল্য মণি মণির কদর কিছু হত না কখনি।
পৃথিবীর সব বস্তুই মানুষ সমান গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করে না। দৈনন্দিন জীবনে যেসব জিনিস অতি প্রয়োজনীয়, সেসব জিনিসের প্রতি সবাই গুরুত্ব প্রদান করে। সহজলভ্য বস্তুগুলো মানুষের কাছে কম গুরুত্ব বহন করে। যেমন-আলো, বাতাস, পানি প্রভৃতি ছাড়া মানুষ বাঁচতে পারে না। কিন্তু প্রকৃতিতে এসব প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায় বলেই এসবের প্রতি মানুষের গুরুত্ব কম। মানুষের জীবন ধারণের জন্য এগুলো আবশ্যকীয় উপাদান হলেও মানুষ সাধারণত মনি-মুক্তা, সোনা-রূপাকে বেশি মূল্যবান হিসেবে গণ্য করে। কারণ প্রকৃতিতে আলো, বাতাস যেমন সহজে পাওয়া যায়, তেমনি মনি-মুক্তা খুজে পাওয়াটা ততোটা সহজ নয়। অনেক শ্রম ও সাধনার বিনিময়ে সেগুলো অর্জিত হয়। আর এই দুর্লভ্যতাই মনি-মুক্তার মূল্যমানকে অনেক গুণ বাড়িয়ে দেয়। একইভাবে মানবজীবনে কষ্টার্জিত বস্তুই সবচেয়ে বেশি দামি। অনায়াসে লব্ধ বস্তুর প্রতি মানুষের কোনো আকর্ষণ থাকে না এবং তা কখনোই কষ্টলব্ধ বস্তুর মূল্য বিন্দুমাত্র কমাতে পারে না। অনুরূপভাবে, জীবনে প্রত্যেক মানুষই যদি সফল ও সুখী হত তাহলে এসবের কোনো গুরুত্ব থাকত না।শিক্ষা: কষ্ট করে সাফল্য লাভ করতে হয় বলে, সফল মানুষের সংখ্যা কম। কিন্তু সহজেই যদি সাফল্য লাভ করা যেত, তাহলে সফল মানুষের সংখ্যা আরো বেশি হতো।
সকলের তরে সকলে আমরা প্রত্যেকে আমরা পরের তরে।
প্রতিটি সমাজেই কিছু আত্মকেন্দ্রিক, স্বার্থপর মানুষ বাস করে। তারা সমাজের প্রতি দায়িত্ব ভুলে নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত। সামাজিক জীব হিসেবে সমাজ এবং সমাজের সদস্যদের প্রতি প্রত্যেকের দায়িত্ব রয়েছে। সমাজবদ্ধভাবে বসবাসের মধ্য দিয়েই মানুষ সভ্যতার জন্ম দিয়েছে। পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে মানুষ প্রতিষ্ঠা করেছে সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্যরে এই সমাজ। আমাদের ব্যক্তিগত জীবনে যেমন সমাজের অবদান রয়েছে তেমনি সমাজের প্রতিও রয়েছে আমাদের দায়িত্ব। সমাজবদ্ধভাবে বাস করতে হলে ব্যক্তিস্বার্থের চিন্তা পরিহার করে চলতে হয়। স্বার্থবাদী চিন্তা নিয়ে সমাজের উন্নয়ন যেমন সম্ভব না তেমনি ব্যক্তি জীবনেও সাফল্য আসে না। সকলের সহযোগিতায় গড়া সমাজ যেন আনন্দ-কানন। সমাজের অন্য সদস্যরা যাতে ব্যক্তিস্বার্থের সংকীর্ণতার শিকার হয়ে কষ্ট না পায় সেটাই হওয়া উচিত সব মানুষের কামনা। আর এর জন্য প্রয়োজন স্বীয় স্বার্থ ত্যাগ করা। কারণ অন্যের উপকারে উৎসর্গিত জীবনই প্রকৃত জীবন। পরোপকারী মানুষ অমর এবং সর্বজন পূজনীয় হয়। বিবেক এবং চিন্তার শক্তিই মানুষকে শ্রেষ্ঠত্বের আসনে বসিয়েছে। সুতরাং বিবেকবান কোনো মানুষই নিজের স্বার্থের কথা ভেবে সমাজ এবং চারপাশের মানুষের প্রতি তার দায়িত্ব ভুলে যেতে পারে না। বিবেকবান মানুষমাত্রই পরোপকারী এবং সমাজসেবক হয়ে থাকেন। আর সমাজের প্রতিটি মানুষ যদি তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করে তাহলে সমাজ হয়ে উঠবে সুন্দর।শিক্ষা: ব্যক্তিস্বার্থ ত্যাগ করে মানবতার স্বার্থে নিয়োজিত হওয়াই মানবজীবনের লক্ষ্য হওয়া উচিত। আর এর মধ্যেই মানবজীবনের প্রকৃত সার্থকতা নিহিত।
রাত যত গভীর হয়, প্রভাত তত নিকটে আসে।
শিক্ষা: দুঃখ দেখে, পরাজয়কে দেখে ভয় পেলে চলবে না। মেধা-মননের সমন্বয়ে সাহসী উদ্যোগে জীবন-চলার পথকে মসৃণ করতে হবে। মনে রাখতে হবে দুঃখের পরেই সুখ আর আনন্দ জীবনকে ছুঁয়ে যাবে।
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু নিভাইছে তব আলো তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ তুমি কি বেসেছ ভাল?
পরম করুণাময়ের অপরিসীম দয়ায় মানুষ আজ সভ্যতার পথে অগ্রগামী। গোটা পৃথিবী দাড়িয়ে আছে বিশ্বায়ন নামক ছাতার নিচে। বিজ্ঞানের নব নব আবিষ্কার পৃথিবীর নানা প্রান্তের মানুষকে একসূত্রে গেঁথে ফেলেছে। মহাকালের এই ঘূর্ণায়মান চাকায় মানবতা আজ ভূলুষ্ঠিত। ভ্রাতৃত্বের বন্ধন ভেঙ্গে গিয়ে তৈরি হচ্ছে বৈরী সম্পর্ক। মানুষের মাঝে বিভেদ ক্রমশ বেড়েই চলছে। আত্মকেন্দ্রীক চিন্তা ভাবনার কারণে মানবিক সম্পর্ক আজ বিষিয়ে উঠেছে। পারস্পরিক হিংসা বিদ্বেষের ফলে শান্তির আলো নিভে গেছে। মানুষের ব্যক্তিকেন্দ্রীকতার কারণে সম্প্রীতি আর সৌহার্দের বন্ধন ভেঙ্গে গেছে। সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলতে গিয়ে মানুষ প্রাকৃতিক পরিবেশকে বিপন্ন করে তুলছে। জগতের বাহ্যিক সৌন্দর্য বাড়াতে গিয়ে বিনষ্ট হচ্ছে প্রকৃতির চিরন্তন সৌন্দর্য। নির্বিচার হস্তক্ষেপ প্রাকৃতিক পরিবেশকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গেছে। প্রকৃতির নির্মল বাতাসে আজ বিষাক্ত কার্বন। বহতা নদীর বুক চিরে গড়ে উঠছে মানব বসতি। অবাধে চলছে বন্যপ্রাণী ও পাহাড় ধ্বংসের মহোৎসব। মানুষের সাথে প্রকৃতির স্বাভাবিক সম্পর্ক নষ্ট হয়ে গেছে বহু আগেই। সৃষ্টিকর্তার অপার সৌন্দর্যের এই লীলাভূমি মানুষ ধ্বংস করে চলছে নির্বিচারে। এর ফলে সৃষ্টিকর্তা মানুষের প্রতি রুষ্ট হয়ে যেতে পারেন। মানবজাতির উপর নেমে আসতে পারে ভয়াবহ শাস্তি। কিন্তু সৃষ্টিকর্তা পরম করুণাময় ও দয়ালু। তিনি মানুষকে শত অপরাধ সত্ত্বেও ক্ষমা করে দেন। তার সেরা সৃষ্টি মানুষকে তিনি ভালোবাসেন সবচেয়ে বেশি। তার এই নিরন্তর ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ হিসেবে তিনি মানুষকে ক্ষমা করে দেন। মানুষের তাই আরো সচেতন হওয়া উচিত। স্রষ্টা প্রদত্ত সকল সৌন্দর্যের রক্ষণাবেক্ষণ করা উচিত।
শিক্ষা: প্রকৃতিকে নষ্ট করলে তার প্রভাব মানুষের উপরেই বেশি পড়বে। স্রষ্টা প্রদত্ত কোনো সম্পদ বিনষ্ট করা স্রষ্টাকে কষ্ট দেয়ার শামিল। আর তাই মহান স্রষ্টাকে ভালোবাসার মাধ্যমে তার সকল সৃষ্টিকে সংরক্ষণ করা মানুষের নৈতিক দায়িত্ব।
যাহারা এ পৃথিবীতে হয়ে গেছেন চিরধন্য নিজের জন্য ভাবেন নিকো, ভেবেছিলেন পরের জন্য।
আমাদের এই পৃথিবীর জীবন ক্ষণস্থায়ী। আমরা কেউই চিরকাল পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে পারব না। নির্দিষ্ট সময় শেষে সবাইকে পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হবে। পৃথিবীতে প্রতিনিয়ত মানুষ জন্ম নিচ্ছে এবং মৃত্যুবরণ করছে তাদের সবাইকে মানুষ সমানভাবে মনে রাখছে না। যারা মানবতার কল্যাণে কাজ করেছেন তাদেরকে মানুষ মৃত্যুর পরও শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে। কিন্তু সমাজে কিছু আত্মকেন্দ্রিক স্বার্থপর লোক আছে যারা সবসময় নিজেকে নিয়ে চিন্তা করে। আত্মচিন্তা, আত্মসুখ তাদের চিন্তাচেতনার মূল বিষয়। পৃথিবীর ভাল-মন্দ, হাসি-কান্না, মঙ্গল-অমঙ্গল তাদের হৃদয়কে কখনও স্পর্শ করে না। তাদের ভোগেই প্রকৃত সুখ। আমরা পৃথিবীতে অনেককেই দেখি যারা মানুষের তরে কাজ করে আজ চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন। মাদার তেরেসা, হাজী মুহাম্মদ মুহসীন, মার্টিন লুথার কিং, নেলসন ম্যান্ডেলা, মহাত্মা গান্ধী, ফ্লোরেন্স নাইটিংগেলসহ এমন অনেকেই আছেন যাদের মৃত্যুর অনেক বছর পর আজও মানুষ তাদের শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে। মহৎ ব্যক্তিদের বৃক্ষের সাথে তুলনা করা যায়। বৃক্ষ তার ফুল, ফল, ছায়া দিয়ে মানুষের কল্যাণ করে। কিন্তু প্রতিদানে পৃথিবীর কিছুই চায় না, শুধু দিয়েই যায়। একজন বিত্তশালী মানুষকে মৃত্যুর পর তখনই মানুষ মনে রাখে যখন তার অর্থ সম্পদ মানুষের কল্যাণে ব্যবহৃত হয়। মহান মানুষরা প্রত্যেকেই বিভিন্নভাবে মানুষের কল্যাণে কাজ করে গিয়েছেন। তাঁরা তাদের মেধা, শ্রম ও অর্থ দিয়ে এমন সব কর্মযজ্ঞ সম্পাদন করে গেছেন যার জন্য চিরকাল মানুষের হৃদয়পটে তারা স্মরণীয় হয়ে থাকবে।শিক্ষা: আত্মচিন্তার মধ্যে প্রকৃত সুখ পাওয়া যায় না। সমাজে মানুষের কল্যাণে প্রত্যেক মানুষের এগিয়ে আসা দরকার। তবেই মানুষের মাঝে অমরত্ব লাভ করা সম্ভব।
যে অন্যায় আদেশ পালন করে সেও অন্যায় করে।
মানবজাতিকে বলা হয় সৃষ্টির সেরা জীব। অপরের কল্যাণসাধন করাই জীবনের মূল সার্থকতা। কিন্তু মানব সমাজের অনেকেই পরস্পরের ক্ষতি করতে চায়। সমাজে তারা বিশৃংখলা সৃষ্টির মাধ্যমে বিভেদ তৈরি করে। মানুষের কল্যাণার্থে রচিত আইন তারা ভঙ্গ করে এবং আরেকজনের অধিকারে হস্তক্ষেপ করে। সমাজে এসব কাজ যারা করে তারা নিঃসন্দেহে অন্যায়কারী ও অপরাধী। কিন্তু অনেকেই আবার এদেরকে নানাভাবে সহায়তা করার মাধ্যমে নিজের অজান্তেই অন্যায় কাজে জড়িয়ে পড়ে। শক্তিশালী ও ক্ষমতাধর ব্যক্তিরা অপেক্ষাকৃত দুর্বল শ্রেণির লোকদেরকে অনেক সময় তাদের অন্যায় কাজের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে। সমাজের প্রভাবশালীরা অধিনস্তদেরকে নানা ধরণের অন্যায় কাজের আদেশ দিয়ে থাকে। এক্ষেত্রে বাধ্য হয়ে সেই আদেশ পালন করার মাধ্যমে অনেক ভালো মানুষও প্রকৃতপক্ষে অন্যায়কারীদের তালিকায় বন্দি হয়ে যায়। কেননা অন্যায় কাজের আদেশের প্রতিবাদ না করে তা সহ্য করাও একটা অন্যায়। এটি পালন করা আরো বড় অন্যায়। অন্যায় আদেশ পালন করার মাধ্যমে তারা পরোক্ষভাবে অপরাধীদের সাহস যোগান দেয়। কাউকে অন্যায় কাজে সাহায্য করলে সমাজ থেকে অপরাধ প্রবণতা দিন দিন আরো বৃদ্ধি পায়। অন্যায়কারী তার অপরাধের জন্য যেরূপ শাস্তি পাওয়ার যোগ্য তেমনি অন্যায় আদেশ পালনকারীও সেরূপ শাস্তি পাওয়ার যোগ্য। কারণ তার একটি অন্যায় আদেশ পালনের ফলে সমাজের বৃহৎ স্বার্থ ক্ষুণ্ন হয়। অপরদিকে সমাজের বিচারে সে অপরাধী, যে অন্যায় কাজের আদেশ দেয় তার ব্যক্তিগত স্বার্থ সিদ্ধ হয় এবং সমাজে অশান্তি ও অরাজকতা সৃষ্টি হয়। তাই দুর্বলচিত্তে কারো অন্যায়কে প্রশ্রয় দেয়া ও তার অন্যায় আদেশ পালন করা সমাজের চোখে একটি গর্হিত অপরাধ।
শিক্ষা: সহযোগিতা ও আন্তরিকতা উদার মানসিকতার পরিচায়ক হলেও কাউকে অন্যায় কাজে সহযোগিতা করা যাবে না। একটি অন্যায় আদেশ পালন করার দরুন সারাজীবন সমাজে একজন অন্যায়কারী হিসেবে বিবেচিত হতে হবে।
যে একা সেই সামান্য, যে একা সেই সামান্য, যার ঐক্য নাই সে তুচ্ছ।
মানুষ সামাজিক জীব। প্রতিনিয়তই তাকে অন্যের উপর নির্ভর করতে হয়। পৃথিবীতে যে ব্যক্তি একা সে নিঃসঙ্গ এবং অসহায়। মানসিক দিক দিয়ে সে খুব দুর্বল। কঠিন কাজ করতে গিয়ে সে ভেঙ্গে পড়ে। বড় ও বেশি কাজ দেখে একাকী মানুষ ভয় পায়। কাজের স্পৃহা হারিয়ে ফেলে। নিঃসঙ্গ মানুষকে হতাশা আষ্টে-পৃষ্ঠে জরিয়ে রাখে। মানুুষের জীবন সংগ্রামময়। নিঃসঙ্গ মানুষ জীবন সংগ্রামে জয়ী হতে পারে না। একাকী মানুষের শক্তি প্রতিকূলতার কাছে তুচ্ছ। আজকের আধুনিক বিশ্বজগতের পেছনে রয়েছে মানুষের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা। প্রাচীনকাল থেকে মানুষ নিজের অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখার জন্য বেছে নিয়েছে ঐক্যবদ্ধ জীবন। সংঘবদ্ধভাবে কাজ করলে অনেক কঠিন কাজ সহজ, অসম্ভব কাজ সম্ভব হয়ে যায়। সমস্ত বৃহৎ ও স্মরণীয় কাজের পেছনে রয়েছে সংঘবদ্ধ মানুষের অক্লান্ত প্রচেষ্টা। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বালুকণা যেমন মহাদেশ গড়ে তোলে, তেমনি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র শক্তির সমন্বয়ে গড়ে ওঠে বৃহত্তর সংঘবদ্ধ কর্ম-শক্তি। যেখানে ঐক্য নেই, সেখানে ব্যর্থতা লুকায়িত থাকে। নিঃসঙ্গ মানুষ জীবন সংগ্রামে চলতে পারে না। পৃথিবীতে অতিক্ষুদ্র প্রাণী পিঁপড়া মৌমাছির মধ্যে ঐক্যবদ্ধতার যে রূপ আমরা দেখি তা অতুলনীয়। কথায় আছে, দশে মিলে করি কাজ, হারি জিতি নাহি লাজ। দশজনে মিলে কাজ করে ব্যর্থ হলেও তাতে কষ্ট লাগে না, নতুন উদ্যমে পুনরায় কাজ শুরু করা যায়। সংঘবদ্ধ শক্তি জাতীয় জীবনের উন্নয়নে বিরাট অবদান রাখে। সংঘবদ্ধ শক্তি অজেয়কে জয় করে। সমগ্র বাঙালি জাতির মধ্যে একতা ছিল বলেই আমরা বাংলাভাষাকে মাতৃভাষা ও রাষ্ট্রভাষা হিসেবে পেয়েছি এবং মুক্তিযুদ্ধে জয়ী হয়ে বাংলাদেশকে পেয়েছি। ঐক্যের কারণেই পৃথিবীর বড় বড় আন্দোলনগুলো সংঘটিত হয়েছে এবং নির্যাতিত, শোষিত মানুষগুলো তাদের অধিকার ফিরে পেয়েছে। জাতীয় জীবনে সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক উন্নতির জন্য ঐক্যের কোনো বিকল্প নেই। তাই আমাদের ব্যক্তিগত এবং সমষ্টিগত জীবনে একতা বজায় রেখে কাজ করতে হবে এবং জাতিকে সামনে এগিয়ে নিতে হবে।
শিক্ষা: নিঃসঙ্গ নয়, ঐক্যবদ্ধ জীবনই মানুষের কাম্য। একটি সফল ও সুন্দর জীবনের জন্য ঐক্যবদ্ধতার বিকল্প আর কিছু নেই কারণ ঐক্যই অপরাজেয় শক্তি।
যে জন দিবসে মনের হরষে জ্বালায় মোমের বাতি আশু গৃহে তার দেখিবে না আর নিশীথে প্রদীপ বাতি।
শিক্ষা: মনের ক্ষণস্থায়ী আনন্দের জন্য বিলাসিতা করে অর্থ-সম্পদ অপচয় করা উচিত নয়। অপচয় না করলে সাধারণত অভাবও হয় না। অপরের সাহায্য ছাড়াই দুর্দিনে দারিদ্র্যের মোকাবেলা করা যায়।
যে নদী হারায়ে স্রোত চলিতে না পারে, সহস্র শৈবালদাম বাঁধে আসি তারে। যে জাতি জীবন হারা অচল, অসাড় পদে পদে বাঁধে তারে জীর্ণ লোকাচার।
আমাদের পৃথিবী ও মানবসভ্যতা টিকে রয়েছে তার গতির জন্য। পৃথিবী অনবরত ঘুরছে সূর্যের চারদিকে। যদি পৃথিবী গতিশীল না হত, তাহলে পৃথিবীতে দিন-রাত্রি সংঘটিত হত না। এতে পৃথিবী থেকে প্রাণের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যেত। আবার গতি বা স্রোত রয়েছে বলেই নদী শুকিয়ে যায় না। নদীর গৌরব তার ছুটে চলার মধ্যেই নিহিত। স্রোতই বাঁচিয়ে রাখে নদীকে। নদী তার আপন বেগে চির-চঞ্চল। কিন্তু যদি কোনো কারণে তার স্রোত থেমে যায় তবে সে আপন গৌরব হারায়। তখন নদীর বুকে জন্মায় শৈবাল, নদী হারায় তার সহজাত বৈশিষ্ট্য। নদীর মতোই একটি জাতির গৌরব নির্ভর করে তার চলমানতার ওপর। যদি কোনো জাতি তার উদ্যম, প্রাণবন্ততা হারিয়ে ফেলে, সেই জতি তার অগ্রসরতার পথ থেকে বিচ্যুত হয়। কোনো দেশের নাগরিক যখন চিন্তা-চেতনা, মননশীলতা কর্মোদ্যম হারিয়ে ফেলে তখন তারা পদে পদে ব্যর্থ হয়। পরিবর্তনকে স্বাগত জানাতে না পারলে, সে জাতি স্থবির হয়ে পড়ে। উন্নতিও সে জাতির জন্য অধরা হয়ে যায়। জাতীয় জীবনে নিশ্চলতার সুযোগে নানা কুসংস্কার ও জরাজীর্ণ লোকাচার বাসা বাঁধে। আর নিশ্চল ও গতিহীন জাতি কুসংস্কার ও অন্ধ বিশ্বাসে আবদ্ধ হয়ে পড়ে। ক্রমে সে জাতি উন্নয়নের পথ থেকে দূরে সরে যায়। কিন্তু স্বাধীন চিন্তা এবং বুদ্ধিতে যে জাতি প্রতিনিয়তই পরিবর্তনশীল, সে জাতিকে কোনো বাধা-বিপত্তিই অচল করতে পারে না। প্রত্যেকটি উন্নত জাতির সফলতার পেছনে রয়েছে নতুন, পরিবর্তন ও আধুনিকতাকে গ্রহণ করার মানসিকতা ও উদ্যম। অপ্রয়োজনীয় পুরাতনকে ঝেড়ে ফেলে উদ্ভাবনী শক্তির দ্বারা সামনে এগিয়ে যাওয়ার মধ্যেই একটি জাতির সার্থকতা নির্ভর করে। স্বাধীন চিন্তা-চেতনা না থাকা, উন্নত ধ্যান-ধারণার অভাব, নতুনকে গ্রহণ না করা, যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে না পারার কারণে পৃথিবী থেকে অনেক সভ্যতাই হারিয়ে গেছে। বর্তমান আধুনিক বিশ্বে তথ্য-প্রযুক্তি একটি বিশাল উদ্ভাবন। এর সাথে যে জাতি তাল মিলিয়ে চলতে পারবে না, তারা নিশ্চল হবে, পিছিয়ে পড়বে সভ্যতার অগ্রযাত্রার থেকে।
শিক্ষা: গতি ও চলমানতা জাতিকে সচল রাখে, স্থিরতা জাতিকে থামিয়ে দেয়। চলমানতা ধরে রাখাই জাতির উন্নয়নে একমাত্র চাবিকাঠি। চলমানতা ও গতিই কোনো জাতিকে পৌঁছে দেয় চূড়ান্ত সফলতার দ্বারপ্রান্তে।
যে সহে, সে রহে।
জীবনে চলার পথ নিছক সরল-সোজা নয়। নানারকম বাধা-বিপত্তি, দুঃখ-শোক, হতাশা, গ্লানি, ভয়, দারিদ্র্য প্রভৃতি বিরুদ্ধ শক্তি এসে বারবার মানুষের পথ আগলে দাঁড়ায়। এসব প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করে মানুষকে এ পৃথিবীতে টিকে থাকতে হয়। আর পদে পদে এসব প্রতিবন্ধকতার সাথে লড়তে মানুষের মধ্যে সবার আগে যে মহৎ গুণটির থাকা প্রয়োজন সেটি হলো সহনশীলতা। পৃথিবীর ইতিহাসে যারা চির স্মরণীয় হয়ে আছে তাদের দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায়, তাদের জীবনের অন্যতম মূলমন্ত্র ছিল সহিষ্ণুতা তথা সহনশীলতা। যুগে যুগে মহামানবেরা তাদের অসীম ধৈর্য শক্তির গুণে সাধারণ মানুষদের কল্যাণের পথে টেনে এনেছেন। এ পথে চলতে গিয়ে তাদের বিভিন্ন সময় বিভিন্নরকম অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছে। কিন্তু কোনো অবস্থাতেই তারা অসহিষ্ণুতার পরিচয় দেননি। মুহাম্মদ (স.) কিংবা যিশু খ্রীষ্টের জীবন সহনশীলতার অসামান্য নিদর্শন। কেবল মহামানবদের জীবন নয় বরং সাধারণ মানুষের জীবনেও পদে পদে আছে নৈরাশ্যের বেদনা, পরাজয়ের গ্লানি, ব্যর্থতার ক্লান্তি, বিপদের আশঙ্কা। এসবের বিরুদ্ধে প্রতি মুহুর্তে সংগ্রাম করে মানুষকে এ বিশ্ব সংসারে তার অবস্থান তৈরি করে নিতে হয়। আর এই সংগ্রামের মূল পাথেয় বা শক্তি হচ্ছে ধৈর্য তথা সহনশীলতা। সহনশীল ব্যক্তি পরাজয়, ব্যর্থতা, হতাশা, ক্লান্তি, ভয় প্রভৃতির কাছে কখনোই মাথা নত করে না। উপরন্তু এসবের বিরুদ্ধে ধৈর্য সহকারে সংগ্রাম করে সফলতার পথে এগিয়ে যায়। কেননা সে জানে অধৈর্য হলে এই প্রতিকূল শক্তিগুলোর বিরুদ্ধে সফলতা অর্জন করা সম্ভব হবে না। একমাত্র সহনশীলতার গুণেই মানুষ কঠিন বাস্তবতার সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে সাফল্যের পথে অগ্রসর হতে সক্ষম হয়। সহনশীলতা বা ধৈর্যের গুণেই স্কটল্যান্ডের রাজা রবার্ট ব্রুস বারবার যুদ্ধে পরাজিত হয়েও মাকড়সার জাল বোনা দেখে যুদ্ধ জয়ের স্বপ্ন দেখেন এমনকি যুদ্ধে জয়লাভও করেন। তাই ব্যর্থতাকে ভয় পেলে চলবে না বরং সহিষ্ণুতাকে ধারণ করে আত্মপ্রত্যয় নিয়ে সম্মুখে এগিয়ে যেতে হবে।
শিক্ষা: জীবনের প্রতি ক্ষেত্রেই সহনশীলতা একান্ত প্রয়োজনীয়। জীবনের যেকোনো প্রতিকূল পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে ধৈর্য সহকারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ না করলে বড় ধরণের বিপদের আশঙ্কা থেকে যায়। অন্যদিকে ধৈর্য ও সহনশীলতার সঙ্গে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলে সাফল্য অনিবার্য।
যেখানে দেখিবে ছাই, উড়াইয়া দেখো তাই পাইলেও পাইতে পারো অমূল্য রতন।
জগতের কোনো বস্তুকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা উচিত নয়। কারণ অতি সাধারণ বস্তুর মধ্যেই অসাধারণ বস্তু লুকিয়ে থাকে। যেমন-কয়লা খনির মধ্যেই মহামূল্যবান হীরক পাওয়া যায়। দেখতে অসুন্দর ঝিনুকের মধ্যে মুক্তা পাওয়া যায়। আমরা মানুষের বাইরের অবস্থা ও অর্থ-সম্পদ দেখে মানুষকে মূল্যায়ন করি। ধনী-গরিবের পার্থক্য করি। প্রকৃত পক্ষে তা করা উচিত নয়। অতি সাধারণ থেকেও অনেকে বিশ্বের সেরা ধনী হয়েছেন। নিতান্তই সাধারণ ঘরে জন্মগ্রহণ করেও অনেকে বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ, পন্ডিত, রাষ্ট্রপ্রধান হয়েছেন। যে বাইরের সৌন্দর্য দেখে, সবকিছু বিচার করতে চায় সে মানুষের প্রকৃত মূল্য ও মর্যাদা বুঝতে পারে না। তুচ্ছ বস্তুর মধ্যেই অসাধারণ জিনিস পাওয়া যেতে পারে এটা তাদের ধারণাতেও থাকে না। অনেক মানুষের পোশাক-পরিচ্ছদ এবং বাহ্যিক অবয়ব দেখে সাধারণ মনে হলেও, তাদের মধ্যে লুকিয়ে থাকে অসাধারণ মানুষ। সমাজের অনেক মানুষকে আমরা তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করি, অথচ তারা আমাদের চেয়ে জ্ঞান গরীমায় অতুলনীয় এবং অনুসরণীয়। অনেক সাধারণ মানুষই অসাধারণ গুণাবলীর অধিকারী হয়ে থাকে। কিন্তু সেসব গুণাবলী সঠিক পরিচর্যার অভাবে পরিপূর্ণভাবে বিকশিত হয় না। এ ধরণের সুপ্ত প্রতিভা উপযুক্ত পরিচর্যা পেলে জ্বলে উঠতে পারে যেকোনো সময়। প্রত্যেক মানুষই কোনো না কোনো দিক থেকে মেধাবী হয়। তাই কাউকেই উপেক্ষা-অবহেলা করা উচিত নয়।
শিক্ষা: তুচ্ছ বলে কোনো বস্তুকে অবহেলা করা উচিত নয়। কারণ তুচ্ছ বস্তুতেও মহামূল্যবান রত্ন থাকতে পারে। মানব সমাজে গরিব-নীচ জাত বলে কাউকে তুচ্ছ করা ঠিক নয়। কারণ, তাদের মধ্য থেকেও মহামানবের আগমন ঘটতে পারে।
যেমন কর্ম তেমন ফল।
মানুষ হলো সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব। মানুষের মতো বিচক্ষণ, কর্মক্ষম ও ধৈর্যশীল জীব এই সৃষ্টি জগতে আর একটিও নেই। সুন্দরভাবে জীবন পরিচালনার সকল উপাদান পরিপূর্ণভাবে মানুষকে প্রদান করা হয়েছে। পরিশ্রম ও একনিষ্ঠ সাধনা ছাড়া মানুষ সফলতার স্বর্ণশিখরে আরোহন করতে পারে না। যারা অলস এবং বিশ্বাস করে যে ভাগ্যই তাদেরকে সবকিছু পাইয়ে দিবে তারা কাপুরুষ। জীবনে কখনোই তারা উন্নতি লাভ করতে পারে না। কর্মহীন অলসরাই কেবল স্বপ্নবিলাসী হয় এবং ভাগ্যের ওপর নির্ভর করে হাত গুটিয়ে বসে থাকে। পৃথিবীর সকল ক্ষেত্রে সফলতা অর্জনের পেছনে পরিশ্রম ও অধ্যবসায়ের ভূমিকা অনস্বীকার্য। কোনো শিক্ষার্থী যদি পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করতে চায় তাহলে তাকে অবশ্যই পড়াশুনার পেছনে অনেক সময় ব্যয় করতে হবে। আর যারা ভালো ফলাফল করতে চায় অথচ এর জন্য পরিশ্রম করে না, তাদের স্বপ্ন সফল হওয়া অসম্ভব। তেমনিভাবে কোনো ব্যবসায়ী তার ব্যবসাক্ষেত্রে লাভবান হতে চাইলে তাকে বসে থাকলে চলবে না। তার বিচক্ষণতা দ্বারা নতুন নতুন কৌশল প্রণয়ন করে ধৈর্যের সাথে ব্যবসার কাজ পরিচালনা করতে হবে। তবেই তার সফলতা অর্জন সম্ভব হবে। কিন্তু সে যদি ভাগ্যের ওপর নির্ভর করে অলসভাবে বসে থাকে তাহলে সে কখনই উন্নতি করতে পারবে না। সুতরাং প্রতিটি মানুষ তার নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে তার সফলতা বা ব্যর্থতার জন্য দায়ী। শ্রমবিমুখতা এবং অলসতা জীবনের জন্য অভিশাপস্বরূপ। পরিশ্রম ও অধ্যবসায় ছাড়া জীবন অচল হয়ে পড়ে। জীবনে সফলতা অর্জনের জন্য পরিশ্রমের কোনো বিকল্প নেই। নিজের ব্যর্থতা বা পরাজয়ের জন্য কোনো মানুষ অন্য কাউকে দোষারোপ করতে পারে না। অন্যদিকে নিজের সফলতা ব্যক্তি মানুষের নিজেরই।
শিক্ষা: পরিশ্রম দিয়েই জীবনে সফলতা অর্জন করা সম্ভব। যে যেমন পরিশ্রম করবে সে তেমন ফল ভোগ করবে। সুতরাং আমাদের আকাঙ্ক্ষা পরিশ্রম নির্ভর হওয়া উচিত। কম পরিশ্রম করে উচ্চ আকাঙ্ক্ষা করা উচিত নয়।
মৃত্যুই কেবল উৎকোচ গ্রহণ করে না।
পৃথিবীর যে বিষয়টির ব্যাপারে কারো কোনো সন্দেহ নেই তা হলো মৃত্যু। মৃত্যুর বিভিন্ন দিক সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা রয়েছে। তা সত্ত্বেও প্রযুক্তিগতভাবে অগ্রসর দেশসমূহের মধ্যে মৃত্যুর অনিবার্যতা অস্বীকার করার প্রবণতা রয়েছে। মৃত্যুকে অনিবার্য হিসাবে গ্রহণ করা প্রকৃতির কাছে মানুষের নতি স্বীকারের শামিল। তাই লক্ষ্য করা যায় বয়ঃবৃদ্ধির প্রক্রিয়া রহিতকরণের মাধ্যমে বা অন্য কোনো উপায়ে মৃত্যুকে জয় করার চেষ্টায় মানুষ তৎপর। তবে জীবনকে দীর্ঘমেয়াদী করার যাবতীয় প্রচেষ্টা সত্ত্বেও তাকে মানতেই হবে যে, মৃত্যুই সর্বক্ষেত্রে শেষ পর্যন্ত বিজয়ী হবে। পবিত্র কোরিআন শরীফে মহান আল্লাহ তাআলা বলেছেনÑ ‘প্রতিটি প্রাণীই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করবে (সূরা- মায়িদা-২৯)। মৃত্যুবরণ নিশ্চয়ই কোনো তুচ্ছ বিষয় না। যার জন্ম আছে তাকে অবশ্যই মৃত্যুবরণ করতে হবে। এই বাস্তবতাকে মেনে নিয়ে আমরা যদি তার মর্ম উপলব্ধি করি এবং মৃত্যু সম্পর্কে আলোচনা করি, তাহলে সার্থক জীবনযাপন করতে পারব। ইসলামধর্ম মতে মৃত্যুর মাধ্যমে পার্থিব জীবনের অবসান হলেও মানব অস্তিত্বের অবসান ঘটে না। হিন্দুধর্ম মতে মোক্ষ লাভের মাধ্যমে পবিত্র সত্ত্বার মর্যাদায় উপনীত না হওয়া পর্যন্ত বারবার পৃথিবীতে আগমন করে কর্মের মাধ্যমে আত্মার পরিশুদ্ধি লাভ করতে হবে। বৌদ্ধধর্ম মতে প্রতিটি প্রাণী পৃথিবীতে ফিরে আসে এবং কর্মের মাধ্যমে নির্বাণ লাভ করে। ইসলাম ধর্ম, ইহুদি ও খ্রিস্টানধর্মের সাথে একমত যে, মানুষের পুনর্জন্ম ও পুনর্মৃত্যু হবে না। প্রত্যেক ধর্মেই মৃত্যুর কথা বলা হয়েছে। মৃত্যুকে কোনো প্রকার তদবির কিংবা চেষ্টা দ্বারা ঠেকানো যাবে না। তাই কারো চিন্তা করার অবকাশ নেই যে কারো জীবনে মৃত্যু আসবে না।
শিক্ষা: মৃত্যুর স্বাদ সকলকেই নির্ধারিত সময়ে গ্রহণ করতে হবে। এটাকে উপেক্ষা করা কারো পক্ষেই সম্ভব নয়। তাই আমাদের প্রত্যেকের উচিত সর্বদা মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত থাকা।
মুকুট পরা শক্ত; কিন্তু মুকুট ত্যাগ করা কঠিন।
ক্ষমতার মুকুট পরার ইচ্ছা প্রত্যেক মানুষের মধ্যে আছে। কেউ প্রকাশ করে, কেউ করে না। এই ইচ্ছা পূরণ করার জন্য প্রয়োজন কঠোর পরিশ্রম ও সাধনার। এর পাশাপাশি দরকার মেধা ও মননের। এরপরই কেবল ক্ষমতার মুকুট নাগালে আসে। ক্ষমতার আসন লাভের পর ক্ষমতাশালী ব্যক্তি অনেক কিছুই করতে পারে। অনেক সুখ ভোগ করতে পারে। বিলাস বহুল জীবন যাপন করতে পারে। আলাদিনের চেরাগ পেলে একজন মানুষ যেমন অসীম ক্ষমতাধর হয়। তেমনই ক্ষমতার আসনধারী মানুষও ঠিক তেমনই। ফলে ক্ষমতার প্রতি মানুষের লোভ ও দুর্বলতা আসে এবং তা ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। তখন তারা ক্ষমতাপূর্ণ জীবন থেকে বাইরে আসার কথা কল্পনাও করতে পারে না। তখনই জাতির জীবনে বিপর্যয় নেমে আসে। ক্ষমতাবানরা ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার জন্য অন্যায়ের পথ অবলম্বন করতেও পিছপা হয় না। যেকোনো ধরণের নিকৃষ্ট কাজ করেও তারা ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করে। তখন ক্ষমতাবানরা দুর্নীতি, নিপীড়ন, নির্যাতন, জাতির সাথে প্রতারণা ইত্যাদি পথ অবলম্বন করে ক্ষমতার অপব্যবহার করে। ফলে ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের শত্রু-মিত্র দুই-ই সৃষ্টি হয়। আর ক্ষমতা ছাড়ার সাথে সাথে তারা ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারে। তাছাড়া সুখ ও বিলাসবহুল জীবন থেকেও তারা বঞ্চিত হয়। তাই তারা ক্ষমতার মোহে পড়ে মুকুট ত্যাগ করতে চায় না।
শিক্ষা: দেশ পরিচালকরাই মুকুটধারী। মুকুট পরার সাথে তাদের দায়িত্ব বেড়ে যায়। পাশাপাশি ক্ষমতা বা মুকুটের স্বাদ তারা গ্রহণ করতে করতে বিভোর হয়ে দেশ ও জাতীয় কল্যাণের কথা ভুলে যায়। ফলে ক্ষমতা ছেড়ে দেয়া তাদের জন্য অসম্ভব হয়ে পরে।
মেঘ দেখে কেউ করিসনে ভয়, আড়ালে তার সূর্য হাসে হারা শশীর হারা হাসি, অন্ধকারেই ফিরে আসে।
মেঘ সূর্যের সব আলো গ্রাস করে পৃথিবীকে অন্ধকার করে দেয়। অমাবস্যা ঢেকে দেয় চাঁদের আলো। আলো-অন্ধকারের এই খেলা সর্বত্র দৃশ্যমান হলেও তা চিরস্থায়ী নয়। মেঘ সূর্যকে ঢেকে দিলেও এক সময় মেঘ কেটে গিয়ে দেখা দেয় ঝলমলে আকাশ। তেমনি অমাবস্যার পরে আসে পূর্ণিমা। আমাদের জীবনের চলার সব রাস্তাও মসৃণ নয়। জীবনে দুঃখ-সুখ আসে পালাক্রমে। কোনো মানুষের জীবনেই সুখ-দুঃখ চিরস্থায়ী নয়। জীবনে যখন দুঃখ আসে তখন মানুষ মনে করে এ দুঃখ-যন্ত্রণার বুঝি শেষ নেই। দুঃখ আর হতাশায় আকণ্ঠ নিমজ্জিত মানুষের কাছে প্রতিটি দিনই অসহ্য মনে হয়। কিন্তু এক সময় এ দুঃখ-কষ্টের ঠিকই অবসান হয়। কাজেই দুঃখের সময় বিচলিত না হয়ে বরং তা সাহসের সাথে বরণ করে নিতে হয়। জীবনে সুখের পাশাপাশি কষ্ট আসবেই। তাই কষ্টের অমানিশা দেখে শঙ্কিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। ধৈর্য এবং সংগ্রামের মধ্য দিয়ে সকল দুঃখ কষ্টকে বরণ করে নিতে হয়। কারণ অন্ধকার রাতের পরেই আসে আলোকিত ভোর। মানুষের জীবনেও অনুরূপভাবে দুঃখের পরে সুখ আসবে। দুঃখ-কষ্ট, বিপদ-আপদ এসব সাময়িক ব্যাপার মাত্র। তাই দুঃখ-কষ্ট দেখে ভয় পাওয়া উচিত নয়। মানুষের জীবনে বিপদ আসবেই। কিন্তু বিপদের দিনে ভেঙে পড়লে চলবে না, মনে সাহস রেখে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। তেমনি মানুষের জীবনে সুখটাও ক্ষণস্থায়ী। তাই সুখের দিনেও মানুষের এটা ভাবা ঠিক নয় যে, এটাই জীবনের পূর্ণতা । সুখ-দুঃখকে পাশাপাশি রেখেই মানুষকে জীবনের পথে অগ্রসর হতে হবে।শিক্ষা: রাতের পরে যেমন দিন আসে, মেঘ সরে গেলে তেমন সূর্য হাসে। মানুষের জীবনেও দুঃখের সময় অতিক্রান্ত হয়ে সুখের সোনালি দিন আসে। তাই জীবনের দুঃসময়ে বিচলিত না হয়ে ধৈর্য ধরতে হবে।
মোদের গরব মোদের আশা আ-মরি বাংলা ভাষা।
প্রত্যেক দেশেরই একটি নিজস্ব ভাষা রয়েছে, যে ভাষায় সে দেশের মানুষ মনের ভাব প্রকাশ করে। তাই সম্পর্ক সৃষ্টির প্রধান মাধ্যম হলো ভাষা। জন্মের পর থেকে শিশু তার মায়ের মুখ থেকে আধো আধো করে যা বলতে শিখে তা হলো তার মায়ের ভাষা। বাংলা হলো আমাদের মায়ের ভাষা। আমাদের হাসি-কান্না, দুঃখ-বেদনা, ইচ্ছা-আকাক্সক্ষা সবকিছুর প্রকাশ ঘটে বাংলা ভাষার মাধ্যমে। বাংলা ভাষার রয়েছে গৌরবোজ্জল ইতিহাস যা অন্য কোন জাতি বা গোষ্ঠীর মধ্যে খুঁজে পাওয়া যায় না। পৃথিবীর ইতিহাসে এমন কোনো দেশ নেই যেখানে মানুষ ভাষার জন্য জীবন দিয়েছে। কিন্তু বাঙালি এক জাতি যারা ভাষার জন্যে আন্দোলন করে জীবন দিয়েছে। ১৯৫২ সালে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা করে এদেশের মানুষকে তা মেনে নিতে বাধ্য করেছিল। কিন্তু বাংলার ছাত্রসমাজ তথা আপামর জনতা তা মেনে নেয়নি। ফলে ১৯৫২ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারিতে তার প্রতিবাদে মিছিল করতে গিয়ে সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার, শফিউরসহ নাম না জানা অনেকেই প্রাণ দিয়েছে ভাষার জন্য। ফলে আন্দোলন তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে ওঠে। অবশেষে পাকিস্তানের সংবিধানে ১৯৬৫ সালে ২১৪ নং অনুচ্ছেদে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেওয়া হয়। পরবর্তীতে ইউনেস্কো বাঙালিদের আত্মত্যাগের স্বীকৃতি স্বরূপ ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর, ২১ শে ফেব্রুয়ারীকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবে স্বীকৃতি প্রদান করে। অতএব আন্দোলন সংগ্রামের ফলে বাংলা ভাষা স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে আমাদের জাতীয় চেতনায়। তাই বাংলা ভাষা আমাদের আশা অকাঙ্ক্ষা ও গর্বের বিষয়।
শিক্ষা: বাংলা ভাষা আজ বিশ্বময় সমাদৃত। এ অর্জন বাংলাদেশের ক্ষুদ্র মানচিত্রকে উজ্জ্বল করেছে। তাই ভাষার চেতনাকে জাগ্রত রেখে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে।
যত মত, তত পথ।
একই স্রষ্টার সৃষ্টি মানুষ। কিন্তু সেই মানুষের মধ্যে অনেক পার্থক্য বিদ্যমান। তাদের মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি দেখা যায়। একই সময়ে জন্ম নেয়া দু’টি জমজ শিশুর মধ্যেও দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য বিদ্যমান। পার্থক্য দেখা যায়, তাদের পছন্দ-অপছন্দের, মতামতের। ধর্ম, পরিবেশ, সামাজিক অবস্থা ইত্যাদি মানুষে মানুষে পার্থক্য সৃষ্টি করে। এক ধর্মের অনুসারীদের রীতিনীতি, জীবনাচার ইত্যাদি অন্য ধর্মের অনুসারীদের চেয়ে ভিন্ন হয়। কারণ তাদের ধর্মীয় বিশ্বাসের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। আবার উচ্চবিত্ত এবং নিম্নবিত্ত শ্রেণির মানুষের মধ্যেও দৃষ্টিভঙ্গি এবং মতামতের সুবিশাল পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। উচ্চবিত্ত শ্রেণিতে জন্ম নেয়া একটি শিশু যেভাবে গড়ে উঠে, নিম্নবিত্ত শ্রেণিতে জন্ম নেয়া শিশু সেভাবে গড়ে উঠে না। উচ্চবিত্ত শ্রেণিতে শিশুটি যেমন সুযোগ-সুবিধা পায়, নিম্নবিত্ত শ্রেণিতে জন্ম নেয়া শিশুটি তেমন সুযোগ-সুবিধা পায় না। তাই তাদের জীবনধারার মধ্যে বিস্তর অমিল দেখা যায়। সব মানুষ যখন তাদের নিজ নিজ বিশ্বাস এবং জীবনধারা সুষ্ঠুভাবে মেনে চলে তখন সমাজে শান্তির সুবাতাস বয়ে চলে। সমাজে তখন কোনো অশান্তি দেখা যায় না। কিন্তু এর ব্যতিক্রম ঘটলেই সমাজে নেমে আসে অশান্তি। এক ধর্ম ও বর্ণের মানুষের সাথে অন্য ধর্ম ও বর্ণের মানুষের মধ্যে শুরু হয় দ্বন্দ্ব ও রেষারেষি, যা সমাজের সুন্দর পরিবেশকে এক মুহূর্তেই নষ্ট করে দেয়। একজনের নিজস্ব মতামত যখন অন্যের ওপর চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হয়, তখনই সমাজে বিভিন্ন সমস্যা দেখা দেয়। ফলে নষ্ট হয় সম্প্রীতির বন্ধন। মানুষের নিজের মতকে অপরের ওপর চাপিয়ে দেয়ার হীন মনোবৃত্তি তাকে করে তোলে অহংকারী এবং উগ্র। পৃথিবীতে সমস্যা যেমন রয়েছে তেমনি রয়েছে সমস্যার সমাধান। মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি যতো ভিন্নই হোক না কেন প্রত্যেকেই নিজস্ব পথ অবলম্বন করে লক্ষ্যে পৌছায়। তাই বলা যায় পরিবর্তিত দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে সঙ্গে সমাধানের পথও ভিন্নতর হয়।
শিক্ষা: পৃথিবীতে প্রতিটি সমস্যার রয়েছে সমাধান। দৃষ্টিভঙ্গি যতো ভিন্ন হবে তার প্রয়োগ পদ্ধতিও ততো ভিন্নতর হবে। তাই সমাজের শান্তি এবং সম্প্রীতি রক্ষার জন্য সকলের মতামতকে গুরুত্ব দেয়া, সমাজের প্রতিটি মানুষের নৈতিক দায়িত্ব ও কর্তব্য।
যত বড় হোক ইন্দ্রধনু সে সুদূর আকাশে আঁকা আমি ভালবাসি মোর ধরণীর প্রজাপতিটির পাখা।
মানুষ রূপ বৈচিত্র্যে ভরা মাটির পৃথিবীর সন্তান। প্রকৃতির নদী-নালা, লতা-পাতা, ফুল-ফল, পাখি এসব নিয়েই তার পরিবেশ। এখানেই তার অভ্যস্ত জীবনযাত্রা অব্যাহত গতিতে এগিয়ে চলছে। কিন্তু মানুষ স্বপ্ন বিলাসীও। অধরার সৌন্দর্যকে নিয়ে তার কল্পনা-বিলাসের অন্ত নেই। দূরের আকাশে সাতরঙের বিচিত্র ছটায় ইন্দ্রধনু দেখা যায়। তার সৌন্দর্য মানুষের স্বপ্নচারী মনকে হাতছানি দেয়। কিন্তু যা ধরা- ছোঁয়ার বাইরে তা যত বড় বা যত সুন্দরই হোক না তা মানুষের স্পর্শের বাইরে। তার চেয়ে আকর্ষণীয় প্রতিদিনের এই চিরপরিচিত ধূলিমাখা পৃথিবী। কারণ অনেক দূরের বস্তু যতই মনোমুগ্ধকর হোক না কেন, বাস্তবজীবনের সাথে তার কোনো যোগ নেই। তাকে কখনোই আপন করে পাওয়া যায় না। অন্যদিকে, ছোট প্রজাপতি তার বিচিত্র রঙের পাখা নিযে মানুষের চার পাশে উড়ে বেড়ায়। মানুষ সহজেই খুব কাছ থেকে তার সৌন্দর্য উপভোগ করে। মনে হয় অপরূপ সৌন্দর্যের আধার এই প্রজাপতি। তাই মানুষ দূরের রংধনুর সৌন্দর্যের চেয়ে প্রজাপতির সৌন্দর্যে বেশি মুগ্ধ হয়, ভালোবাসে সে তার গৃহের নিকটে ফুটে থাকা নানান বর্ণের ফুল, ভোরের শিশির বিন্দু আর পাখির কলকাকলি। এ যেন প্রকৃতি-জননীর নিজের হাতে সাজিয়ে রাখা অন্তহীন সৌন্দর্য। প্রকৃত সৌন্দর্য প্রেমিকরা অলীক সৌন্দর্যের মিথ্যা মায়ায় ডুবে থাকে না। বরং ভালোবাসে চারপাশের বিশ্ব প্রকৃতির সৌন্দর্যকে। আর তারাই তো সৌন্দর্যের সত্যিকার সাধক।শিক্ষা: অধরা কিছু পাওয়ার দুরাশা না করে হাতের কাছে যা আছে তা নিয়েই খুশি থাকা উত্তম। কারণ বাস্তব আর কল্পনার মাঝে রয়েছে বিশাল ব্যবধান। তাই প্রতিটি মানুষেরই উচিত আকাশ কুসুম কল্পনা না করে, সাধ ও সাধ্যের মধ্যে সংগতি বজায় রেখে পথ চলা।
যতক্ষন শ্বাস, ততক্ষন আঁশ।
মানুষের চলার পথ মসৃণ নয়। প্রতিটি পদক্ষেপ নানা বাধা-বিপত্তিতে ভরা। চাওয়ার সাথে পাওয়ার মধ্যে বিস্তর ফারাক। প্রতিনিয়ত প্রতিকূল পরিবেশের সাথে যুদ্ধ করতে হয়। তবুও মানুষ স্বপ্ন দেখে আশায় বুক বাঁধে। অসংখ্য তরঙ্গ যেমন সাগরকে বিক্ষুদ্ধ করে, তেমনি দুঃখ-কষ্ট সংসার জীবনে মানুষকে করে তোলে হতাশ বিপর্যস্ত। ভেলা ভাসিয়ে মানুষ যেমন উত্তাল সমুদ্র পাড়ি দেয় তেমনি আশার তরীতে ভেসে মানুষ সংসারের সাগরকে অতিক্রম করে। উত্তাল সাগরে মানুষের অবলম্বন হয় ভেলা আর সংসারে মানুষের অবলম্বন হয় আশা বা স্বপ্ন। সমস্যা এবং দুঃখ স্থায়ী নয়। আজকের দিনের সমস্যা এবং দুঃখ একদিন না একদিন শেষ হবে। অন্ধকার কালো রাতের পর নতুন ভোর আসবে। দুঃখের দিনের একদিন অবসান ঘটবে, এই আশাতেই মানুষ সকল দুঃখ কষ্টকে অতিক্রম করে। আশা না থাকলে কোনো মানুষ বাচঁতে পারতো না এক মুহুর্তের জন্যেও। যেদিন মানুষ স্বপ্ন দেখা ভুলে যাবে, সেদিনই তার কাছে বেঁচে থাকা মূলহীন হয়ে পড়বে। এই জগতের কোনো কিছুই আর তাকে আকর্ষণ করবে না। আশা বা স্বপ্ন মানুষকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়। সাফল্যের পথে প্রেরণা যোগায় প্রতিটি ক্ষণে। ভবিষ্যতের আশা বা স্বপ্ন প্রেরণা যোগায় বলেই, বর্তমানকে আমরা মেনে নিতে পারি।
শিক্ষা: আশা বা স্বপ্ন আছে বলেই, নতুন নতুন উদ্ভাবন এবং মানুষের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে পৃথিবী আজকের অবস্থানে দাঁড়িয়ে আছে। নতুন ভোর আসবে এই বিশ্বাস আছে বলেই, মানুষ অত্যন্ত সহজভাবে জীবনকে গ্রহণ করেছে এবং এগিয়ে যাচ্ছে একেকটি নতুন স্বপ্নের দিকে।
যারে তুমি নিচে ফেল, সে তোমারে বাঁধিছে যে নিচে, পশ্চাতে রেখেছ যারে, সে তোমারে পশ্চাতে টানিছে।
মানুষ সামাজিক জীব। পারস্পরিক সাহায্য সহযোগিতার মাধ্যমে সবাই শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করবে এটাই কাম্য। কিন্তু আমাদের সমাজের দিকে তাকালে দেখা যায় ভিন্নরকম চিত্র। সমাজ নানা শ্রেণীতে বিভক্ত। ধন-সম্পদ, মান-মর্যাদা, ধর্ম-বর্ণ প্রভৃতিকে মাপকাঠি হিসেবে ব্যবহার করে মানুষের মধ্যে নানা স্তরের আবির্ভাব হয়েছে। সমাজের উচ্চ স্তরে যারা অবস্থান করছে তারা সবসময় অপেক্ষাকৃত নিচু স্তরের মানুষের উপর নির্যাতন চলায়, তাদেরকে নিচু স্তরেই বেঁধে রাখতে চায়, উপরে উঠতে দেয় না। এ নির্যাতন ও শোষণের ফলে নিম্নশ্রেণির মানুষেরা তাদের নিজেদের উন্নতি ঘটাতে পারে না। এতে শুধু বিশেষ কোনো শ্রেণি ক্ষতিগ্রস্ত হয় তা নয়। প্রকৃতপক্ষে গোটা দেশ ও জাতির উন্নতিই ব্যাহত হয়। কেননা একটি দেশ ও জাতির উন্নতির জন্য দরকার সর্বস্তরের মানুষের সুষম উন্নয়ন। এদিকে পিছনে পড়া শ্রেণিও চুপ করে থাকে না। ক্রমাগত অবহেলার শিকার হতে হতে এক সময় তাদের মনে সচেতনতা আসে। তাদের প্রতিবাদী সত্ত্বার স্ফূরণ ঘটতে থাকে। একসময় তারা বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। যারা তাদের পশ্চাদপদতার জন্য দায়ী তাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। যারা তাদের নিচে আটকে রাখে তাদের পেছন থেকে টানতে থাকে। ফলে সমাজে পরস্পরকে পেছনে ফেলার একটি অনাকাঙ্ক্ষিত প্রতিযোগিতা সবসময়ই চলতে থাকে। এ প্রতিযোগিতা কখনই কাম্য নয়। ইতিহাসে দেখা যায় পারস্পরিক অসহযোগিতার কারণে অনেক দেশ ও জাতি ধ্বংস হয়ে গেছে।
শিক্ষা: সর্বদা একে অন্যের ক্ষতি করার চেষ্টা করলে শেষ পর্যন্ত কারও পক্ষেই উন্নতি করা সম্ভব হবে না। তাই সবার মধ্যে সাহায্য-সহযোগিতার মনোভাব গড়ে তোলা উচিত।
যার যোগ্যতা যত অল্প, তার আড়ম্ভর তত বেশি ।
জ্ঞানার্জনের কোনো বাঁধা-ধরা সীমা নেই। আধুনিক পৃথিবীর সাথে তালমিলিয়ে চলতে গিয়ে, মানুষ প্রতিনিয়ত জ্ঞানার্জনের মাধ্যমে নিজেকে আরো বেশি যোগ্যতাসম্পন্ন করে তোলার চেষ্টা করছে। আধুনিক পৃথিবীর যোগ্যতম মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার এই প্রচেষ্টায় কেবলমাত্র ব্যক্তি নিজেই নয় বরং সমাজ, দেশ ও জাতি সমানভাবে উপকৃত হয়। কিন্তু তাই বলে মহৎ ব্যক্তিরা কখনোই নিজের যোগ্যতাকে বড় করে প্রচার করার প্রয়োজন মনে করে না। তারা নিজেকে নিয়ে কোনরকম গর্ব বা অহংকারও করে না। অন্যদিকে কিছু মানুষ আছে যাদের যোগ্যতা অতি সামান্য কিন্তু তারা অন্যের সামনে নিজের যোগ্যতাকে বড় করে দেখানোর চেষ্টা করে। এ ধরণের মানুষ দেশ ও জাতির জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। এরা নিজেদের অযোগ্যতাকে গোপন রাখতে মিথ্যার পর মিথ্যা বলে যায়। মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে তারা নিজেদের যোগ্য বলে প্রচার করেই ক্ষান্ত হয় না বরং সমাজের উঁচু পদে আসীন হতেও দ্বিধা করে না। এ ধরণের মানুষেরা একজন হাতুড়ে ডাক্তার হয়েও নিজেকে অভিজ্ঞ বলে দাবি করে; যার ফলে অসংখ্য রোগীর জীবন বিপন্ন হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এ সকল নিকৃষ্ট, হীনচিত্তের মানুষেরা সমাজের কাছ থেকে নাম কিনতে ব্যস্ত থাকে। কিন্তু তার এই মিথ্যা আত্মপ্রচার যে সমাজের ক্ষতিসাধন করছে সেটি সে ভেবে দেখে না। তবে আশার কথা এই যে, এসব মানুষ তাদের মিথ্যা যোগ্যতার অহংকার নিয়ে বেশিদিন টিকে থাকতে পারে না। ভিত্তিহীন প্রচারের মাধ্যমে স্বল্প সময়ের জন্য তারা সমাজের মধ্যমণি হয়ে উঠলেও, খুব শিগগিরই তাদের মিথ্যার প্রাসাদ ভেঙে পড়ে। মূলত নিজের অযোগ্যতা ধরা পড়ে যাবার ভয়েই তারা ক্রমাগত আত্মপ্রচারে ব্যস্ত থাকে। যে প্রকৃতই অযোগ্য সে সব সময় আতঙ্কে থাকে কোথায় তার অযোগ্যতা ধরা পড়ে যায়। আর এই ভয়ের কারণেই সে সারাক্ষণ লোকের কাছে নিজেকে জাহির করে বেড়ায়। বস্তুত যারা অলস, অধ্যাবসায় ও শ্রম বিমুখ, নিকৃষ্ট ও হীন চিন্তার অধিকারী তারাই আত্মপ্রচারে সচেষ্ট থাকে। আর এসব আত্মপ্রচারসর্বস্ব ব্যক্তি নিজের অযোগ্যতাকে ধামাচাপা দিতে লোকের কাছে নিজেকে গুণী ও মহৎ ব্যক্তিরূপে প্রচার করে বেড়ায়।
শিক্ষা: নিজের অযোগ্যতাকে ঢেকে রেখে মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে সেসব ব্যক্তি নিজেকে যোগ্য বলে প্রচার করে সেসব ব্যক্তিরা সমাজের জন্য সব সময়ই অকল্যাণ বয়ে আনে। এ ধরণের মানুষকে চিহ্নিত করা প্রয়োজন এবং মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে দখল করা উঁচু পদগুলো থেকে তাদেরকে অপসারণ করে প্রকৃত যোগ্য ব্যক্তির হাতে দায়িত্ব তুলে দেয়া আমাদের কর্তব্য।
যাহা চাই তাহা ভুল করে চাই, যাহা পাই তাহা চাই না।
মানব-জীবনে চাওয়া-পাওয়ার অন্ত নেই। তেমনি নেই কোনো সামঞ্জস্য। পার্থিব এই জগতে মানুষের চাওয়া-পাওয়া অসীম। তাই মানুষের চাহিদা বা আশা-আকাঙ্ক্ষার সমাপ্তি ঘটে না। একটি চাহিদা পূরণ হওয়ার সাথে সাথেই অন্য আরো নতুন চাহিদার সৃষ্টি হয়। এটি মানুষের চিরন্তন বৈশিষ্ট্য। সভ্যতার সূচনালগ্ন খেকেই মানুষের মধ্যে এই বৈশিষ্টটি বিদ্যমান। তাই জীবনে চাওয়া আছে, পাওয়া আছে; কিন্তু এই চাওয়া-পাওয়া অসীম। সে যে কী চায়, মাঝে মাঝে সে নিজেও জানে না। তাই মানুষ কাম্য বস্তুর প্রাপ্তি দ্বারা কখনো আত্মতৃপ্তি লাভ করতে পারে না। কারণ একবার মানুষ যা চায় তা পেয়ে গেলে নতুন করে আরো কিছু পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা জাগে। জীবনের এই অফুরন্ত চাওয়ার পরে সে না পাওয়ার হতাশায় ভোগে। কেননা এই অসীম চাওয়াকে পূরণ করা একেবারে অকল্পনীয়। তাই চাওয়া পাওয়ার এই জগতে মানুষ যা চায় তা পাওয়ার পর তার কাছে মনে হয় ভুল করে চেয়েছিল। তাই মানুষের কাছে এই অসীম চাওয়া-পাওয়া ভুল মনে হলেও আসলে তা ভুল নয়। এটাই বাস্তব আর এটাই মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। তাই এ ক্ষেত্রে ক্যালভিন ওরেন এর উক্তিটি যথার্থ সার্থকতা লাভ করে- “মানবজীবন চিরদিনই সুখ-শান্তিতে কাটে না। আকাশের দিকে হাত বাড়ালে শূন্যতা ছাড়া আর কিছুই পাওয়া যায় না। চাওয়া-পাওয়ার গন্ডি তাই মাটির কাছাকাছি হওয়া ভালো।” তাই মানুষ যদি সীমিত চাওয়া-পাওয়ার অভ্যস্ত হয় তাহলে সহজেই না পাওয়ার দুঃখগুলো দূর করা সম্ভব। এতে অপ্রাপ্তির বেদনা যেমন দূর হবে, পাওয়ার আনন্দগুলো আরো বেশি বিকশিত হবে।
শিক্ষা: চাওয়া-পাওয়ার চিরন্তন দ্বন্দ্বের মধ্যে মানব হৃদয়ের বসবাস। এই পাওয়া না পাওয়ার অর্ন্তদ্বন্দ্বই মানুষকে ভুল পথে নিয়ে গেলেও বিবর্তনশীল দ্বন্দ্বের অবসানে বিকশিত হয় মানুষের জীবন। অর্থ্যাৎ মানুষের চাওয়া-পাওয়া সীমিত হওয়াই শ্রেয়।
সততাই সর্বোৎকৃষ্ট পন্থা।
মানবজীবন চিরস্থায়ী নয়। মানুষ একটি নির্দিষ্ট সময়ের পর পৃথিবী থেকে বিদায় নেয়। কিন্তু সে যদি সৎ, নিষ্ঠাবান ও আদর্শবান হয় তাহলে মৃত্যুর পরও পৃথিবীতে অমর হয়ে থাকে। পৃথিবীতে একমাত্র সততার মাধ্যমেই সকলের ভালোবাসা অর্জন করা সম্ভব। মানবজীবনে ভাল-মন্দ এবং সৎ-অসৎ পাশাপাশি অবস্থান করে। সমাজে যেমন সত্যবাদী লোক রয়েছে তেমনি আবার মিথ্যাবাদী লোকও রয়েছে। সত্যবাদী লোকেরা জীবনে স্থায়ী সাফল্য লাভ করে। আর মিথ্যাবাদী লোকেরা যদিও মিথ্যার মাধ্যমে অনেক কিছু অর্জন করে কিন্তু তা বেশি দিন স্থায়ী হয় না। যে সত্য কথা বলে সে সকলের ভালোবাসা পায়। সমাজের মানুষ তাকে বিশ্বাস করে। এভাবে ধীরে ধীরে সে সমাজে শ্রদ্ধার পাত্র হয়ে উঠে। সত্যবাদী ব্যক্তিরাই পারে সমাজের প্রকৃত শান্তি ফিরিয়ে আনতে। আবার যে সব লোক মিথ্যাবাদী তাদের কাজই হলো মিথ্যা কথা বলে বেড়ানো। কিভাবে অন্যের ক্ষতি করা যায়, তারা সব সময় এই চিন্তায় ব্যস্ত থাকে। সমাজের মানুষের প্রতি তাদের কোনো ভালোবাসা থাকে না। সত্যবাদীরা পৃথিবীতে যুগ যুগ ধরে অমর হয়ে থাকে। হযরত মুহাম্মদ (স.) সৎ সাহস এবং সততার মাধ্যমে একটি বর্বর জাতিকে সভ্য করে গড়ে তুলেছিলেন। আর সেই আরববাসীরাই হযরত মুহাম্মদ (স.)-কে ‘আল আমীন’ উপাধি দিয়েছিল। পৃথিবীর যে জাতি যত বেশি সৎ, সে জাতি তত বেশি উন্নত। সততা ও ন্যায়-নিষ্ঠা একটি দেশের উন্নয়নের পিছনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। তাই আমাদের দেশ ও জাতীর অগ্রগতির স্বার্থে সততার বিষয়টি জড়িত। আর এজন্য প্রতিটি মানুষকেই তার ব্যবসা-বাণিজ্য, চাকরি, রাজনীতি, অর্থনীতি প্রভৃতি ক্ষেত্রে সততার সাথে দায়িত্ব পালন করা উচিত। তাহলে দেশ শান্তি ও উন্নয়নের পথে এগিয়ে যাবে।
শিক্ষা: সততাই পারে একজন মানুষকে প্রকৃত মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে। আর পরিবারই পারে তাদের সন্তানদের সৎ পথে পরিচালিত করতে। মানুষের জন্য অনুকরণীয় সর্বোৎকৃষ্ট পন্থা হলো সততা।
সত্য মূল্য না দিয়েই সাহিত্যের খ্যাতি করা চুরি ভালো নয় ভালো নয়, নকল সে সৌখিন মজদুরী।
সত্যের মর্যাদা সবচেয়ে উঁচুতে, সত্যের পথে অর্জিত সাফল্য চিরন্তন। কিন্তু মিথ্যার আশ্রয়ে কিছু অর্জন করলে তা স্থায়ী হয় না। অর্জিত বস্তু তার মাহাত্ম্য হারিয়ে ফেলে। সত্যচর্চার গুরুত্ব মানবজীবনে যেমন অপরিহার্য সাহিত্যের ক্ষেত্রেও তেমনি। সাহিত্যে সত্যের প্রতিফলন পূর্ণ মাত্রায় ঘটলে সে সাহিত্যকর্ম মহৎ হয়ে ওঠে। সত্যাশ্রিত সাহিত্য কর্মের আবেদন কখনও শেষ হয় না। যুগে যুগে তা মানুষকে সত্য পথ অনুসরণের প্রেরণা দেয়। এর মাধ্যমে একজন লেখক হয়ে উঠেন মহীয়ান। কিন্তু অনেক সময় লোভ লালসার বশবর্তী হয়ে লেখক প্রকৃত সত্যকে চাপা দিয়ে কিংবা সত্যকে বিকৃত করে সাহিত্য রচনা করেন। এটি একটি গর্হিত অপরাধ। মিথ্যার আশ্রয়ে সাহিত্য রচনা করলে সে সাহিত্যের মাহাত্ম্য নষ্ট হয়। আর সে লেখকও তাঁর মর্যাদা হারায়। সত্য যতই কঠিন হোক না কেন সত্যের মুখোমুখি দাঁড়ানোর সৎ সাহস প্রত্যেক লেখকের থাকা উচিত। ভয় কিংবা লোভের বশবর্তী হয়ে কারো বিরুদ্ধে মিথ্যা সমালোচনা বা কারো মিথ্যা প্রশংসা করা উচিত না। আবার অনেক লেখক আছেন যারা পূর্ববর্তী কোনো লেখককে অনুকরণ করে সাহিত্য রচনা করেন। এটাও একটি নীতি-নৈতিকতা বিরোধী অপরাধ। অন্যের অনুকরণে নয়, আপন সৃজনশীলতার মাধ্যমেই একজন লেখকের লেখক সত্ত্বার বিকাশ সম্ভব। অন্যের অনুকরণে রচিত সাহিত্য কর্ম গ্রহণযোগ্যতা পায় না। লেখকের পরিশ্রমটুকুই কেবল বৃথা হয়। পূর্বসূরিদের পদানুসরণ করে নিজের মেধার প্রতিফলন ঘটানোর মাধ্যমে একজন লোক বড় হয়ে ওঠতে পারে।
শিক্ষা: মিথ্যার আবরণে তৈরি সাহিত্য কর্ম কিংবা অন্যের অনুকরণে রচিত সাহিত্য কর্ম শিল্প সাফল্য মন্ডিত হতে পারে না। তাই লেখকের উচিত সত্যের পথ অবলম্বন করে নিজের সৃজনশীলতার বিকাশ ঘটানোর চেষ্টা করা।
সব সাধকের বড় সাধক আমার দেশের চাষা দেশ মাতারই মুক্তিকামী দেশের সে যে আশা।
বাংলাদেশের জাতীয় অর্থনীতির অনেকটাই নির্ভর করে কৃষিখাতের উপর। প্রতিবছর জাতীয় আয়ের একটি বড় অংশ আসে কৃষি ও কৃষিজাত দ্রব্য থেকে। আর এই কৃষিনির্ভর বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি এ দেশের কৃষকেরা। তাদের অনেক সাধনার ফল মাঠভরা ফসলের হাসি। রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে, মাথার ঘাম পায়ে ফেলে, কঠিন ও শুষ্ক মাটির বুকে তারা ফসল ফলায়। তাদের ঘাম ঝরানো ফসলই দেশের অর্থনীতির চাকাকে সচল রাখে। তারা নিজেদের সুখ-শান্তি, আরাম আয়েস বিসর্জন দিয়ে নিঃস্বার্থভাবে দেশের সকল মানুষের খাদ্যের যোগান দেয়। অক্লান্ত পরিশ্রমের মাধ্যমে তারা জাতীয় অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করে তুলছে। কিন্তু বিনিময়ে তারা নিজেদের জীবনের আরাম-আয়েসের নিশ্চয়তা পায়না। বছরের পর বছর তারা অভাবের সঙ্গে লড়াই করে টিকে থাকে। অনাহারে অর্ধাহারে বিনা চিকিৎসায় অশিক্ষায় তারা মানবেতর জীবনযাপন করে। দেশের উন্নয়নের অন্যতম দাবিদার এ কৃষকেরাই সব থেকে বেশি ভাগ্যহীন, দরিদ্র ও অসহায়। কিন্তু এই অভাব নিয়ে তাদের মনে কোনো ক্ষোভ নেই। বরং দেশের মানুষের জন্য খাদ্যের যোগান দিতে পেরেই তারা সন্তুষ্ট। এমন নিঃস্বার্থ, নির্লোভ, নিরহংকারী সাধক আর নেই। যুগে যুগে অনেকেই সাধনা করেছেন। এদের মধ্যে কেউ স্রষ্টাকে পাওয়ার জন্য, কেউ নিজেকে জানার জন্য, কেউবা নির্বান লাভের জন্য। তবে যারা সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত, রোদ-বৃষ্টি-ঝড় উপেক্ষা করে দেশের মানুষের খাদ্যের যোগান দিচ্ছে সেই সব কৃষকদের মতো বড় সাধক আর নেই। মানবকল্যাণে তারা নিজেদের জীবনের সুখ-শান্তি, আরামআয়েশে, ভোগবিলাস সমস্ত কিছু বিসর্জন দিয়েছে। দেশ ও দেশের মানুষের কল্যাণে তারা নিজেদের পুরো জীবন ব্যয় করে। তাদের এই নিঃস্বার্থ সাধনা দেশের অর্থনীতিকে উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির পথে নিয়ে যায়। আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম এই কৃষকের জয়গান করে বলেছেন- ‘গাহি তাহাদের গান, ধরনীর হাতে দিল যারা আনি ফসলের ফরমান।’শিক্ষা: কৃষকেরা বাংলাদেশের অর্থনীতির মেরুদ-। কিন্তু তবু যুগ যুগ ধরে এরাই হচ্ছে অবহেলিত, অনাদৃত, নিপীড়িত, অত্যাচারিত, দেশের অর্থনীতিকে আরো বেশি সমৃদ্ধ করতে হলে কৃষকদের যথাযথ মর্যাদা দিতে হবে।
সবলের পরিচয় আত্মপ্রসারে, আর দুর্বলের স্বস্তি আত্মগোপনে।
দৃঢ়চিত্তের অধিকারী ব্যক্তিরা নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার ক্ষেত্রে সফল হন। আত্মবিকাশ বা আত্মপ্রকাশের মাধ্যমে তিনি নিজেদেরকে সবার সামনে তুলে ধরেন। সবলেরা শুধু নিজেকে নিয়ে ভাবেন না। সততা, জ্ঞান, মেধা, দায়িত্ববোধ, ইত্যাদি সকলের মধ্যে তারা ছড়িয়ে দিতে চান। অন্যের জন্য নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে, জীবনের প্রকৃত সার্থকতা খুজে নিতে চান তারা। যুগে যুগে যারা বিখ্যাত হয়েছেন, তারা সকলেই তাদের জ্ঞান, উপলদ্ধি, দর্শন, অভিজ্ঞতা ইত্যাদির মাধ্যমে মানুষকে দিয়েছে মুক্তির স্বাদ। সমাজ এবং মানুষের কাছে তারা মহাপুরুষ হিসেবে পরিচিত লাভ করেছেন। কর্মের মাধ্যমে মানুষ নিজের যোগ্যতা এবং দক্ষতা প্রমাণ করে আত্মপ্রসার ঘটায়। আত্মবিশ্বাস এবং আত্মশক্তি মানুষকে তার অভিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছে দেয়। অপরপক্ষে দুর্বল মানুষেরা নিজেদেরকে সব সময় আড়াল করে রাখতে চায়। জীবনযুদ্ধে নামতে ভয় পায়। তারা বারবার পরাজিত হয় এবং অকালে ঝরে পড়ে। দুর্বল চিত্ত্বের অধিকারী মানুষ সমাজ এবং দেশের বোঝা স্বরূপ। এরা অলস এবং অকর্মণ্য জীবনযাপনের মাধ্যমে নিজেদের ধ্বংস ডেকে আনে। ইংরেজ নাট্যকার উইলিয়াম শেক্সপিয়র বলেন- “কাপুরুষেরা মরার আগে বহুবার মরে।” দুর্বল চিত্তের লোকেরা ভাবে যে, তাদেরকে দিয়ে সফলতা অর্জন সম্ভব নয়। ফলে তারা আত্মগোপন করে থাকতে স্বস্তিবোধ করে।
শিক্ষা: অলসতা থেকে এক সময় হতাশা ও ব্যর্থতার সৃষ্টি হয়। তাই অলসতা পরিহার করতে হবে এবং কাজের মধ্য দিয়ে নিজেকে যোগ্য ও দক্ষ গড়ে তুলতে হবে। পরিশ্রমের মাধ্যমে আত্মপ্রসার ঘটিয়ে মানব জীবনের সকল ব্যর্থতাকে জয় করতে হবে ।
সবুরে মেওয়া ফলে।
সবুর শব্দের শাব্দিক অর্থ হলো অপেক্ষা বা ধৈর্য। ধৈর্য বলতে মানুষের সহনশীলতাকেই বুঝায়। সহনশীল মানুষ জীবনের কঠিন সময়েও সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে। অন্যদিকে যে ব্যক্তি সবুর করতে পারে না সে জীবনের কোনো ক্ষেত্রেই উপযুক্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। ধৈর্যশীল মানুষ পরাজিত হলেও জয়ের জন্য ধৈর্য ধরতে পারে। ফলে সে কোনো একদিন জয়ের মুকুট ছিনিয়ে নিতে পারে। কিন্তু ধৈর্যহীনের পক্ষে তা সম্ভব নয়। ফলে ধৈর্যহীন মানুষের জীবনে ব্যর্থতা নেমে আসে। একজন সহনশীল, ধৈর্যশীল মানুষ সমাজের অন্যান্য মানুষের দৃষ্টিতে আদর্শস্বরূপ। আর একজন ধৈর্যহীন ব্যক্তির সান্নিধ্য কেউ কামনা করে না। ইসলাম ধর্মেও বলা হয়েছে- ‘ধৈর্যশীল ব্যক্তিই উত্তম।’ মানব ইতিহাস পর্যালোচনা করলেই দেখা যায় যেসকল মহান ব্যক্তিরা সাফল্যের স্বর্ণ শিখরে পৌঁছেছেন তাঁরা প্রত্যেকেই ছিলেন ধৈর্যশীল, সহনশীল। সবুর করাই বুদ্ধিমানের কাজ। অধৈর্য ও তাড়াহুড়া করে কেউ কখনও ভালো কিছু অর্জন করতে পারে না। সবুর করার ফলাফল নিঃসন্দেহে ব্যক্তিজীবন ও সমাজজীবনে কল্যাণ বয়ে আনে। ধৈর্যের ফলেই জগতের সকল দুঃসাধ্য কাজ মানুষের নাগালের মধ্যে চলে এসেছে। ধৈর্যশীল ব্যক্তিই সর্বোত্তম ফল ভোগ করতে সক্ষম হয়।
শিক্ষা: যে সকল গুণ একজন মানুষকে সাফল্যের পথে এগিয়ে নিয়ে যায়, তার মধ্যে ধৈর্য অন্যতম। সুতরাং, ব্যক্তিস্বার্থে তথা সমাজের স্বার্থে আমাদের প্রত্যেকেরই এই গুণের অধিকারী হওয়া উচিত।
সম্পদে যাদের ঠেকে না চরণ মাটির মালিক তাহারাই হন।
মানব সভ্যতার ইতিহাস অনেক পুরানো। এই সভ্যতা এক দিনে গড়ে উঠেনি। সভ্যতার পরিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে শ্রমজীবী মানুষ। সভ্যতার বিকাশের শুরুতে অর্থনীতির বিষয়টি তেমন গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। তখন সমাজে সম্পদের মালিকানা বিষয়টি তেমন জটিলতার সৃষ্টি করেনি। সভ্যতা যখন ধীরে ধীরে পরিবর্তন হতে থাকে তখন মানুষের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাও পরিবর্তন হতে থাকে। মানুষ যখন সভ্যযুগের দিকে অগ্রসর হয় তখন অর্থনীতিকে কেন্দ্র করে জমির মালিকানার বিষয়টি চলে আসে। তখন থেকেই সমাজে ভূ-স্বামী ও ভূমিহীন শ্রেণির উদ্ভব হয়। ভূ-স্বামী ও পুঁজিপতিরা জমির মালিক হয়ে যায় এবং ভূমিহীন মানুষগুলো আরো নিঃস্ব হয়ে যায়। অথচ এই শ্রমজীবী মানুষগুলোই পৃথিবীকে সুন্দর করে সাজিয়েছেন। তারা মাঠে ফসল উৎপাদন করে এবং কল-কারখানায় কাজ করে। এভাবে মাটির সাথে শ্রমজীবী মানুষের এক ধরণের সম্পর্ক গড়ে উঠে। আর যারা পুঁজিপতি শ্রেণি তারা শোষণে ব্যস্ত। শ্রমজীবী মানুষকে ঠকিয়ে পুঁজিপতি শ্রেণির মানুষেরা সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলে। পুঁজিপতিরা ভোগ-বিলাসিতা করে বেড়ায়। তারা গাড়িতে চড়ে, ইটপাথরের দালানকোঠায় বসবাস করে। তাদের পা মাটির মধ্যে পড়তেই চায় না। মাটির সাথে তাদের কোনো সম্পর্ক নেই। কিন্তু পুঁজিপতি শ্রেণিরাই আবার ভূমি জমির মালিক। যারা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে দিন-রাত পরিশ্রম করে তারাই আজ বঞ্চিত। শ্রমিকরা তাদের প্রাপ্ত মজুরি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। পৃথিবীর সভ্যতার ইতিহাসের প্রতিটি ইটের সাথে শ্রমিকের গায়ের ঘাম জড়িত। তারা রোদে পুড়ে আবার জলে ভিজে। কিন্তু সম্পদের মালিক হচ্ছে পুঁজিপতি শ্রেণি। সামাজিক সম্পদের সঠিক উৎপাদন এবং সুষম বণ্টন ব্যবস্থাই পারে এই পার্থক্য দূর করতে।
শিক্ষা: একটি দেশের সার্বিক উন্নয়নে শ্রমজীবী মানুষ ব্যাপকভাবে অবদান রাখে। তাই শ্রমিকদের ব্যাপারে পুঁজিপতি শ্রেণির আপোষমূলক মনোভাব থাকা উচিত। তাহলেই জাতীয় উন্নয়ন সম্ভব হবে।
সমালোচক শত্রু নয়, সেই প্রকৃত বন্ধু।
মানুষের প্রতিটি কর্মের যেমন সমালোচনাকারী আছে, তেমনি প্রশংসাকারীও আছে। যে প্রশংসা করে তাকে আমরা বন্ধু মনে করি। আর যে সমালোচনা করে তাকে শত্রু ভাবা হয়। জীবনে চলার পথে যেমন অনেক বন্ধু জোটে, তেমন শত্রুও তৈরি হয়। বন্ধু সকল কাজে এগিয়ে আসে, সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়। একজন বন্ধু অন্য বন্ধুর বিপদে সাহায্য করে, পরামর্শ দেয়। প্রকৃত বন্ধু যেমন তার সুখে সুখী হয়, তেমন দুঃখে কষ্ট পায়। প্রকৃত বন্ধুই কাজের ভুল-ত্রুটি সংশোধন করে সঠিক পথের নির্দেশ দেয়। সাধারণত যে ব্যক্তি সমালোচনা করে তাকে আমরা শত্রু ভাবি। শত্রু মানুষের সর্ব প্রকার অনিষ্ট সাধনের চেষ্টা করে। যে সমালোচনা করে সে অন্যের দোষ গুণ নিয়ে কথা বলে। সমালোচনাকারী মানুষের সামনে অন্য ব্যক্তির দোষ নিয়ে কথা বলে তাকে অপমান করার জন্য। কারণ একজন শত্রু ব্যক্তির সকল কাজের সমালোচনা করে, কুৎসা রটায়, তাকে হেয় প্রতিপন্ন করার জন্য। শত্রুরূপী এই সমালোচনাকারীর উপর আমরা রাগ হই। কিন্তু পরোক্ষভাবে সে আমাদের ভুলগুলোকে চোখের সামনে এনে সংশোধন করার সুযোগ করে দেয়। ফলে দেখা যায় সমালোচনাকারী ব্যক্তি ক্ষতি করতে গিয়ে লাভ করে দেয়। বন্ধু যদি সমালোচনা করে, ভুল-ত্রুটি ধরিয়ে না দেয়, তাতে বরং ক্ষতিই হয়। কারণ তখন ভুলগুলো চোখের সামনে আসে না। ফলে সংশোধনেরও সুযোগ থাকে না। সমালোচনাকারী ব্যক্তিই আমাদের প্রকৃত বন্ধু। তার সমালোচনা আমাদের শুনতে খারাপ লাগে। কিন্তু মহৎ গুণাবলীর মানুষ হিসেবে গড়ে উঠতে পরোক্ষভাবে আবার সাহায্যও করে। তাই তো কবি তার ‘পাছে লোকে কিছু বলে’ কবিতায় বলেছেন- “নিন্দুকেরে বাসি আমি সবার চেয়ে ভালো, যুগ জনমের বন্ধু সে যে আঁধার ঘরের আলো।”
শিক্ষা: বন্ধু যদি গঠনমূলক সমালোচনা না করে শুধু প্রশংসা করে তবে সেটা উপকারে না এসে ক্ষতিই করে। তাই সমালোচনাকারী শত্রু হলেও সে সঠিক চরিত্র গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
সত্য যে কঠিন কঠিনেরে ভালো বাসিলাম, সে কখনো করেনা বঞ্চনা।
সত্য আলো হয়ে পথ দেখায়, মিথ্যা ও অসত্যকে বিতাড়িত করে। সত্য বলতে আমরা বুঝি কোনো কিছুর যথাযথ প্রকাশকেই। এর মধ্যে ধামাচাপার কিছু নেই। সত্যের অনুসরণে জীবন হয় সুন্দর, মানুষ অর্জন করে সততা। এর মধ্য দিয়েই মানুষ মহৎ গুণের অধিকারী হয়, যা মানব চরিত্রের উজ্জ্বল অলংকার। তাই যুগে যুগে মানুষ সত্যের সাধনা করছে। কারণ সত্যই মানুষের জীবনে সফলতা এনে দেয়। জীবনের কঠিন পথ পাড়ি দিয়ে সকল ভুল-ভ্রান্তি আর মিথ্যাকে অতিক্রম করেই মানুষ সত্যের সন্ধান পায়। সত্য অপ্রিয় হলেও তা সত্যই। মিথ্যা দিয়ে একে ঢেকে রাখা যায় না। মানুষের জন্য মৃত্যু যত নির্মমই হোক না কেন, তা সত্য। এই সত্যকে মেনে নিয়েই মানুষ তার ক্ষুদ্র জীবনকে পৃথিবীতে কর্মময় করে তোলে। আবার, কিছু স্বার্থান্ধ মানুষ অনেক সময় নিজের স্বার্থ উদ্ধারের জন্যে মিথ্যার আশ্রয় নেয়। আপাতদৃষ্টিতে যদিও সে জয়ী হয় কিন্তু সত্যের প্রকাশ এক সময় অনিবার্য হয়ে ওঠে। সত্যের বিজয় ঘোষিত হয়। মিথ্যার আশ্রয়কারী ধ্বংসের দিকে ধাবিত হয়। সত্য যত কঠিনই হোক, তা চিরদিনই মাথা উঁচু করে থাকে। তাই তো যুগে যুগে মহামানবগণ সত্যের সাধনা করেছেন, হয়েছেন মহান আদর্শ। কারণ, সত্যের বলে বলীয়ান হয়েই তারা চরম শত্রুকেও পরাজিত করেছেন। ইতিহাসে হযরত মুহাম্মদ (স) এর সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্যে ত্যাগ তিতিক্ষা উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে আছে। আমাদের সমাজের কঠিন সত্যগুলোকে মিথ্যা দিয়ে ঢাকার চেষ্টা না করে যদি আমরা তা মেনে নিয়েই কর্ম ঠিক করি তাহলে সমাজের অনেক অশান্তি, বিশৃঙ্খলা ও অন্যায় দূর হয়ে যাবে। কেননা, শত শতাব্দীর বিস্মৃতির তলেও সত্য হারিয়ে যায় না। সত্য উপেক্ষায় মরে না, অপমানে অস্থির হয় না, আঘাতে টলে না, তাই সত্য কঠিন হলেও তা মানুষকে বঞ্চিত করে না।শিক্ষা: সত্যের জয় অবশ্যম্ভাবী। তাই জীবনে জয়ী হওয়ার জন্যে কঠিন সত্যই আমাদের আশ্রয় হওয়া উচিত।
সঙ্গদোষে লোহা ভাসে।
মানুষ সামাজিক জীব। একা বাস করতে পারে না বলে মানুষ সমাজবদ্ধ হয়ে বাস করে। বিপদে-আপদে, সুখে-দুঃখে একে অপরকে সঙ্গ দেয়। এভাবে একে-অপরের বন্ধুত্ব লাভ করে। একজনের জীবনের ওপর তার সঙ্গীর প্রভাব অনিবার্যভাবে পড়ে। বন্ধু যদি সৎ কর্ম করে তাহলে অপরজন তা অনায়াসে শিখতে পারবে। এক বন্ধুর সৎ কাজের দ্বারা অনুপ্রাণিত ও উৎসাহিত হয় অপর বন্ধু। কারণ প্রত্যেক মানুষের মধ্যে অনুকরণ-বাসনা বিদ্যমান। একজন মানুষ ভালো হবে না খারাপ হবে অনেকাংশে তা নির্ভর করে তার পরিবেশের ওপর। আর ঐ পরিবেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো মানুষ যাদের সান্নিধ্যে সে থাকে। একজন ভালো মানুষের সান্নিধ্যে একজন খারাপ মানুষও ভালো মানুষে পরিণত হয়। আবার একজন মানুষ যত ভালোই হোক না কেন সে যদি মন্দলোকের সংস্পর্শে থাকে, তাহলে তার প্রভাবে মন্দ কাজ করতে বাধ্য হবে। যেমন, লোহা সাধারণত পানিতে ফেললে তা নিমেষেই ডুবে যাবে। কিন্তু তার সাথে যদি পানিতে ডোবে না এমন কোনো বস্তু বেঁধে দেওয়া হয়, তাহলে লোহা পানিতে ভেসে থাকে। অর্থাৎ বলা যায়, আগুনে হাত দিয়ে তা না পোড়ার কথা যেমন চিন্তা করা যায় না, তেমনই অসৎ সঙ্গীর সান্নিধ্যে থেকে ভালো কাজ করার কথা কল্পনাও করা যায় না। সবসময় মনে রাখতে হবে যে, দুষ্ট গরুর চেয়ে শূন্য গোয়াল ভালো। বন্ধু থাকা ভালো। তবে যেখানে সৎ বন্ধু দুর্লভ, সেখানে অসৎ বন্ধুর সঙ্গ লাভের চেয়ে বন্ধুহীন নিঃসঙ্গ থাকাই ভালো। কারণ কুসঙ্গে মানুষ নিজের অজান্তেই ধীরে ধীরে খারাপ পথে অগ্রসর হয়। যেমন কেউ যদি মাদকসেবীর বন্ধুত্ব গ্রহণ করে, একদিন না একদিন কৌতহলী হয়ে মাদক নেয়ার ইচ্ছা হতে পারে। আবার ধীরে ধীরে নেয়ার পর তা নেশায় পরিণত হয়ে যেতে পারে। তাই অসৎ, চরিত্রহীন মানুষের স্পর্শ থেকে দূরে থাকা উচিত।
শিক্ষা: মানুষ সঙ্গী ছাড়া থাকতে পারে না, তাই প্রত্যেকের উচিত সৎ, ন্যায়পরায়ণ সঙ্গী খুঁজে নেওয়া। জীবনকে সৎ, সুন্দর, মহৎ করতে সৎ সঙ্গী নির্বাচন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ মন্দ সঙ্গী যেমন মন্দের দিকে টানে, তেমনই সৎ সঙ্গী সৎ ও সুন্দরের দিকে টানে।
সার্থক জনম আমার জন্মেছি এই দেশে সার্থক জনম মাগো, তোমায় ভালবেসে।
প্রতিটি মানুষ তার মাতৃভূমিকে হৃদয় দিয়ে ভালোবাসে। জন্মর পর থেকেই মানুষ তার প্রিয় জন্মভূমির রূপ, রস, গন্ধ, বর্ণ উপভোগ করে। জন্মভূমির অবারিত আলো হাওয়ায় বেড়ে ওঠে। জন্মভূমির জলে-ডাঙ্গায় হেসে খেলে মানুষ শৈশব অতিক্রম করে কৈশোর ও যৌবনে পদার্পণ করে। জন্মভূমিতে সম্পদের প্রাচুর্য না থাকলেও প্রকৃতির অপার সৌন্দর্যের ভান্ডার পেয়ে মানুষ মুগ্ধ হয়। স্বদেশের প্রকৃতি মানুষের কাছে প্রিয় হয়ে ওঠে। জন্মভূমির তরুলতা প্রকৃতির মাঝে প্রাণের সঞ্চার করে। জন্মভূমির গাছে গাছে ফুটে থাকা ফুলের গন্ধে মানুষ বিমোহিত হয়। মাতৃভূমির চাঁদের আলো মানুষকে নির্মল আনন্দ দেয়, এর চিরসুন্দর প্রকৃতি উৎসাহ জোগায় সামনে এগিয়ে যাওয়ার। এভাবে স্বদেশের মাটির সঙ্গে গড়ে ওঠে মানুষের নিবিড় সম্পর্ক। তাই মানুষ পৃথিবীর যে প্রান্তেই থাক, জন্মভূমি তাকে হাতছানি দিয়ে কাছে টানে। কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত সুদূর ফ্রান্সে গিয়েও জন্মভূমিকে ভুলতে পারেননি। জন্মভূমির ভালোবাসা তাঁকে স্বদেশের মাটিতে ফিরিয়ে এনেছে। জন্মভূমির সাথে মানুষের নাড়ীর বন্ধন। জন্মভূমির ধূলিকণা মানুষের কাছে সোনার চেয়েও খাঁটি মনে হয়। মাকে সন্তান যেমন ভালোবাসে, তেমনি জন্মভূমিকেও মানুষ ভালোবাসে। তাই জীবনের শেষ আশ্রয় মানুষ নিজ-নিজ জন্মভূমিতেই কামনা করে।
শিক্ষা: জন্মের পরেই জন্মভূমির আলোয় মানুষের চোখ জুড়ায়, এজন্য তার মাটিতেই মানুষ চিরনিদ্রায় শায়িত হতে চায়।
সাহিত্য জাতির দর্পণস্বরূপ। শব্দার্থ-দর্পণ:-আয়না।
সাহিত্যকে একটি জাতির দর্পণ বা আয়নার সাথে তুলনা করা যায়। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আমরা আমাদের নিজ ছবি দেখতে পাই। একইভাবে কোনো জাতির সামাজিক, রাজনৈতিক অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জীবনের চিত্র সাহিত্যের মাধ্যমে জানা যায়। সমাজ ও মানবজীবন সাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। সমাজ জীবনের বিভিন্ন ঘটনা নিয়ে সাহিত্য রচিত হয় বলে সাহিত্যকে সমাজের প্রতিফলন বলা হয়। সাহিত্য মানুষকে আনন্দ দান করে। এটি মানুষের মনে প্রেরণা দেয় এবং জানার আগ্রহ বাড়িয়ে দেয়। সাহিত্য ভীরুকে সাহসী করে তোলে। দেশের সংকটময় মুহূর্তে সাহিত্য জনগণের মনের উৎসাহ ও উদ্দীপনা দান করে। পৃথিবীর অনেক কবি-সাহিত্যিক আছেন যারা সাহিত্য রচনা করে অমর হয়ে আছেন। কবি সাহিত্যিকরা পারেন কোনো দেশ বা জাতিকে বিশ্বের কাছে সুন্দরভাবে তুলে ধরতে। কাজী নজরুল ইসলাম ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের সময় সাহিত্য রচনার মাধ্যমে জনগণের মনে প্রেরণা দান করেছিলেন। জীবনানন্দ দাশ তাঁর কাব্যগুলোর মাধ্যমে বাংলাদেশের প্রকৃতির বৈচিত্র্য বর্ণনা করেছেন। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আমাদের সোনার বাংলাকে সুন্দরভাবে বিশ্বের দরবারে উপস্থাপন করেছেন। আবার বিদেশি সাহিত্যের মাধ্যমে আমরা বিভিন্ন জাতির আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থার বর্ণনা পাই। যেমন, রাশিয়ার একজন বিখ্যাত কথা সাহিত্যিক হলেন লিও তলস্তয়, তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস ‘ওয়ার এন্ড পিস’ এর মাধ্যমে আমরা সমগ্র রাশিয়ার আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে ধারণা লাভ করতে পারি। শুধু ব্যক্তিগত জীবনে নয়, জাতীয় জীবনেও সাহিত্যের গুরুত্ব অপরিসীম। কোনো জাতির অতীত ইতিহাস ও ঐতিহ্য সাহিত্যে স্থান পায়। যে জাতির সাহিত্য যত বেশি সমৃদ্ধ সে জাতি তত বেশি উন্নত। বাংলাদেশ একটি ছোট আয়াতনের দেশ। এ দেশের সাহিত্য ও সংস্কৃতি অনেক সমৃদ্ধ। তবে সাহিত্য বলতে শুধু কবি বা সাহিত্যিকদের রচনা নয়। এটি একটি জাতির সামগ্রিক সংস্কৃতিকে বহন করে।
শিক্ষা: পৃথিবীর বিভিন্ন জাতির পরিচয় সাহিত্যে পাওয়া যায়। এই সাহিত্যের মাধ্যমেই বিভিন্ন দেশ ও জাতির পরিচয় গোটা পৃথিবীর সামনে তুলে ধরা যায়।
সুকঠিন গার্হস্থ্য ব্যাপার কে পারে চালাতে রাজ্য শাসনের রীতিনীতি সূক্ষ্মভাবে রয়েছে ইহাতে।
পরিবার হলো সামাজিক কাঠামোর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রতিষ্ঠান। শৈশবকাল থেকে পরিবার শিশুকে সামাজিকভাবে চলার জন্য উপযোগী করে গড়ে তোলে। কার সঙ্গে কী ধরণের আচার-ব্যবহার করতে হবে, অবস্থান ভেদে তার দায়িত্ব ও কর্তব্য কী হবে এসব পরিবারই আমাদেরকে শিখিয়েছে। পরিবার হলো একটি বিশাল ব্যবস্থাপনা ক্ষেত্র। এই ব্যবস্থাপনার কেন্দ্রবিন্দু মূলত মা-ই হয়ে থাকেন। তিনি অত্যন্ত সুশৃঙ্খলভাবে পরিবারের সকল কাজ সম্পাদন করেন। পরিবারের সদস্যদের নৈতিক শিক্ষা এবং প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ভিত্তি তার হাতেই রচিত। অসুস্থ সদস্যকে সেবাদান করে সুস্থ করে তোলার জন্য তিনিই অনান্য ভূমিকা পালন করেন। বাবা আর্থিক যোগান দিলেও পরিবারের বাজেট প্রণয়ন ও ব্যয় নির্বাহ তিনিই করে থাকেন। তবে বর্তমানে মায়েরা আর্থিকভাবেও পরিবারে বিশাল অবদান রেখে চলেছেন। সর্বোপরি একজন সুগৃহিনী মা অত্যন্ত সুশৃঙ্খলভাবে পরিবার পরিচালনা করে থাকেন। এই পরিবার পরিচালনার বিষয়টি অনেকাংশেই রাষ্ট্র পরিচালনার মতো। নাগরিকদের সুযোগ সুবিধা দেয়ার জন্য রাষ্ট্র যেমন বিবিধ কার্য সম্পাদন করেন তেমনি পরিবার পরিচালনার জন্য একজন গৃহিনীও বিভিন্ন ধরণের কাজ করে থাকেন। বলতে গেলে রাষ্ট্রেরই ছোট একটি অবয়ব হলো পরিবার। রাষ্ট্র পরিচালনার সঙ্গে পরিবার পরিচালনার অনেক মিল রয়েছে। রাষ্ট্র শাসন করার যে রীতিনীতিগুলো রয়েছে তা অনেকাংশেই পরিবার পরিচালনার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।
শিক্ষা: সুন্দরভাবে রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য যা যা প্রয়োজন পরিবার পরিচালনার জন্যও তা প্রয়োজন। আমাদেরকে সুন্দরভাবে পরিবার পরিচালনা শিখতে হবে যাতে দেশের প্রয়োজনে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব আসলে তা সুন্দরভাবে সম্পন্ন করা যায়।
সুখের ফসল এতই সোজা চাষাবাদে দহন-সহন তবেই না প্রাপ্তির খোঁজ।
পৃথিবীতে এক শ্রেণির মানুষ আছে যারা গাছ না লাগিয়েই তার ফল খেতে চায়। তারা চায় বিনা পরিশ্রমে তাদের সকল চাহিদা মিটে যাক। কিন্তু পৃথিবীটা কোনো রূপকথার যাদুময় স্থান নয়, যে চাইলেই সবকিছু হাতের মুঠোয় চলে আসবে। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে যা কিছুই দেখি তার কোনোটিই এমনিতে আসে না। কৃষক যদি ফাঁকা মাঠে বীজ ছড়িয়ে চলে আসত তাহলে কখনোই কাঙ্ক্ষিত ফসল পাওয়া যেত না। কৃষককে রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে জমি চাষ করতে হয়, সঠিক নিয়মে ফসল বুনতে হয়, নিবিড় পরিচর্যা করতে হয়, সঠিক সময়ে ফসল কাটতে হয় তবেই কৃষক কাঙ্ক্ষিত অর্জন করে। কষ্ট ব্যতিত যে সুখ পাওয়া যায় তা নিতান্তই ক্ষণস্থায়ী। সারা মৌসুম হাড় ভাঙা খাটুনি খেটে, পাকা ধান ঘরে তোলার পর কৃষক তার সকল কষ্ট ভুলে যায়। তেমনি যেকোনো কাজ সফলতার সাথে শেষ করতে পারলে কোনো কষ্টই কষ্ট মনে হয় না। সফলতার আনন্দে শিহরিত হয় মানুষের মন। আর কোনো কাজে সফল হওয়ার পূর্বশর্তগুলো হলো-দৃঢ়তা, ধারাবাহিকতা, পরিশ্রম করার মানসিকতা প্রভৃতি। এগুলো ব্যতিত সফল হওয়া যায় না। সৃষ্টিকর্তা আমাদেরকে হাত দিয়েছেন পরিশ্রম করার জন্য। যারা পরিশ্রম করতে চায় না, কর্মবিমূখ তারা অলস। অলস ব্যক্তিগণ পৃথিবীর অভিশাপ। অলস ব্যক্তি কখনই সুখী হতে পারে না। সাময়িক তুষ্টি পেলেও দীর্ঘ সময় তাদের কষ্ট ভোগ করতে হয়।শিক্ষা: কোনো কিছু প্রাপ্তির জন্য একটি নির্দিষ্ট সময় ও পদ্ধতি রয়েছে। এর ব্যতিক্রম হলে সফলতা আসবে না। কষ্টার্জিত সুখই প্রকৃত ও চিরস্থায়ী সুখ।
সুশিক্ষিত লোক মাত্রই স্বশিক্ষিত।
প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা এবং বাস্তব জীবনের প্রেক্ষাপটে প্রকৃতি থেকে অর্জিত শিক্ষা-এ দুয়ের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। বিদ্যালয়ের শিক্ষা মূলত পরীক্ষা পাশের শিক্ষা, জীবিকার্জনের শিক্ষা। সীমাবদ্ধতার মধ্য দিয়ে এ শিক্ষা শেষ হয়ে যায়। কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে শিক্ষার কোনো সীমা-পরিসীমা নেই। তাই স্কুল কলেজের শিক্ষাকে প্রকৃত অর্থে সুশিক্ষা বলা যায় না। সুশিক্ষার অর্থ স্বশিক্ষা। স্কুল-কলেজের শিক্ষার পাশাপাশি স্বচেষ্টায় স্বতঃস্ফূর্তভাবে জ্ঞানান্বেষণ সুশিক্ষার পর্যায়ে পড়ে। সুশিক্ষায় শিক্ষিত ব্যক্তি হবেন কুসংস্কারমুক্ত, তার চিন্তা হবে সুদূরপ্রসারী, বৈজ্ঞানিক ও মুক্তবুদ্ধির আলোকে উদ্ভাসিত। এমন অনেক ডিগ্রিধারী লোক আছেন যাদের শিক্ষার সঙ্গে বাস্তব জীবনচর্চার কোনো সামঞ্জস্য ঘটেনা। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা মানুষের বাহ্যিক অবয়ব তৈরি করতে পারলেও তার অন্তর্দৃষ্টিকে প্রসারিত করতে পারে না। মূলত শিক্ষার প্রধান উদ্দেশ্য জ্ঞানশক্তি অর্জন করা। শিক্ষা সম্পূর্ণভাবে অর্জন সাপেক্ষ। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় জ্ঞানচর্চা ও জ্ঞান আহরণের পথ অনেক সময় সুগম হলেও তাতে পূর্ণতা আসে না। স্বশিক্ষায় অর্জিত জ্ঞান ছাড়া মানুষের অন্তর্দৃষ্টি প্রসারিত হয় না। স্বশিক্ষা মানুষকে সুদৃঢ়প্রসারী জ্ঞানদান করে। তখন তিনি বিজ্ঞানমনস্ক যুক্তিবাদী দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী হয়ে উঠেন, পরিশীলিত রুচিবোধে হয়ে উঠেন উদার ও নম্র স্বভাবের। বস্তুত প্রকৃত শিক্ষার ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠান মুখ্য নয়। পৃথিবীতে অনেক স্বশিক্ষিত ব্যক্তি ছিলেন, যারা প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রি ছাড়াই মুক্ত চিন্তা ও জ্ঞান দিয়ে মানবতার উপকার করে গেছেন। এ প্রসঙ্গে সক্রেটিস, প্লেটো, এরিস্টটল, রবীন্দ্রনাথ ও কাজী নজরুল ইসলামের কথা আমরা উল্লেখ করতে পারি। স্বচেষ্টায় স্বতঃস্ফূর্তভাবে এঁরা জ্ঞান রাজ্যে বিচরণ করেছেন। তাই বলা যায় যারা প্রকৃত অর্থেই শিক্ষিত আর জ্ঞানী তারা সকলেই স্বশিক্ষায় শিক্ষিত।
শিক্ষা: গুরুর শিক্ষা কিংবা প্রাতিষ্ঠানিক সীমাবদ্ধ শিক্ষা মানুষকে সুশিক্ষিত করে না। সুশিক্ষা অর্জন হয় আত্মপ্রচেষ্টা, আগ্রহ ও অধ্যয়নের মাধ্যমে।
সুসময়ে বন্ধু বটে অনেকের হয় অসময়ে হায় হায় কেউ কারো নয়।
জীবনে চলার পথ সহজ নয়। পদে পদে মানুষকে নানা বাধা বিপত্তির সম্মুখীন হতে হয়। মানুষের জীবন সবসময় একরকম থাকে না। সুখ-দুঃখ দুটোই জীবনের নিত্য সঙ্গী। তাই জীবনে সুসময় যেমন আসে তেমনি দুঃসময়ও আসে। ভালো সময়ে মানুষের চারপাশে শুভাক্সক্ষীর অভাব হয় না। কিন্ত দুঃসময়ে তাদের দেখা পাওয়া যায় না। সুসময়ে চারপাশে মৌমাছির মতো মধু নিতে আসে অসংখ্য মানুষ। প্রকৃত বন্ধু চেনা যায় বিপদের সময়। বিপদে যে ব্যক্তি বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দেয় সেই প্রকৃত বন্ধু। দুঃসময়ের বন্ধুই আসল বন্ধু। দুঃসময়ে যেসব বন্ধুর সাহায্য পাওয়া না যায়, সুসময়ে সেসব বন্ধুর কোনো প্রয়োজন নেই। পৃথিবীতে স্বার্থপর মানুষের সংখ্যাই বেশি। বেশিরভাগ মানুষ মানুষের সাথে বন্ধুত্ব করে সুবিধা পাওয়ার জন্য। এই সমস্ত স্বার্থপর বন্ধুগুলোকে চেনা যায় বিপদকালীন সময়ে। বিপদের সময় স্বার্থপর বন্ধুকে খুঁজে পাওয়া যায় না। জীবনে চলার পথে ঐ সব বন্ধুদের পরামর্শ নিয়ে চলতে হয় যারা দুঃসময়ে পাশে থাকে। সুসময়ের বন্ধুদেরকে কবুতরের সাথে তুলনা করা যেতে পারে। যতক্ষণ ধান ছিটানো হয় কবুতর ততক্ষণ মানুষের কাছাকাছি থাকে। কিন্তু ধান শেষ হয়ে গেলেই সে আকাশে উড়ে যায়। স্বার্থপর মানুষের বৈশিষ্ট্যও তেমনি। টাকা পয়সা খরচ করলে চারদিকে বন্ধুর অভাব হয় না। কিন্তু যখনই কারো টাকা শেষ হয়ে যায়, খরচ করার মতো অবস্থা থাকে না তখন আর এইসব বন্ধুদের খুঁজে পাওয়া যায় না।
শিক্ষা: মানুষের সুসময়ে অনেক বন্ধু-বান্ধব থাকলেও তারা সবাই প্রকৃত বন্ধু নয়। সেই বন্ধুই প্রকৃত যে মানুষের বিপদের সময় পাশে দাড়াঁয়। তাই জীবনে চলার পথে প্রকৃত বন্ধুকে খুজে নিতে হবে ।
দোষ-গুণ এই দুই মিলিয়েই মানুষ। কারো ক্ষেত্রে গুণের পাল্লাটা ভারি কারো বা দোষের পাল্লা। কিন্তু যার একটি মাত্র দোষ ও নেই কিংবা একটি মাত্র গুণ ও নেই সে কখনো মানুষ হতে পারে না। সে হবে মানুষের বাইরে অন্য কিছু। হয়তো ফেরেশতা নয়তো পশু। প্রকৃতপক্ষে যারা ভালো মানুষ অর্থাৎ সুজন তারা মানুষের ভেতরের ভালোটাকেই চেনে। অন্যকে তারা ভালো চোখে দেখে। খুব সহজেই তারা মানুষের গুণগুলোকে, ভালো দিকগুলোকে চিহ্নিত করতে পারে। সেই সাথে ব্যক্তির দোষগুলোও তাদের দৃষ্টি এড়ায় না। কিন্তু তারা ভালো মানুষ বলেই, অন্যের দোষ ত্রুটি মানুষের সামনে প্রকাশ করে না।কাউকে ছোট করে না। কারো কুৎসা রটনা করে না। বরং ব্যক্তির গুণগুলোকেই তারা জনসম্মুখে নিয়ে আসে। ব্যক্তিকে প্রশংসিত ও মহিমান্বিত করে। এর মাধ্যমে অজান্তেই সুজনের নিজের মাহাত্ম্যও প্রকাশ পায়। কারো গুণের প্রচার করতে তার দ্বিধা হয় না। মনের ভেতর জড়তা থাকে না। বরং মানুষের ভেতরে ভালো কিছু আবিষ্কারের নেশায় সে উপভোগ করে অপার আনন্দ। অপরদিকে যারা হীন প্রকৃতির মানুষ তারা কখনোই অন্যের ভালো দেখতে পারে না। তাই এই কুজনেরা মানুষের ভালো দিকগুলো না খুঁজে ত্রুটি খুঁজে বের করে এবং তা প্রচার করে। কারো ভালো কিছু তাদের দৃষ্টি গোচর হয় না। এমনকি সেই ভালোগুণকেও দোষের মোড়কে আবৃত করে তারা মানুষের সামনে আনতে চায়। অন্যের দোষ নিয়েই তারা মাতামাতি করে। কারো গুণ প্রকাশ করতে হীন ব্যক্তিরা দ্বিধাবোধ করে, ভয় পায়, ঈষান্বিত হয়। কারো সম্পর্কে ভালো কথা বলা কুজনের স্বভাবে নেই। তারা দ্বিধাহীন চিত্তে অন্যের দোষ বর্ণনাকেই জীবনের ব্রত হিসেবে নেয়। কিন্তু এতে করে তারা কেবল নিজেদের দুর্বলতাকেই প্রকাশ করে না বরং হীনরুচিরও পরিচয় দেয়। আর সমাজ-সংসারে নিজেকে নীচ বলে প্রমাণ করে।
শিক্ষা: আদিকাল থেকেই সমাজে ভাল-খারাপ মানুষ ছিল, থাকবে এবং যার যার মতো কাজ করবে। আমাদেরকে শুধু এই ভাল-খারাপের পার্থক্য বুঝে তাদেরকে চিহ্নিত করতে হবে। নিজ দায়িত্বে খারাপ মানুষ থেকে দূরে থাকতে হবে।
মানুষ মরণশীল। একটি নির্দিষ্ট সময় পর প্রতিটি মানুষই মৃত্যুবরণ করে। অর্থাৎ খুব অল্প সময়ের জন্যই মানুষ পৃথিবীতে আসে। এই অল্প সময়েই তাকে করে যেতে হয় অনেক কাজ, অনেক সাধনা। কাজ ফুরাবার আগেই হয়তো বেজে ওঠে তার বেলা শেষের গান। দীর্ঘশ্বাস আর অতৃপ্তি বুকে নিয়ে তাকে চলে যেতে হয়, এটাই নিয়ম। এই নিঃশব্দে চলে যাওয়ার মাঝে বেদনা আছে, তবে সেই সাথে আছে সান্তনাও। কারণ মানুষ চলে যায় কিন্তু রেখে যায় তার কর্ম। প্রবাদ আছে- ‘মানুষ বাঁচে তার কর্মের মধ্যে, বয়সের মধ্যে নয়।’ কিছু মানুষ আছে যারা আত্মসুখের চেয়ে মানবতার সেবাকে মহৎ বলে বিবেচনা করে। এ ধরণের পরোপকারী সজ্জনের অবদানে মানুষ উপকৃত হয়। শ্রদ্ধাভরে মানুষ স্মরণ করে তাদের উপকারের কথা। মহৎ গুণাবলী ও পরোপকার ব্রতের দ্বারা যিনি মানুষের মনে ঠাঁই করে নিয়েছেন, প্রতিনিয়তই মানুষ তাকে হৃদয়ের মধ্যে অনুভব করে। এ ধরণের মানুষই ধন্য। জীবন কেবল তখনই সার্থক হয় যখন মানুষের হৃদয়ে কেউ নিত্য পূজা লাভ করে। যারা নিজ সার্থকে বিসর্জন দিয়ে পরের কল্যাণে নিজেকে বিলিয়ে দিতে পারে তারাই মৃত্যুঞ্জয়ী মহিমায় ভাস্বর। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায়- ‘নিঃশেষে প্রাণ, যে করিবে দান, ক্ষয় নাই, তার ক্ষয় নাই।’ অর্থাৎ পরার্থ কামনার এই ব্রতে যিনি আত্মসুখকে বিসর্জন দিয়ে বৃহৎ জগতের মাঝে ঠাঁই নিয়েছেন, জীবনের ভিড়ে যিনি জীবকে খুঁজে নিয়েছেন, মৃত্যুর পরও মানুষের ধ্যানলোকে তিনি অমর।
শিক্ষা: জীবন একটাই। তাই এই জীবনে আমাদের সবার লক্ষ্য যেন হয় মানবের কল্যাণে নিজেকে নিয়োজিত করা। জীবন ও জগতের জন্য কল্যাণকর কর্মের মাধ্যমেই আমরা হয়ে উঠতে পারব স্মরনীয় ও বরণীয়।
মানুষ সামাজিক জীব। সে চাইলেই একা থাকতে পারে না। সমাজে বসবাস করতে হলে সব ধরণের মানুষের সাথে চলাফেরা করতে হয়। সেখানে ভালো মানুষ যেমন আছে তেমনি খারাপ মানুষও আছে। তবে জন্মগত ভাবে মানুষ খারাপ হয় না। পরিবেশ, পরিস্থিতি, আর সঙ্গী সাথীর কারণে মানুষের চরিত্র কলঙ্কিত হয়। তাই বন্ধু নির্বাচনের ক্ষেত্রে সচেতন থাকতে হবে। সৎ বন্ধু ভালো পরামর্শ দিয়ে, সহযোগিতা করে জীবনের লক্ষ্যে পৗঁছাতে সাহায্য করে। জীবনকে সুন্দর ও অর্থবহ করে তুলতে পারে সৎ সঙ্গ। তাই সৎ সঙ্গ সবাই কামনা করে। সৎ সঙ্গের বিপরীত হচ্ছে অসৎ সঙ্গ। যাদের মাধ্যমে কখনই ভালো কিছু আশা করা যায় না। সৎ সঙ্গীর পরামর্শ অনেক সাফল্য এনে দিতে পারলেও অসৎ সঙ্গীর পরামর্শ জীবনকে ধ্বংস করে দিতে পারে। একজন মানুষ ভালো কি মন্দ তা বোঝা যায় তার বন্ধু নির্বাচনের মাধ্যমে। কোনো মানুষের বন্ধু বা সঙ্গী যদি ভালো না হয় তবে তাকে সবাই খারাপ মনে করে। অসৎ সঙ্গীর কারণে ভালো মানুষও একসময় বিপথে চলে যায়। অন্যদিকে সৎ সঙ্গ জীবনকে সাফল্যমন্ডিত করে তোলে। মানুষ যখন কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারে না তখন একজন ভালো বন্ধু সৎ পরামর্শ দিয়ে সাহায্য করতে পারে। কোনো মানুষের আচরণ, চরিত্র কেমন হবে সেটা বোঝা যায় তার সঙ্গী-সাথী দেখে। মানুষ তার সঙ্গী দ্বারা অনেকটাই প্রভাবিত হয়। ভালো মানুষের সঙ্গ খারাপ ব্যক্তিকেও ভালো করে, আবার খারাপ মানুষের সংস্পর্শে ভালো মানুষও ধীরে ধীরে খারাপ হয়ে উঠে।
শিক্ষা: ভালো সঙ্গীর অভাবে অনেক সময় মানুষের জীবন নষ্ট হয়ে যায়। আবার অনেকের জীবন সফল হয়ে ওঠে শুধু সৎ সঙ্গে চলার কারণে। তাই জীবনকে সুন্দর করতে চাইলে সৎ সঙ্গী গ্রহণ, আর অসৎ সঙ্গী বর্জন করতে হবে।
একজন ভালো বা প্রকৃত বন্ধু প্রতিটি মানুষের জীবনেই কাম্য। প্রকৃত বন্ধুর বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, আনন্দ-বেদনায়, সুখে-দুঃখে, বিপদে-আপদে, কষ্ট-হতাশায় সব সময় সে বন্ধুর পাশে থাকে। মানুষ যখন বিপথে চলে যায়, তখন একজন প্রকৃত বন্ধু তাকে পথে ফিরিয়ে আনে। কিন্তু অনেক সময় দেখা যায়, বন্ধুত্ব নষ্ট হওয়ার আশঙ্কায় বন্ধুর খারাপ দিকগুলো অন্য বন্ধু ধরিয়ে দেয় না। নির্বাক দর্শকের ভূমিকা পালন করে। ফলে সে ভুল পথে পরিচালিত হয়, নিজেকে শুধরিয়ে নিতে পারে না। এতে ঐ বন্ধুর চরম ক্ষতি সাধন হয়। স্পষ্টবাদিতা মানুষের অন্যতম মহৎ গুণ, যা নির্বাক বন্ধুর থাকে না। স্পষ্টভাষী শত্রু স্পষ্টভাবে তার খারাপ দিকগুলো তাকে ধরিয়ে দেয় বা খারাপ দিকগুলোর সমালোচনা করে। এতে সে তার ভুল বুঝতে পেরে সঠিক পথে ফিরে আসতে পারে। মন্দ ব্যাপারগুলো বুঝতে পেরে নিজেকে শুধরিয়ে নিতে পারে। তাই বলা চলে স্পষ্টভাষী শত্রুই প্রকৃত বন্ধু।
শিক্ষা: নির্বাক বন্ধু অপেক্ষা একজন স্পষ্টভাষী শত্রু ভালো। কারণ স্পষ্টবাদী শত্রু একজন প্রকৃত মহৎ বন্ধুর ভূমিকাই পালন করে থাকে। তাই মানুষের জীবনে নির্বাক বন্ধু অপেক্ষা, একজন স্পষ্টভাষী শত্রুই কাম্য।
বিশিষ্ট সাহিত্যিক সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজী বলেছেন- ‘একজন মানুষ নানা গুণের অধিকারী হতে পারে, কিন্তু সে যদি দেশের কোনো কল্যাণ না করে থাকে, তাহলে প্রকৃত প্রস্তাবে সে নরাধম, ঘৃণিত, বর্বর।’ মানুষের প্রকৃত পরিচয় দেশের প্রতি তার দৃষ্টিভঙ্গি ও কর্মকান্ড দ্বারাই নির্ধারিত হয়। ইসলাম ধর্মে বলা হয়েছে- ‘দেশপ্রেম ঈমানের অঙ্গ।’ সনাতন হিন্দু ধর্মে বলা হয়েছে- ‘জন্মভূমি স্বর্গস্বরূপ, মাতৃস্থানীয়; তাকে রক্ষা করা সবার একান্ত কর্তব্য।’ পশুর সঙ্গে মানুষের কিছু পার্থক্য রয়েছে। পশুর কাজ খাদ্য ও বাসস্থানের জন্য আস্তানার চিন্তা করা এবং এর জন্য ক্ষেত্রবিশেষে অন্যান্য পশুর সাথে লড়াই করা। যে মানুষ কেবল বৈষয়িক নানা কর্মকান্ডের সঙ্গে জড়িত থেকে নিজের স্বার্থ ও সুখের প্রচেষ্টা করে জীবন পার করে দেয়, দেশ ও দেশের জন্য কিছু করে না, দেশের কল্যাণে মনোনিবেশ করে না, প্রকৃত প্রস্তাবে সে ঐ পশুর মতোই। কারণ তার কর্মকান্ডের সাথে পশুর কর্মকান্ডের কোনো প্রভেদ নেই। দেশ প্রেমিকেরাই প্রকৃত মানুষ। যারা শ্রম দিয়ে, অর্থ দিয়ে দেশ ও জাতির নিরন্তর সেবা করে যাচ্ছে তারাই শ্রেষ্ঠ মানুষ। দেশপ্রেমিকেরা কখনো মাথা নত করে না। তাই তো প্যালেস্টাইনের এক কবি বলেছেন- ‘স্বদেশের মাটি স্পর্শ করার সময় ছাড়া আমার শির আর কখনো নত হয় না।’ স্বদেশের মঙ্গল ও কল্যাণের দিকে যার কোনো দৃষ্টি নেই, কেবল নিজের স্বার্থের জন্য, নিজের সুবিধা প্রাপ্তির জন্য যে তৎপর, বিবেকহীন পশুর সাথে তার কোনো পার্থক্যই নেই। এর উদাহরণ আছে আমাদের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসেই। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় একদল নরপশুর আবির্ভাব ঘটেছিল, যারা আমাদের স্বাধীনতার বিরোধী শক্তি রূপে কাজ করেছে। নিজেদের স্বার্থের জন্য যারা দেশের স্বাধীনতাকে পর্যন্ত অস্বীকার করেছে তারা আসলে পশুর চেয়েও অধম। ইংরেজি সাহিত্যের কবি বায়রন বলেছেন- ‘যে তার দেশকে ভালোবাসতে পারে না, সে কিছুই ভালোবাসতে পারে না।’ দেশকে, সমাজকে যে উন্নয়নের দিকে অগ্রসর করতে চেষ্টা না করে সে দেশ ও সমাজের জন্য কলঙ্ক হয়ে বেঁচে থাকে।
শিক্ষা: আমাদের সবারই উচিত যার যার অবস্থান থেকে সাধ্যমত স্বদেশ ও স্বজাতির জন্য কল্যাণকর কাজ করা, নতুবা আমরাও মানুষ রূপী পশু হিসেবে গণ্য হবো।
স্বর্ণ তার নিজের সৌন্দর্য দিয়ে অন্যকে সাজায়। পরের সৌন্দর্য বৃদ্ধিতে সে নিজেকে নিবেদন করে। অপরদিকে বাঁশিও কখনো নিজের জন্য সুমধুর, সুরেলা ধ্বনি সৃষ্টি করে না। বরং তার সেই সুর সৃষ্টি হয় শুধুমাত্র অন্যদেরকে মুগ্ধ করার জন্য, আনন্দ দেয়ার জন্য, বিমোহিত করার জন্য। এই স্বর্ণ ও বাঁশির সৃষ্টি যেন শুধুমাত্র অপরের মনোরঞ্জনের জন্য হয়েছে। এখানেই তাদের সৃষ্টির সার্থকতা। স্বর্ণ ও বাঁশির মতো মানব জীবনেরও ধর্ম হলো পরের জন্য কাজ করা, অন্যের মঙ্গলসাধন করা, পরের কল্যাণে নিজের জীবনকে সর্বদাই নিয়োজিত রাখা। ফুল যেমন নিজের জন্য ফোঁটে না। তেমনি মানুষের জীবনও শুধু তার নিজের জন্য নয়। অপরকে ভালোবাসার মধ্যে যে তুষ্টি, পরের জন্য কিছু করার মধ্যে যে প্রশাšি,Í তা আর কোনো কিছুতেই নেই। মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব এই কারণে যে, তার বিচার, বুদ্ধি, বিবেক আছে। মানুষই একমাত্র প্রাণী যে অন্যকে ভালোবেসে তার জন্য নিজেকে উৎসর্গ করতে পারে। আর এই উৎসর্গ করতে পারার মধ্যেই মানবজীবনের সার্থকতা নিহিত। পরোপকারীতার মধ্যেই নিহিত প্রকৃত মহত্ত্ব। অপরের কল্যাণ সাধনের নিমিত্বেই কাজ করেন জগতের সকল মহান ব্যক্তিবর্গ। নিজেদের জীবন ও কর্মকে উৎসর্গ করেন সমগ্র মানবজাতির উৎকর্ষ সাধনে।
শিক্ষা: নিজের জন্য নয়, পরের জন্য নিজের জীবনকে উৎসর্গ করাই মানব জীবনের প্রকৃত লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হওয়া উচিত।
প্রত্যেক মানুষের কাছেই স্বাধীনতা একান্ত কাম্য। কেউ পরাধীন থাকতে চায় না। তবে পরাধীনতা থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন হওয়া অনেক কঠিন। আবার স্বাধীন হওয়ার চেয়ে স্বাধীনতা ধরে রাখা আরো কঠিন। কারণ তখন স্বাধীন রাষ্ট্রের প্রতি স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি অনেক সোচ্চার থাকে। তাই স্বাধীনতা রক্ষার সংগ্রাম আরো বড় হয়ে সামনে আসে। শক্তিশালী শাসক গোষ্ঠীর কাছ থেকে বহুকষ্টের স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনলেও নানা কারণে তা রক্ষা করা কঠিন হয়ে যায়। কারণ স্বাধীন দেশের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা প্রথমদিকে স্বাভাবিকভাবেই দুর্বল থাকে। আর তখন স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি নানাভাবে এসব দুর্বলতার সুযোগ নিতে চায়। এসময় তাদের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। তাই নতুন স্বাধীন হওয়া দেশকে প্রথমে সুগঠিত করতে হয়। দেশের প্রতিটি মানুষকে তাদের জ্ঞান-বিজ্ঞান, বুদ্ধি দিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। সেই সাথে অর্থনীতি, শিল্প, কৃষিসহ সকল অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করতে হয়। ফ্রান্সের বিশিষ্ট সমাজতত্ত্ববিদ রোঁমা রোঁলা বলেছেন- “কোনো দেশ বা জাতিকে শুধু তার সীমান্ত রক্ষা করলেই চলবে না তার শুভ বুদ্ধিকেও রক্ষা করতে হবে। জাতি তার স্বাধীনতা রক্ষা করবে, পাশাপাশি রক্ষা করবে তার চিন্তা ও আত্মার স্বাধীনতা।” স্বাধীনতা অর্জন করতে যেমন সাহসী পদক্ষেপ নিতে হয় তেমনি রক্ষার জন্যও আরো দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ ও সংগ্রামী হতে হবে। স্বাধীনতাকে দীর্ঘস্থায়ী করতে সকলকে সচেতন ও সংঘবদ্ধ হতে হবে। স্বাধীনতাকে মর্যাদা দিতে হবে এবং স্বাধীনতাকে গুরুত্ব দিয়ে সমস্ত বিরোধী শক্তির হাত থেকে দেশকে রক্ষার জন্য দায়িত্ব সচেতন ও নিবেদিত প্রাণ দেশপ্রেমিক হতে হবে।
শিক্ষা: স্বাধীনতা অর্জনের জন্য একটি জাতিকে বহু কষ্ট ও ত্যাগ স্বীকার করতে হয়। আবার এই অর্জিত স্বাধীনতাকে ধরে রেখে নিজেদের অবস্থান আরো উন্নত করার জন্য দেশের সকলকে আরো বেশি দায়িত্ব নিয়ে কাজ করতে হবে।
ক্ষণস্থায়ী মানব জীবনে মানুষ অবিরাম ছুটে চলে সুখের সন্ধানে। কারো কাছে এই সুখ মানে হলে অগাধ অর্থ-সম্পদ, বিত্ত-বৈভব, আরাম-আয়েশ আর বিলাসিতা। আবার কারো কাছে সুখ মানেই হলো পরের জন্য কিছু করা, সমাজ, দশ ও দেশের মঙ্গল সাধন করা। আত্মকেন্দ্রিকতাকে বিসর্জন দিয়ে সকলের ভালোর জন্য কাজ করাকে জীবনের ব্রত হিসেবে নেয়া। যারা শুধু নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকে, নিজের স্বার্থ সিদ্ধিকে জীবনে অবশ্যম্ভাবী মনে করে তারা সবসময়ই পার্থিব সকল ভোগ্য বস্তুর প্রতি আকৃষ্ট হয়। সেসবের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে নিজের আরাম আয়েশ নিশ্চিত করে। এর মাধ্যমে তারা তাদের জীবনের পূর্ণতা খোঁজে, বেঁচে থাকাকে সার্থক মনে করে। কিন্তু এই সবকিছু মানুষকে হয়তো সাময়িক সুখ দিতে পারে। জীবনকে কিছু দিনের জন্য উপভোগ্য করে তুলতে পারে। কিন্তু কখনোই স্বার্থক কিংবা পরিপূর্ণ করতে পারে না। একটা সময়ে এই সুখ আর থাকে না। বেঁচে থাকাকে অর্থহীন মনে হয়। অপরদিকে সত্যিকারের কল্যাণকামী মানুষেরা কখনোই কেবল নিজের সুখের কথা ভাবে না, স্বার্থের কথা ভাবে না। বরং সকলের স্বার্থই তাদের স্বার্থ, সকলের ভালোই তাদের ভালো। তারাই জানে কি করে সত্যিকার অর্থে বেঁচে থাকতে হয়। পরের জন্য জীবন উৎসর্গ করে তারা জীবনকে পরিপূর্ণতা দেয়। পৃথিবীর যত মহান ব্যক্তিদেরকে আমরা মনে রেখেছি তা পরের কল্যাণে নিজেদের উৎসর্গ করার সুবাদেই। কেবল তাদেরকেই আমরা আমাদের মননে, চেতনায় বাঁচিয়ে রেখেছি। অন্যদিকে যারা কেবল নিজের জন্য বেঁচে ছিল তারা চিরদিনের জন্য হারিয়ে গেছে মহাকালের অনন্ত অন্ধকারে। তারা জানতেও পারেনি সত্যিকারের বেঁচে থাকা কাকে বলে আর জীবনের সার্থকতা কোথায়। কিন্তু যারা পরের জন্য নিরন্তর কাজ করে চলেছে তারা জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে সুখকে উপভোগ করে। নিজ স্বার্থ আর সুখের চিন্তা ত্যাগ করে তারা মেতে ওঠে জীবনের অনাবিল আনন্দে। মৃত্যুর আগে ও পরে তারা সমানভাবে বাঁচে। এই বৃহৎ জগৎ-সংসারে প্রকৃত অর্থেই বেঁচে থেকে তারা রচনা করে স্বার্থক জীবন কাহিনী।
শিক্ষা: বেঁচে থাকার অর্থ নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকা নয়। পরের মঙ্গল ও সুখে নিজেকে নিবেদন করে নিজের সুখ সন্ধান করে বেঁচে থাকাই সত্যিকারের বাঁচা।
কোনো ব্যক্তির কথার মাধ্যমে তার সম্পর্কে একটা ধারণা তৈরি হয়। কথাতেই মানুষের মনের ভাব, চাওয়া, পাওয়া প্রকাশ পায়। অন্যের কাছে নিজের ভাব প্রকাশের জন্য বেশি কথা বলার প্রয়োজন হয় না। কিন্তু যে ব্যক্তি বেশি কথা বলে সে কথার মাঝে মিথ্যার আশ্রয় নেয়। যে বেশি কথা বলে তাকে সাধারণত কেউ পছন্দ করে না। কথার মাঝে একটা মিথ্যাকে প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে আরো অনেক মিথ্যা বলতে হয়। আর মিথ্যা কখনও চাপা থাকে না। যে মিথ্যা কথা বলে সে বাচাল ও মিথ্যাবাদী হিসেবে চিহ্নিত হয়। অন্যদিকে পৃথিবীতে যারা মহামানব তাদের জীবনী থেকে জানা যায় তারা কেউই বেশি কথা বলতেন না। তারা কথা নয় কাজে বিশ্বাসী ছিলেন। কাজের সময় বেশি কথা না বলে চিন্তাভাবনা করলে তার সুফল পাওয়া যায়। আবার কথা অনুযায়ী কাজ না করলে ওই ব্যক্তি সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়। পরিমিত কথা গুছিয়ে বললে সে অনুযায়ী কাজ করলে বুদ্ধির পরিচয় ফুটে উঠে। কিন্তু কাজ না করে শুধু কথার মাধ্যমে নিজেকে উপস্থাপন করলে বেশি কথা বলতে হয় এবং কথার মাঝে মিথ্যা বলতে হয় যা কিনা সব দিক থেকেই ক্ষতিকর। কারণ বেশি কথা বলতে গিয়ে মিথ্যা কথা বলা অনকের বদ-অভ্যাসে পরিণত হয়ে যায়। এজন্য পারতপক্ষে মানুষ এ ধরণের বাচাল ও মিথ্যাবাদী লোকদের সঙ্গ থেকে দূরে থাকতে চায়। বুদ্ধিমান ব্যক্তি কখনও বেশি কথা বলে না বরং সে কথা বলার চেয়ে শুনতে বেশি আগ্রহী হয়। যে বেশি কথা বলতে গিয়ে মিথ্যা কথা বলে তাকে কেউ বিশ্বাস করে না। তাই আত্মসম্মানকে বজায় রাখতে হলে প্রয়োজনীয় কথার অতিরিক্ত না বলাই মঙ্গল।
শিক্ষা: মিথ্যা সকল পাপের উৎস। একটা মিথ্যাকে সত্য হিসেবে দাঁড় করাতে চাইলে হাজারো মিথ্যার আশ্রয় নিতে হয়। এ জন্য কথাও বেশি বলতে হয়। তাই কথাকে সংযত করার মাধ্যমে মিথ্যা থেকে অনেকটাই দূরে থাকা সম্ভব।
মানুষ সামাজিক জীব। সামাজিক জীব হিসেবে মানুষকে সমাজে বসবাস করতে হয়। আর সমাজে বসবাস করতে গিয়ে মানুষকে অনেক দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করতে হয়। আমরা যারা শিক্ষার্থী তাদের কর্তব্য হলো পড়াশুনা ঠিক মতো করা। শিক্ষকের দায়িত্ব হলো ছাত্রদের সময় মতো পড়ানো ও পড়া আদায় করা এবং পরীক্ষা নেয়া। ছাত্র শিক্ষক উভয়ে তাদের দায়িত্ব কর্তব্য পালন করলে সামগ্রিক উন্নয়ন ঘটবে। সমাজ অগ্রসর হবে, দেশ উন্নত হবে। ছাত্র-শিক্ষকের মতোই সামাজিক স্তর বিন্যাসের বিভিন্ন অবস্থানে মানুষ অবস্থান করে। তাদের নিজ নিজ দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করতে হয়। আজকের কাজ কালকের জন্য ফেলে রাখা ঠিক নয়। সবারই মধ্যে সহযোগিতামূলক দৃষ্টিভঙ্গি রাখা প্রয়োজন। মানুষকে নিজের কাজ করতে হবে। অন্য একজন কাজ করল কি-না তা সমালোচনা না করে নিজের কাজে মনোনিবেশ করতে হবে। দায়িত্বশীলতার সাথে সবাই তার নিজ নিজ কাজ করলে দেশ উন্নত হবে। আজ চীন, জাপান, সুইজারল্যান্ড, আমেরিকা, কানাডা ও মালয়েশিয়ার মতো দেশ উন্নত দেশ বলে স্বীকৃত। যদি আমরা খোঁজ নেই তাহলে দেখব যে, এ সকল রাষ্ট্রের মানুষ অনেক দায়িত্বশীল ও কর্তব্য পরায়ন। নিজ দায়িত্ব কর্তব্য পালন করলে শ্রেষ্ঠত্বের আসনেও আসীন হওয়া যায়। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্র নায়কদের ও সুধী সমাজকে বিশেষ ভূমিকা পালন করতে হয়। তাই সংসারে প্রত্যেকের যে কাজই থাকুক না কেন, নিত্য তাদেরকে সেই কাজ করতে হবে। দেশকে উন্নতির শিখরে আরোহণ করতে সহযোগিতা করতে হবে।
শিক্ষা: দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনের মধ্য দিয়ে নিজেকে মহৎ করা যায়। সমাজ ও দেশকে উন্নতির শিখরে আরোহণে সহযোগিতা করা যায়।
প্রতিনিয়ত মানুষ পৃথিবীকে সুন্দর করে সাজাতে চায়। চায় মায়া মমতার বন্ধনে আবদ্ধ সুখের সংসার। কিন্তু মানবজীবন পুষ্পশয্যা নয়। সংসারে আছে জটিলতা, নানা সমস্যা আর চাওয়া-পাওয়ার দ্বন্দ্ব। কখনো দুঃখ এসে তছনছ করে দেয় সুখের সাজানো সংসার। স্বপ্ন পূরণের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায় নানা প্রতিবন্ধকতা। জীবনের চরম বিপর্যয়ের দিনগুলোতেও মানুষ আশায় বুক বাঁধে। সংসার সাগরে একদিকে দুঃখ খেলা করে অন্যদিকে সে খেলায় টিকে থাকার জন্য মানুষের অবলম্বন আশা। মানুষ আশাকে ভরসা করেই জীবনতরীর হাল ধরে শক্ত করে। উত্তাল সাগরের বুকে জাহাজ চালানো খুবই কঠিন। তারপরও নাবিক বেঁচে থাকার আশায় তীরে পৌঁছানোর জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করে। তেমনি সংসাররূপ উত্তাল দুঃখের সাগর মানুষ পাড়ি দেয় আশার তরণী ভাসিয়ে। মানুষ রঙিন স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসে, তাই জীবনকে সামনের দিকে নিয়ে যায় এই আশাতে যে,্আগামী দিনগুলো সুন্দর হবে। কোনো দুঃখ কষ্ট থাকবে না। স্বপ্ন একদিন পূরণ হবে, ধরা দিবে বাস্তবে এসে। তাই মানুষের বেঁচে থাকার অবলম্বন হলো আশা। সাফল্যের পথে আশা মানুষকে দেয় প্রেরণা। কেননা, পৃথিবীর সব ছোট-বড় সৃষ্টির পেছনে কাজ করেছে আশা। শত দুঃখ-কষ্ট সহ্য করে যারা আশা নিয়ে পরিশ্রম করে গেছেন তারাই হয়েছেন স্মরণীয়-বরণীয়। কখনো দুঃখের সাগরে হাবুডুবু খেতে খেতে হয়তো দুরাশা এসে মন দখল করতে পারে। কিন্তু সেটা ক্ষণস্থায়ী। দুরাশার দুঃসময়েও মানুষ নতুন করে আশায় উদ্দীপ্ত হয়। চায় নিজের অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখতে। আশাই মানুষের জীবনীশক্তি। তাইতো বলা হয়- ‘আশায় বসতি।’ আশা ভাগ্যহতকে শোনায় জেগে উঠার গান। আশার ভেলায় ভর করেই চলছে পৃথিবী, তৈরি হচ্ছে নতুন নতুন সমাজব্যবস্থা। আশা আছে বলেই শত প্রতিকূলতার মধ্যেও প্রতিটি মানুষ বাঁচতে শেখে।
শিক্ষা: এ ক্ষণস্থায়ী জীবনে মানুষকে নানা বাধা বিঘ্ন পার হতে হয়, পুড়তে হয় দুঃখের আগুনে। কিন্তু আশা মানুষকে পথ দেখায় কীভাবে দুঃখের আগুনে পুড়ে সুখ লাভ করা যায়, প্রকৃত মানুষ হওয়া যায়।
মানুষের প্রকৃত পরিচয় কর্ম ও সাফল্যের ওপর নির্ভর করে। জীবনে উন্নতির মূল চাবিকাঠি হচ্ছে পরিশ্রম। দৈহিক শ্রম দ্বারা মানুষ তার নিজের ভাগ্যকে নির্মাণ করে। পৃথিবীতে অনেক মানুষ আছে যারা কায়িক শ্রমকে ছোট মনে করে, নিজে কাজ করতে অপমানবোধ করে এবং মিথ্যা আর মূর্খতা দ্বারা নিজের গৌরব বৃদ্ধি করতে চায়। কিন্তু মিথ্যা পদে পদে তাদের ধ্বংস ডেকে আনে। মূর্খতা তাদের জীবনে অভিশাপ হয়ে দেখা দেয়। যুগ যুগ ধরে কুলি মজুরের মতো লক্ষ কোটি শ্রমজীবী মানুষের হাতে গড়ে উঠেছে মানবসভ্যতা। এদেরই অক্লান্ত শ্রম আর ঘামে মোটর, জাহাজ, রেলগাড়ি চলছে, গড়ে উঠেছে আকাশছোঁয়া দালানকোঠা। আমাদের দেশের কৃষকরা আমাদের খাদ্যের যোগান দিতে ঝড়-বৃষ্টি রোদ্র উপেক্ষা করে ফসল ফলায়। এ কাজ তাদের কঠিন সাধনার কাজ। এতে তাদের গৌরব কমে না এই কাজের মধ্য দিয়েই তারা পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সাধক রূপে পরিগণিত হয়েছে। আমাদের দেশের অর্থনীতিকে টিকিয়ে রেখেছে এই শ্রমজীবী মানুষ। আমাদের পোশাক শিল্পকে শ্রম দ্বারাই টিকিয়ে রেখেছে শ্রমিকশ্রেণি। আধুনিক বিশ্বের চালিকা শক্তি বিদ্যুৎ উৎপাদনের গুরুত্বপূর্ণ কাচাঁমাল কয়লা, যা উত্তোলন করে শ্রমিকরা। পৃথিবীতে যারা মহামানবের অবিধায় অভিসিক্ত হয়েছেন তারা কায়িক পরিশ্রম করেছেন। তাতে তাদের সম্মান কমেনি বরং বেড়েছে। অন্যের কাছে হাত পেতে ভিক্ষা নেওয়ার মধ্যে কোনো গৌরব নেই। আমেরিকার ষোড়শ প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন বলেছেন- “পাঁচটি টাকা কুড়িয়ে পাওয়ার চেয়ে একটি টাকা উপার্জনের মধ্যে তৃপ্তি অনেক বেশি।” আমাদের প্রিয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম শৈশবে রুটির দোকানে কাজ করেছেন। হাতের কারুকার্যে চিত্রশল্পী কাজ হিসেবে পৃথিবীতে বিখ্যাত হয়েছেন লিওনার্দো-দ্যা-ভিঞ্চি, পাবলো পিকাসো এবং ভ্যানগগের মতো ব্যক্তিবর্গ। মিথ্যা ও মূর্খতা নয় সাধুতা ও সত্যের ভিতর দিয়ে সত্তার মহিমা উদ্ভাসিত হয়। কাজের মাধ্যমে সমাজ স্বনির্ভর হয় এতে মানুষের অফুরন্ত শক্তির প্রকাশ ঘটে।
শিক্ষা: আমাদের কর্মশক্তি ভরা দুটি সবল হাত রয়েছে যা দ্বারা জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার সমন¦য়ে আমরা পেতে পারি সার্থক জীবনের সন্ধান এবং আত্মপ্রতিষ্ঠার শক্তি।
চলার পথ বাধাহীন, সাবলীল নয়। তাই বলে নিজেকে দুঃখী-হতভাগা ভাবার কোনো কারণ নেই। বরং সব বাধা বিপত্তি অতিক্রম করে আনন্দকে জয় করে চারপাশে ছড়িয়ে দিতে হবে। অদৃষ্টকে পাশ কাটিয়ে না গিয়ে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে ভয়কে জয় করার মানসিক শক্তি অর্জন করতে হবে। নিজেকে বিশ্বাস করাতে হবে যে, আমিও পারব, থাকতে হবে আনন্দ সৃষ্টির নিরন্তর প্রয়াস। আপন কর্মের মাধ্যমে পরিবর্তন করতে হবে অদৃষ্টকে। সে যাত্রায় হয়তো মুখ থুবড়ে পড়তে হবে বারবার। হয়তো ভাগ্যের হাতে বড় নির্মমভাবে নিপীড়িত, নিগৃহীতও হতে হবে। তবুও উঠে দাঁড়াতে হবে আশায় বুক বেঁধে তা অর্জন করার সাহস নিয়ে। আর যেখানে স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরআনে ঘোষণা করেছেন- ‘আল্লাহ, কোনো জাতির ভাগ্য ততক্ষণ পরিবর্তন করেন না, যতক্ষণ না তারা নিজেরা নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তন করে।’ তাই কোনো কাজে সফলতা অর্জন করতে হলে ধৈর্য ও সহিষ্ণুতার মাধ্যমে নিরবিচ্ছিন্ন চেষ্টা করাই একমাত্র উপায়। যিনি জানেন, জীবন হলো সুখ-দুঃখময় এক অনিবার্য পরিবর্তনশীল ক্ষেত্র, তিনি দুঃখের দিনে হতাশায় ভেঙে পড়েন না। দুঃখ-বিপাককে জীবনের অমোঘ পাথেয় হিসেবে মেনে নিয়ে দিনবদলের সংগ্রামে নামেন। দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদবিরোধী অবিসংবাদিত নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা বলেছেন- ‘সাহস মানে ভয়ের অনুপস্থিতি নয় বরং ভয়কে জয় করা। সে সাহসী নয়, যে ভীতি অনুভব করে না বরং সে-ই সাহসী যে ভীতিকে জয় করে।’ যদিও এই ভয় বা আতংকই কিছু মানুষের জীবনের সব সুখ শান্তি কেড়ে নেয়। কিন্তু ভয়ের মুখোমুখি হয়ে জয় করার মাধ্যমে অর্জিত হয় আত্মতুষ্টি ও তাৎপর্যপূর্ণ প্রশান্তি যা জীবনে এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা।
শিক্ষা: মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়। মানুষের অসাধ্য কিছুই নেই, ইচ্ছাই তার প্রধান চালিকা শক্তি। যার মাধ্যমে সে তার কাক্সিক্ষত স্বপ্নচূড়ায় আরোহণ করতে পারে।
মহাকাল অনাদি, অনন্ত ও নিরবিচ্ছিন্ন। মহাকালের এই অনন্ত ব্যাপ্তির মধ্যে রয়েছে ত্রিমাত্রিক কালবিন্দু-অতীত, বর্তমান আর ভবিষ্যৎ। ক্ষুদ্রায়ু মানুষের পক্ষে মহাকালের অখ- প্রবাহকে উপলদ্ধি করা কখনোই সম্ভব নয়। তাই মানুষ সময়কে উপলদ্ধি করে অতীত বর্তমান আর ভবিষ্যতের সীমারেখায়। মানুষের জীবনচর্চায় বর্তমান হলো অস্তিত্বময় এক কালপর্ব, ভবিষ্যৎ হলো কল্পনা বিস্তারের এক অনাগত স্বপ্ন। আর অতীত হলো ধূসর স্মৃতির রাজ্য। জীবনের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ধারাবাহিক অংশ যা একদিন বর্তমান ছিল, মহাকালের ঘূর্ণাবর্তে লাভ করে বর্তমান ও ভবিষ্যতের সৌধ। আসলে অতীত নেপথ্যে থেকে নীরবে নিঃশব্দে বর্তমানকে প্রণোদিত করে। বর্তমানে যে সাফল্য, যে সঞ্চয়, যে অর্জন তা অতীতের অভিজ্ঞতা ও কর্মজ্ঞান থেকেই প্রাপ্ত। অতীত বিরাট মহীরুহের ন্যায় কর্ম, জ্ঞান ও সংস্কৃতি নিয়ে কাজ করে চলেছে মানুষের ওপর, একটি জাতীর উপর। বর্তমানের জীবন, সংস্কার, সংস্কৃতি অতীতের জীবনের বীজ থেকে উৎপন্ন। অতীতের বীজাঙ্কুর থেকেই জন্ম নেয় বর্তমানের বিশাল মহীরূহ। অতীতের শ্রম, সাধনা, কর্ম বর্তমান ও ভবিষ্যৎ জীবনের জন্য বয়ে আনে সমৃদ্ধি ও সাফল্য। অতীতের ব্যর্থতা বর্তমানকে সতর্কভাবে গড়ে তোলার শিক্ষা দেয়। অতীতের শিক্ষা মানুষকে সঠিক ও সতর্কভাবে পথ চলার নির্দেশ দেয়। জীবনে চলার পথে মানুষ যখন হোঁচট খেয়ে থমকে দাঁড়ায়, বিচলিত সঙ্কটে মানুষ তখন মূল্যায়ন করে অতীতকে। আজকের বর্তমান আগামী দিনে অতীত হয়ে মানুষকে অভিজ্ঞতার আলোকে পথনির্দেশ করবে, তাই আজকের বর্তমানকে সুন্দর ও অভিজ্ঞতাময় করে তোলা অত্যন্ত জরুরী।
শিক্ষা: অতীত মানবজীবনের এক অবিচ্ছেদ্য কালপর্ব। অতীত নেপথ্যে থেকে পরিচালনা করে বর্তমান ও ভবিষ্যতকে। তাই অতীতকে মূল্যায়ন করার মাধ্যমে বর্তমান ও ভবিষ্যতকে সাফল্যমন্ডিত করে তুলতে হবে।
পৃথিবীর যাবতীয় সম্পদ, ঐশ্বর্য ভোগ উপভোগ করার জন্য সকলই মানুষের সৃষ্টি। কিন্তু অনেক মানুষের শ্রেষ্ঠত্বের গুণে তাদের হৃদয় অহমিকায় পূর্ণ। তাই, এক মানুষ অন্য মানুষের মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টি করে- ঐশ্বর্যবান ব্যক্তি দীনহীনের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে। অর্থনৈতিক পার্থক্যই এ বিভেদ সৃষ্টির কারণ। এছাড়া জাতি, ধর্ম, বর্ণ ইত্যাদি নিয়ে নানা সংস্কারের কারণে মানুষের মধ্যে পার্থক্য থাকে। কিন্তু এই উঁচু নিচুর পার্থক্য মানুষের সামাজিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করে। মানুষ হয়ে ওঠে কৃত্রিম ও স্বার্থপর। এক মানুষ অন্য মানুষের সাথে ঝগড়া, বিবাদ, ঘৃণা ও বিদ্বেষে জড়িয়ে পড়ে। ফলে, মানুষের মধ্যে থেকে মানবিকতাবোধের মতো সাধারণ গুণও লোপ পায়। মানুষ হয়ে ওঠে হিংস্র। তার মধ্যে হিংসাত্মক প্রবণতা বেড়ে যায়। অভিজাত শ্রেণির কাছে সাধারণ মানুষ নিষ্পেষিত হয়। এভাবে এক সময় মানুষ নীতি ও আদর্শ বিবর্জিত কাজ করতেও দ্বিধা করে না। কিন্তু মানুষ ভুলে যায় জীবনের প্রয়োজনেই সবকিছুর আয়োজন করা হয়েছে। তাই কোনো কিছু জীবনের চেয়ে বড় হতে পারে না। মানুষের মর্যাদা দেয়া হলে হিংসার পথ পরিহার করে মানুষের মধ্যে সম্প্রীতি বজায় রাখলে সুখস্বচ্ছন্দ্য বজায় থাকবে। মানুষের মর্যাদা সবকিছুর ঊর্ধ্বে। মানুষের মধ্যে ছোট বড় ভেদ থাকা অর্থহীন। মানুষকে তার স্বীয় মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করতে হলে অন্যকে সম্মান করতে হবে। মানুষ যে গোত্রেরই হোক, যত দরিদ্রই হোক তাকে মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। অমানবিকতা দূর করে মানুষের সৎ গুণাবলির উত্তরণ ঘটাতে হবে। কারণ, অন্য প্রাণী থেকে মানুষের পার্থক্য হচ্ছে তার মনুষ্যত্ববোধে। মধ্যযুগের কবি চণ্ডীদাস সবার উপরে মানুষকে স্থান দিয়েছেন। তেমনি হাজী মুহাম্মদ মুহসীন, রনদা প্রসাদ সাহা আলফ্রেড, নোবেল, মাদার তেরেসা সকলেই মানুষের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করে আমাদের কাছে দৃষ্টান্ত হয়ে আছেন। মানুষের প্রতি অনুগ্রহ, সহমর্মিতা ইত্যাদি সঙ্গতভাবেই প্রত্যাশিত। পৃথিবীর সব মানুষকে নিয়েই মানুষের প্রকৃত সত্ত্বা। সেই সত্ত্বা মানুষের সর্বমানবিক সত্ত্বা, যা জাগিয়ে তোলার মধ্যেই রয়েছে যথার্থ মানুষ হয়ে ওঠা।
জ্ঞান : ধনী-নির্ধন সবাই পারস্পরিক বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে সম্প্রীতির এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে এটাই কাম্য।
সুজনে সু-যশ গায় কু-যশ ঢাকিয়া কুজনে কু-রব করে সু-রব নাশিয়া।
দোষ-গুণ এই দুই মিলিয়েই মানুষ। কারো ক্ষেত্রে গুণের পাল্লাটা ভারি কারো বা দোষের পাল্লা। কিন্তু যার একটি মাত্র দোষ ও নেই কিংবা একটি মাত্র গুণ ও নেই সে কখনো মানুষ হতে পারে না। সে হবে মানুষের বাইরে অন্য কিছু। হয়তো ফেরেশতা নয়তো পশু। প্রকৃতপক্ষে যারা ভালো মানুষ অর্থাৎ সুজন তারা মানুষের ভেতরের ভালোটাকেই চেনে। অন্যকে তারা ভালো চোখে দেখে। খুব সহজেই তারা মানুষের গুণগুলোকে, ভালো দিকগুলোকে চিহ্নিত করতে পারে। সেই সাথে ব্যক্তির দোষগুলোও তাদের দৃষ্টি এড়ায় না। কিন্তু তারা ভালো মানুষ বলেই, অন্যের দোষ ত্রুটি মানুষের সামনে প্রকাশ করে না।কাউকে ছোট করে না। কারো কুৎসা রটনা করে না। বরং ব্যক্তির গুণগুলোকেই তারা জনসম্মুখে নিয়ে আসে। ব্যক্তিকে প্রশংসিত ও মহিমান্বিত করে। এর মাধ্যমে অজান্তেই সুজনের নিজের মাহাত্ম্যও প্রকাশ পায়। কারো গুণের প্রচার করতে তার দ্বিধা হয় না। মনের ভেতর জড়তা থাকে না। বরং মানুষের ভেতরে ভালো কিছু আবিষ্কারের নেশায় সে উপভোগ করে অপার আনন্দ। অপরদিকে যারা হীন প্রকৃতির মানুষ তারা কখনোই অন্যের ভালো দেখতে পারে না। তাই এই কুজনেরা মানুষের ভালো দিকগুলো না খুঁজে ত্রুটি খুঁজে বের করে এবং তা প্রচার করে। কারো ভালো কিছু তাদের দৃষ্টি গোচর হয় না। এমনকি সেই ভালোগুণকেও দোষের মোড়কে আবৃত করে তারা মানুষের সামনে আনতে চায়। অন্যের দোষ নিয়েই তারা মাতামাতি করে। কারো গুণ প্রকাশ করতে হীন ব্যক্তিরা দ্বিধাবোধ করে, ভয় পায়, ঈষান্বিত হয়। কারো সম্পর্কে ভালো কথা বলা কুজনের স্বভাবে নেই। তারা দ্বিধাহীন চিত্তে অন্যের দোষ বর্ণনাকেই জীবনের ব্রত হিসেবে নেয়। কিন্তু এতে করে তারা কেবল নিজেদের দুর্বলতাকেই প্রকাশ করে না বরং হীনরুচিরও পরিচয় দেয়। আর সমাজ-সংসারে নিজেকে নীচ বলে প্রমাণ করে।
শিক্ষা: আদিকাল থেকেই সমাজে ভাল-খারাপ মানুষ ছিল, থাকবে এবং যার যার মতো কাজ করবে। আমাদেরকে শুধু এই ভাল-খারাপের পার্থক্য বুঝে তাদেরকে চিহ্নিত করতে হবে। নিজ দায়িত্বে খারাপ মানুষ থেকে দূরে থাকতে হবে।
সেই ধন্য নরকুলে লোকে যারে নাহি ভুলে মনের মন্দিরে নিত্য সেবে সর্বজন।
মানুষ মরণশীল। একটি নির্দিষ্ট সময় পর প্রতিটি মানুষই মৃত্যুবরণ করে। অর্থাৎ খুব অল্প সময়ের জন্যই মানুষ পৃথিবীতে আসে। এই অল্প সময়েই তাকে করে যেতে হয় অনেক কাজ, অনেক সাধনা। কাজ ফুরাবার আগেই হয়তো বেজে ওঠে তার বেলা শেষের গান। দীর্ঘশ্বাস আর অতৃপ্তি বুকে নিয়ে তাকে চলে যেতে হয়, এটাই নিয়ম। এই নিঃশব্দে চলে যাওয়ার মাঝে বেদনা আছে, তবে সেই সাথে আছে সান্তনাও। কারণ মানুষ চলে যায় কিন্তু রেখে যায় তার কর্ম। প্রবাদ আছে- ‘মানুষ বাঁচে তার কর্মের মধ্যে, বয়সের মধ্যে নয়।’ কিছু মানুষ আছে যারা আত্মসুখের চেয়ে মানবতার সেবাকে মহৎ বলে বিবেচনা করে। এ ধরণের পরোপকারী সজ্জনের অবদানে মানুষ উপকৃত হয়। শ্রদ্ধাভরে মানুষ স্মরণ করে তাদের উপকারের কথা। মহৎ গুণাবলী ও পরোপকার ব্রতের দ্বারা যিনি মানুষের মনে ঠাঁই করে নিয়েছেন, প্রতিনিয়তই মানুষ তাকে হৃদয়ের মধ্যে অনুভব করে। এ ধরণের মানুষই ধন্য। জীবন কেবল তখনই সার্থক হয় যখন মানুষের হৃদয়ে কেউ নিত্য পূজা লাভ করে। যারা নিজ সার্থকে বিসর্জন দিয়ে পরের কল্যাণে নিজেকে বিলিয়ে দিতে পারে তারাই মৃত্যুঞ্জয়ী মহিমায় ভাস্বর। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায়- ‘নিঃশেষে প্রাণ, যে করিবে দান, ক্ষয় নাই, তার ক্ষয় নাই।’ অর্থাৎ পরার্থ কামনার এই ব্রতে যিনি আত্মসুখকে বিসর্জন দিয়ে বৃহৎ জগতের মাঝে ঠাঁই নিয়েছেন, জীবনের ভিড়ে যিনি জীবকে খুঁজে নিয়েছেন, মৃত্যুর পরও মানুষের ধ্যানলোকে তিনি অমর।
শিক্ষা: জীবন একটাই। তাই এই জীবনে আমাদের সবার লক্ষ্য যেন হয় মানবের কল্যাণে নিজেকে নিয়োজিত করা। জীবন ও জগতের জন্য কল্যাণকর কর্মের মাধ্যমেই আমরা হয়ে উঠতে পারব স্মরনীয় ও বরণীয়।
সৎ সঙ্গে স্বর্গবাস অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ।
মানুষ সামাজিক জীব। সে চাইলেই একা থাকতে পারে না। সমাজে বসবাস করতে হলে সব ধরণের মানুষের সাথে চলাফেরা করতে হয়। সেখানে ভালো মানুষ যেমন আছে তেমনি খারাপ মানুষও আছে। তবে জন্মগত ভাবে মানুষ খারাপ হয় না। পরিবেশ, পরিস্থিতি, আর সঙ্গী সাথীর কারণে মানুষের চরিত্র কলঙ্কিত হয়। তাই বন্ধু নির্বাচনের ক্ষেত্রে সচেতন থাকতে হবে। সৎ বন্ধু ভালো পরামর্শ দিয়ে, সহযোগিতা করে জীবনের লক্ষ্যে পৗঁছাতে সাহায্য করে। জীবনকে সুন্দর ও অর্থবহ করে তুলতে পারে সৎ সঙ্গ। তাই সৎ সঙ্গ সবাই কামনা করে। সৎ সঙ্গের বিপরীত হচ্ছে অসৎ সঙ্গ। যাদের মাধ্যমে কখনই ভালো কিছু আশা করা যায় না। সৎ সঙ্গীর পরামর্শ অনেক সাফল্য এনে দিতে পারলেও অসৎ সঙ্গীর পরামর্শ জীবনকে ধ্বংস করে দিতে পারে। একজন মানুষ ভালো কি মন্দ তা বোঝা যায় তার বন্ধু নির্বাচনের মাধ্যমে। কোনো মানুষের বন্ধু বা সঙ্গী যদি ভালো না হয় তবে তাকে সবাই খারাপ মনে করে। অসৎ সঙ্গীর কারণে ভালো মানুষও একসময় বিপথে চলে যায়। অন্যদিকে সৎ সঙ্গ জীবনকে সাফল্যমন্ডিত করে তোলে। মানুষ যখন কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারে না তখন একজন ভালো বন্ধু সৎ পরামর্শ দিয়ে সাহায্য করতে পারে। কোনো মানুষের আচরণ, চরিত্র কেমন হবে সেটা বোঝা যায় তার সঙ্গী-সাথী দেখে। মানুষ তার সঙ্গী দ্বারা অনেকটাই প্রভাবিত হয়। ভালো মানুষের সঙ্গ খারাপ ব্যক্তিকেও ভালো করে, আবার খারাপ মানুষের সংস্পর্শে ভালো মানুষও ধীরে ধীরে খারাপ হয়ে উঠে।
শিক্ষা: ভালো সঙ্গীর অভাবে অনেক সময় মানুষের জীবন নষ্ট হয়ে যায়। আবার অনেকের জীবন সফল হয়ে ওঠে শুধু সৎ সঙ্গে চলার কারণে। তাই জীবনকে সুন্দর করতে চাইলে সৎ সঙ্গী গ্রহণ, আর অসৎ সঙ্গী বর্জন করতে হবে।
স্পষ্টভাষী শত্রু, নির্বাক মিত্র অপেক্ষা ভালো ।
একজন ভালো বা প্রকৃত বন্ধু প্রতিটি মানুষের জীবনেই কাম্য। প্রকৃত বন্ধুর বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, আনন্দ-বেদনায়, সুখে-দুঃখে, বিপদে-আপদে, কষ্ট-হতাশায় সব সময় সে বন্ধুর পাশে থাকে। মানুষ যখন বিপথে চলে যায়, তখন একজন প্রকৃত বন্ধু তাকে পথে ফিরিয়ে আনে। কিন্তু অনেক সময় দেখা যায়, বন্ধুত্ব নষ্ট হওয়ার আশঙ্কায় বন্ধুর খারাপ দিকগুলো অন্য বন্ধু ধরিয়ে দেয় না। নির্বাক দর্শকের ভূমিকা পালন করে। ফলে সে ভুল পথে পরিচালিত হয়, নিজেকে শুধরিয়ে নিতে পারে না। এতে ঐ বন্ধুর চরম ক্ষতি সাধন হয়। স্পষ্টবাদিতা মানুষের অন্যতম মহৎ গুণ, যা নির্বাক বন্ধুর থাকে না। স্পষ্টভাষী শত্রু স্পষ্টভাবে তার খারাপ দিকগুলো তাকে ধরিয়ে দেয় বা খারাপ দিকগুলোর সমালোচনা করে। এতে সে তার ভুল বুঝতে পেরে সঠিক পথে ফিরে আসতে পারে। মন্দ ব্যাপারগুলো বুঝতে পেরে নিজেকে শুধরিয়ে নিতে পারে। তাই বলা চলে স্পষ্টভাষী শত্রুই প্রকৃত বন্ধু।
শিক্ষা: নির্বাক বন্ধু অপেক্ষা একজন স্পষ্টভাষী শত্রু ভালো। কারণ স্পষ্টবাদী শত্রু একজন প্রকৃত মহৎ বন্ধুর ভূমিকাই পালন করে থাকে। তাই মানুষের জীবনে নির্বাক বন্ধু অপেক্ষা, একজন স্পষ্টভাষী শত্রুই কাম্য।
স্বদেশের উপকারে নেই যার মন কে বলে মানুষ তারে, পশু সেই জন।
বিশিষ্ট সাহিত্যিক সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজী বলেছেন- ‘একজন মানুষ নানা গুণের অধিকারী হতে পারে, কিন্তু সে যদি দেশের কোনো কল্যাণ না করে থাকে, তাহলে প্রকৃত প্রস্তাবে সে নরাধম, ঘৃণিত, বর্বর।’ মানুষের প্রকৃত পরিচয় দেশের প্রতি তার দৃষ্টিভঙ্গি ও কর্মকান্ড দ্বারাই নির্ধারিত হয়। ইসলাম ধর্মে বলা হয়েছে- ‘দেশপ্রেম ঈমানের অঙ্গ।’ সনাতন হিন্দু ধর্মে বলা হয়েছে- ‘জন্মভূমি স্বর্গস্বরূপ, মাতৃস্থানীয়; তাকে রক্ষা করা সবার একান্ত কর্তব্য।’ পশুর সঙ্গে মানুষের কিছু পার্থক্য রয়েছে। পশুর কাজ খাদ্য ও বাসস্থানের জন্য আস্তানার চিন্তা করা এবং এর জন্য ক্ষেত্রবিশেষে অন্যান্য পশুর সাথে লড়াই করা। যে মানুষ কেবল বৈষয়িক নানা কর্মকান্ডের সঙ্গে জড়িত থেকে নিজের স্বার্থ ও সুখের প্রচেষ্টা করে জীবন পার করে দেয়, দেশ ও দেশের জন্য কিছু করে না, দেশের কল্যাণে মনোনিবেশ করে না, প্রকৃত প্রস্তাবে সে ঐ পশুর মতোই। কারণ তার কর্মকান্ডের সাথে পশুর কর্মকান্ডের কোনো প্রভেদ নেই। দেশ প্রেমিকেরাই প্রকৃত মানুষ। যারা শ্রম দিয়ে, অর্থ দিয়ে দেশ ও জাতির নিরন্তর সেবা করে যাচ্ছে তারাই শ্রেষ্ঠ মানুষ। দেশপ্রেমিকেরা কখনো মাথা নত করে না। তাই তো প্যালেস্টাইনের এক কবি বলেছেন- ‘স্বদেশের মাটি স্পর্শ করার সময় ছাড়া আমার শির আর কখনো নত হয় না।’ স্বদেশের মঙ্গল ও কল্যাণের দিকে যার কোনো দৃষ্টি নেই, কেবল নিজের স্বার্থের জন্য, নিজের সুবিধা প্রাপ্তির জন্য যে তৎপর, বিবেকহীন পশুর সাথে তার কোনো পার্থক্যই নেই। এর উদাহরণ আছে আমাদের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসেই। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় একদল নরপশুর আবির্ভাব ঘটেছিল, যারা আমাদের স্বাধীনতার বিরোধী শক্তি রূপে কাজ করেছে। নিজেদের স্বার্থের জন্য যারা দেশের স্বাধীনতাকে পর্যন্ত অস্বীকার করেছে তারা আসলে পশুর চেয়েও অধম। ইংরেজি সাহিত্যের কবি বায়রন বলেছেন- ‘যে তার দেশকে ভালোবাসতে পারে না, সে কিছুই ভালোবাসতে পারে না।’ দেশকে, সমাজকে যে উন্নয়নের দিকে অগ্রসর করতে চেষ্টা না করে সে দেশ ও সমাজের জন্য কলঙ্ক হয়ে বেঁচে থাকে।
শিক্ষা: আমাদের সবারই উচিত যার যার অবস্থান থেকে সাধ্যমত স্বদেশ ও স্বজাতির জন্য কল্যাণকর কাজ করা, নতুবা আমরাও মানুষ রূপী পশু হিসেবে গণ্য হবো।
স্বর্ণ করে নিজ রূপে অপরে শোভিত বংশী করে নিজ স্বরে অপরে মোহিত।
স্বর্ণ তার নিজের সৌন্দর্য দিয়ে অন্যকে সাজায়। পরের সৌন্দর্য বৃদ্ধিতে সে নিজেকে নিবেদন করে। অপরদিকে বাঁশিও কখনো নিজের জন্য সুমধুর, সুরেলা ধ্বনি সৃষ্টি করে না। বরং তার সেই সুর সৃষ্টি হয় শুধুমাত্র অন্যদেরকে মুগ্ধ করার জন্য, আনন্দ দেয়ার জন্য, বিমোহিত করার জন্য। এই স্বর্ণ ও বাঁশির সৃষ্টি যেন শুধুমাত্র অপরের মনোরঞ্জনের জন্য হয়েছে। এখানেই তাদের সৃষ্টির সার্থকতা। স্বর্ণ ও বাঁশির মতো মানব জীবনেরও ধর্ম হলো পরের জন্য কাজ করা, অন্যের মঙ্গলসাধন করা, পরের কল্যাণে নিজের জীবনকে সর্বদাই নিয়োজিত রাখা। ফুল যেমন নিজের জন্য ফোঁটে না। তেমনি মানুষের জীবনও শুধু তার নিজের জন্য নয়। অপরকে ভালোবাসার মধ্যে যে তুষ্টি, পরের জন্য কিছু করার মধ্যে যে প্রশাšি,Í তা আর কোনো কিছুতেই নেই। মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব এই কারণে যে, তার বিচার, বুদ্ধি, বিবেক আছে। মানুষই একমাত্র প্রাণী যে অন্যকে ভালোবেসে তার জন্য নিজেকে উৎসর্গ করতে পারে। আর এই উৎসর্গ করতে পারার মধ্যেই মানবজীবনের সার্থকতা নিহিত। পরোপকারীতার মধ্যেই নিহিত প্রকৃত মহত্ত্ব। অপরের কল্যাণ সাধনের নিমিত্বেই কাজ করেন জগতের সকল মহান ব্যক্তিবর্গ। নিজেদের জীবন ও কর্মকে উৎসর্গ করেন সমগ্র মানবজাতির উৎকর্ষ সাধনে।
শিক্ষা: নিজের জন্য নয়, পরের জন্য নিজের জীবনকে উৎসর্গ করাই মানব জীবনের প্রকৃত লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হওয়া উচিত।
স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে রক্ষা করা কঠিন।
প্রত্যেক মানুষের কাছেই স্বাধীনতা একান্ত কাম্য। কেউ পরাধীন থাকতে চায় না। তবে পরাধীনতা থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন হওয়া অনেক কঠিন। আবার স্বাধীন হওয়ার চেয়ে স্বাধীনতা ধরে রাখা আরো কঠিন। কারণ তখন স্বাধীন রাষ্ট্রের প্রতি স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি অনেক সোচ্চার থাকে। তাই স্বাধীনতা রক্ষার সংগ্রাম আরো বড় হয়ে সামনে আসে। শক্তিশালী শাসক গোষ্ঠীর কাছ থেকে বহুকষ্টের স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনলেও নানা কারণে তা রক্ষা করা কঠিন হয়ে যায়। কারণ স্বাধীন দেশের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা প্রথমদিকে স্বাভাবিকভাবেই দুর্বল থাকে। আর তখন স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি নানাভাবে এসব দুর্বলতার সুযোগ নিতে চায়। এসময় তাদের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। তাই নতুন স্বাধীন হওয়া দেশকে প্রথমে সুগঠিত করতে হয়। দেশের প্রতিটি মানুষকে তাদের জ্ঞান-বিজ্ঞান, বুদ্ধি দিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। সেই সাথে অর্থনীতি, শিল্প, কৃষিসহ সকল অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করতে হয়। ফ্রান্সের বিশিষ্ট সমাজতত্ত্ববিদ রোঁমা রোঁলা বলেছেন- “কোনো দেশ বা জাতিকে শুধু তার সীমান্ত রক্ষা করলেই চলবে না তার শুভ বুদ্ধিকেও রক্ষা করতে হবে। জাতি তার স্বাধীনতা রক্ষা করবে, পাশাপাশি রক্ষা করবে তার চিন্তা ও আত্মার স্বাধীনতা।” স্বাধীনতা অর্জন করতে যেমন সাহসী পদক্ষেপ নিতে হয় তেমনি রক্ষার জন্যও আরো দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ ও সংগ্রামী হতে হবে। স্বাধীনতাকে দীর্ঘস্থায়ী করতে সকলকে সচেতন ও সংঘবদ্ধ হতে হবে। স্বাধীনতাকে মর্যাদা দিতে হবে এবং স্বাধীনতাকে গুরুত্ব দিয়ে সমস্ত বিরোধী শক্তির হাত থেকে দেশকে রক্ষার জন্য দায়িত্ব সচেতন ও নিবেদিত প্রাণ দেশপ্রেমিক হতে হবে।
শিক্ষা: স্বাধীনতা অর্জনের জন্য একটি জাতিকে বহু কষ্ট ও ত্যাগ স্বীকার করতে হয়। আবার এই অর্জিত স্বাধীনতাকে ধরে রেখে নিজেদের অবস্থান আরো উন্নত করার জন্য দেশের সকলকে আরো বেশি দায়িত্ব নিয়ে কাজ করতে হবে।
স্বার্থমগ্ন যেজন বিমুখ বৃহৎ জগৎ হতে, সে কখনো শেখেনি বাঁচিতে।
ক্ষণস্থায়ী মানব জীবনে মানুষ অবিরাম ছুটে চলে সুখের সন্ধানে। কারো কাছে এই সুখ মানে হলে অগাধ অর্থ-সম্পদ, বিত্ত-বৈভব, আরাম-আয়েশ আর বিলাসিতা। আবার কারো কাছে সুখ মানেই হলো পরের জন্য কিছু করা, সমাজ, দশ ও দেশের মঙ্গল সাধন করা। আত্মকেন্দ্রিকতাকে বিসর্জন দিয়ে সকলের ভালোর জন্য কাজ করাকে জীবনের ব্রত হিসেবে নেয়া। যারা শুধু নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকে, নিজের স্বার্থ সিদ্ধিকে জীবনে অবশ্যম্ভাবী মনে করে তারা সবসময়ই পার্থিব সকল ভোগ্য বস্তুর প্রতি আকৃষ্ট হয়। সেসবের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে নিজের আরাম আয়েশ নিশ্চিত করে। এর মাধ্যমে তারা তাদের জীবনের পূর্ণতা খোঁজে, বেঁচে থাকাকে সার্থক মনে করে। কিন্তু এই সবকিছু মানুষকে হয়তো সাময়িক সুখ দিতে পারে। জীবনকে কিছু দিনের জন্য উপভোগ্য করে তুলতে পারে। কিন্তু কখনোই স্বার্থক কিংবা পরিপূর্ণ করতে পারে না। একটা সময়ে এই সুখ আর থাকে না। বেঁচে থাকাকে অর্থহীন মনে হয়। অপরদিকে সত্যিকারের কল্যাণকামী মানুষেরা কখনোই কেবল নিজের সুখের কথা ভাবে না, স্বার্থের কথা ভাবে না। বরং সকলের স্বার্থই তাদের স্বার্থ, সকলের ভালোই তাদের ভালো। তারাই জানে কি করে সত্যিকার অর্থে বেঁচে থাকতে হয়। পরের জন্য জীবন উৎসর্গ করে তারা জীবনকে পরিপূর্ণতা দেয়। পৃথিবীর যত মহান ব্যক্তিদেরকে আমরা মনে রেখেছি তা পরের কল্যাণে নিজেদের উৎসর্গ করার সুবাদেই। কেবল তাদেরকেই আমরা আমাদের মননে, চেতনায় বাঁচিয়ে রেখেছি। অন্যদিকে যারা কেবল নিজের জন্য বেঁচে ছিল তারা চিরদিনের জন্য হারিয়ে গেছে মহাকালের অনন্ত অন্ধকারে। তারা জানতেও পারেনি সত্যিকারের বেঁচে থাকা কাকে বলে আর জীবনের সার্থকতা কোথায়। কিন্তু যারা পরের জন্য নিরন্তর কাজ করে চলেছে তারা জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে সুখকে উপভোগ করে। নিজ স্বার্থ আর সুখের চিন্তা ত্যাগ করে তারা মেতে ওঠে জীবনের অনাবিল আনন্দে। মৃত্যুর আগে ও পরে তারা সমানভাবে বাঁচে। এই বৃহৎ জগৎ-সংসারে প্রকৃত অর্থেই বেঁচে থেকে তারা রচনা করে স্বার্থক জীবন কাহিনী।
শিক্ষা: বেঁচে থাকার অর্থ নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকা নয়। পরের মঙ্গল ও সুখে নিজেকে নিবেদন করে নিজের সুখ সন্ধান করে বেঁচে থাকাই সত্যিকারের বাঁচা।
সে কহে বিস্তর মিছা, যে কহে বিস্তর।
কোনো ব্যক্তির কথার মাধ্যমে তার সম্পর্কে একটা ধারণা তৈরি হয়। কথাতেই মানুষের মনের ভাব, চাওয়া, পাওয়া প্রকাশ পায়। অন্যের কাছে নিজের ভাব প্রকাশের জন্য বেশি কথা বলার প্রয়োজন হয় না। কিন্তু যে ব্যক্তি বেশি কথা বলে সে কথার মাঝে মিথ্যার আশ্রয় নেয়। যে বেশি কথা বলে তাকে সাধারণত কেউ পছন্দ করে না। কথার মাঝে একটা মিথ্যাকে প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে আরো অনেক মিথ্যা বলতে হয়। আর মিথ্যা কখনও চাপা থাকে না। যে মিথ্যা কথা বলে সে বাচাল ও মিথ্যাবাদী হিসেবে চিহ্নিত হয়। অন্যদিকে পৃথিবীতে যারা মহামানব তাদের জীবনী থেকে জানা যায় তারা কেউই বেশি কথা বলতেন না। তারা কথা নয় কাজে বিশ্বাসী ছিলেন। কাজের সময় বেশি কথা না বলে চিন্তাভাবনা করলে তার সুফল পাওয়া যায়। আবার কথা অনুযায়ী কাজ না করলে ওই ব্যক্তি সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়। পরিমিত কথা গুছিয়ে বললে সে অনুযায়ী কাজ করলে বুদ্ধির পরিচয় ফুটে উঠে। কিন্তু কাজ না করে শুধু কথার মাধ্যমে নিজেকে উপস্থাপন করলে বেশি কথা বলতে হয় এবং কথার মাঝে মিথ্যা বলতে হয় যা কিনা সব দিক থেকেই ক্ষতিকর। কারণ বেশি কথা বলতে গিয়ে মিথ্যা কথা বলা অনকের বদ-অভ্যাসে পরিণত হয়ে যায়। এজন্য পারতপক্ষে মানুষ এ ধরণের বাচাল ও মিথ্যাবাদী লোকদের সঙ্গ থেকে দূরে থাকতে চায়। বুদ্ধিমান ব্যক্তি কখনও বেশি কথা বলে না বরং সে কথা বলার চেয়ে শুনতে বেশি আগ্রহী হয়। যে বেশি কথা বলতে গিয়ে মিথ্যা কথা বলে তাকে কেউ বিশ্বাস করে না। তাই আত্মসম্মানকে বজায় রাখতে হলে প্রয়োজনীয় কথার অতিরিক্ত না বলাই মঙ্গল।
শিক্ষা: মিথ্যা সকল পাপের উৎস। একটা মিথ্যাকে সত্য হিসেবে দাঁড় করাতে চাইলে হাজারো মিথ্যার আশ্রয় নিতে হয়। এ জন্য কথাও বেশি বলতে হয়। তাই কথাকে সংযত করার মাধ্যমে মিথ্যা থেকে অনেকটাই দূরে থাকা সম্ভব।
সংসারে সংসারী সাজ কর নিত্য নিজ কাজ।
মানুষ সামাজিক জীব। সামাজিক জীব হিসেবে মানুষকে সমাজে বসবাস করতে হয়। আর সমাজে বসবাস করতে গিয়ে মানুষকে অনেক দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করতে হয়। আমরা যারা শিক্ষার্থী তাদের কর্তব্য হলো পড়াশুনা ঠিক মতো করা। শিক্ষকের দায়িত্ব হলো ছাত্রদের সময় মতো পড়ানো ও পড়া আদায় করা এবং পরীক্ষা নেয়া। ছাত্র শিক্ষক উভয়ে তাদের দায়িত্ব কর্তব্য পালন করলে সামগ্রিক উন্নয়ন ঘটবে। সমাজ অগ্রসর হবে, দেশ উন্নত হবে। ছাত্র-শিক্ষকের মতোই সামাজিক স্তর বিন্যাসের বিভিন্ন অবস্থানে মানুষ অবস্থান করে। তাদের নিজ নিজ দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করতে হয়। আজকের কাজ কালকের জন্য ফেলে রাখা ঠিক নয়। সবারই মধ্যে সহযোগিতামূলক দৃষ্টিভঙ্গি রাখা প্রয়োজন। মানুষকে নিজের কাজ করতে হবে। অন্য একজন কাজ করল কি-না তা সমালোচনা না করে নিজের কাজে মনোনিবেশ করতে হবে। দায়িত্বশীলতার সাথে সবাই তার নিজ নিজ কাজ করলে দেশ উন্নত হবে। আজ চীন, জাপান, সুইজারল্যান্ড, আমেরিকা, কানাডা ও মালয়েশিয়ার মতো দেশ উন্নত দেশ বলে স্বীকৃত। যদি আমরা খোঁজ নেই তাহলে দেখব যে, এ সকল রাষ্ট্রের মানুষ অনেক দায়িত্বশীল ও কর্তব্য পরায়ন। নিজ দায়িত্ব কর্তব্য পালন করলে শ্রেষ্ঠত্বের আসনেও আসীন হওয়া যায়। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্র নায়কদের ও সুধী সমাজকে বিশেষ ভূমিকা পালন করতে হয়। তাই সংসারে প্রত্যেকের যে কাজই থাকুক না কেন, নিত্য তাদেরকে সেই কাজ করতে হবে। দেশকে উন্নতির শিখরে আরোহণ করতে সহযোগিতা করতে হবে।
শিক্ষা: দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনের মধ্য দিয়ে নিজেকে মহৎ করা যায়। সমাজ ও দেশকে উন্নতির শিখরে আরোহণে সহযোগিতা করা যায়।
সংসার সাগরে দুঃখ তরঙ্গের খেলা আশা তার একমাত্র ভেলা।
প্রতিনিয়ত মানুষ পৃথিবীকে সুন্দর করে সাজাতে চায়। চায় মায়া মমতার বন্ধনে আবদ্ধ সুখের সংসার। কিন্তু মানবজীবন পুষ্পশয্যা নয়। সংসারে আছে জটিলতা, নানা সমস্যা আর চাওয়া-পাওয়ার দ্বন্দ্ব। কখনো দুঃখ এসে তছনছ করে দেয় সুখের সাজানো সংসার। স্বপ্ন পূরণের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায় নানা প্রতিবন্ধকতা। জীবনের চরম বিপর্যয়ের দিনগুলোতেও মানুষ আশায় বুক বাঁধে। সংসার সাগরে একদিকে দুঃখ খেলা করে অন্যদিকে সে খেলায় টিকে থাকার জন্য মানুষের অবলম্বন আশা। মানুষ আশাকে ভরসা করেই জীবনতরীর হাল ধরে শক্ত করে। উত্তাল সাগরের বুকে জাহাজ চালানো খুবই কঠিন। তারপরও নাবিক বেঁচে থাকার আশায় তীরে পৌঁছানোর জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করে। তেমনি সংসাররূপ উত্তাল দুঃখের সাগর মানুষ পাড়ি দেয় আশার তরণী ভাসিয়ে। মানুষ রঙিন স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসে, তাই জীবনকে সামনের দিকে নিয়ে যায় এই আশাতে যে,্আগামী দিনগুলো সুন্দর হবে। কোনো দুঃখ কষ্ট থাকবে না। স্বপ্ন একদিন পূরণ হবে, ধরা দিবে বাস্তবে এসে। তাই মানুষের বেঁচে থাকার অবলম্বন হলো আশা। সাফল্যের পথে আশা মানুষকে দেয় প্রেরণা। কেননা, পৃথিবীর সব ছোট-বড় সৃষ্টির পেছনে কাজ করেছে আশা। শত দুঃখ-কষ্ট সহ্য করে যারা আশা নিয়ে পরিশ্রম করে গেছেন তারাই হয়েছেন স্মরণীয়-বরণীয়। কখনো দুঃখের সাগরে হাবুডুবু খেতে খেতে হয়তো দুরাশা এসে মন দখল করতে পারে। কিন্তু সেটা ক্ষণস্থায়ী। দুরাশার দুঃসময়েও মানুষ নতুন করে আশায় উদ্দীপ্ত হয়। চায় নিজের অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখতে। আশাই মানুষের জীবনীশক্তি। তাইতো বলা হয়- ‘আশায় বসতি।’ আশা ভাগ্যহতকে শোনায় জেগে উঠার গান। আশার ভেলায় ভর করেই চলছে পৃথিবী, তৈরি হচ্ছে নতুন নতুন সমাজব্যবস্থা। আশা আছে বলেই শত প্রতিকূলতার মধ্যেও প্রতিটি মানুষ বাঁচতে শেখে।
শিক্ষা: এ ক্ষণস্থায়ী জীবনে মানুষকে নানা বাধা বিঘ্ন পার হতে হয়, পুড়তে হয় দুঃখের আগুনে। কিন্তু আশা মানুষকে পথ দেখায় কীভাবে দুঃখের আগুনে পুড়ে সুখ লাভ করা যায়, প্রকৃত মানুষ হওয়া যায়।
হাতে কাজ করায় অগৌরব নেই, অগৌরব হল মিথ্যায়, মূর্খতায়।
মানুষের প্রকৃত পরিচয় কর্ম ও সাফল্যের ওপর নির্ভর করে। জীবনে উন্নতির মূল চাবিকাঠি হচ্ছে পরিশ্রম। দৈহিক শ্রম দ্বারা মানুষ তার নিজের ভাগ্যকে নির্মাণ করে। পৃথিবীতে অনেক মানুষ আছে যারা কায়িক শ্রমকে ছোট মনে করে, নিজে কাজ করতে অপমানবোধ করে এবং মিথ্যা আর মূর্খতা দ্বারা নিজের গৌরব বৃদ্ধি করতে চায়। কিন্তু মিথ্যা পদে পদে তাদের ধ্বংস ডেকে আনে। মূর্খতা তাদের জীবনে অভিশাপ হয়ে দেখা দেয়। যুগ যুগ ধরে কুলি মজুরের মতো লক্ষ কোটি শ্রমজীবী মানুষের হাতে গড়ে উঠেছে মানবসভ্যতা। এদেরই অক্লান্ত শ্রম আর ঘামে মোটর, জাহাজ, রেলগাড়ি চলছে, গড়ে উঠেছে আকাশছোঁয়া দালানকোঠা। আমাদের দেশের কৃষকরা আমাদের খাদ্যের যোগান দিতে ঝড়-বৃষ্টি রোদ্র উপেক্ষা করে ফসল ফলায়। এ কাজ তাদের কঠিন সাধনার কাজ। এতে তাদের গৌরব কমে না এই কাজের মধ্য দিয়েই তারা পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সাধক রূপে পরিগণিত হয়েছে। আমাদের দেশের অর্থনীতিকে টিকিয়ে রেখেছে এই শ্রমজীবী মানুষ। আমাদের পোশাক শিল্পকে শ্রম দ্বারাই টিকিয়ে রেখেছে শ্রমিকশ্রেণি। আধুনিক বিশ্বের চালিকা শক্তি বিদ্যুৎ উৎপাদনের গুরুত্বপূর্ণ কাচাঁমাল কয়লা, যা উত্তোলন করে শ্রমিকরা। পৃথিবীতে যারা মহামানবের অবিধায় অভিসিক্ত হয়েছেন তারা কায়িক পরিশ্রম করেছেন। তাতে তাদের সম্মান কমেনি বরং বেড়েছে। অন্যের কাছে হাত পেতে ভিক্ষা নেওয়ার মধ্যে কোনো গৌরব নেই। আমেরিকার ষোড়শ প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন বলেছেন- “পাঁচটি টাকা কুড়িয়ে পাওয়ার চেয়ে একটি টাকা উপার্জনের মধ্যে তৃপ্তি অনেক বেশি।” আমাদের প্রিয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম শৈশবে রুটির দোকানে কাজ করেছেন। হাতের কারুকার্যে চিত্রশল্পী কাজ হিসেবে পৃথিবীতে বিখ্যাত হয়েছেন লিওনার্দো-দ্যা-ভিঞ্চি, পাবলো পিকাসো এবং ভ্যানগগের মতো ব্যক্তিবর্গ। মিথ্যা ও মূর্খতা নয় সাধুতা ও সত্যের ভিতর দিয়ে সত্তার মহিমা উদ্ভাসিত হয়। কাজের মাধ্যমে সমাজ স্বনির্ভর হয় এতে মানুষের অফুরন্ত শক্তির প্রকাশ ঘটে।
শিক্ষা: আমাদের কর্মশক্তি ভরা দুটি সবল হাত রয়েছে যা দ্বারা জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার সমন¦য়ে আমরা পেতে পারি সার্থক জীবনের সন্ধান এবং আত্মপ্রতিষ্ঠার শক্তি।
হাস্যমুখে অদৃষ্টেরে করব মোরা পরিহাস।
চলার পথ বাধাহীন, সাবলীল নয়। তাই বলে নিজেকে দুঃখী-হতভাগা ভাবার কোনো কারণ নেই। বরং সব বাধা বিপত্তি অতিক্রম করে আনন্দকে জয় করে চারপাশে ছড়িয়ে দিতে হবে। অদৃষ্টকে পাশ কাটিয়ে না গিয়ে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে ভয়কে জয় করার মানসিক শক্তি অর্জন করতে হবে। নিজেকে বিশ্বাস করাতে হবে যে, আমিও পারব, থাকতে হবে আনন্দ সৃষ্টির নিরন্তর প্রয়াস। আপন কর্মের মাধ্যমে পরিবর্তন করতে হবে অদৃষ্টকে। সে যাত্রায় হয়তো মুখ থুবড়ে পড়তে হবে বারবার। হয়তো ভাগ্যের হাতে বড় নির্মমভাবে নিপীড়িত, নিগৃহীতও হতে হবে। তবুও উঠে দাঁড়াতে হবে আশায় বুক বেঁধে তা অর্জন করার সাহস নিয়ে। আর যেখানে স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরআনে ঘোষণা করেছেন- ‘আল্লাহ, কোনো জাতির ভাগ্য ততক্ষণ পরিবর্তন করেন না, যতক্ষণ না তারা নিজেরা নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তন করে।’ তাই কোনো কাজে সফলতা অর্জন করতে হলে ধৈর্য ও সহিষ্ণুতার মাধ্যমে নিরবিচ্ছিন্ন চেষ্টা করাই একমাত্র উপায়। যিনি জানেন, জীবন হলো সুখ-দুঃখময় এক অনিবার্য পরিবর্তনশীল ক্ষেত্র, তিনি দুঃখের দিনে হতাশায় ভেঙে পড়েন না। দুঃখ-বিপাককে জীবনের অমোঘ পাথেয় হিসেবে মেনে নিয়ে দিনবদলের সংগ্রামে নামেন। দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদবিরোধী অবিসংবাদিত নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা বলেছেন- ‘সাহস মানে ভয়ের অনুপস্থিতি নয় বরং ভয়কে জয় করা। সে সাহসী নয়, যে ভীতি অনুভব করে না বরং সে-ই সাহসী যে ভীতিকে জয় করে।’ যদিও এই ভয় বা আতংকই কিছু মানুষের জীবনের সব সুখ শান্তি কেড়ে নেয়। কিন্তু ভয়ের মুখোমুখি হয়ে জয় করার মাধ্যমে অর্জিত হয় আত্মতুষ্টি ও তাৎপর্যপূর্ণ প্রশান্তি যা জীবনে এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা।
শিক্ষা: মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়। মানুষের অসাধ্য কিছুই নেই, ইচ্ছাই তার প্রধান চালিকা শক্তি। যার মাধ্যমে সে তার কাক্সিক্ষত স্বপ্নচূড়ায় আরোহণ করতে পারে।
হে অতীত তুমি ভুবনে ভুবনে কাজ করে যাও গোপনে গোপনে।
মহাকাল অনাদি, অনন্ত ও নিরবিচ্ছিন্ন। মহাকালের এই অনন্ত ব্যাপ্তির মধ্যে রয়েছে ত্রিমাত্রিক কালবিন্দু-অতীত, বর্তমান আর ভবিষ্যৎ। ক্ষুদ্রায়ু মানুষের পক্ষে মহাকালের অখ- প্রবাহকে উপলদ্ধি করা কখনোই সম্ভব নয়। তাই মানুষ সময়কে উপলদ্ধি করে অতীত বর্তমান আর ভবিষ্যতের সীমারেখায়। মানুষের জীবনচর্চায় বর্তমান হলো অস্তিত্বময় এক কালপর্ব, ভবিষ্যৎ হলো কল্পনা বিস্তারের এক অনাগত স্বপ্ন। আর অতীত হলো ধূসর স্মৃতির রাজ্য। জীবনের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ধারাবাহিক অংশ যা একদিন বর্তমান ছিল, মহাকালের ঘূর্ণাবর্তে লাভ করে বর্তমান ও ভবিষ্যতের সৌধ। আসলে অতীত নেপথ্যে থেকে নীরবে নিঃশব্দে বর্তমানকে প্রণোদিত করে। বর্তমানে যে সাফল্য, যে সঞ্চয়, যে অর্জন তা অতীতের অভিজ্ঞতা ও কর্মজ্ঞান থেকেই প্রাপ্ত। অতীত বিরাট মহীরুহের ন্যায় কর্ম, জ্ঞান ও সংস্কৃতি নিয়ে কাজ করে চলেছে মানুষের ওপর, একটি জাতীর উপর। বর্তমানের জীবন, সংস্কার, সংস্কৃতি অতীতের জীবনের বীজ থেকে উৎপন্ন। অতীতের বীজাঙ্কুর থেকেই জন্ম নেয় বর্তমানের বিশাল মহীরূহ। অতীতের শ্রম, সাধনা, কর্ম বর্তমান ও ভবিষ্যৎ জীবনের জন্য বয়ে আনে সমৃদ্ধি ও সাফল্য। অতীতের ব্যর্থতা বর্তমানকে সতর্কভাবে গড়ে তোলার শিক্ষা দেয়। অতীতের শিক্ষা মানুষকে সঠিক ও সতর্কভাবে পথ চলার নির্দেশ দেয়। জীবনে চলার পথে মানুষ যখন হোঁচট খেয়ে থমকে দাঁড়ায়, বিচলিত সঙ্কটে মানুষ তখন মূল্যায়ন করে অতীতকে। আজকের বর্তমান আগামী দিনে অতীত হয়ে মানুষকে অভিজ্ঞতার আলোকে পথনির্দেশ করবে, তাই আজকের বর্তমানকে সুন্দর ও অভিজ্ঞতাময় করে তোলা অত্যন্ত জরুরী।
শিক্ষা: অতীত মানবজীবনের এক অবিচ্ছেদ্য কালপর্ব। অতীত নেপথ্যে থেকে পরিচালনা করে বর্তমান ও ভবিষ্যতকে। তাই অতীতকে মূল্যায়ন করার মাধ্যমে বর্তমান ও ভবিষ্যতকে সাফল্যমন্ডিত করে তুলতে হবে।
সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই
পৃথিবীর যাবতীয় সম্পদ, ঐশ্বর্য ভোগ উপভোগ করার জন্য সকলই মানুষের সৃষ্টি। কিন্তু অনেক মানুষের শ্রেষ্ঠত্বের গুণে তাদের হৃদয় অহমিকায় পূর্ণ। তাই, এক মানুষ অন্য মানুষের মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টি করে- ঐশ্বর্যবান ব্যক্তি দীনহীনের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে। অর্থনৈতিক পার্থক্যই এ বিভেদ সৃষ্টির কারণ। এছাড়া জাতি, ধর্ম, বর্ণ ইত্যাদি নিয়ে নানা সংস্কারের কারণে মানুষের মধ্যে পার্থক্য থাকে। কিন্তু এই উঁচু নিচুর পার্থক্য মানুষের সামাজিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করে। মানুষ হয়ে ওঠে কৃত্রিম ও স্বার্থপর। এক মানুষ অন্য মানুষের সাথে ঝগড়া, বিবাদ, ঘৃণা ও বিদ্বেষে জড়িয়ে পড়ে। ফলে, মানুষের মধ্যে থেকে মানবিকতাবোধের মতো সাধারণ গুণও লোপ পায়। মানুষ হয়ে ওঠে হিংস্র। তার মধ্যে হিংসাত্মক প্রবণতা বেড়ে যায়। অভিজাত শ্রেণির কাছে সাধারণ মানুষ নিষ্পেষিত হয়। এভাবে এক সময় মানুষ নীতি ও আদর্শ বিবর্জিত কাজ করতেও দ্বিধা করে না। কিন্তু মানুষ ভুলে যায় জীবনের প্রয়োজনেই সবকিছুর আয়োজন করা হয়েছে। তাই কোনো কিছু জীবনের চেয়ে বড় হতে পারে না। মানুষের মর্যাদা দেয়া হলে হিংসার পথ পরিহার করে মানুষের মধ্যে সম্প্রীতি বজায় রাখলে সুখস্বচ্ছন্দ্য বজায় থাকবে। মানুষের মর্যাদা সবকিছুর ঊর্ধ্বে। মানুষের মধ্যে ছোট বড় ভেদ থাকা অর্থহীন। মানুষকে তার স্বীয় মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করতে হলে অন্যকে সম্মান করতে হবে। মানুষ যে গোত্রেরই হোক, যত দরিদ্রই হোক তাকে মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। অমানবিকতা দূর করে মানুষের সৎ গুণাবলির উত্তরণ ঘটাতে হবে। কারণ, অন্য প্রাণী থেকে মানুষের পার্থক্য হচ্ছে তার মনুষ্যত্ববোধে। মধ্যযুগের কবি চণ্ডীদাস সবার উপরে মানুষকে স্থান দিয়েছেন। তেমনি হাজী মুহাম্মদ মুহসীন, রনদা প্রসাদ সাহা আলফ্রেড, নোবেল, মাদার তেরেসা সকলেই মানুষের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করে আমাদের কাছে দৃষ্টান্ত হয়ে আছেন। মানুষের প্রতি অনুগ্রহ, সহমর্মিতা ইত্যাদি সঙ্গতভাবেই প্রত্যাশিত। পৃথিবীর সব মানুষকে নিয়েই মানুষের প্রকৃত সত্ত্বা। সেই সত্ত্বা মানুষের সর্বমানবিক সত্ত্বা, যা জাগিয়ে তোলার মধ্যেই রয়েছে যথার্থ মানুষ হয়ে ওঠা।
জ্ঞান : ধনী-নির্ধন সবাই পারস্পরিক বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে সম্প্রীতির এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে এটাই কাম্য।
1 Response to "ভাব সম্প্রসারণ-২ "
উত্তরমুছুন