জর্জ ওয়াশিংটন
শুক্রবার, ৫ জুলাই, ২০১৯
Comment
১৮০৭-১৮৭০

First in war, first in peace, first in the hearts of his countrymen.
আমেরিকার ভার্জিনিয়াতে ১৭৩২ সালের এই দিনে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তার পূর্বপুরুষ ছিলেন ইংল্যান্ডের নর্দাম্পটনশায়ারের অধিবাসী। অল্প বয়সেই বাবাকে হারিয়ে জর্জের জায়গা হয় ভার্জিনিয়ার সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি লর্ড ফেয়ারফ্যাক্সের বাড়িতে।
এই ধনী ব্যক্তি ছিলেন জর্জ ওয়াশিংটনের সৎভাই লরেন্সের শ্বশুর। এখানেই জর্জ নানা প্রতিকূলতা সত্ত্বেও নিজের বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েই বড় হতে থাকেন।
একসময় ভাই-ভাবির মৃত্যুর পর সব সম্পত্তির মালিক হন জর্জ ওয়াশিংটন। এ সম্পত্তির মালিক হয়েই ভেরন উপত্যকার বন্ধুর অঞ্চলে গড়ে তোলেন একটি খামার।
অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে এ খামারের আট হাজার একর জায়গার মধ্যে তিন হাজার একর কৃষির অন্তর্ভুক্ত করে নিজেই এর দেখাশোনা শুরু করেন।
আস্তে আস্তে এটি হয়ে ওঠে একটি আদর্শ খামার। ঘুরে যেতে থাকে জর্জের জীবনের গতি।ছোটবেলা সৈনিক হওয়ার ইচ্ছা থেকেই এক সময় ভার্জিনিয়ার গভর্নরকে লিখে জানালেন তার আগ্রহের কথা।
গভর্নরও তাকে বিশেষ কাজের জন্য ডেকে পাঠালেন। ভার্জিনিয়ার একটা বিরাট অঞ্চল তখন ফরাসিদের দখলে। ওয়াশিংটনের ওপর দায়িত্ব পড়ল তাদের হটিয়ে দেওয়ার।
৬০০ সৈনিকের এক বাহিনী নিয়ে তিনি ফরাসি দুর্গ দখল করেন। সেনাপতি হিসেবে তিনি অসাধারণ বুদ্ধিমত্তা ও রণকুশলতার পরিচয় দেন।
পরে ভার্জিনিয়ার গভর্নর ব্রাডকের মৃত্যুর পর তার স্থলাভিষিক্ত হন জর্জ ওয়াশিংটন। পাশাপাশি সমগ্র ভার্জিনিয়ার সৈন্য বাহিনীরও প্রধান হলেন ওয়াশিংটন।
১৭৭৬ সালের ৭ জুন ১৩ প্রদেশের প্রতিনিধিরা সম্মিলিতভাবে আমেরিকার স্বাধীনতা ঘোষণা করার পর পাঁচজনের এক একটি পরিচালনা দল তৈরি করা হয়।
৪ জুলাই স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র প্রচার করার পর দেশের বিভিন্ন প্রদেশে শুরু হয়ে যায় ব্রিটিশ বাহিনীর সঙ্গে আমেরিকানদের যুদ্ধ।
নানা প্রতিকূলতার মধ্যে ওয়াশিংটন তার সৈন্য বাহিনীকে সংগঠিত করলেন। তার সৈন্যেদের যুদ্ধের অভিজ্ঞতাও ছিল কম।
তবুও তারা অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্টের মধ্যে যুদ্ধ করেই চললেন। প্রথমদিকে ইংরেজ বাহিনী সাফল্য লাভ করলেও শেষ পর্যন্ত তারা পিছু হটতে বাধ্য হয়।
দীর্ঘ ৫ বছর সংগ্রামের পর ইংরেজরা ১৭৮১ সালে আত্মসমর্পণ করেন। যুদ্ধে জয়ী হয় আমেরিকানরা। এই যুদ্ধে জয়ের পেছনে জর্জ ওয়াশিংটনের ভূমিকা ছিল সবচেয়ে বেশি।
তার ইচ্ছাশক্তি ও সৈনিকদের প্রতি ভালোবাসা এবং শৃঙ্খলাবোধ এই যুদ্ধে তাকে বিজয়ী নায়কের গৌরব এনে দিয়েছিল। স্বাধীনতা যুদ্ধের নায়ক হলেও তার কোনো উচ্চাশা ছিল না।
নিজের কর্তব্য শেষ করে সেনাপতির পদ ত্যাগ করে ফিরে আসেন নিজের জমিদারিতে। কিন্তু মানুষের ভালোবাসা তো তাকে ছাড়ল না।
নতুন দেশের সংবিধান তৈরি করার জন্য সারাদেশের প্রতিনিধিরা সম্মিলিত হলেন। জর্জও সেখানে যোগ দিলেন।
নতুন সংবিধানের রূপরেখা বর্ণনা করে সদস্যরা জর্জ ওয়াশিংটনকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত করলেন। তিনি হলেন আমেরিকার প্রথম প্রেসিডেন্ট।
১৭৮৯ সালে ফরাসি বিপ্লব শুরু হলে তিনি বিপ্লবীদের সমর্থন করলেও নিরপেক্ষতার নীতি গ্রহণ করেন। ফলে আমেরিকা প্রতিটি বিবদমান দেশেই বাণিজ্য করার সুযোগ পায়।
তার অসাধারণ যোগ্যতা প্রদর্শনের ফলে ১৭৯২ সালে তাকে দ্বিতীয়বাবের মতো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত করা হয়।
এখন এই মধ্যাহ্নে ম্যারিল্যান্ডের আকাশে কালো মেঘ জমে আছে। সকাল থেকে ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়ে যাচ্ছিল। প্রেসিডেন্ট জর্জ ওয়াশিংটন একটি সাদা রঙের স্প্যানিশ মাসটাং ঘোড়ার পিঠের উপর বসে ফোর্ট কাম্বারল্যান্ডের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া পটোম্যাক নদীর দিকে চেয়ে আছেন। তার মুখে উদ্বেগের গাঢ় ছাপ ফুটে আছে । তার কারণ আছে। পেনসালভানিয়ায় হুইস্কি উৎপাদনকারীরা সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষনা করেছে। পেনসালভানিয়ায় বিদ্রোহ দমনের জন্য ফোর্ট কাম্বারল্যান্ডে সৈন্যরা সমবেত হয়েছে। সৈন্যদের সে সমাবেশ পরিদর্শন করছেন প্রেসিডেন্ট ।
১৭৯২ খ্রিস্টাব্দ। জুলাই মাসের মাঝামাঝি। ক’দিন ধরে থেমে থেমে বৃষ্টি পড়ছে। আর তাতে পটোম্যাক নদীর পানি উপচে উঠেছে । নদীর পাড়ের সারিবদ্ধ উইলো গাছগুলি বিষন্ন ম্লান আলোর ভিতর চুপচাপ বৃষ্টিতে ভিজছে। মাঝে-মাঝে অশান্ত বাতাসে কাঁপছে উইলো পাতারা । অবিরাম বৃষ্টির ফলে ফোর্ট কাম্বারল্যান্ডের সামনের রাস্তায় কাদা জমেছে। ফলে সৈন্যদের অগ্রগতি শ্লথ হয়ে পড়েছে। অথচ অবিলম্বে পেনসালভানিয়ায় ঝটিকা অভিযান পরিচালনা করে বিদ্রোহ দমন করতে হবে, নইলে সদ্য প্রতিষ্ঠিত জাতীয় সরকারের অস্তিত্ব সঙ্কটের মুখে পড়বে ...
এ সব কারণেই প্রেসিডেন্ট জর্জ ওয়াশিংটন-এর মুখে উদ্বেগের গাঢ় ছাপ ফুটে উঠেছে ।
অশ্বারোহী প্রেসিডেন্ট জর্জ ওয়াশিংটন-এর ঠিক পাশেই একটি বাদামী রঙের মর্গান ঘোড়ার পিঠে সওয়ার জেনারেল রোনান্ড স্টিভ । তিনি প্রেসিডেন্টের নিরাপত্তা বিষয়ক উপদেষ্ট। প্রেসিডেন্টের ওপর সব সময় তীক্ষ্ম নজর রাখেন রোনান্ড স্টিভ । প্রেসিডেন্টের মাথায় দু’পাশে ভাঁজ করা কোঁকড়ানো শুভ্র চুল। ঈষৎ লম্বাটে ফরসা মুখ। চোখ দুটি গভীর অর্ন্তদৃষ্টি সম্পন্ন । নাকটি তীক্ষ্ম । পরনে ঘিরে রঙের টিউনিকের ওপর ছোট কালো সামরিক কোট। কোটের দু-কাঁধের ওপর সোনালি ঝালর। মাথায় কালো সোনালি ঝালর বসানো ক্যাপ, পায়ে কালো বুট।
প্রেসিডেন্টকে গভীর শ্রদ্ধা করেন জেনারেল রোনান্ড স্টিভ ।
তার কারণ আছে ...
...ব্রিটেনের কাছ থেকে আমেরিকার স্বাধীনতা অর্জনের জন্য গত আট বছরে (১৭৭৫-১৭৮৩) মরণপণ সংগ্রাম করেছেন প্রেসিডেন্ট জর্জ ওয়াশিংটন; তারই যোগ্য নেতৃত্বে গ্রেট ব্রিটেনের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করেছে আমেরিকা । শুধু তাই নয় স্বাধীনতা লাভের পর তেরোটি অঙ্গরাজ্যের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা নতুন আমেরিকান ফেডারেল সরকারকে ঐক্যবদ্ধ করেছেন প্রেসিডেন্ট; আর এ ক্ষেত্রে অভাবনীয় সব সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে তাঁকে। জেনারেল রোনান্ড স্টিভ এর কানে প্রেসিডেন্টের একটি কথা বাজে: I walk on untrodden ground... কথাটি সত্য ... নজীরবিহিন পথেই হাঁটছেন প্রেসিডেন্ট: যেমন নিজস্ব দক্ষতায় মার্কিন সেনাবাহিনী গড়ে তুলেছেন প্রেসিডেন্ট; এরাই ১৭৭৫ থেকে ১৭৮৩ সালের আমেরিকান বিপ্লবে রক্তক্ষয়ী লড়াই করে বিজয় ছিনিয়ে এনেছে। আট বছর তীব্র লড়াইয়ের পর ব্রিটিশ সৈন্যরা ইয়র্কটাউন এবং ভার্জিনিয়ার যুদ্ধে পরাজিত হয়। গ্রেট ব্রিটেন আমেরিকাকে স্বাধীনতা দিতে বাধ্য হয়। এর পর পরই আমেরিকার জনসাধারণের চোখের মনিতে পরিনত হয়েছেন প্রেসিডেন্ট । প্রেসিডেন্ট ইচ্ছে করলেই নিজেকে আমেরিকার সামরিক শাসক কিংবা রাজা বলে ঘোষনা করতে পারতেন। কিন্তু, প্রেসিডেন্ট জর্জ ওয়াশিংটন-এর চিন্তাচেতনা অতটা সংকীর্ণ নয়। আমেরিকায় গনতন্ত্র সমুন্নত রাখার উদ্দেশ্যে কংগ্রেস এবং সংবিধানকেই গুরুত্ব দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট; এখনও কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে যুক্তরাষ্ট্রের সাধারণ কর্মচারী হিসেবে নিরন্তর কাজ করে যাচ্ছেন। প্রেসিডেন্টের চোখে ইউনাইটেড স্টেটস অভ আমেরিকার স্বপ্ন। তবে সে স্বপ্ন বাস্তবায়ন সহজ নয়। এই মুহূর্তে পেনসালভানিয়ার হুইস্কি উৎপাদনকারীরা বিদ্রোহ ঘোষনা করেছে। পেনসালভানিয়ার হুইস্কি উৎপাদনকারীদের ওপর করারোপের সিদ্ধান্তটি ট্রেজারি সেক্রেটারি আলেকজান্দার হ্যামিলটন-এর । জাতীয় ঋনের পরিমান হ্রাস করার লক্ষে করারোপ না- করে উপায় ছিল না। অথচ, সদ্য গঠিত জাতীয় সরকারটি পূর্বাঞ্চল ভিত্তিক হওয়ায় পেনসালভানিয়ার হুইস্কি উৎপাদনকারীরা একে পশ্চিমের ওপর পুবের শোষণ হিসেবে দেখছেন। ... গভীর শ্বাস টানলেন জেনারেল রোনান্ড স্টিভ । প্রেসিডেন্ট অবশ্য দীর্ঘদিন ধরে এই ধরনের জটিল সমস্যা মোকাবেলা করে আসছেন । জেনারেল রোনান্ড স্টিভ-এর বিশ্বাস ... প্রেসিডেন্ট এবারও জয়ী হবেন ...
হঠাৎ জেনারেল রোনান্ড স্টিভ দেখতে পেলেন রাস্তায় ওপর কাদায় একটি ঘোড়ার গাড়ি আটকে গেছে। পেনসালভানিয়া অভিমুখি সৈন্য দলটি দাঁড়িয়ে পড়েছে। কয়েক জন সৈন্য অবশ্য ঘোড়াগাড়ির চাকা ধরে ঠেলছে আর ‘মারো টান হেইয়ো’ বলে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করছে। জেনারেল রোনান্ড স্টিভ প্রেসিডেন্টের দিকে তাকালেন। দৃশ্যটি প্রেসিডেন্ট জর্জ ওয়াশিংটনের চোখেও পড়েছে। তিনি ক্ষিপ্র গতিতে ঘোড়া থেকে নেমে দ্রুত পায়ে কাদা মাড়িয়ে ঘোড়াগাড়ির কাছে পৌঁছলেন। তারপর সবাইকে বিস্মিত করে দিয়ে সাধারণ সৈন্যদের সঙ্গে কাদা মাখা চাকা ঠেলতে লাগলেন। ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়ছে। ভিজে যাচ্ছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম প্রেসিডেন্ট। তার কালো রঙের বুট জুতায়, ঘিয়ে রঙের টিউনিকে কাদা মেখে যাচ্ছে।
পটোম্যাক নদীর পাড়ের সারিবদ্ধ উইলো গাছগুলি বিষন্ন ম্লান আলোর ভিতর চুপচাপ বৃষ্টিতে ভিজছে।
মাঝে-মাঝে অশান্ত বাতাসে কাঁপছে উইলো পাতারা ...
ম্যারিল্যান্ডের মেঘলা মধ্যাহ্নের ক্ষীন আলোয় ওই অভূতপূর্ব দৃশ্য দেখে জেনারেল রোনান্ড স্টিভ অভিভূত হয়ে পড়লেন।
গভীর শ্বাস টানলেন জেনারেল রোনান্ড স্টিভ ।
তার মনে হল: ভবিষ্যতের মার্কিন প্রজন্ম প্রেসিডেন্ট জর্জ ওয়াশিংটন কে যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে সবচে গুরুত্বপূর্ণ নেতার মর্যাদা দেবে । ... আর, আমেরিকা যে অল্প সময়ের মধ্যেই পৃথিবীর একটি উন্নত রাষ্ট্রে পরিনত হতে যাচ্ছে ... আজ সাধারণ সৈন্যদের কাতারে নেমে কাদা মাখা চাকা ঠেলে প্রেসিডেন্ট জর্জ ওয়াশিংটন সেই উন্নতির অটল ভিতটি গড়ে দিলেন ...
☞ এই পোষ্ট সম্পর্কে যদি আপনার কোন প্রশ্ন☞জিজ্ঞাসা☞সমস্যা☞তথ্য জানার থাকে তাহলে আপনি☞কমেন্ট করলে আপনাকে আমরা প্রয়োজনীয় তথ্য দিয়ে সাহায্য করার চেষ্টা করব☞☞☞ "জর্জ ওয়াশিংটন"
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন