জোহান্স গুটেনবার্গ
রবিবার, ৭ জুলাই, ২০১৯
Comment
আজকের এই জ্ঞান বিজ্ঞানের সাথে জড়িত আছে বই। আর এই বই কোনো না কোনো ছাপা কারখানায় মুদ্রিত। ছাপাখানা আবিষ্কারের আগে মানুষ হাতে লেখা বই পড়তো। আমাদের বসার ঘরে পড়ার ঘরে যে বই শোভা পাচ্ছে সেটার অবদান জোহান্স গুটেনবার্গ এর আধুনিক মুদ্রণযন্ত্রের। মুদ্রণযন্ত্র আবিষ্কারের ফলে সভ্যতা দ্রুত বিকাশ লাভ করে। তাই যদি বলা হয় আজকের জ্ঞানবিজ্ঞানের অগ্রগতির বড় সহায়ক আধুনিক মুদ্রণশিল্প, তাহলে মোটেই বাড়িয়ে বলা হবেনা।
মুদ্রণশিল্প প্রথম আবিষ্কার হয় চীনে। সেখানকার মানুষরা কাঠের খোদাই অক্ষর দিয়ে মুদ্রণশিল্পের কাজ করতেন। হাত দিয়ে ছাপ দিয়ে তৈরি হত তখনকার বই। এই কাজে অনেক সময় লাগতো এবং পরিশ্রমও হতো অনেক বেশি। এখানে ব্যবহৃত অক্ষরগুলো অন্য কাজে ব্যবহার করা যেত না। আর এখানেই আধুনিক মুদ্রণযন্ত্রের সাফল্য। আধুনিক মুদ্রণযন্ত্রে ব্যবহৃত মুদ্রণ অক্ষরগুলো আলাদা আলাদা। তাই অনেকবার ব্যবহার করা যায়। গুটেনবার্গ সর্ব প্রথম ছাপার জন্য ধাতব অক্ষর ব্যবহার করেন। তাঁর সেই পদ্ধতি আজ পর্যন্ত কার্যকর। তাঁর আবিষ্কৃত পদ্ধতি এখন বিশ্বের অনেক দেশেই ব্যবহৃত হয়। বাংলাদেশেও তাঁর আবিষ্কৃত পদ্ধতি ব্যবহৃত হয়।
এই মহান আবিষ্কারকের জীবন বৃত্তান্ত বড়ই বৈচিত্র্যময়। তাঁর জন্ম হয়েছিল জার্মানিতে। জার্মানির একটি শহর মাইনজ এ তিনি জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর পিতামাতা ছিলেন দরিদ্র। সংসারে অভাব লেগে থাকতো। শৈশবে তিনি স্কুলে ভর্তি হয়েছিলেন। কিন্তু অভাবের তাড়নায় তাকে স্কুল ছেড়ে দিতে হয়। স্কুল ছেড়ে তাকে কর্মের সন্ধানে বের হতে হয়। অনেক চেষ্টার পর তিনি একটি স্বর্ণকারের দোকানে কাজ পান। তাঁর কাজ ছিল স্বর্ণকারের সহযোগীর। এখানে তিনি কাজ শিখতে থাকেন। তখন সোনার দোকানে অন্যান্য ধাতব-দ্রবের অলঙ্কারও তৈরি হত। তিনি সেখানে অন্যান্য ধাতুর গুনাগুণ সম্পর্কে ধারণা লাভ করেন। মূলত এই স্বর্ণকারের দোকানের কাজটি তাঁর পরবর্তী জীবনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
কাজ শেখার পর তিনি সেখানকার চাকরী ছেড়ে দন এবং জার্মানির স্ট্রেসবার্গে চলে আসেন। এখানে তিনি একটি বড় স্বর্ণকারের দোকানে কাজ নেন। এখানে তিনি প্রায় চার বছর ছিলেন। এই সময় তিনি নিজেই ধাতব বস্তু দিয়ে অলঙ্কার তৈরি করতেন। দক্ষ কারিগর হিসেবে তাঁর নাম ছিল। তিনি সব সময় নতুন কিছু আবিষ্কারের নেশায় থাকতেন। তিনি তিনি কখনোই চাইতেন না তাঁর আবিষ্কার যেন অন্য লোক জানতে না পারে। তাঁর কাজের কলাকৌশল কাউকে শেখাতেন না। এই সময় তিনি নিজের উদ্যোগে আয়না তৈরি এবং মণিমুক্তা কাটার একটা কারখানা দাঁড় করান। ১৪৩৮ সালে তিনি কয়েকজনকে নিয়ে একটি নতুন কারখানা দাঁড় করান। কারখানা পার্টনারদের মধ্যে শর্ত ছিল কেউ মারা গেলে তাঁর পরিবার কারখানার অংশীদার হতে পারবেন না। কিন্তু তারা কারখানার লভ্যাংশ লাভ করবেন। এর মধ্যে তাদের পার্টনার ড্রিজেন মারা যান। তাঁর স্ত্রী কারখানার অংশীদারি দাবী করেন। তিনি আদালতে মামলা ঠুকে দেন। আদালত গুটেনবার্গদের পক্ষেই রায় দেয়। ড্রিজেনের স্ত্রী আদালতে এই বলে নালিশ করেন যে গুটেনবার্গ একটি নতুন ধরণের মুদ্রণশিল্প আবিষ্কারের জন্য কাজ করছেন। আমার সকলেই এই ব্যাপারে জানতে চাই। গুটেনবার্গের বিপক্ষে সাক্ষী দেয় তারই এক কর্মচারী। কিন্তু তাঁর পেট থেকে কথা বের করতে পারেনি। তিনি অত্যন্ত গোপনীয়তা অবলম্বন করছিলেন। তিনি সত্যি সত্যি এক ধরণের মুদ্রণশিল্প আবিষ্কার করার চেষ্টা করছিলেন। তিনি তাঁর কাজ গোপন রেখেছিলেন ১৪৪৪ সাল পর্যন্ত। অত্যন্ত পরিশ্রমের ফলে এক সময় তাঁর মুদ্রণের একটি নতুন পদ্ধতি আবিষ্কার করলেন।
তিনি এবার তাঁর আবিষ্কার কাজে লাগাতে চান। তাঁর জন্য তিনি উপযুক্ত জায়গা হিসেবে বেছে নিলেন তাঁর নিজের শহরকে। তিনি সবকিছু ছেড়ে দিয়ে তাঁর নিজের শহরে চলে এলেন। হাতে বেশি টাকাও নেই। আবার আধুনিক প্রেস দিতে হলে অনেক টাকার প্রয়োজন। তিনি এমন কাউকে খুঁজছিলেন যিনি তাঁর এই মুদ্রণশিল্পে টাকা খাটাতে চান। নতুন শিল্প বলে এবং লোকসানের ঝুঁকি আছে বলে কেউ টাকা খাটাতে রাজী হচ্ছিলেন না। অনেক খুঁজে তিনি একজনকে পেয়েছেন যিনি এখানে টাকা খাটাতে চান। গুটেনবার্গের ছাপা কারখানায় টাকা খাটাতে রাজী হন তখনকার বিখ্যাত ধনী জোহান ফাস্ট।
ফাস্ট তাকে ৮০০ ডলার দিলেন তাঁর ছাপা কারখানার জন্য। বিনিময়ে তিনি হলে গুটেনবার্গের ব্যবসার অংশীদার হন। শুরু হল বিশ্বের প্রথম আধুনিক ছাপা কারখানার কাজ। গুটেনবার্গ মনপ্রাণ দিয়ে কাজ করতে লাগলেন। এসময় ছাপা হচ্ছিল বাইবেল। ফাস্ট ছিলেন একটু চতুর এবং লোভী। তিনি চাইছিলেন যেন ছাপা কারখানায় বেশি বেশি ছাপার কাজ হোক। কিন্তু গুটেনবার্গ চাইছিলেন কাজের মান ভাল হোক। এই নিয়ে গুটেনবার্গের সাথে ফাস্টের বনিবনা হচ্ছিল না। ফাস্ট তাঁর টাকা ফেরত চেয়ে গুটেনবার্গের বিরুদ্ধে মামলা ঠুকে দেন। ফাস্ট জানতেন যে মামলায় হেরে গেলে পুরো কারখানার মালিক হবেন তিনি। এই মামলায় গুটেনবার্গ হেরে যান এবং আদালত তাকে ২,০২৬ ডলার ফেরত দিতে নির্দেশ দেন। তিনি টাকা দিতে না পারায় তাঁর ছাপা কারখানা ফাস্ট দখল করে নেয়। ছাপা কারখানায় কাজ করতো গুটেনবার্গের সহকারী পিটার স্কোফার। পিটারকে তিনি নিজের হাতে কাজ শিখিয়েছিলেন। পিটার ফাস্টের সাথে যোগ দিয়ে সেই কারখানাতেই থেকে যান। আবার ছাপা হতে থাকে বাইবেল। কিন্তু আগের ছাপা বইগুলো সরিয়ে ফাস্ট মুদ্রাকরের নামের যায়গায় নিজের নাম বসিয়ে দেয়।
১৪৫৫ সালের ৬ নভেম্বর তিনি প্রেসের কর্তৃত্ব হারান। তাঁর হাতে তখন কোন সঞ্চিত অর্থ নেই। তিনি পথে পথে ঘুরছিলেন। তাঁর ছাপার দক্ষতার কথা তখন অনেকেই জানে। মাইনজের আরেক ধনী ব্যক্তি ডঃ কনরাড হোমারি নিজের ইচ্ছেয় গুটেনবার্গকে নতুন একটি ছাপা কারখানার জন্য মূলধন দেন। তিনি আবার পুরোদমে কাজ শুরু করেন। এই কাজটি তিনি শেষ করতে পারেন নি। কারণ তাঁর বয়স বেড়ে গিয়েছিল এবং তাঁর চোখদুটি নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। শেষ বয়সে এসে তাঁর অর্থকষ্ট আরও বেড়ে যায়। জীবন ধারণের জন্য তিনি অন্যের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েন। তাঁর একান্ত কাছের মানুষজন তার ভরণপোষণের দায়িত্ব নেন। চারপাশে দেনার চাপ আর মানসিক চাপে তাঁর শরীর ভেঙে পড়ে। শেষ দিনগুলো তিনি অনেক কষ্টে কাটিয়েছিলেন। এই কর্মঠ মানুষটির জীবনাবসান হয় ১৪৬৮ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি। যতদিন মুদ্রণশিল্প থাকবে বই থাকবে ততদিন মানুষ শ্রদ্ধাভরে এই মানুষটির নাম স্মরণ করবে।
☞ এই পোষ্ট সম্পর্কে যদি আপনার কোন প্রশ্ন☞জিজ্ঞাসা☞সমস্যা☞তথ্য জানার থাকে তাহলে আপনি☞কমেন্ট করলে আপনাকে আমরা প্রয়োজনীয় তথ্য দিয়ে সাহায্য করার চেষ্টা করব☞☞☞ "জোহান্স গুটেনবার্গ"
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন